চলচ্চিত্র, চেতনা এবং সেন্সরশিপ

  • সারাহ নাফিসা সাহিদ; ভাষান্তর: লুবনা সুলতানা

সম্পাদকীয় মন্তব্য: সারাহ নাফিসা সাহিদ টরোন্টো ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সার লেখক; NOW Toronto, Hyperallergic, The McGill Daily, The Daily Star, Wear Your Voice, Directed by Women ইত্যাদি পত্রিকা/ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেন। আগ্রহের বিষয় মূলত চলচ্চিত্র, শিল্প, সংস্কৃতি। ২০১৮ সালে ‘Cinema, Consciousness, and Censorship‘ শীর্ষক লেখাটি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপের উদ্ভব, এর সাথে ক্ষমতা ও উপনিবেশের সম্পর্ক, দেশীয় চলচ্চিত্র-মাধ্যমে এর প্রভাব, বিদ্যমান পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় এতে ফুটে উঠেছে।

চলচ্চিত্র রূপান্তরকামী- এটি অনুপ্রাণিত করে, উৎসাহ দেয় এবং বিনোদন চিত্তের উর্ধে গিয়েও আলোড়ন তৈরী করে। এই কারণে জনগণের কর্তৃক গৃহীত ধারনাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে শাসকদের কাছে চলচিত্র একটি মূল্যবান যন্ত্র।

গুটিকয়েক দেশে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গ্লোবাল সাউথে যেমন, ভারত, ইরান, চীন এবং মালয়েশিয়াতে এখন পর্যন্ত সেন্সর বোর্ড আছে। বিশ্বের বাকি দেশে সেন্সরশিপ শিশু পর্নোগ্র্যাফির মধ্যেই সীমাবদ্ধ- এছাড়া, চলচ্চিত্রকে সেন্সর করা হয়না কিন্তু তা দেখার আগে প্রিভিউ গ্রেড দ্বারা প্রত্যয়িত করা হয় এবং নৈতিক ও দার্শনিক বিচ্যুতির পরীক্ষা করা হয়ে থাকে চলচ্চিত্র সমালোচকদের দ্বারা।

উপনিবেশিক আইন দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় কোন কোন চিত্র জনগণ দেখবে। তবে সেন্সরবোর্ড কোন ধরণের চিত্রকে হূমকিস্বরূপ মনে করে এবং তা কীভাবে চলচ্চিত্র  উৎপাদনের গুণমানকে প্রভাবিত করে? বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সেন্সর বোর্ডের ভূমিকা বুঝতে আমি কথা বলেছি বিভিন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে এবং বোর্ড কর্মীদের সাথে। 

Cartoonist: Kianoush Ramezani; Cartoon Movement

সেন্সর বোর্ডের উপনিবেশিক ইতিহাস

সেন্সর বোর্ডের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে এর কাঠামো মূলত নির্মিত হয়েছিলো সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া বা উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য যা কিনা জনগণের মধ্যে উপনিবেশ বিরোধী মনোভাবের তাড়না জোগাচ্ছিলো। ভারতে চলচ্চিত্রের আভির্ভাব ঘটে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতি বাড়ছিলো।  উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের সৃজনশীল সদস্যরা জনতাকে তাদের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তাকে প্রয়োগ করেছিলেন। বৃটিশ-ভারতীয় সরকার “আপত্তিকর চলচ্চিত্রের প্রদর্শন রোধ করতে” তখন সিনেমাটোগ্রাফ এক্ট, ১৯১৮ গঠন করে।  তৎকালীন উপনিবেশিত ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশের সামান্য আভাস রয়েছিলো বলে এবং চলচ্চিত্রের নায়ককে “গান্ধী টুপি” পরিধান করানোর জন্য বৃটিশ-ভারতীয় সেন্সর বোর্ড দ্বারা প্রথম আপত্তিকর  চলচ্চিত্র বলা হয় ১৯২১ সালের ‘ভক্ত ভিদুর’ সিনেমা’কে । ১৯২৮ সালে ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফ কমিটি উদ্ধৃত করে যে, “এটি (চলচ্চিত্রটি) সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি এবং জনগণকে অসহযোগী হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে”।

