- লেখক: ব্রুনো লাতুর; ভাষান্তর: কাজী তাফসিন
করোনা ভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ফরাসি নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ব্রুনো লাতুরের La crise sanitaire incite à se préparer à la mutation climatique শীর্ষক লেখাটা Le Monde-তে প্রকাশিত হয়েছে গত ২৫শে মার্চ, ২০২০-তে। লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ পরদিন প্রকাশিত হয় Is This a Dress Rehearsal? শিরোনামে। সেই ইংরেজি অনুবাদ থেকে লাতুরের লেখাটির অনুবাদ করেছেন কাজী তাফসিন। তাফসিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। অনুবাদটি পূর্বে বোধিচিত্তের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয়েছে।
মূল প্রবন্ধ
খুব অদ্ভুতভাবে আমরা এখনকার এই কারাবাস আর খ্রিস্টানদের প্রায়শ্চিত্তকাল ঠিক একই সময়েই পেয়ে গেলাম। যাদেরকে একত্রিত না হয়ে এই মুহূর্তে হাত-পা গুটিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে দূরে বসে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা এটাকে খুব সুন্দরভাবে মেনে নিচ্ছে। এইভাবে যে জোর করে না খাইয়ে এই সেক্যুলার ও রিপাবলিকান রমজানে রোজা রাখানো হচ্ছে সেটা তাদের জন্য একটা মোক্ষম সময় হইতে পারে। কোন বিষয়টা আমাদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা কম এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারবে… যার জন্য আমাদের সামনে এই ভাইরাসের আক্রমণ ভবিষ্যৎ দিনগুলোর জন্য হাজির হয়েছে একটা পোশাকী মহড়া হিসেবে- যেটাকে আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশ্লেষণ করতে হবে এইজন্যই যে সেটা আমাদের বেঁচে থাকার সবগুলো শর্তকে শর্তকে সকল দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করবে। এই পর্যায়ে এসে আলাপ এগিয়ে নেয়ার জন্য অন্যান্য অনেকের মতোই আমিও একটা হাইপোথিসিস পেশ করব আপনাদের সামনে। হাইপোথিসিস’টা হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যে সঙ্কটকাল আমরা এখন পার করছি সেটা সামনের জলবায়ু সঙ্কটের জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত কিংবা কিংবা প্ররোচিত করছে অথবা উস্কানি দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার এই হাইপোথিসিসকে এখন একটু খুঁটিয়ে দেখা দরকার।
পরপর এই দুইটা সংকট আমাদের চোখের সামনে হাজির হওয়াটা আমাকে একরকম আকস্মিক আর বেদনাদায়ক উপলব্ধি দিচ্ছে এই কারণে যে, ‘সমাজ’ বলতে আদ্দিকালে যে সংজ্ঞাটা চালু ছিল সেটা এখন আর টিকতেই পারছে না। মানে, মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যেই [একত্রিত হয়ে] সমাজ গঠন করেছে—ধাঁচের সমাজের যেই সংজ্ঞা ছিল সেটা এখন আর কোন অর্থই তৈরি করতে পারছে না।২ বরং প্রতিমুহূর্তে সমাজের অবস্থান নির্ভর করছে বিভিন্ন রকম অ্যাক্টরের১ সমন্বয় তৈরি করার মাধ্যমে। এসব সমন্বয়গুলোর বেশিরভাগেরই কোনো মানবরূপী গড়ন নাই। আমরা লুই পাস্তুরের পরবর্তী সময় থেকেই দেখে আসছি যে এই কথাগুলো মাইক্রোবের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, একইভাবে ইন্টারনেট, আইন, সংগঠন হিসেবে হাসপাতাল কিংবা রাষ্ট্রের কলকব্জা বোঝার ক্ষেত্রেও সত্য। আর সবশেষে এই কথাটা প্রযোজ্য জলবায়ুকে বোঝার ক্ষেত্রে। আর অবশ্যই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের এই ‘যুদ্ধাবস্থা’ ঘোষণার হুলস্থূল বাদেও, এটাকে শুধুমাত্র মাস্ক কিংবা টেস্টের ব্যবস্থাপনার একটা বিষয় হিসাবে দেখলে কিংবা এটাকে মানুষের সম্পত্তি, আচার-আচরণের নিয়ন্ত্রণ এবং মানুষের ‘সম্মিলিত ঐক্য’ দিয়ে বুঝতে চাইলে আমরা সংক্রামক