দীর্ঘ পাঁচ মাসের কারাবাস!
প্রিয় বন্ধু/সহযোদ্ধাগণ!
আমার সালাম নিবেন। আপনারা সবাই জানেন, করোনা মহামারীর মধ্যে আমি রাষ্ট্রচিন্তার কাজের অংশ হিশেবে দুস্থ মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ এবং দুর্যোগ মনিটরিং সেলের হয়ে ত্রাণ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায় সরকারের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ডকুমেন্ট করার কাজে লিপ্ত ছিলাম। এর মধ্যেই গত মে মাসের ৫ তারিখে ইফতারের ঠিক আগ মুহুর্তে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরবর্তীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের মাধ্যমে আমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে।
আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো অভিযোগ সম্পর্কে আপনারা ইতোমধ্যেই জানেন, এগুলো আসলে সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন এবং হয়রানিমূলক। কেবলমাত্র একচেটিয়া ক্ষমতা ও নিপীড়নমূলক জবাবদিহিতাহীন জুলুমবাজ আইনি কাঠামো থাকার ফলেই ; কোন কারণ ছাড়াই , আমাকে দুই দুইটা ঈদ পরিবার-পরিজন-বন্ধু-সহযোদ্ধা, আমার আদরের তিন সন্তান ছাড়াই অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করতে হয়েছে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে যে ধরনের জবাবদিহিতাহীন অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমি কথা বলতাম, লেখালেখি করতাম, রাজপথে সোচ্চার থাকতাম ; দীর্ঘ এই কারাবাসের অভিজ্ঞতায় সেই বীভৎস ক্ষমতাতন্ত্রের ভয়াল রূপ আমার সামনে স্পষ্ট হয়েছে আরো নগ্নভাবে।
আমার ‘অপরাধ’ প্রমাণ হওয়ার আগেই যেভাবে আমাকে এতদিন ধরে বন্দি রাখা হলো, পরিবার-সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হলো ; আমি সেই ক্ষমতাতন্ত্রের হিংস্রতা আরো প্রকটভাবে চিহ্নিত করতে শিখলাম খোদ নিজের বন্দি জীবন ও অস্তিত্ব দিয়ে। আমার বিশ্বাস, আমার পরিবার ও বন্ধু-সহযোদ্ধারা আপাতভাবে একটা ‘মুক্ত’ জীবনের অধিকারী হলেও, তারাও এই সময়কালে একই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গেছেন। বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারসৃষ্ট গুমট রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে বাংলাদেশের আপামর জনতার বন্দীত্বের গগনবিদারী দীর্ঘশ্বাস আমি যেন নিজের বন্দি সত্তার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছি।দীর্ঘ এই কারা অভিজ্ঞতা থেকে আমার মধ্যে এই বিশ্বাসও দৃঢ় হয়েছে যে, যে ধরনের রাজনৈতিক সংকটে জনমনে নাভিশ্বাস উঠেছে, কারাগার সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই চরমতম বহিঃপ্রকাশ।
কারাঅভ্যন্তরে আমি যা দেখেছি, তা নিয়ে বলার অনেক কিছুই আছে। আপাতত সেসব থাক। শুধু এটুকুই বলি, আমাদের যেমন এই একচেটিয়া একপদকেন্দ্রীক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যাপক সংস্কার করতে হবে ; ঠিক একইভাবে আমাদের দেশের কারাগারগুলোরও ব্যাপকমাত্রার সংস্কার করতে হবে। কারাসংস্কারের প্রকল্প বাদ দিয়ে একটা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কল্পনাই করা যায় না! কারাবন্দীদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার প্রশ্নে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকার কর্মী সাংবাদিকসহ সকল মহলকেই সোচ্চার হতে হবে।
জেল থেকে বের হওয়ার পরে, আমার মধ্যে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে যে, রাষ্ট্রের উপর এই দেশের মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা, জুলুমবাজির আইন প্রণয়ন করতে পারার সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎসের লাগাম টেনে ধরাসহ গণক্ষমতাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে লড়াই এর আমি একজন ক্ষুদ্র কর্মী ছিলাম ; সেই লড়াইকে আরো সততা নিষ্ঠা ও রাজনৈতিক দায়বোধের সাথে বেগবান করা ভিন্ন কোন পথ আমাদের সামনে খোলা নাই। হাওয়ার্ড জিনের ভাষা ধার করে বলতে চাই : You can’t be neutral in a moving train!
আপনার-আমার বর্তমান-ভবিষ্যত-স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কোন অবতার হাজির হবে না, আপনাকে-আমাকেই হয়ে উঠতে হবে স্ব স্ব অস্তিত্বের পাহারাদার। আমাদের লুন্ঠিত মর্যাদা অধিকার স্বাধীনতা আমাদেরকেই দাবী করতে হবে এবং সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে ধারণ করতে পারার মতো গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে তীব্র করতে হবে। সেই সংগ্রামে আমি আগেও ছিলাম, সামনের দিনেও নিজের সাধ্যমত ভূমিকা রাখতে চাই।
আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া ও মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর প্রতিক্রিয়ায় যারা প্রতিবাদ করেছেন রাজপথে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ; তাদের প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আমি মনে করি সংকটের কালে পরস্পরের প্রতি দায়বোধ, সহমর্মিতা, পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা অত্যন্ত রাজনৈতিক কাজ।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ, ছাত্র ও যুব সংগঠন, সাংস্কৃতিক সামাজিক সংগঠন, দেশ ও বিদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভূমিহীন কৃষক, নানা মত পথের অ্যাক্টিভিস্ট, কবি, শিল্পী , সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিপুল সংখ্যক নেটিজেন প্রজন্ম যেভাবে আমিসহ এই আইনে বন্দী অন্যদের মুক্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন ; তা এক সত্যিকারের মানবিক বাংলাদেশের পদধ্বনিকে আরো মূর্ত করে তোলে। আপনাদের সবার প্রতি আমি আবারো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
পাশাপাশি এও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অসংখ্য মানুষ এখনো কারাগারে বন্দী অত্যন্ত ঠুনকো সব অভিযোগে এবং বর্তমান সরকারের জুলুম কেবল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সীমাবদ্ধ নয় ; খুন-ধর্ষণ-ক্রসফায়ার-গুম-হামলা-হয়রানিমূলক মামলায় দেশের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে বর্তমান সরকার।
সাংবাদিক কাজল ভাই, যার সাথে কারাগারে আমার অত্যন্ত হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তিনি এখনো কারাগারে বন্দী; নাভাল আর্কিটেক্ট মাহফুজ আজ সতের মাসের বেশী সময় ধরে একই আইনে কারাযাপন করছেন। অবিলম্বে এঁরাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সকল বন্দীদের মুক্তি চাই। এই আইন বাতিল চাই। স্বৈরাচারী আইন প্রণয়নের উৎস ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন চাই।
সরকারি ও রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, সংগ্রাম চলছে, চলবে। জালিমতন্ত্রের অবসান ঘটাতেই হবে।