১৯১৮ সালের  আইনটি পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে ইস্ট বেঙ্গল বোর্ড অব ফিল্ম সেন্সর তৈরীর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো, যা কিনা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র মতো চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েছিল (যেটি  পরবর্তীতে  মুক্তি পায়)।

পাকিস্তান সরকার আরও কিছু ধারা যোগ করে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস এক্ট, ১৯৬৩  প্রবর্তন করে এবং ঢাকা ও লাহোরে ব্রাঞ্চ করে কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র অনুমোদন পর্ষদ গঠন করা হয়। বৃটিশ উপনিবেশিক শাসন আমলের এবং পাকিস্তান শাসন আমলের উভয় আইনই এখনো কার্যকর আছে এবং এগুলোই  বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের নির্দেশনাবলীর মূল দলিল গঠন করে।

জহির রায়হান পরিচালিত’ জীবন থেকে নেয়া’

সেন্সরশিপ এবং রাষ্ট্র আরোপিত জাতীয় পরিচয় 

১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধ চলাকালীন আয়ুব খান সেন্সরশিপ অব ফিল্মস এক্ট, ১৯৬৩ ব্যবহার করে  ভারতীয় হিন্দি-ভাষা এবং ভারতীয় বাংলা-ভাষার চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করার জন্য জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে ব্যবহার করেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তানের স্থানীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি রক্ষা করা। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে, ১৯৬৩ সালের এই- আইনের ধারা ব্যবহার করে হিন্দি এবং উর্দু ভাষা-ভাষী চলচ্চিত্রের প্রভাব রোধ করতে ভারতীয় এবং পাকিস্তানি চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করা হয়। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষিত করার জন্য এই পদক্ষেপগুলির প্রয়োজন হলেও, একটি বাংলা-ভাষা কেন্দ্রিক জাতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে দেশের অ-বাঙালি ভাষীদের, যেমন,- আদিবাসী সম্প্রদায়কে, অদৃশ্য করে রেখেছে।  

সেন্সরশিপ আইনগুলিতে অন্যান্য ভাষাকে নিরুৎসাহিত করে এমন কোনো স্পষ্ট ধারা নেই, তবে অন্যান্য ভাষার, বিশেষ করে আদিবাসী ভাষার অন্তর্ভুক্তির প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ উল্লেখও নেই।

সেন্সর বোর্ড কিভাবে আদিবাসী সংস্কৃতি প্রান্তিককরণ করে তা স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায় ২০১৫ সালে। বেঙ্গল ক্রিয়েশনের নির্বাহী নির্মাতা অং রাখাইন’এর পরিচালিত দেশের প্রথম চাকমা ভাষার ছায়াছবিমর থেংগারি বা Mor Thengari (আমার বাইসাইকেল)-এর প্রত্যয়ন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড।

পরিচালক অং বিশ্বাস করেন, “আপাত দৃষ্টিতে ভাষা অবশ্যই একটি কারণ হতে পারে না। বাংলা ভাষাভাষী দর্শক কেনো আমার সিনেমার দৃশ্যায়িত ভাষা বুঝতে অক্ষম হবে এটা আমার ঠিক বোধগম্য হয়না” । 

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সেন্সর বোর্ডের সদস্য, নাসিরুদ্দিন দিলু একমত পোষণ করেন, “যদি আদিবাসী- ভাষার সিনেমা জমা দেয়া হয়, আমরা অবশ্যই তা পর্যালোচনা করবো”। মর থেঙ্গারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, দিলু বলেন, “আমি এমন কোনো সিনেমা সম্পর্কে জ্ঞাত নই। সেন্সর বোর্ডে এখন অবধি কোনো আদিবাসী-ভাষার সিনেমা জমা দেয়া হয়নি”।

মর থেঙ্গারি/ My Bicycle

মর থেঙ্গারি চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে সেট করা হয়েছে এবং চাকমা ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখানো হয়েছে। অং বলেন যে তাকে “সেন্সর বোর্ড কর্তৃক বিজ্ঞপ্তি জানানো হয় যে তারা তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে একটি দীর্ঘ চিঠি পেয়েছে যাতে সিনেমাটির বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইস্যু তোলা হয়েছে”। এরপরে তাকে অনুরোধ করা হয় সিনেমাটির অন্তত দশটি দৃশ্য কেটে ফেলার জন্য যার ফলে তিনি সেন্সর বোর্ড থেকে ছবিটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।