হিসেবে এই ভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত পুরো চেইনের কেবল একটা অংশমাত্র বুঝতে পারবো। কিন্তু পুরো ভয়াবহতা কখনোই টের পাব না। যখন এর সাথে সম্পর্কিত পুরো নেটওয়ার্কটা (সম্পর্কজাল) আমলে না নিয়ে শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট অংশের ওপর জোর দেয়া হবে, তখন আমরা হয়তো দেখতে পাব কিভাবে এটার প্রভাব ভিন্ন ভিন্নভাবে তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, নিউইয়র্ক বা প্যারিসে পড়ছে। তাই এই মহামারীকে কোনোভাবেই ‘প্রাকৃতিক’ বলা যায় না, যেভাবে বলা যায় না পূর্বের যেকোন দুর্ভিক্ষ কিংবা বর্তমান সময়ের জলবায়ু সঙ্কটকেও। এই ‘সমাজ’ আসলে আর সঙ্কীর্ণ ‘সামাজিক পরিসরে’ আটকে নাই, বরং তাকে ছাপিয়ে গেছে সেটা অনেকদিনই হতে চলেছে।
যদিও আমি দুইটা ঘটনাকে পাশাপাশি এনে আলোচনা এগিয়ে নিতে চেয়েছি তবুও আমি জানি না এদেরকে সমান্তরালে রেখে কতদূর পর্যন্ত আলাপ টেনে নেয়া যায়। আর মোটাদাগে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যেকোন ঝুঁকি তো আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তাছাড়া তড়িৎগতির ও উৎসাহ-উদ্দীপনার রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলোও খুব একটা অত্যাশ্চর্য লাগছে না। এর আরও উদাহরণ দরকার পড়লে আপনারা এখন পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের উদ্যমী পদক্ষেপগুলোর ব্যর্থতার দিকে নজর দিলেই বুঝতে পারবেন। ‘সন্ত্রাসবাদী’ আক্রমণের—যা কিনা শুধুমাত্র একটা পুলিশি কারবারের হিসাব—চেয়েও এই মহামারী আমাদের নেতাদেরকে বেশি সজাগ করে তুলেছে। এটা নেতাদের মধ্যে ‘সুরক্ষা’ নিয়ে একরকম স্বপ্রতীতি বোধ তৈরি করতে পেরেছে যেখানে তারা বলছে “আমরা আপনাকে সুরক্ষা দিচ্ছি” “আপনারাও আমাদেরকে সুরক্ষা দিন”। এটা একভাবে আবারও শাসক হিসেবে রাষ্ট্রকে ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে পুনরায় আরও ক্ষমতাশীল করে তোলে। জনতার পরবর্তী বিক্ষোভ-মিছিল-মিটিং থেকে এটা তাদেরকে রেহাই পাবার একটা উছিলা করে দেয়।৩
কিন্তু এই মুহূর্তে যেই রাষ্ট্র আমরা দেখছি সেটা আসলে প্রতিবেশ বা ইকোলজিকাল সঙ্কটের সময়কালীন একুশ শতকের কোনও রাষ্ট্র না; বরং এটা হচ্ছে উনিশ শতকের তথাকথিত ‘জৈব-ক্ষমতা’র রাষ্ট্র।৪ আলা দেরোজিয়াঁ এই জাতের রাষ্ট্রের নাম দিয়েছেন Statistics [পড়ুন স্টেট-ইস্টিক্স, রাষ্ট্র-গণিত]: যেখানে মানুষকে জনসংখ্যায় পরিণত করে তাদেরকে বিশেষজ্ঞের ক্ষমতার মাধ্যমে ওপর থেকে সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে শাসন করা হয়।a এই মুহূর্তে আমরা শুধুমাত্র এই একটা বিষয়ই দেখতে পাচ্ছি যেটার একই কাঠামোটাই ভিন্ন ভিন্ন জাতিরাষ্ট্র একইভাবে অনুকরণ করে বেড়াচ্ছে, যেন এই ব্যবস্থাটাকে সারা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দেয়া যায়। এই মুহূর্তে আমরা এমন একটা জৈব-রাজনীতির ক্যারিকেচার দেখাচ্ছি, যেই খেলায় আমরা সবাই বসে আছি নিজের বাসায় আর বাকিসব দায়িত্ব হস্তান্তর করে রেখেছি বাইরের টহলরত পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িগুলোর ওপর-যেটা কিনা সরাসরি ফুকোর আলাপ থেকেও আমরা দেখতে পাব। এখানে এমন কিছু মানুষের কথা না বললেই না যাদেরকে এমনকি এই সময়েও সবার আগোচরে বাধ্য করানো হচ্ছে কাজ করার জন্য, যেন বাকিরা সবাই সাপের মতন নিজ বাড়িতে শান্তিতে গর্ত খুঁড়ে বসে থাকতে পারে। এই মুহূর্তে অভিবাসীদের কথাও বাদ দেয়া যায় না, কারণ তারা এখন নিজদেশে থাকুক কিংবা পরদেশেই থাকুক না কেন, দুটো জায়গাতেই তারা পরবাসী হিসেবেই বেঁচে আছে। কিন্তু এমন কিছু একটার ক্যারিকেচারের মধ্যে আমরা আছি যেটা আসলে আমাদের হাতেই নাই।