আরেকটি উদাহরণ, যেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জড়িয়েছিলো, তা হচ্ছে ২০০৫ সালে তানভীর মোকাম্মেল এর ডকুমেন্টারি ‘কর্ণফুলীর কান্না’। সেখানেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়কে চিত্রিত করা হয়েছিলো। মোকাম্মেল বলেন, ‘যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক অভিযানে নিয়োজিত ছিলো তখনকার কথা। পার্বত্য জনগণের প্রতি  সহানুভূতিশীল মনোভব প্রকাশের জন্য ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো’।

উভয় ক্ষেত্রেই, ১৯৬৩ সালের আইনের যে সকল ধারা স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে সমর্থন যোগানোর কথা বলেছিল, সেগুলোকেই ব্যবহার করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রির মধ্যকার বৈচিত্র রোধ করতে, বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হতে উঠে আসা গল্প-কাহিনী নিরুৎসাহিত করতে।

কর্ণফুলীর কান্না, তানভীর মোকাম্মেল

সরকারের পরিবর্তন, নৈতিকতার পরিবর্তন

সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তগুলি পনেরোজন সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড সদস্যের নৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে বোর্ডটি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সরকারি প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। সরকার মনোনীত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কিছু ব্যাক্তিও সদস্য, যেমন নাসিরুদ্দিন দিলু এবং মুশফিকুর রহমান গুলজার। জনগণের জন্য কি ধরনের চলচ্চিত্র জুতসই হবে তার সিদ্ধান্ত নেন এই বোর্ড। 

১৯৯১ সালে, তানভীর মোকাম্মেলের ডকুমেন্টারি “স্মৃতি’৭১” এর উপর আপত্তি জানায় সেন্সর বোর্ড – বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আমলের কথা। এ বিষয়ে মোকাম্মেল বর্ণনা করেন: “স্মৃতি’৭১ এর পুরো ধারণা বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আদর্শিক অবস্থানের জন্য এক ধরণের অভিশাপের মতো ছিলো। এ সিনেমায় ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আল-বদর ও অন্যান্য পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বীভৎসতা ফুটে উঠে। সিনেমার বিষয় হিসেবে, সবাই বুঝতেই পারেন এটি তৎকালীন সরকারের পছন্দের ছিলো না যেহেতু সেই সরকার নিজেই জামাত-ই-ইসলামী পার্টির ছিলো যারা কিনা আল-বদরের ডেথ স্কোয়াড তৈরি করেছিল।”

একই মেয়াদে-  ১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদের “মুক্তির গান” চলচ্চিত্রের উপর আপত্তি আরোপ করা হয়েছিল। ব্যাখ্যা দেখানো হয় যে ছবিট- আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জাগিয়ে তোলার ভয়ে।  তানভীর মোকাম্মেলের আরেকটি চলচ্চিত্র, “নদীর নাম মধুমতী” সেন্সর বোর্ড কর্তৃক ১৯৯৪ সালে নিষিদ্ধ করা হয় তাকে “জাতীয়তাবাদ-বিরোধী” বলে (মোকাম্মেল “স্বাধীনতার পক্ষে” শব্দটি ব্যবহার করেন)। মোকাম্মেল এই নিষেধাজ্ঞাকে হাইকোর্ট এবং পরে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। যাইহোক, চলচ্চিত্রটি দুইটিই পরবর্তীতে মুক্তি পায় যখন ক্ষমতাসীন দল বদলায়, এবং আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে।

মুক্তির গান

২০০৯ সালে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু থাকার কারণে এনামুল হক নির্ঝরের রাজনৈতিক স্যাটায়ার “নমুনা”কে সেন্সরশিপ ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করা হয়। চলচ্চিত্রটি রূপকভাবে একটি  ছোট গ্রাম সম্প্রদায়ের স্তরে বর্তমান রাজনৈতিক ভূ-দৃশ্যটি তুলে ধরে- অনেকটা জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া”র মতন। সেন্সর বোর্ডের চলচ্চিত্র পরিদর্শক ওবায়দুল কবির মোল্লা এ বিষয়ে  বলেন, “পরিচালক সিনেমাটিতে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাঙ্গাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন, তাই আমরা প্রশংসাপত্র প্রত্যাখান করার পরে তাকে সিনেমাটি উঠিয়ে নিতে বলি”।  

তারপর ২০১১ সালে দেখা যায় যে, খলনায়কের গায়ে ‘মুজিব কোট’ পরিধান করানোর দায়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের “হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ” ও নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান সুরত কুমার সরকার এএফপিকে জানান, হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ ‘দেশের রাজনৈতিক দর্শনের পরিপন্থী’।  

মূলত, এই ঘটনাগুলো বিচিত্রভাবে ফুটিয়ে তোলে কীভাবে চলচ্চিত্র কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে অনুপযোগী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেন্সরশিপ আইনগুলোর নিরপেক্ষতা বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী সরকার বলেন, ‘আমরা নির্দিষ্ট করে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারিনা, এটা একদম নির্ভর করে ঠিক কোন সময়ে একটি চলচ্চিত্রটিকে ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করা হয়েছিলো এবং তখনকার বোর্ড সদস্যেরা ছবির রাজনৈতিক উপাদানগুলি সম্পর্কে কি ভেবেছিলেন’।

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী, যার সিনেমাগুলোও সেন্সর বোর্ডের যন্ত্রণায় অংশীদার হয়েছে, তিনি যোগ করেন, ‘আমাদের সেন্সরশিপ আইন খুব একটা সুবিধাজনক ও স্বচ্ছ নয় এবং এতে কিছু অধ্যায় রয়েছে যা ভবিষ্যতে কেউ যদি সরকারের বিরুদ্ধে যায় বা এমন কিছু দেখিয়ে থাকেন, তাহলে তাকে কড়া জেরার মুখে ফেলা যাবে।’ 

নদীর নাম মধুমতী, তানভীর মোকাম্মেল

সুস্থ চলচ্চিত্রে সেন্সরশিপের প্রভাব

সুস্থ চলচ্চিত্র হচ্ছে সেইসব চলচ্চিত্র যেগুলো গতানুগতিক কাঠামোর বাইরে থেকে উৎপাদিত হয়। প্রায়শই, তারা বড় স্টুডিওর লাভজনক পন্থা অনুসরণ না করে এটাকে নয়া জমানার চিন্তার প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে তৈরী করে। এই বিকল্প ধারার আন্দোলনের অন্যতম পরিচালক ফারুকি বলেন যে, ‘ঐতিহ্যগতভাবে, সুস্থ অথবা সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক সিনেমাগুলিই সেন্সর বোর্ডের হাতে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়’। 

বিভিন্ন উদাহরণে দেখা যায়, ভিন্নধারার চলচ্চিত্রগুলো সেন্সর বোর্ডের যে সকল ধারার জন্য প্রত্যয়ন বাতিলের মুখোমুখী হয় বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলো তা থেকে অব্যাহতি পায়। ১৯৭২-১৯৯৬ সালের কথা বিবেচনা করুন, যেখানে মূলধারার বাংলা সিনেমায় ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি লাঞ্চনার চিত্র দৃশ্যায়িত হতো উপভোগ ও সুখ্যাতির ক্যামেরায়, প্রায় সফট পর্ণের কাছাকাছি বলা যায়, যা কিনা কোড ফর সেন্সরশিপ, ১৯৮৫ ধারা আইনলঙ্গন করে।

এদিকে, ফারুকীর নির্মিত “থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার” চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে দেখা যায় প্রধান চরিত্রে থাকা নারী একজন মাতালের শিসের ডাকে সাড়া না দেওয়ায় তার দিকে সেই মাতাল থুথু ফেলে নারীটিকে হয়রানি করছে এবং ২০০৯ সালে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পূর্বে সেন্সর বোর্ড কর্তৃক দৃশ্যটি কেটে দেয়া হয় এই যুক্তিতে যে এখানে একজন নারীকে অসম্মান করা হয়েছে। কিন্তু তা ব্যাখ্যা করতে হলে দেখতে হবে কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দৃশ্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাণিজ্যিক সিনেমাগুলিতে উত্তেজনাপূর্বক লাঞ্চনার দৃশ্য যেখানে অনুমোদন পায় সেখানে বাস্তব ও হয়রানির সাথে প্রাসঙ্গিক দৃশ্য আপত্তিকর হয়ে পড়ে  অ-বাণিজ্যিক সিনেমার ক্ষেত্রে।