এখানে [রাষ্ট্রের] দুইটা অবস্থানের মধ্যে কিন্তু একটা বড় পার্থক্য আছে। প্রথমত, যখন ভাইরাসের হাত থেকে আপনাকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য রাষ্ট্র বলবে, “আমি আপনাকে জীবন ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছি”—সেক্ষেত্রে রক্ষা করার এই দায় কিন্তু পুরোপুরি দিয়ে দেয়া হয়েছে বিজ্ঞানীদের হাতে। এক্ষেত্রে এই ঘটনার সকল প্রভাব একমাত্র পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত দিয়েই [রাষ্ট্রের পক্ষে] জানা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয়ত, জলবায়ু সঙ্কটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যখন ঝুঁকি নিয়ে বলবে, “আমি আপনাকে জীবন ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছি, কেননা একইসাথে পৃথিবীতে যাদের [মানুষ ও না-মানুষ] ওপর ভর করে আপনি [নাগরিক] বেঁচে আছেন তাদের বেঁচে থাকার সকল শর্তগুলোও আমি [রাষ্ট্র] রক্ষা করে চলি”—তখন কিন্তু তার হিসাব-নিকাশটা পুরোপুরি ভিন্ন হবে।
ভেবে দেখুন। মনে করেন চার্চিলের মতো সুরে এখনকার ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাকরনও কোন একদিন ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে, এখন থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল ও গ্যাস মাটির নিচে মজুদ রাখতে হবে এবং উঠানো যাবে না, কীটনাশক বেচাকেনা করা যাবে না, কৃষিকাজের সময় অতিরিক্ত গভীরে মাটি খোঁড়া যাবে না, এমনকি মদের বারগুলোতেও এখন থেকে হিটার ব্যবহার করা যাবে না। যদি গ্যাসের মত বিষয় থেকে ইয়োলো-ভেস্টের মত আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে এখানে বলা অন্যান্য বিধিনিষেধের কারণে কি পরিমাণ মানুষ জড়ো হবে তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই আর যাই হোক না কেন, এই মুহূর্তের জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির তুলনায় জলবায়ু বিপর্যয়ের সময় [শাসনের] এই প্রয়োজনটা আরো বেশি অনুভূত হবে। [মানুষকে শাসন করবার] এই প্রয়োজনটা ফ্রান্সের মানুষের ভালোর জন্য এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য একেবারে দরকারী হয়ে পড়বে। কেননা জলবায়ু সংকট শুধু কয়েক হাজার মানুষকে নাই করে দিবে না তা নয়, বরং এটা একে একে প্রত্যেকটা মানুষকেই এটা গ্রাস করবে। আর, এটা একবারের জন্য গ্রাস করবে তাও নয়, বরং আজীবনের জন্যই আসবে।
এটা ইতোমধ্যেই পরিষ্কার যে, এরকম রাষ্ট্র এই মুহূর্তে কোথাও নাই—কিংবা হয়তো আছে কোথাও। এখানে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হল এই যে, আমরা যখন একটা সঙ্কট থেকে আরেকটা সঙ্কটে উপনীত হচ্ছি তখনও আমরা পরবর্তী সঙ্কটের জন্য রাষ্ট্রকে কিভাবে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে তা নিয়ে ভাবছি না । বিশেষত এই সময়ে যে জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যে শিক্ষকসুলভ ধাঁচের ব্যবস্থাগুলো মানুষজনকে শেখাতে চাচ্ছে সেগুলো খুবই আদ্দিকালের। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো যে আবারও নিজ নিজ দেশের সীমান্ত বন্ধ করে রাখতে শুরু করেছে সেটাই এই আদ্দিকালে হঠাৎ ফিরে যাওয়ার চেষ্টার একটা উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু জলবায়ু সংকটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি হবে ঠিক পুরো উল্টোটা—যেখানে কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ধরনের মানুষজনের কাছ থেকে বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে শিখতে হবে। আমাদের শাসকদের তখন খুঁজতে হবে এই বৈশ্বিক উৎপাদনের ঠ্যালা থেকে বাঁচতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কিভাবে জীবনধারণ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখনকার রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে অসমর্থ হবে। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির ঝামেলা মেটাতে রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রদের শেখানোর মত শেখাচ্ছে যে কীভাবে হাত ধুতে হবে আর কাশি দেবার সময় কিভাবে কনুইতে মুখ ঢাকতে হবে। কিন্তু জলবায়ু সঙ্কটের সময়ে হিসাব হবে পুরো উল্টো, সেখানে খোদ রাষ্ট্র নিজেকে খুঁজে পাবে ‘ছাত্রের ভূমিকায়’।
[যেকোন সংকট আসা মাত্রই] সব মানুষ এভাবে একত্রিত হয়ে ‘ভাইরাসের [ঐ সংকটের] বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করার এই আদলটা কিন্তু আরেকটা কারণে একেবারেই অন্যায্য।৫ জনস্বাস্থ্য সংকটের ক্ষেত্রে এটা হয়তো সত্য যে আমরা আসলেই এইক্ষেত্রে ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করতে পারছি—যদিও আমাদের ঠোট থেকে ঠোটে সংক্রমিত হলে হয়তো এই ভাইরাসের কোন ফায়দাই নাই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের ক্ষেত্রে এই হিসাবটা কিন্তু পুরোই উল্টো হবে, এবং যেটা আসলেই খুব দুঃখজনক হবে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ‘রোগ’টা পৃথিবীর সকল জীবিত মানুষ কিংবা না-মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলবে সেই রোগটার জন্য কোনো ভাইরাস দায়ী থাকবে না। বরং সেই রোগের জন্য দায়ী হবে স্বয়ং ‘মানবজাতি’ নিজেই! কিন্তু তাই বলে যে সকল মানুষই এই দুর্দশার জন্য সমান দায়ী হবে সেটা বলছি না। এটার জন্য শুধুমাত্র সেসব মানুষই দায়ী থাকবে, যারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা না দিয়েই ইতোমধ্যে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছে। আর এই যুদ্ধের সামনাসামনি হবার জন্য এখনকার সময়ের রাষ্ট্র খুবই বাজেভাবে ভগ্ন দশায়, রুগ্ন দশায় পড়ে আছে। কারণ জলবায়ু সঙ্কটের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যে যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়া লাগবে, সে যুদ্ধের ময়দানের সম্মুখভাগ যে শুধুমাত্র একটাই হবে তা নয়, বরং এটার সম্মুখভাগ হবে কয়েকপদের, যে সম্মুখভাগগুলো আবার পরস্পর পরস্পরকে ছেদ করবে। এতকিছু বিবেচনা করে তাই বলাই যায় যে, এবারের সংকটে ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের এভাবে একত্রিত হতে পারাটা অবশ্যই এটা প্রমাণ করে না যে আমরা এর পরবর্তী সঙ্কটও এভাবে [যুদ্ধ ঘোষণা করে] জিততে পারব। প্রত্যেকবারই এমনটা হবে না যে, আমরা যুদ্ধের মিলিটারীর লোকজনকেই সম্মুখভাগে রাখতে পারব।
কিন্তু শেষতক আপনি কখনও জানতেনই না; এই রমজান মাস, সেটা হোক সেক্যুলার কিংবা প্রজাতান্ত্রিক, সেটা যেকোন বিশেষ আলাপের দিকে পরিচালিত করতে পারে।৬ বিগত বছরগুলোর মধ্যে এই প্রথমবার, আমরা এই লক্ষ কোটি মানুষজন, আমাদের নিজের জায়গায় বন্দী হয়ে আছি, যেন আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই আয়েশী ভাবটা আবারও খুঁজে পেয়েছিঃ এই আয়েশী জীবনের পথে কোন কোন বিষয়গুলো সচরাচর অনর্থক বাঁধা হয়ে দাড়িয়ে থাকে সেটা ভাববার সময় এখন এসে গেছে। চলুন, অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া এই ক্লান্তিকর ও দীর্ঘ উপবাসগুলোকে সম্মান জানাই।
২৬ শে মার্চ, ২০২০
a. Alain Desrosières, The Politics of Large Numbers: A History of Statistical Reasoning, trans. Camille Naish (Cambridge, Mass., 2002).
অনুবাদকের টীকা
১। নৃবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ব্রুনো লাতুর মূলত আধুনিকতা বিষয়ক আলোচনায় ন–আধুনিক অবস্থান নেন। অর্থাৎ, লাতুর একই সাথে ‘আধুনিকতা’ এবং ‘আধুনিকতা-বিরোধীতা’ এই দুটোর কোনোটিতেই দাঁড়াতে চাইছেন না। লাতুর মনে করেন, আধুনিকতা হচ্ছে একধরনের চুক্তি যেটা প্রকৃতি ও সংস্কৃতির পরস্পরের মধ্যে একধরনের অধিবিদ্যক ফারাক তৈরি করে, যেটা একধরনের (সত্তাগত) ফারাক তৈরি করে রাখে মানুষ (human) আর না-মানুষ (non-human) এর মধ্যে। চিন্তাজগতে আধুনিকেরা এই দুইজাতের ভাগ বাটোয়ারা করার ফলে, সকল মানবসত্তা থাকে তাদের হিসাবের একপাশে যারা কিনা সাংস্কৃতিক (Cultural), আর সকল ন-মানবসত্ত্বা থাকে অন্যপাশে যাদেরকে প্রাকৃতিক (Natural) বলে ধরে নেয়া হয়। এই দুটো আলাদা শ্রেণীকরণের(বা ক্যাটাগরি তৈরি করবার) পর আধুনিকতা বিভিন্নভাবে এদের পরস্পরের শুদ্ধিকরণ (purification) করবার চেষ্টা করতে থাকে—যেটা থেকে লাতুর বের হয়ে আসতে চেয়েছেন। এই প্রকৃতি/সংস্কৃতি কিংবা মানুষ/না-মানুষের বৈপরীত্যের লীলাখেলা থেকে বের হয়ে আসার জন্য লাতুর সবকিছুকে একেকটা অ্যাক্টর (Actor) বলছেন তার অ্যাক্টর-নেটওয়ার্ক থিওরিতে (Actor-Network Theory)। অর্থাৎ, লাতুরের দৃষ্টিতে অস্থিত্বশীল কিংবা অনস্থিত্বশীল সবকিছুই একেকটা অ্যাক্টর। মানে, বরিস জনসন, জনসন এন্ড জনসন কোম্পানী, কেরু এন্ড কোম্পানী, স্যানিটাইজার, করোনা ভাইরাস, মরা বাঘ প্রত্যেকটা বিষয়ই একেকটি অ্যাক্টর। আর এই অ্যাক্টরগুলো যদি কোন একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকে, তবে তারা পরস্পর পরস্পরকে প্রভাবিত করতে পারবে। লাতুর এভাবে সবকিছুকে একনাগাড়ে অ্যাক্টর বলার উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মূলত একইসাথে আধুনিকতা এবং আধুনিকতা-বিরোধীতা— এই দুটোকেই মাড়িয়ে (bypass) আসা। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে লাতুরের The Pasteurization of France (১৯৮৪) বইটি দেখতে পারেন।
২। লাতুর আরও দেখান যে, আধুনিকতা কিভাবে ‘সমাজ’কে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে যেখানে সমাজ বলতে শুধুমাত্র মানুষের সমষ্টি ও তাদের পারস্পরিক এজেন্সীকেই বোঝানো হয়—এবং সেই কল্পিত ‘সমাজ’ এর সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া হয় সকল না-মানুষগুলোকে। অর্থাৎ আধুনিকতা হচ্ছে এক ধরনের চুক্তি (settlement) যেখানে রাজনৈতিক পরিসর (polity) থেকে না-মানুষ যত অ্যাক্টর আছে সেগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ভাবা হয়। আধুনিকতার এই ক্যারিকেচার থেকে বের হয়ে লাতুর তাই রাজনৈতিক পরিসরে সকল না-মানুষ অ্যাক্টরগুলিকে একে একে আমলে আনতে আগ্রহী। লাতুর আরও মনে করেন যে, শুধু মানুষ নয়, বরং একইসাথে না-মানুষ অ্যাক্টরগুলোও মাঝে মাঝে দানবীয় রূপে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। না, তিনি এখানে কোনো লাফক্রাফটের ফিকশনের কথা বলছেন না। বরং ‘মানব সমাজে’ এই না-মানুষ অ্যাক্টরগুলো মাঝেমাঝে এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে যে সেটা মানুষের তৈরি করা মোটামুটি সবচেয়ে বিশাল আকারের প্রতিষ্ঠান (যেমন: রাষ্ট্র)-কেও শক্তিমাপে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যেটা হয়তো আমরা এই করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখছি। সেজন্যই লাতুর এখানে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলছেন যে, ‘মানবসমাজ’ আর আগের মতন শুধুমাত্র মানুষের পরস্পরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কারণ ‘মানবসমাজে’ আমরা ক্রমাগত বিভিন্ন রকম না-মানুষ অ্যাক্টরকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখছি, যেগুলো অনস্বীকার্য।
৩। তাদেরকে এটা বলার একটা উছিলা তৈরি করে দেয় যে, জনতা যদি কোন মিটিং-মিছিল করে, তাহলে পরিস্থিতি কোনো ভালো যায়গায় গিয়ে ঠেকবে না।
৪। লাতুরের এই লেখার সমালোচনা করে ইতোমধ্যেই The Rise and Fall of Biopolitics: A Response to Bruno Latour নামের একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য ফুকোর জৈব-রাজনীতি (biopolitics) নিয়ে লাতুর এই প্রবন্ধে সরাসরি কোন দ্বিমত করছেন না বলেই আমার মত। কিন্তু ফুকো ‘সমাজকে রক্ষা করতে হবে’ বলার সময় যে ‘সমাজ’ এর কথা বলছেন সেখানে না-মানুষ (non-human) একেবারেই অনুপস্থিত। আর না-মানুষ’কে রাজনৈতিক পরিসরে (বা polity-তে) অনুপস্থিত ভেবে নিলে আমরা কখনোই জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে সন্তোষজনক কোন সমাধান করতে পারব বলে লাতুর মনে করেন না। কারণ, জলবায়ু সঙ্কট শুধুমাত্র মানুষের একার নয়, বরং পৃথিবীর সকল জীবিত কিংবা অ-জীবিত বিষয় আশয়ের অস্তিত্বের প্রশ্ন (লাতুর একজন স্মিটিয়ান কিনা তা জানতে লাতুরের ২০০৭ সালে প্রকাশিত Facing Gaia বইটি আমাদের সহায়তা করবে।)। তবে কারণে-অকারণে ফুকোডিয়ানদের সাথে লাতুরের এই তাত্ত্বিক অমীমাংসা একেবারেই নতুন নয়। ফুকোডিয়ানদের সাথে লাতুরের এই দূরত্ব নিয়ে আরও জানতে গ্রাহাম হারমানের Reassembling The Political (২০১৪) বইটি বেশ কাজের।
৫। লাতুর এখানে বুঝাতে চাচ্ছে, হুটহাট সবকিছুর বিরুদ্ধে না বুঝে জেহাদ ঘোষণা বা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াটা কোনো কাজের কথা না। আগে চিন্তা করার সময় নেয়া দরকার। চিন্তা করা দরকার যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাইতেছি সেটা কি, কেমন, কেন আমাদের সামনে এসে হাজির হলো… ইত্যাদি।
৬। লাতুর বলছেন যে আমরা আগে থেকে জানতাম না এই রমজান মাস কিংবা লেন্টই যে আমাদেরকে আলোচনা করার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।