চলচ্চিত্র পরিদর্শক মোল্লাকে যখন তাদের এই দ্বৈত-মান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি জানান, ‘এগুলি বিএনপির শাসন আমলে ছিলো। আমরা এখন অধিক কঠোর, এমনকি বাণিজ্যিক সিনেমাতেও এমন দৃশ্য আর অনুমোদিত করি না’। তবুও, স্থানীয় থিয়েটারগুলিতে চলমান সিনেমার পোস্টারের দিকে একবার দ্রুত নজর বুলালেই প্রমাণ মিলে যে এখনো আপত্তিকর নান্দনিকতা পুরুষ দর্শকের মনে ও স্ক্রিনে প্রসারিত।

সেন্সর বোর্ডের সদস্য দিলু বলেন, ‘আমরা অবশ্যই অশ্লীলতাকে অনুমোদন করিনা কিন্তু আমরা নারীদের ইমেজ নিয়ে এখন আরো উদার। আমরা যদি এগুলোর অনুমতি না দিই তাহলে সিনেমা হলে কেউ আসবে না। চলচ্চিত্রের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সিনেমাগুলির উপার্জনে সক্ষম হতে হবে আর তা একমাত্র সম্ভব হবে যদি এসব চিত্রে আমরা ছাড় দিই”।

দিলুর এই বক্তব্য প্রকাশ করে যে সমাজের সংস্কৃতিগত দিকের চাইতে চলচ্চিত্র শিল্পের “ইন্ডাস্ট্রি” অংশের দিকে সেন্সর বোর্ডের মূল মনোনিবেশ। এই পদ্ধতি সুস্থ চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের বাইরের লক্ষ্য বিচারে অক্ষম। চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের বিশ্বাস, ‘যে বোর্ড কিনা অতি সাধারণ বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রকে সেন্সর করে তার সৃজনশীল চলচ্চিত্রের শৈল্পিক ও সামাজিক বিষয়বস্তু বিচার করার যোগ্যতা নাও থাকতে পারে’।  

তাছাড়া, অনেক অ-বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র স্বতন্ত্রভাবে অথবা গণ-তহবিলের মাধ্যমে নির্মিত হয়, যেমন অং রাখাইনের মর থেঙ্গারি তাদের টিকে থাকা এবং বিতরণ প্রায়শয়ই নির্ভর করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে তাদের কর্মক্ষমতার উপর। কিন্তু, সেন্সর বোর্ডের প্রত্যয়নের আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার নিয়মিত বিলম্বের কারণে অনেক সিনেমা এরকম ইভেন্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়না। ‘সেন্সর বোর্ড কাগজপত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছিলো এবং এর ফলে প্রত্যয়নের প্রক্রিয়াতে দেরী হয়’, অং বলছিলেন, যার আবেদনপত্র পর্যালোচনা করতে লেগেছিলো তিন মাস, ‘প্রত্যেক সিনেমার সাফল্যের জন্য একটি উপযোগী সময় থাকে এবং এই বিলম্ব আমার আন্তর্জাতিক উৎসবে যোগ দেওয়ার সেই সুযোগকে নষ্ট করছিলো’। 

Cartoonist: Osama Hajjaj; Cartoon Movement

সেন্সরশিপের অস্তিত্বের সংকট

কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবিরের ১৯৮১ সালের রচনা “সংস্কৃতি চাই’’-তে সেন্সরশিপের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়: ‘বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। যে জাতির জন্ম হয়েছে রক্তাক্ত ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সে জাতির জন্য সাংস্কৃতিক সেন্সরশিপ অপমানজনক এবং অপ্রয়োজনীয়। অন্য সকল সেন্সর ব্যবস্থার মতো, চলচ্চিত্র সেন্সরের বিধিগুলি বৃটিশ উপনিবেশ রক্ষার্থে রচিত ও আরোপিত হয়েছিলো। বর্তমান সেন্সর বোর্ডের গঠন শীঘ্রই বাতিল করতে হবে।’

কবির নিজেও উর্দু ও হিন্দি চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে সংরক্ষণ-নীতি সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু, তিনিও চলচ্চিত্রে নজরদারির বিরুদ্ধে সচেতন ছিলেন।

কবির তার রচনায় যে ভাব প্রদর্শন করেছেন এখনকার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে তা এখনও বিদ্যমান। নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার বিজয়ী তানভীর মোকাম্মেল কবিরের মতামতকে আরো বিস্তারিত করেন: ‘আমার বিশ্বাস আমাদের জনগণ ভালো, খারাপ ও অশুভের মধ্যে বাছ বিচার করার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ব। যদি তারা তাদের দেশের জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারেন তবে তারা কোন সিনেমা দেখবেন আর কোনটা দেখবেন না সেটা বাছাই করার অধিকার থাকা উচিত। একজন শিল্পী হিসেবে আমি কোনো ধরণের শিল্পের মধ্যে সেন্সর সমর্থন করি না।’

আলমগীর কবির

ফারুকীর সাথে সাথে মোকাম্মেলও ধারণা করেন যে সেন্সর বোর্ডকে গ্রেডিং প্রত্যয়ন বোর্ডে সংস্কার করা উচিত। ‘যদি এর অস্তিত্ব রাখতেই হয় তবে এর ভূমিকা হওয়া উচিত সিনেমা নিষদ্ধকরণে নয় বরং কেবল গ্রেডিং সরবরাহ করা। যেমন, অভিভাবকের নির্দেশনায়, শিশুদের জন্য, প্রাপ্তবয়স্কাদের জন্য ইত্যাদি। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে মানুষের অধিকার আছে সবকিছু দেখার। আমাদের একগাদা নৈতিকতার পুলিশের প্রয়োজন নেই’, বলছিলেন মোকাম্মেল।

প্রকৃতপক্ষে, এই ডিজিটাল জমানায় যেখানে অনলাইনে সবকিছুর অবাধ বিচরণ সেখানে সেন্সরিশিপের সক্ষমতা খুবই সীমিত*। নৈতিক পুলিশের ধারণাটা ধরেই নেয় যে, জনতা নিজের ভালো বোঝার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয়। এই মনোভাব একদম ভারতীয় সম্পর্কে বৃটিশদের মনোভাবের সমরূপ। অথবা পুরো বিপরীতটা হতে পারে- সিনেমার চিত্রায়নের স্বতন্ত্র শক্তিকে শাসকগোষ্ঠী হুমকিস্বরূপ দেখে। যাই হোক না কেনো, বাস্তবতা হচ্ছে, সেন্সরশিপ জাতীয় চলচ্চিত্রের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমানে শ্রোতাদের কাছে নকল প্লট আর সস্থা আইটেম গান দিয়ে ভরা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তাই বেশি কিন্তু এর কারণ রূচি বা বুদ্ধিমত্তা নয়। বাংলাদেশী আমজনতা  আকর্ষণীয় এবং চিন্তা-চেতনামূলক সিনেমা থেকে বঞ্চিত । সেন্সর বোর্ডের মতো কর্তৃত্বমূলক সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত চলচ্চিত্র প্রোডাকশনের কাঠামো উদ্যমী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নতুন যুগের ভাবনায় নিরুৎসাহিত করে। চলচ্চিত্রকে তার আসল উদ্দেশে পরিবেশন করতে এবং বিপ্লবী ধ্যান ধারণার প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হতে হলে  প্রথমেই প্রপাগান্ডা ও নিয়ন্ত্রণের ঔপনিবেশিক মূল থেকে শিল্পকে উপড়ে ফেলতে হবে।  

ফুটনোট:

*. উল্লেখ্য, লেখাটা ২০১৮ সালের। ছাপা’র কয়েক মাস পড়েই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত দুই বছরে আরও অনেককেই এই আইনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার, হয়রানির শিকার হয়তে হয়। ফেইসবুক, ব্লগ, টিক টক, ইউটিউব ওয়েব সিরিজ জাতীয় নানান মিডিয়া এখন নিয়ন্ত্রিত। তাই এই “সীমিত” ব্যাপারটা হয়তো আর প্রযোজ্য নয়। লেখাটি পড়ার সময় এই প্রেক্ষাপট মাথায় রাখবার দরকার।  

  • সারাহ নাফিসা সাহিদ: চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক ও লেখক; লুবনা সুলতানা : শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *