- ডেভিড কেইলি; ভাষান্তর: মোহাম্মদ শাহিন
ইভান ইলিচ অস্ট্রীয় দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও রোমান ক্যাথলিক যাজক। ইতালীয় প্রখ্যাত দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের কাজের সূত্র ধরে অনায়াসেই এই চিন্তকের সাথে পরিচিতি ঘটা সম্ভব। করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে আগামবেনের লেখাজোখায় ইলিচের প্রকট উপস্থিতি যেকারও নজরে পড়বে। ১৯৭১ সনে প্রকাশিত Deschooling Society গ্রন্থটি ইলিচ’কে প্রথম জনপরিসরে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। বিশ শতকের এই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকের কাজের ডক্যুমেন্টেশনের কাজটি করে চলেছেন টরেন্টোভিত্তিক কানাডীয় বুদ্ধিজীবী, লেখক ও রেডিও সম্প্রচারক ডেভিড কেইলি(David Cayley)। ইতিমধ্যে ইভান ইলিচকে নিয়ে তাঁর লেখা দুটি বই Ivan Illich in Conversation (১৯৯২) ও The Rivers North of the Future (২০০৫) প্রকাশিত হয়েছে। Penn State Press থেকে আগামী বছরে ইলিচের বায়োগ্রাফি বের করতে চলেছেন। পশ্চিমা ঔষধশাস্ত্রকে তীব্র ও বিস্তৃত মোকাবিলায় লেখা ইভান ইলিচের Medical Nemesis(১৯৭৫) ও তাঁর অপরাপর কাজের উপর ভিত্তি করে চলমান করোনা মহামারী প্রসঙ্গে ডেভিড কেইলি’র Questions about the current pandemic from the point of view of Ivan Illich লেখাটি গত ৩রা মার্চে প্রকাশিত হয়েছে। ডেভিড কেইলি’র এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ শাহিন। অনুবাদটি পূর্বে বোধিচিত্ত-এ প্রকাশিত হয়েছে। বোধিচিত্ত ও অনুবাদকের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
চলমান মহামারী নিয়ে গত সপ্তাহে আমি একখানা প্রবন্ধ রচনা শুরু করি। মহামারীটি যে মৌলিক-প্রশ্ন আমাদের সামনে নিয়ে আসে বলে আমি মনে করি, তা সেখানে আলোকপাত করার চেষ্টা করি: ভাইরাসটির ক্ষয়ক্ষতির বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে যে এতসব বৃহদাকার ও ব্যয়বহুল তাবলাতি করা হচ্ছে, শুধু সেটাই কি আমাদের হাতে আখেরি তরিকা? সবচেয়ে নাজুক লোকদের বাঁচাতে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেটা দূরদর্শিতার সংশয়াতীত ও অনিবার্য পরীক্ষা থেকে বেশি কিছু নয় কি? অথবা যেটা নিশ্চিতভাবে হাতের বাইরে সেটার উপর নিয়ন্ত্রণ সমুন্নত রাখা কি কোনো সর্বনাশা প্রচেষ্টা, এমন প্রচেষ্টা যেটা এই রোগের ফলে সাধিত ক্ষয়ক্ষতির সাথে অদূর ভবিষ্যতে যেসব নতুন ঝায়-ঝামেলা উত্থিত হবে সেগুলোর সংমিশ্রণ ঘটাবে? অনেকদিন যাবত আমি লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম যদ্দিন না আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, আমার চারপাশে যেসব ধ্যান-ধারণা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছিল আর আমার ধারণাগুলোর—যেগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলাম—মধ্যে বিস্তর তফাৎ বিদ্যমান। আমি যেসব বিষয়ে আলোকপাত করেছি সেগুলো মূলত ইভান ইলিচের কাজকর্ম নিয়ে দীর্ঘ বোঝাপড়ার ফসল। এটা আমাদের কী প্রস্তাবনা দেয়, আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার আগে, আমি প্রথমেই স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও কল্যাণ (well-being) নিয়ে ইভান ইলিচের ভাবনার ছক তুলে ধরব, যেসব বিষয়বস্তুর বিকাশ ইলিচ তাঁর জীবদ্দশায় করে গেছেন। সে অনুসারে, সামনের আলোচনায় যা আসবে, আমি জৈব-চিকিৎসা নিয়ে ইলিচের করা সমালোচনার বিকাশের সংক্ষিপ্ত ধারাপাত দিয়ে শুরু করব এবং সেইসাথে যেসব প্রশ্নের উপর আমি কেবল আলো ফেলেছি সেগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করব।
সমকালীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুসৃত প্রথাগত উন্নয়নের গতিধারা সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন ইলিচ তা নিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর Tools of Conviviality বইয়ের শুরুতে আলোচনা করেন, যেখানে তিনি চিকিৎসাকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গতিপথ ‘দুইটা সীমারেখা’র মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সেটার প্রথম পর্যায় অতিক্রম করেছে, যখন স্পষ্টভাবেই মেডিকেল চিকিৎসা [রোগ-বালাইয়ের বিপক্ষে] কার্যকর হয় এবং তার সুফল মোটাদাগে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে শুরু করে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক ইতিহাসবিদদের কাছে এটাই একমাত্র যৌক্তিক নির্দেশক, যাদের ধারণা এই পর্যায় থেকে অগ্রগতি অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকবে এবং সেখান থেকে হ্রাস পেয়ে উল্টো পথ ধরলেও, নীতিগতভাবে এমন কোনো পর্যায় আসবে না যেখানে এই অগ্রগতি থেমে যাবে। ইলিচের ক্ষেত্রে বিষয়টা সেরকম ছিল না। তিনি দ্বিতীয় সীমারেখার ধারণা অবতারণা করেন, যে-সীমারেখা তিনি মনে করতেন ইতোমধ্যে অতিক্রম করা হয়ে গেছে এবং এমনকি যখন তিনি লিখছেন সেই সময়ে মধ্যেই সেটা ঘটে গেছে। দ্বিতীয় এই সীমারেখার বাইরেও তিনি মনে করতেন, তিনি যেটাকে প্রতি-উৎপাদন (Counterproductivity) বলেন, সেটা শুরু হয়ে গেছে— চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভাবন তার নিজের উদ্দেশ্যকেই পিছনে ফেলে সুফলের থেকে বেশি কুফল বয়ে আনবে। তিনি দাবি করেন, যেকোন প্রতিষ্ঠান, দ্রব্য বা সেবার চরিত্র এটাই— এমন একটা পর্যায় চিহ্নিত করা যায় যেখানে সেটার উপযোগিতা যথেষ্ট এবং যেটার পর তারা বাড়াবাড়ি হয়ে দাঁড়াবে। Tools for Conviviality সেসব ‘স্বাভাবিক মাপকাঠিগুলো’ চিহ্নিত করার একটা প্রয়াস ছিল— প্রযুক্তির দর্শন তালাশে এরকম সর্বজনীন এবং প্রকল্পভিত্তিক একমাত্র কাজ, যেটা ইলিচ করে গেছেন।
দু’বছর পর Medical Nemesis গ্রন্থে, পরে সেটার সর্বশেষ ও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংস্করণে Limits to Medicine নামকরণ করা হয়, ইলিচ চিকিৎসাব্যবস্থা যেসব সুফল এবং কুফল বয়ে আনছে সেগুলোর বিস্তারিত ফিরিস্তি দেয়ার চেষ্টা চালান। তিনি সাধারণত গণস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড়-আকারে [জনসাধারণের কল্যাণে] উদ্ভাবনের পক্ষপাতি ছিলেন, যা আমাদের সুষম খাদ্য, নিরাপদ পানি, সুস্থ বাতাস এবং আবর্জনা নিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি দিয়েছে। বেশিরভাগ নাগরিকের আজীবন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এমন বিলাসী পণ্য তৈরির দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ঠেলে না দিয়ে, বরং সব নাগরিকের জন্য যাতে তা সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী হয় সেজন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ঔষধ প্রস্তুত-প্রণালীর নির্দেশনা সম্বলিত তালিকা (Pharmacopeia) প্রতিষ্ঠায় চীন ও চিলি কর্মযজ্ঞ চালায়। তিনি সেটার প্রশংসাও করেন। তথাপি গ্রন্থটির মূল লক্ষ্য ছিল প্রতি-উৎপাদনের প্রভাব চিহ্নিত করা এবং তা আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা, যা তখন প্রতীয়মান হওয়া শুরু করেছিল বলে তিনি বোধ করেছিলেন। কেননা চিকিৎসাবিজ্ঞান তার দ্বিতীয় সীমারেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। অতিরিক্ত ঔষধের ফলে বিপর্যয়কে তিনি চিকিৎসা-জনিত-ক্ষতি (iatrogenesis) হিসেবে উল্লেখ করেন এবং সেগুলোকে তিনটি শিরোনামে ভাগ করে আলোচনা করেন। যথা: চিকিৎসা কেন্দ্রিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। প্রথমটা এখন সবারই বুঝে আসে— আপনি যদি ভুল চিকিৎসা, ভুল ঔষধ এবং ভুল অপারেশন পান, আপনি হাসপাতালে অসুস্থ হবেন, এসব আরকি। এসব ক্ষয়ক্ষতি একেবারে মামুলি না। ২০১২ সালের এপ্রিলে রেচাল জিস(Rachel Giese) The Warlus নামক কানাডীয় একটি ম্যাগাজিনে “The Errors of Their Ways” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানের হিসেব মতে, প্রতিবছর কানাডার হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া বাসিন্দাদের ৭.৫ শতাংশ লোক ন্যুনতম হলেও একটি ‘ক্ষতিকর [শারীরিক] ঘটনা’র সম্মুখীন হন এবং চিকিৎসায় ভুলের কারণে ২৪,০০০ জন লোক মারা যান। এই বছরেরই কাছাকাছি সময়ে Harper’s Magazine -এ এসম্পর্কে লিখতে গিয়ে রাল্ফ নেডার জানান যে, নিরাময়যোগ্য চিকিৎসার ভুলের কারণে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে যে সংখ্যক লোক মারা যান সেটা চার লাখের আশেপাশে। যদি অতিরঞ্জিত করা হয়েও থাকে, তবুও সংখ্যাটা পিলে চমকে দেয়ার মত। নেডারের হিসাব The Warlus -এর থেকে মাথাপিছু হিসেবে দ্বিগুণ বেশি। কিন্তু এই দূর্ঘটনাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কোনোভাবেই ইলিচের আলোচ্য ছিল না। মূলত যে বিষয়টি তাঁকে নাড়া দিয়েছিল সেটা হচ্ছে- মাত্রাতিরিক্ত মেডিকেল চিকিৎসা [নির্ভরতা] যেভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মৌলিক প্রবণতাগুলোকে নাজুক করে দিচ্ছে। তিনি যেটাকে চিকিৎসা-জনিত সামাজিক ক্ষতি বলেন তার উদাহরণ হিসেবে, যে-পন্থায় চিকিৎসাব্যবস্থার কলা-কৌশল (art of medicine) প্রবাহিত হয় সেটা তুলে ধরা যেতে পারে। যেখানে চিকিৎসক নিরাময়ক, দ্রষ্টা এবং পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন, চিকিৎসার বিজ্ঞানের পথ সুগম করেন— যেখানে ডাক্তার নিশ্চিতভাবে যথাযথ অর্থেই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর রোগীকে একটি গবেষণার বস্তু হিসেবে দেখা বৈ স্বতন্ত্র কোনো বিষয় হিসেবে দেখেন না। পরিশেষে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের চুড়ান্ত আঘাত সামনে আসেঃ চিকিৎসা-জনিত সাংস্কৃতিক ক্ষতি। ইলিচ জানান, এটা ঘটে যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গড়ে ওঠা ও বয়ে আসা সাংস্কৃতিক সক্ষমতাগুলোর ভিত প্রথমে দূর্বল করে দেয়া হয় এবং এরপর একইসাথে যখন ধীরে ধীরে সে জায়গা [নতুন উপাদান দিয়ে] দখল করে নেয়া হয়। মোটের উপর, কারও নিজস্ব বাস্তবতার পীড়া সওয়া এবং বইবার সাগ্রহ ইচ্ছা এবং কারও নিজের মওত গ্রহণ করার ক্ষমতা সেসব [সাংস্কৃতিক] সক্ষমতার মধ্যে পড়ে। তিনি যুক্তি দেখান, পীড়া সওয়ার সংস্কৃতি (art of suffering)-কে ঢেকে রাখা হয়েছে এই ভাবনা থেকে যে, সবধরনের অসুখবিসুখ রাতারাতি নিরামিয় করা যায় এবং এমনটাই হওয়া উচিৎ। এটা এমন একটা মানসিকতা যা আদতে পীড়া দূর করে না বরং সেটাকে নিছক একটি দূর্ঘটনা বা প্রায়োগিক ভুল হিসেবে দেখিয়ে [খোদ পীড়াকে] অন্তসারশূন্য করে তোলে। সবশেষে মওতকে একটি একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনা, এমনকিছু যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘটে, থেকে অর্থহীন একটা পরাজয়ে রূপান্তরিত করেছে, যার মানে চিকিৎসার নিছক থেমে যাওয়া বা যেমনটা কেউ একজন নির্দয়ভাবে বলেছিলেন: “সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া”। ইলিচের যুক্তির পেছনে বুনিয়াদি খ্রিস্ট্রীয় ধ্যানধারণা আছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, পীড়া এবং মওত সহজাতভাবেই মানবিক অবস্থায় (the human condition) বিদ্যমান, সেগুলো তার ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার উপকরণের অংশ। একইসাথে তিনি দাবি করেন, এই মানব-অবস্থার (the human condition) হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের স্বকীয় সৃজনশীলতার এক সর্বনাশা হরণ ঘটাবে। তিনি বলেন, মানব সমাজের [পীড়া] কমানো এবং উৎকর্ষ সাধন মঙ্গলকর। তথাপি সেটা [মানব-অবস্থা] খুইয়ে ফেলা মানে মানে সর্বনাশ হওয়া। কেননা আমরা ঈশ্বর হয়ে ইশ্বরকে মালুম করতে পারব না, যে নিজের ভাগ্যের দেখনেওয়ালা নিজেই। বরং স্রেফ সৃষ্টি, ভেঙে বললে সৃষ্ট অথবা প্রদত্ত সত্ত্বা, হিসেবেই তাঁকে মালুম করতে পারি।
Medical Nemesis গ্রন্থখানা পেশাদারি ক্ষমতা সম্পর্কিত আলাপ নিয়ে রচিত— চলমান সময়ে যখন গণস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে অভূতপূর্ব ক্ষমতা চর্চার হিড়িক চলছে তখন এই দিকটা নিয়ে একটুক্ষণ ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ বৈকি। ইলিচের মতে, সর্বকালেই সমসাময়িক চিকিৎসাব্যবস্থা রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করে, যদিও এই চরিত্রটি ঢেকে রাখা হতে পারে এই বলে— যা-ই করা হচ্ছে তা সেবার জন্য। ওন্টারি প্রদেশে, যেখানে আমি থাকি, সাম্প্রতিককালে ‘গণস্বাস্থ্য’ খাত সরকারি বাজেটের ৪০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে রাখে, যা উল্লেখিত বিষয়টা যথেষ্টভাবে পরিষ্কার করার কথা। তথাপি প্রতিদিনকার [চর্চিত] এই ক্ষমতা— যা খোদ সেটার মতই গুরুতর— আরও বিস্তৃত হতে পারে,, যেটাকে ইলিচ ‘সংকটের আচারে-পরিণত-করণ’ (the ritualization of crisis) বলছেন। এই প্রবণতা চিকিৎসাব্যবস্থাকে ‘এমন এক অনুমতি’ প্রদান করে ‘যা সাধারণত সামরিক শক্তি কেবল আরোপ করতে পারে’। তিনি আরও বলেন,
“সংকটকালীন চাপের মুহূর্তে যেসব পেশাদারদেরকে কাণ্ডারী বলে ধরা হয় তাঁরা ন্যায় এবং শিষ্টাচারের সাধারণ নিয়ম-নীতির ফাঁক-ফোঁকর থেকে সহজেই রেহাই পেয়ে যায়। মওতের [সংখ্যা বৃদ্ধির] উপর নিয়ন্ত্রণে যাকে নিয়োগ করা হয় তাঁকে আম মানুষ হিসেবে ধরা হয়। কেননা তাঁরা রঙচঙে মোড়া এমন এক সীমারেখা টেনে দেয় যা এই দুনিয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। সেই সময়-ব্যাপ্তি ও সমাজ-আয়তন জুড়ে চিকিৎসা সম্পর্কিত যেসকল উদ্যোগ দখল করে আছে, সেগুলো তাঁদের ধর্মীয় ও সামরিক প্রতিরূপের মতোই পরম-পবিত্র।”
এই অনুচ্ছেদেরই পাদটীকায় ইলিচ যোগ করেন, “যে [চিকিৎসক] নির্দ্বিধায় কোন সংকটকালে ক্ষমতা খাটাতে পারে, সে মানবিক বিবর্তনকে ছুড়ে ফেলতে এবং ধ্বংস করে দিতে পারে। [সাধারণ] ব্যক্তির সংকটগুলো [অসুখ-বিসুখ] মূল্যায়ন ও চিকিৎসা করতে চিকিৎসকের একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর গোঁ ধরার মনোভাব প্রতীকীভাবে তাঁকে হোয়াইট হাউজের কুটুমগোছের লোকে পরিণত করে।“ Political Theology নামক গ্রন্থে জার্মান আইনজ্ঞ কার্ল স্মিটের প্রস্তাবনার সাথে এখানে এক আকর্ষিক সাদৃশ্য চোখে পড়ে। যেখানে তিনি বলেন, ‘ব্যতিক্রমী মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার’ ক্ষমতা-ই প্রকৃত সার্বভৌমত্বের পরিচায়ক। স্মিটের কথা হচ্ছে যে, সার্বভৌমত্বের বাস আইনের উপরে। কেননা যেকোন সংকটকালীন মুহূর্তে সার্বভৌমত্ব, [অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে] ব্যতিক্রম জারি করে, আইনের ছুটি করে দিতে পারে এবং সেই জায়গায় বসে আইনের সূতিকাগার হিসেবে শাসন চালিয়ে যেতে পারে। ইলিচ যেটা বলেন, ‘কোন সংকটকালে (চিকিৎসকের)… [ক্ষমতা] খাটানো’র ব্যাপারটা, সত্যিকারভাবেই সেটা ক্ষমতার রূপ। ব্যতিক্রমী পরিপ্রেক্ষিত ‘গতানুগতিক নিয়মকানুন’ থেকে তাঁকে ‘অনাক্রম্য’ (immune) করে তোলে এবং সেই বাস্তবতার মাস্তুল ধরে নতুন নিয়মাকানুন পয়দার ক্ষমতা দিয়ে দেয়৷ কিন্তু স্মিট ও ইলিচের মধ্যে একটা কৌতূহলোদ্দীপক ও জোরালো তফাৎ আমার চোখে পড়ে। যেটাকে স্মিট ‘রাজনৈতিক(political)’ বলছেন সেখানের আশেপাশেই তিনি অনড় রয়ে গেছেন। ইলিচ লক্ষ্য করেন, স্মিট যেটাকে সার্বভৌমত্ব বলেন সেটার বেশিরভাগই অনুপস্থিত বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে সেটাকে উৎখাত করা হয়েছে এবং নানান কিসিমের পেশাদারি হেজিমনি বা নেতৃত্বগুলোতে সেটার পুনঃস্থাপন ঘটেছে।
Medical Nemesis প্রকাশিত হওয়ার একদশক পর ইলিচ তাঁর প্রস্তাবনাগুলো আবার বিবেচনায় নেন এবং সংশোধন আনেন। পূর্বে যা লিখেছেন তা কোনভাবেই তিনি খারিজ করেননি। উপরন্তু তিনি সেগুলোর সাথে নাটকীয়ভাবে আরও [বক্তব্য] যোগ করেন। এবার তাঁর বইটিতে বলছেন, ‘চিকিৎসাজনিত ক্ষতির— যা খোদ শরীরের চিকিৎসাজনিত ক্ষতি— অনেক বেশি প্রতীকী প্রভাবের প্রতি গভীরভাবে অন্ধ’ ছিলেন। তিনি ‘সেই মাত্রা উপেক্ষা করে’ গেছেন, “যে মাত্রায়, [বিশ] শতকের মধ্যবর্তী সময়ে, ‘আমাদের শরীর এবং আমাদের স্বীয় স্বত্তা’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ব ও সেবার ফল হিসেবে দাঁড়িয়েছে।“ অন্যভাবে বললে, Medical Nemisis-এ তিনি এমন লিখেন, যেন কোন স্বাভাবিক শরীরের অস্তিত্ব ছিল, যা প্রযুক্তির তরঙ্গের বাইরে বিদ্যমান, যেটা দ্বারা তার [শরীরের] আত্মসচেতনতা অবিনির্মিত। কিন্তু এখন তিনি সেরকম অস্তিত্বের দেখা পান না। তিনি আরও লেখেন, ‘প্রতিটা ঐতিহাসিক কালকে-ই একটি নির্দিষ্ট-যুগের কায়ায় বিমূর্তরূপ দেয়া হয়’। চিকিৎসাবিজ্ঞান কেবল পূর্ব-বিদ্যমান প্রেক্ষিতেই প্রভাব রাখে না, বরঞ্চ সেই জমি তৈয়ার করতেও নিজে লাঙল ধরে।
এই উন্মোচন ইলিচের দিক থেকে তাঁর নতুন অবস্থানের শুরু মাত্র। Medical Nemesis এমন এক নাগরিক-সম্প্রদায়ের কথা তুলে আনে, যাদের সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, তাঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের হস্তক্ষেপ বিস্তার সীমিত রাখতে সক্ষম থাকবে। এবার তিনি সেইসব মানুষদের আলাপ পাড়েন যাদের স্বীয়-স্বত্তা জৈব-চিকিৎসার দ্বারাই চালিত। Medical Nemesis তার শুরুর বাক্যেই দাবি করে যে, ‘চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিকতা [স্বয়ং] স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি এবার পর্যবেক্ষণ করেন যে, খোদ স্বাস্থ্যের পেছনে ছুটা[র প্রবণতা]-ই স্বাস্থ্যের জন্য প্রধান হুমকি। এরইমধ্যে যুগ-পরিবর্তনের মত ঘটনা ঘটে গেছে, এরকম চিন্তাই তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পেছনের কারণ। ১৯৮৮ সালে তিনি আমাকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, [মানুষের] মনস্তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে একটা পরিবর্তন চলে আসছে যেখানটায় অনেক মানুষ জীবন-যাপন করে। আমরা যেভাবে চৈতন্যের উপলব্ধির মধ্যে বাস করি, সেটা আমার লেখালেখির উপজীব্য হয়ে আসছে, এবং এক্ষেত্রে আমার অভিমত হচ্ছে, এই মুহূর্তে একটা সীমারেখা (watershed) অতিক্রম করছি। আমি আশা করিনি আমার জীবনকালে এই পর্যায় অবলোকন করব।’ ইলিচ ‘বিষয়গুলো দেখার নতুন পথটি’কে, তিনি যেটাকে বলেছেন ‘সিস্টেমের আমল’ বা ‘সিস্টেমের তত্ত্ববিদ্যা’ তার আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যে আমলটাকে তিনি শেষ হিসেবে দেখেছেন সেখানে আধিপত্য যান্ত্রিকতার ধারণার — যে ধারণা হচ্ছে, স্বাস্থ্যের মত কোন উপকারী কিছু বা নিরাময়ের জন্য ঔষধপত্রের মত যান্ত্রিক উপায়ের ব্যবহার। এই আমলের চরিত্রে বিষয় ও উদ্দেশ্যের, উপায় ও নিরাময়ের এবং যন্ত্র ও ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপিত। সিস্টেমের আমলে, তিনি জানান, এই পার্থক্যগুলো ধ্বসে পড়েছে। একটা সিস্টেম হচ্ছে, যেটাকে সাইবারনেটিক্যালি কল্পনা করা হয়, পুরো পরিবেষ্টিত— এটার কোন বাহির নেই। কোন হাতিয়ার ব্যবহারকারী হাতিয়ারখানা হাতে নেন যাতে কিছু নিরাময় ঘটাতে পারেন। যেহেতু চালানেওয়ালার সাথে সিস্টেম তার অবস্থা মানিয়ে নেয়, তাই সিস্টেম চালানেওয়ালা সিস্টেমের গর্ভে অবস্থান করে প্রতিনিয়ত সিস্টেমের সাথে নিজের অস্তিত্বের সমঝোতায় যাচ্ছেন। ব্যক্তিগত মঙ্গলের পেছনে ছুটন্ত [সিস্টেম দ্বারা] নিয়ন্ত্রিত কোনো ব্যক্তি অনাক্রমনীয় সিস্টেমের পথকে সুগম করেন, যা প্রতিনিয়তই পারিপার্শ্বিক [বিদ্যমান] সিস্টেমের সাথে তার বহুরন্ধ্রীয় চৌহদ্দির শক্তির বারবার পরিমাপ করে।
এই নতুন “সিস্টেম বিশ্লেষণ সংক্রান্ত ডিসকোর্স”-এর মধ্যে, যেরকমটা ইলিচ নামকরণ করেন, মানুষের বৈশিষ্ট্যগত অবস্থা হচ্ছে বিমূর্তায়ন। এটা অবশ্যই একটা প্যারাডক্স, কেননা ইলিচ যেটাকে বলেছেন, “স্বাস্থ্যের রোগজনিত অনুবৃত্তি” সেটা যে কারও শারীরিক অবস্থার সাথে তাঁকে এক গভীর, অনবরত এবং কার্যত আত্মরতিমূলক তন্ময়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইলিচ কেন এটাকে বিমূর্তায়ন হিসেবে ধারণা করেছেন সেটা সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে “ঝুঁকি সচেতনতা”-এর উদাহরণ আনা যেতে পারে, যেটাকে তিনি “আজকের দিনে ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “ঝুঁকি বিমূর্তায়িত হচ্ছে কেননা এটা যথার্থভাবে একটি গাণিতিক ধারণা”। এটা ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক রাখে না, বরং সম্পর্ক রাখে সমষ্টির সাথে — অমুক বা তমুক ব্যক্তির সাথে কী ঘটবে তা কেউ জানে, কিন্তু এরকম ব্যক্তির সমষ্টির সাথে কী ঘটবে তা সম্ভাবনারূপে বলে দেয়া যায়। ইলিচ জানান, এই কিসিমের পরিসংখ্যানিক ভূয়া জরিপ দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করা মানে নিজেকে “নিবিড় গাণিতিক সমীকরণে (self-algorithmization)”-এ জড়ানো।
এই “ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত মতবাদ”-এর সাথে তাঁর সবচেয়ে পীড়াদায়ক দ্বন্দ্ব ঘটে গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষার বেলায়। তিনি এটার সাথে পরিচিত হন তাঁর বান্ধবী ও সহকর্মী সিলিয়া সেমারেস্কি-এর মাধ্যমে। সিলিয়া জার্মানিতে হওয়া জেনেটিক পরীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে জেনেটিক পরামর্শ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন, যেটা কিনা গর্ভবতী নারীর জন্য বাধ্যতামূলক— এমন একটা বিষয় পরবর্তীতে যেটা সম্পর্কে The Decision Trap (Imprint-Academic, 2015) নামক একখানা গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। যে বাচ্চাটাকে আশা করা হচ্ছে গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষা সে বাচ্চাটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই প্রকাশ করতে পারে না । যা-ই সেটা সনাক্ত করে না কেন সেগুলো [ইশারাসূচক] সূত্রাবলীমাত্র (markers), যেগুলোর অস্পষ্ট অর্থ কেবল সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে বলা যায়— একটা সম্ভাবনা যেটা, যাকে পরীক্ষা করা হয়, তাঁর বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, নৃতাত্ত্বিকতা ইত্যাদি তালাশের মাধ্যমে সে যে সমাজের অংশভুক্ত তা যোগ-বিয়োগ কষে আবিষ্কার করা। উদাহরণস্বরূপ, যখন তাঁকে [গর্ভবতীকে] বলা হয় যে, ৩০ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে, তাঁর বাচ্চার অমুক কিসিমের বা তমুক কিসিমের উপসর্গ থাকবে, তখন তাঁকে তাঁর নিজের সম্পর্কে বা তাঁর গর্ভের ফসল সম্পর্কে কিছুই জানানো হয় না। তাঁর মত অন্য একজনা [বাচ্চাটি]-এর সাথে কী ঘটতে পারে কেবল তা-ই জানানো হয়। তাঁর প্রত্যাশা, বাসনা এবং প্রতিষ্ঠান [চিকিৎসাবিজ্ঞান] তাঁর কাছে যা মেলে ধরে, তা থেকে বেশি কিছু তিনি তাঁর বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে জানেন না, অন্যদিকে তাঁর পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে ঝুঁকির যে চিত্র নিরূপিত করা হয়েছে তা একটা সিদ্ধান্ত দাবি করে। নির্বাচনটা অস্তিত্ব-সম্পর্কিত; তথ্যগুলো যেটার উপর ভিত্তি করে তুলে আনা সেটা ঐ সম্ভাবনা রেখা— নির্বাচনকারী যে চৌহদ্দির মধ্যে পরিবেষ্টিত। ইলিচ এটাকে সম্পূর্ণ ভয়াবহ একটা অবস্থা হিসেবে দেখছেন। এমনটা না যে তিনি বুঝেন না, মানুষের সব [উদ্ভাবনী] কাজকর্ম অন্ধকারে ঢিল মারার মত— অদেখা-অজানার সম্পর্কে বিবেচনাসূচক হিসেবনিকেশ। তাঁর ভয়ের জায়গাটা সেখানে যখন তিনি দেখেন মানুষজন পরিসংখ্যানগত তথ্যের নির্মিত আয়নায় দেখে নিজেদের [স্বীয় স্বত্তাকে] পুনঃকল্পনা করে নেয়। তাঁর কাছে, এই প্রবণতা সমষ্টির দ্বারা ব্যক্তির বিলীন হওয়া; অকল্পনীয় কিছুকে প্রকাশ করা থেকে ভবিষ্যতেকে বাঁধা দেয়ার একটা অপচেষ্টা; এবং ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার জায়গায় বৈজ্ঞানিক আদর্শের এক প্রতিস্থাপন। সেইসাথে এটা শুধুমাত্র, ইলিচ বুঝতে পেরেছিলেন, গর্ভাবস্থায় জেনেটিক পরীক্ষার সাথে সম্পর্কিত ছিল না, উপরন্তু কম-বেশি পুরো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জুড়েই বিদ্যমান ছিল। মানুষজন ক্রমবর্ধমানহারে তাঁদের ঝুঁকি মোতাবেক প্রত্যাশা ও সম্ভাব্যতা-নির্ভর আচরণ করে যাচ্ছিলেন। তাঁরা, যেরকমটা একবার কানাডীয় স্বাস্থ্য গবেষক অ্যালান ক্যাসেল মজার ছলে বলেছিলেন, “প্রাক-অসুস্থ” (pre-diseased) হয়ে যাচ্ছিলেন— তাঁদেরই মত যে কোন কেউ আক্রান্ত হতে পারে ভেবে অসুখের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক ও সক্রিয় থাকা। স্বতন্ত্র রোগীদের স্বতন্ত্র পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা না করে বরং ক্রমবর্ধমানভাবে [সাধারণীকরণের মাধ্যমে] সাধারণ রোগী হিসেবে, [চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায়] কোনো বিভাগ বা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছিল। একইসাথে চিকিৎসকরা ঘনিষ্ঠ পরামর্শক,যিনি [রোগীদের] সুনির্দিষ্ট পার্থক্য ও ব্যক্তিগত পরিভাষা সম্পর্কে সজাগ থাকবে, তা না হয়ে বরঞ্চ ক্রমবর্ধমানহারে এই সম্ভাব্যতার রাজ্যে যন্ত্র-দাস (servo-mechanism) হয়ে ছিলেন। “গাণিতিক সমীকরণে স্বীয়কে” জড়ানো (self-algorithmization) বা বিমূর্তায়ন বলতে ইলিচ এই প্রবণতার কথাই বুঝিয়েছেন।
চিকিৎসাজনিত ক্ষতিগ্রস্ত শরীর (iatrogenic body) সম্পর্কে বুঝাতে— যেটাকে ইলিচ সমকালীন জৈব-চিকিৎসার প্রাথমিক প্রভাব হিসেবে দেখেছেন— তাঁর সময়কালে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে বিস্তরভাবে পঠিত ও আলোচিত একটি প্রবন্ধের দিকে নজর ফিরাতে হবে। যেটার শিরোনাম ছিল “The Biopolitics of Postmodern Bodies: Constitution of Self in Immune System Discourse”, এটার লেখক ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ডোনা হারাওয়ে এবং ১৯৯১ সালে প্রকাশিত Simians, Cyborg and Women: The Reinvention of Nature নামক গ্রন্থে প্রবন্ধখানা গ্রন্থিত হয়৷ প্রবন্ধখানা ইলিচের— জৈব-চিকিৎসার ডিসকোর্সের [পরিমণ্ডল] কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে— এই ধারণাকেই কেবল প্রভাবিত করেছে বলে আমার কাছে কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হয় না। এরইসাথে, আমি দাবি করতে পারি, ঠিক প্রায় একই বিষয়াদি লক্ষ্য করেও, যেমনটা ইলিচ করেছেন, হারাওয়ে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন তা কড়ায়-গণ্ডায় নাটকীয়ভাবে বিপরীত। উদাহরণস্বরূপ, প্রবন্ধটিতে, তিনি [হারাওয়ে] যেটাকে ” উত্তরাধুনিক শরীর” বলেন সেটার উল্লেখ করে বলেন যে, “[সমাজের] অন্যান্য উপাদান বা উপ-সিস্টেমের মত মানুষকেও অবশ্যই একটা সিস্টেমের স্থাপত্যে স্থাপন করতে হবে, যেটার প্রাথমিক কার্য-সম্পাদনের উপায়সমূহ সম্ভাব্যতা-নির্ভর, পরিসংখ্যানগত”। তিনি আরও বলেন, “এক অর্থে, জৈবিক উপাদানগুলোর (biotic components) পথ সুগম করে দিয়ে জীবকুল জ্ঞানের উপকরণ হিসেবে অস্তিত্ব বজায় রেখে চলছে।” এটা এমন এক অবস্থার দিকে নিয়ে যায় যেখানে “কোনো বস্তু, প্রজাতি বা শরীর নিজেদের মধ্যে অখণ্ড না; উপাদানগুলোকে অন্যান্য উপাদানের সাথে যৌগ ঘটানো যায় যদি সঠিক মাত্রা, সঠিক কোড সিগনাল প্রক্রিয়ার জন্য একটি সাধারণ ধর্মে (common language) নির্মাণ করা যায়। যৌগের এই জামানায়, যেখানে সীমা [জীবদের] প্রকৃত পার্থক্য বের করা থেকে বরং [জীবন] “প্রবাহের মাত্রা” (rates of flow) পরিচালন করে, সেখানে “প্রাকৃতিক জীবের অখণ্ডতা (integrity)” বিবেচ্য কোনো বস্তু না। তিনি লিখেন, “পশ্চিমা সত্তার(self) ‘অখণ্ডতা’ বা ‘আন্তরিকতা’ কার্যপ্রণালী [সর্বস্ব], বিশেষজ্ঞ সিস্টেম এবং সম্পদ বিনিয়োগ কৌশলের দিকে ঠেলে দেয়।”
অন্যভাবে বললে, ইলিচের মত, হারাওয়ে উপলব্ধি করেন যে, ব্যক্তি স্বতন্ত্র, স্থিতিশীল ও পবিত্র সত্ত্বা হিসেবে তাঁর আপাতত স্ব-পরিচালিত উপ-সিস্টেমের সাথে সে যে-বিশাল সিস্টেমের সাগরে ডুবে আছে, সেটার প্রতিনিয়িত সমঝোতা করে চলছে এবং ব্যক্তি সেখানেই ম্লান হয়ে গিয়েছে। তাঁর ভাষায়, “আমরা সবাই যন্ত্র ও জীবের সংকরায়নে গঠিত কল্পিত, তত্বীয় এবং রঞ্জিত দোঁআশলা জীব… আমাদের তত্ববিদ্যা হচ্ছে সাইবর্গ।” তাদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই তাদের পার্থক্য বিদ্যমান। যে সংকলন থেকে আমার উদ্ধৃত প্রবন্ধের কথা বলে আসছি, সেই সংকলনের অন্য জায়াগায় যেটাকে তিনি “সাইবর্গ ইশতেহার” বলছেন তার উল্লেখ করেন। তিনি পাঠকদের এই নতুন প্রেক্ষিতকে চিহ্নিত করতে এবং মেনে নিতে আহ্বান জানান, কিন্তু তা যেন হয় মুক্তির তাগিদে “সেটা উপলব্ধি করা”। পুরুষতান্ত্রিক একটি সমাজে এমন কোনো গ্রহণযোগ্য শর্ত বজায় থাকে না যেটায় কেউ ফিরে আসার আশা রাখে। তাই তিনি “সীমা-পরিসীমার বিভ্রান্তির ক্ষেত্রে তৃপ্তির (pleasure) এবং সেগুলোর নির্মাণের ক্ষেত্রে দায়-দায়িত্বের (responsibility) আলাপ” তুলেন। অন্যদিকে, হারাওয়ে যেটাকে “সাইবর্গ তত্ত্ববিদ্যা” বলেন, সেটা ইলিচের কাছে কোনো উপায় বলে মনে হয়নি। তাঁর ক্ষেত্রে, এক ঐশ্বরিক মূল ও এক ঐশ্বরিক নিয়তি সহযোগে পরমাত্মাযুক্ত (ensouled) জীব হিসেবে মানব ব্যক্তির প্রকৃত চরিত্র তাঁর আগ্রহের জায়গা ছিল। যেহেতু তাঁর সমকালে শারীরিক আত্ম-উপলব্ধি থেকে বোধ (sense)-এর শেষ চিহ্নটুকু উবে গিয়েছিল, তিনি এমন এক দুনিয়ার আঁচ করতে পেরেছিলেন যেটা “নিজের পরিত্রাণ থেকে দূরে” সরে এসেছে। একবার আমাকে তিনি সকরুণভাবে বললেন, “আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, গ্যালিলি’র নাযারেথ শহরে সেই মেয়েটিকে [মাতা মেরি] যখন ফেরেস্তা গেব্রিয়েল [বা জিবরাঈল] বললেন যে, ঈশ্বর তাঁর গর্ভে [সন্তান হিসেবে] আগমন করতে চান, তখন তিনি [গ্যাব্রিয়েল] এমন এক শরীরের দিকে ইশারা করেন যেটা আমি [ইলিচ] যে পৃথিবীতে থাকি সেই পৃথিবী ত্যাগ করেছে।”
ইলিচের মতে, জৈব-চিকিৎসার পরিমণ্ডলে “বিষয়াদিকে নতুনভাবে দেখা”-র যে প্রবণতা উঠে এসেছে তা ” ধার্মিকতার নতুন পর্যায়”-এর উন্মোচন করেছে। ধার্মিকতা (religiosity) শব্দটি তিনি আরও ব্যাপক অর্থে দেখেন, যা প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে গভীরতর এবং আরও পরিব্যাপ্ত কিছু। আমাদের চিন্তাচেতনার দালান যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে তার ভিত্তিভূমি হচ্ছে ধর্ম; বিষয়াদি আমাদের কাছে যেরকমটা দেখায় সেরকমটা কেন এবং কীরকম তার একটা অনুভূতি; সেই প্রাথমিক ছাচ যেটার মাধ্যমে অর্থ (meaning, মানে) তার আকার ধারণ করে। ইলিচের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সৃষ্ট-হওয়া বা প্রদত্ত-হওয়ার ধারণা তাঁর সমস্ত চেতনের ভিত্তি ছিল। তিনি যে অবস্থার আগমন আঁচ করেছিলেন সেটা ছিল সামগ্রিক সর্বেশ্বরবাদ, যেখানে দুনিয়াটা খোদ তার-ই ফসল এবং এর বাইরে অর্থ (meaning) বা বিধির কোনো উৎস নেই— যেমনটা তিনি বলেছেন, “মানুষের হাতের মুঠোর এক মহাবিশ্ব।” এরকম দুনিয়া সবচেয়ে উঁচু-দরজার মঙ্গল হচ্ছে জীবন এবং মানুষের মৌলিক কর্তব্য হচ্ছে জীবন টিকিয়ে রাখা এবং তা যত্ন করা। কিন্তু বাইবেলে যে জীবনের কথা বলা হয়েছে এটা সে জীবন না— যে জীবন ঈশ্বর প্রদত্ত— বরঞ্চ এটা একটা সম্পদ যা মানুষ ধারণ করে এবং মানুষ তা দায়িত্বের সাথে তা পরিচালন করা উচিৎ বলে মনে করে। সেটার অদ্ভুত সম্পদ হচ্ছে সেটা একইসাথে নিষ্ঠা এবং হস্তক্ষেপ (manipulation)-এর বস্তু। শিকড় ছেঁড়া এই স্বাভাবিক-কৃত জীবনই নতুন ঈশ্বর। স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা তার সহোদরদ্বয়। মওত তার দুশমন। মওত চূড়ান্ত পরাজয় আরোপ করলেও তার ব্যক্তিগত কোন সার-সত্তা (meaning) নেই৷ এই অবস্থায় মওতের কোন উপযুক্ত ওয়াক্ত বলতে কিছু নেই— যখন চিকিৎসা হার মানে বা বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন মওত চলে আসে।
“সিস্টেমগুলোকে সত্ত্বায় অধিগ্রহণ” করাকে ইলিচ প্রত্যাখ্যান করেন। মানবিক নীতি বা প্রাকৃতিক নীতি কোনটাই তিনি ত্যাগ করেননি৷ তাঁর বন্ধু ডগলাস লামিজ-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি কেবল সেই নিশ্চয়তাটুকু (certainty) ছাড়তে পারি না যখন, যেসব নিয়ম মেনে আমাদের বেঁচে থাকা উচিৎ সেগুলোর সাথে আমরা-যা সে বোধের (insight) সম্মিলন ঘটে। এই ভাবনা তাঁকে “স্বাস্থ্য [সুরক্ষার] দায়-দায়িত্ব” প্রত্যাখ্যান করার দিকে নিয়ে যায়, যেটাকে আন্তঃমিশ্রিত সিস্টেমগুলোর ব্যবস্থাপনা (management of intermeshed system) হিসেবে ধারণা করা হয়। তিনি প্রশ্ন তুলেন, যেটার না আছে কোন মানে, সীমা, না আছে ভিত্তি সেটার জন্য একজন কেন দায়ী হতে যাবে? এই কিসিমের নিরাপদ ভ্রম ত্যাগ করা এবং এর বদলে স্ব-সীমাবদ্ধ মানসিকতায় জীবন-যাপন করাটা উত্তম, তিনি যেটাকে “সমাজের ভেতরেই সম্পন্ন হওয়া সাহসিক, নীতিনিষ্ঠ এবং আত্ম-সমালোচনামূলক ত্যাগ” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।
সার-সংক্ষেপে বলা যায়, ইলিচ তাঁর জীবনের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত টানেন যে মানবিকতা, অন্তত তাঁর দৃষ্টিতে, নিজ মর্মার্থ থেকে উবে গিয়েছিল এবং সেটাকে এমন এক সিস্টেম প্রণালীর মধ্যে আবদ্ধ করে, বেড়ি পড়িয়ে এবং আঁটোসাটো করে রাখা হয়েছিল যার পুরোটাই নৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তি বিবর্জিত। মানুষ যে শরীরগুলোয় জীবন-যাপন ও চারদিকে হাঁটাচলা করছিল সেগুলো সি. টি-স্ক্যান ও ঝুঁকি সূচকের ভিত্তিতে বোনা কৃত্রিম নির্মাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। “সিস্টেমের তত্ত্ববিদ্যা”-র উপর আধিপত্য রাখায় ব্যস্ত জীবন একটা আধা-আপাত-ধর্মীয় আদর্শ হয়ে গিয়েছিল। মওত এক বুদ্ধিগম্য সহচর হওয়ার বদলে হয়ে গিয়েছিল এক সার-শূন্য অশিষ্টতা। এসব কিছু স্ফুরিত হয়েছিল জোরপূর্বক এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে। “অন্যদিকে… ” তিনি সেটার তীব্রতা কমানোর চেষ্টা করেননি বা কোন সুবিধাবাদী ব্যাখা দাঁড় করাননি। তাঁর চারপাশে যা ঘটছিল সেগুলোকে তিনি যেভাবে অনুধাবন করেছেন তিনি তা দেখিয়েছেন। যতটা সংবেদনশীল থাকা যায় ততোটা থেকে লিখার এবং যতটা সত্যনিষ্ঠ থাকা যায় ততোটা থেকে সেগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা তাঁর সবটা মনোযোগ জুড়ে ছিল। তাঁর দৃষ্টিতে, পৃথিবীটা তাঁর হাতে ছিল না, বরং ছিল ঈশ্বরের হাতে।
২০০২ সালে তাঁর জীবনাবসানকালে ইলিচ “বিষয়াদি দেখার (নতুন) দুয়ার” থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছিলেন, যেটা নিজেকে, তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধ চলাকালে, প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল বলে তিনি মনে করতেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, “সিস্টেমের (এই নতুন) জামানায়” সৃষ্টির মৌলিক একক (primary unit), মানব ব্যক্তি, তার চৌহদ্দি, স্বতন্ত্রতা এবং মর্যাদা খোয়ানো আরম্ভ করেছে। তিনি ভেবেছিলেন যে, সেই আপ্তবাক্য যেটাতে তাঁর শিকড় জড়ানো তা কলুষিত হয়ে গেছে– নিউ টেস্টামেন্টে যে কথাটার ওয়াদা করা হয়েছে “জীবনটা আরও প্রাচুর্যময়”। সেটা মানবসৃষ্ট হেজিমনিতে এমন সর্বাত্মকভাবে এবং এমন আবদ্ধ-অবস্থায় রূপ পরিবর্তিত হয়েছে যে, সেই সিস্টেমের বাইরে থেকে কোন হস্তক্ষেপ তা ঘাটাতে পারবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, চিকিৎসাবিজ্ঞান সেই [উপরে উল্লেখিত] সীমারেখা থেকে এত দূর অতিক্রম করেছিল যে, যেখানে সেটা মানব-অবস্থা (the human condition) সহজ ও পূর্ণ করে দিতে পারতো, তখন সেটা একইসাথে সেই [মানব] অবস্থার বিলোপের হুমকি দিচ্ছিল। এরইসাথে তিনি উপসংহার টানেন যে, মানবজাতির বেশিরভাগই সে-অবস্থার “অনিয়ন্ত্রিত, ছেঁড়াফোঁড়া এবং বিচ্ছিরি চেহারার মাংস” সহ্য করতে আগ্রহী না এবং এর বদলে মানবজাতি জীবনের কিছু বছর কিনে নেয়ার আশায় এবং “কৃত্রিম সৃজনে” জীবনের আরাম-আয়েশ খুঁজে নিতে তার পীড়া সওয়ার এবং মওত গ্রহণের সংস্কৃতির সওদা করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কি চলমান “সংকট” সম্পর্কে কোন ধারণা নেয়া যেতে পারে? আমি বলব হ্যাঁ, কিন্তু তা কেবল ততটুকু যতটুকু আমরা সময়ের জরুরত থেকে পিছনে নজর দিতে এবং আমাদের মূলগত চরিত্র সম্পর্কে যা উদঘাটিত হয়েছে—আমাদের “নিশ্চয়তাগুলো”, যেরকমটা ইলিচ বলেছিলেন— সেগুলো বিবেচনা করতে সময় নিতে পারি।
প্রথমত, ইলিচের দৃষ্টিকোণ এই ইশারা দেয় যে, বর্তমানে আমরা কিছু সময়ের জন্য হলেও সেরকম মনোভাব পোষণ করে আসছি যেগুলো চলমান মহামারীর বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার চরিত্রায়ন করেছে৷ যেকোন ঘটনার বিপরীতে এটা [প্রতিক্রিয়া] একটা কার্যকরী বিষয় যেটা ইতিহাস বদলে দিতে পারে বা “সবকিছু বদলে দিতে পারে” বলে ধারণা করা হয়। কেননা, কেউ মাঝেমধ্যেই শুনে থাকবেন যে, মানুষ প্রায়-ই কোনো না কোনোভাবে সেগুলোর জন্য তৈরি আছেন বলে মনে হয় অথবা এমনকি অসচেতন বা অবচেতন মনে সেগুলোকে আশা করছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিককার কথা স্মরণ করে অর্থনৈতিক-ইতিহাসবিদ কার্ল পোলানী(Karl Polanyi) যেভাবে ইউরোপের দেশগুলো তাদের নিয়তির দিকে নিমজ্জিত হয়েছিল সেই দিকটার চরিত্রায়ন করতে গিয়ে ঘুমের মধ্যে হাঁটার উপমা ব্যবহার করেন— যন্ত্রমানবরা (automatons) অন্ধভাবে সেই নিয়তির দিকে হাঁটছে যা তাঁরা না জেনেও কল্পনা করেছিল। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের ঘটনা— আমরা যেটাকে ৯/১১ হিসেবে জানি— মনে হলো তাৎক্ষণিকভাবে তর্জমা করা এবং সেইসাথে অনুধাবনও করা হয়ে গেলো, যেন প্রত্যেকেই যা ঘটেছে সেটার জাত-অর্থ (patent meaning) ঘোষণার জন্য কেবল অপেক্ষা করছিলেন– কাঠিন্যের যুগ (the Age of Irony)-এর অবসান, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা, যা-ই হোক সেটা। তন্মধ্যে কিছু নিশ্চিতভাবে দৃষ্টিকোণের একটা চাতুরী— যেটার মাধ্যমে ঘটনার পরবর্তী ভাবনা তড়িৎভাবে আকস্মিকতা থেকে জরুরতে রূপান্তরিত হয়ে যায়— অতএব যা কিছুই ঘটুক, আমরা ধরে নিই এটা ঘটারই ছিল সব বরাবর৷ কিন্তু এটা গল্পের পুরো চিত্র হবে বলে আমার মনে হয় না।
করোনাভাইরাসের [বিপরীতে] প্রতিক্রিয়ার গোড়ার দাবি এই যে, যা এখন পর্যন্ত ঘটেনি তা রুখতে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাশিতভাবে [চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাতলে দেয়া] আচরণ করতে: সংক্রমণের জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সরঞ্জামের অভাবনীয় ঘাটতি, যা হাসপাতাল কর্মীদের সেই অমানবিক-কঠিন সিদ্ধান্তে নিয়ে যাবে যখন নির্দিষ্ট মাপকাঠির ভিত্তিতে চিকিৎসা (triage) দিতে হবে ইত্যাদি। অন্যথায়, বলা হয়েছে, যখন আবিষ্কার করব আমরা কিসের সাথে লড়ছি, তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। (প্রসঙ্গত, এদিকে ইঙ্গিত করা বাঞ্চনীয় যে, এটা অ-যাচাইযোগ্য ধারণা: আমরা যদি সফল হই এবং আমরা যেটার ভয় করছি সেটা না ঘটে, তখন আমরা বলতে পারব যে আমাদের প্রতিরোধ তা রুখেছে, কিন্তু প্রকৃতভাবে আমরা কখনও জানতে পারব না বিষয়টা এরকম ছিল কিনা।) বাতলে দেয়া কাজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— এই ধারণাটা তৎক্ষণাৎ মেনে নেয়া হয়ে যায় এবং মানুষজন একজন আরেকজনের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় সেই পিছিয়ে-পড়া লোকদের গালাগালি করতে যারা এই ধারণার প্রতি বিরোধী মনোভাব রেখেছে। কিন্তু এরকম আচরণ করতে একটা প্রকল্পিত (hypothetical) এলাকায় চিন্তা-ভাবনা নির্মাণের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়, যেখানে প্রতিরোধ নিরাময় বর দেয় এবং ঠিক এই কথাটাই ইলিচ বলেন যখন ঝুঁকি (risk)-কে “আজকের দিনে ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ” হিসেবে ব্যাখা করেন। “[পরিসংখানগত] সূচকের রেখা নামিয়ে রাখা”-র মত অভিব্যক্তি সেই সমাজে রাতারাতি সাধারণ বোধে পরিণত হতে পারে যে-সমাজে “সূচক রেখায় উন্নত অবস্থানে থাকার” অনুশীলন করা হয় এবং প্রকৃত অবস্থার বিবেচনা না করে বরং জনসমষ্টির ভিত্তিতে চিন্তা করা হয়।
ঝুঁকির একটা ইতিহাস আছে। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উলরিশ বেক(Ulrich Beck) প্রথম এটাকে ১৯৮৬ সালে তাঁর বই Risk Society-তে (পরে ১৯৯২ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত) সমাজের নয়া বিন্যাসের উন্মাদনা (preoccupation) হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই বইয়ে বেক শেষপর্যায়ের আধুনিকতাকে এক অনিয়ন্ত্রিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বলে অভিহিত করেন। অনিয়ন্ত্রিত বলতে তিনি বুঝিয়েছেন যে, আমাদের বদলা কোন গ্রহ নেই যেখানে আমরা একটা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেখব সেটা কীরকম; দ্বিতীয় কোন বায়ুমন্ডল নেই যেটাকে উত্তপ্ত করে দেখব ফলাফল কেমন আসে। এর মানে, একদিকে, এই টেকনো-সাইন্টিফিক সমাজ অতি-বৈজ্ঞানিক। আবার অন্যদিকে, এখন পর্যন্ত সেটি আপাদমস্তক অবৈজ্ঞানিক, কেননা সেটার সামনে কোন মাপকাঠি নেই যার বিপরীতে সেটা কী করেছে সেগুলো মাপজোক বা বিশ্লেষণ করবে। এ রকম অনিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে—জিন পরিবর্তিত ভেড়া থেকে ধরে গণ আন্তর্জাতিক পর্যটন সহ ব্যক্তিকে যোগাযোগ রিলে (communication relay)-তে রূপান্তরিত করা পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত যেহেতু এ-পরীক্ষাগুলোর অদূরদর্শী এবং অনিশ্চিত পরিণাম রয়েছে, এ-সবগুলো মিলে ইতোমধ্যে এক কিসিমের ভবিষ্যৎ-বাস নির্ভর প্রবণতা নির্মাণ করে ফেলেছে। সেইসাথে আমরা কেবল ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের (risk society) নাগরিক হওয়ার এবং সেই দরুণ আপনা-আপনিভাবে এক অনিয়ন্ত্রিত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার কুশীলব বনে যাওয়ার ফলে আমরা— প্যারাডক্সিক্যালি হই বা না হই— ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করাতে উন্মাদ হয়ে আছি। যেমনটা আমি উপরে ইঙ্গিত করেছি, আমাদের শরীরে রোগ-বালাই আসার সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে আমাদের এমন চিকিৎসা দেয়া হয় এবং দেখানো হয় যে-অসুখগুলো এখনও আমাদের শরীরে আসেনি। সন্তান-সম্ভাবা দম্পতি সম্ভাবনা-নির্ভর ঝুঁকির চিত্র দেখে হায়াত ও মওতের সিদ্ধান্ত নেন। সুরক্ষা হয়ে দাঁড়ায় এক মন্ত্র— “বিদায়” জানানো হয় “নিরাপদে থাকবেন”— স্বাস্থ্য বনে যায় এক ইশ্বর।
জীবনকে মহানরূপে (idolization of life) দেখানো এবং তার কদর্য অন্যচেহারা—মওতের প্রতি দ্বেষ চলমান এই পরিস্থিতিতে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে আমাদের যেকোন মূল্যে “জীবন বাঁচাতে” হবে, এই কথাটা আর প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না। এই ধারণা একটা ছত্রভঙ্গ পরিস্থিতি তৈরি করতে সহজ করে দেয়। পুরো একটা দেশকে “ঘরে যান, ঘরে থাকুন” বলে পাঠানোর, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেরকমটা বলার বেশিদিন হয়নি, অপরিমেয় এবং ধারণাতীত ক্ষতি রয়েছে। কোন ইয়াত্তা নেই কত ব্যবসা লাটে উঠবে, কতজন চাকরি হারাবে, কতজন একাকিত্বের ফলে অসুস্থতায় পড়বে, সঙ্গনিরোধকালে কতজন মাদকাসক্তির দিকে ফিরবে বা একে অন্যের সাথে ঝগড়ায় জড়াবে। কিন্তু যখন-ই মওতের প্রতিচ্ছায়া আমাদের পর্দায় তুলে ধরা হয়, এসব ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় বলে মনে হয়। আবার, দীর্ঘদিন ধরে আমরা মাথা গুণবার অভ্যেস করে আসছি। সর্বশেষ এই বিপর্যয়টিতে “মৃত্যুর হার”-এর প্রতি এই আবেশ মুদ্রার অপর পিঠ মাত্র। জীবন এক বিমূর্তরূপ নিয়ে দাঁড়ায়— গল্পহীন একটা সংখ্যা কেবল।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইলিচ দাবি করেন যে, তিনি এমনসব লোকের দেখা পাওয়া শুরু করেছিলেন যাদের “প্রকৃত [স্বীয়] সত্ত্বা” ছিল “চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সেবা”র ফসল। বোধ করি এটা ব্যাখা করতে সহায়তা করবে কেন কানাডীয় রাষ্ট্র এবং তার অঙ্গ- প্রাদেশিক ও পৌর সরকার, বর্তমানে “ভাইরাসটি”র বিরুদ্ধে “যুদ্ধে” এই সময়ের আমাদের কী কাজ তা অনুধাবন করতে মূলত ব্যর্থ হয়েছে। বিজ্ঞানের উর্দির নিচে আশ্রয় নিয়ে— এমনকি যেখানে বিজ্ঞানের নাম-গন্ধ নেই— এবং স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ঈশ্বরের নিকট সঁপে দেয়াটা তাদের কাছে রাজনৈতিক জরুরত রূপে হাজির হয়েছে। Quebec premier Francois Legault-এর মত যারা তাদের নেতৃত্বের কারণে প্রশংসিত হয়েছেন, তাঁরা সেইসকল নেতৃবৃন্দ যারা প্রথাগত বিদ্যা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের অনন্য-মননশীল দৃঢ়তার মাধ্যমে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র করতে পেরেছেন। এখনও গুটিকতক লোক ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন করার সাহস করেছেন— এবং যখন সেই গুটিকতক লোকের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পড়েন, তখন ক্ষমতাধারী আত্মপ্রসাদ কেবল সুরক্ষিত হয়— তাঁর সাথে সহমত পোষণের সাহস কে করবে? এই ক্ষেত্রে যুদ্ধের উপমার সনির্বন্ধ পুনরাবৃত্তি প্রভাবক হয়ে উঠেছে— কোন যুদ্ধে কেউ ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে না বা বিবেচনা করে না কাকে মূল্য চুকাতে হচ্ছে। প্রথম [এবং সর্বশেষ] কাজ, আমাদের যুদ্ধে জিততেই হবে। যুদ্ধ সামাজিক সংহতির জন্ম দেয় এবং ভিন্নমত নিরুৎসাহিত করে। যারা পতাকা প্রদর্শন করছেন না তাঁদেরকে [ব্রিটেনে ভীরুতার প্রতীক] শাদা-পালকের (white feather)সমান উপযুক্ত বলে দেখানো হয়, যেটার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অ-যোদ্ধাদেরকে অপমান করা হতো।
আমি যে সময়টাতে, এপ্রিলের গোঁড়ার দিকে, বসে লিখছি কেউ জানে না কী ঘটে চলছে। যেহেতু কেউ জানে কতজন রোগটি দ্বারা আক্রান্ত, তাই মৃত্যু হারটা সম্পর্কেও কেউ ওয়াকিবহাল না—ইতালিতে বর্তমানে তালিকাবদ্ধ মওতের হার ১০ শতাংশেরও বেশি, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপর্যয়কর ইনফ্লুয়েঞ্জাজনিত মৃত্যু হারের সমান। যখন জার্মানিতে সেই হার ৮ শতাংশ, যা প্রতিবছর যে পরিমাণ দৃষ্টি-উপেক্ষিত মওত ঘটে তার সমান— সেখানে বেশ কিছু বয়োবৃদ্ধ এবং অল্পকয়েকজন কমবয়সীরা ফ্লু-তে আক্রান্ত হন এবং মারা যান। প্রকৃত জরুরী প্রয়োজনের অল্পকয়েকটা স্থানীয় জায়গার ব্যতিক্রম মাথায় নিয়ে এখানে কানাডায় যে জিনিসটা পরিষ্কার বলে মনে হয় সেটা হচ্ছে— আতঙ্ক ও সংকটের এই পরিব্যাপ্ত রূপটা খোদ মহামারিটির নয় বরং মূলত মহামারীটি রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোরই একটা ফসল। এখানে [মহামারী] শব্দটি নিজে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে— একটা মহামারী এখন সর্বাত্মকরূপে ছড়িয়ে পড়ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমন ঘোষণা কারও স্বাস্থ্য অবস্থার পরিবর্তন করেনি কিন্তু জনমানসের আবহ নাটকীয়ভাবে পাল্টে দিয়েছে। এই ইশারাটির জন্য মিডিয়া অপেক্ষা করে ছিল— এমন এক রেজিমের উন্মোচন করা যেখানে আর কিছু না, শুধু ভাইরাসটিকে নিয়ে মাতামাতি চলবে। এখন পত্রিকায় কোনো খবর করোনাভাইরাস সম্পর্কিত না হওয়াটা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। এটা আর কিছু না বরং খাদের কিনারে থাকা এক পৃথিবীর বার্তা দেয়। আপনি যদি অন্য কিছু চিন্তা না করেন, দ্রুতই মনে হবে যে আসলেই আর কিছু নেই চিন্তা করার। পাখি, ক্রোকাস ফুল, বসন্তের হাওয়া প্রায় বিরক্তিকর বলে মনে হওয়া শুরু হতে পারে— যেমনটা এক পুরনো কান্ট্রি সংগীতের ক্লাসিক গানে প্রশ্ন করা হয়, “হেরা কি জানে না, এইহানেই খতম জমানা?” (don’t they know it’s the end of the world?) ভাইরাসটি দারুণ সব এজেন্সি জুটায়— বলা হয়েছে যে এটা পুঁজিবাজার মন্দায় ফেলে দিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে এবং আতঙ্কসহ ভয় উৎপাদন করেছে, যেন এগুলো সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের না বরং খোদ মহামারীটির কর্ম। এখানে টরোন্টোতে The National Post পত্রিকা আমার কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ ঠেকে এমন একটা হেডলাইন ছাপে। এমন বড় একটা হরফে ছিল যেটা সামনের পাতার উপরে অর্ধেক জায়গা দখল করেছিল, কেবল লেখা ছিল— আতঙ্ক। শব্দটি বর্ণনা নাকি নির্দেশনা হিসেবে পড়ব সেটার কোন আলামত দেয়া ছিল না। এই অস্পষ্টতাই সব মিডিয়ার মৌলিক চরিত্র এবং এটাকে উপেক্ষা করা সেই সাংবাদিকের পেশাদারি বৈশিষ্ট্য (deformation professionnelle )বহির্ভূত। কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠিত সংকটে এটা উপেক্ষা করা সূক্ষ্মভাবে সহজ হয়ে যায়। যে জিনিসটা দুনিয়া ওলট-পালট করে দিয়েছে সেক্ষেত্রে রঙচঙে প্রতিবেদন দেয়া বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা উত্তেজনা সৃষ্টি করাটার বেশি কিছু করার নেই— যা করেছে ভাইরাসটি করেছে। বার্তাবাহককে দোষ দিবেন না। পয়লা এপ্রিলে STAT ওয়েবসাইটে একটা শিরোনামে এমনকি দাবি করেছে “কোভিড-১৯ রাষ্ট্রের তরী ডুবিয়ে দিয়েছে” এবং আমার কাছে এটা কোনো নিছক মজা মনে হয়নি। এই ক্ষেত্রে, এটা চিন্তাভাবনার গবেষণা চালাতে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। যদি এটাকে কখনই মহামারী বলে আখ্যায়িত করা না হতো এবং তা রোধে এরকম কঠোর পদক্ষেপগুলো নেয়া না হতো, তাহলে আমরা নিজেরা এটার মধ্যে কতোটুকু সংকট অনুভব করতাম? অসংখ্য দুর্দশা মিডিয়ার নজর এড়িয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ সুদানের বিপর্যয়কর রাজনৈতিক বিভেদ সম্পর্কে বা ২০০৪ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র’তে গৃহযুদ্ধ স্ফুরিত হওয়ার পর প্রাণ-হারানো দশ লক্ষাধিক মানুষের সম্পর্কে আমরা কতটাই জানি বা খবর রাখি? কোন বিদ্যমান মুহূর্তে আমাদের কাছে সেটাকেই প্রাসঙ্গিক দুনিয়া বলে নির্মিত হবে যেটা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এর পিছনে মিডিয়া একা কাজ করে না— মানুষকে অবশ্যই স্বেচ্ছায় যেতে হবে যেখানে মিডিয়া তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে— তথাপি আমার মনে হয় না এটা অস্বীকার করার জো আছে যে, এই মহামারীটি একটা নির্মিত বস্তু যেটা হয়তো ভিন্নভাবে অবিনির্মাণ করা যেতো।
২৫শে মার্চ তারিখে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো উল্লেখ করেন যে, আমরা “আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রকট স্বাস্থ্য সংকট”-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। স্বাস্থ্যসেবার এক সংকট বলতে তিনি যা বুঝিয়েছেন তা যদি বুঝে থাকি, আমার কাছে তা একধরনের অদ্ভুত অতিরঞ্জন ঠেকে। আদিবাসী সমাজে গুটিবসন্ত (smallpox)-এর বিপর্যয়কর অবস্থার কথাই ভাবুন বা কলেরা ও পীতজ্বর (yellow fever)থেকে ধরে ডিপথেরিয়া ও পোলিওর কারণে অন্যান্য সর্বনাশা মহামারীগুলোর ক্ষয়ক্ষতির হিসেবনিকেশ করর দেখুন। করুণতর অবস্থার কথা তো দূর, এমনকি তখন বলতে পারবেন যে একটা ফ্লু-জনিত মহামারী— যেটা মূলত বয়স্ক লোকদের বা যারা অন্যান্য প্রেক্ষিতের দরুন আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের মওতের পয়গাম নিয়ে হাজির হয়েছে— পুরো জনসমষ্টির ক্ষয়ক্ষতির সমতূল্য? এবং এখনও, প্রধানমন্ত্রীর “সর্বকালের সবচেয়ে প্রকট” এর মত, নজিরবিহীন শব্দটা প্রত্যেকের মুখে মুখে ফিরছে। যা-ইহোক, স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো যদি আক্ষরিকভাবে নিই, তাহলে শুধু স্বাস্থ্য না, গোটা বিষয়টাই পাল্টে যায়। শুরু থেকেই গণস্বাস্থ্য খাতে কানাডায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সেগুলোর লক্ষ্য স্পষ্টতই ছিল অত্যধিক বোঝা থেকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে হালকা রাখা। এই বিষয়টা আমার কাছে হাসপাতালগুলোর প্রতি অসামান্য নির্ভরতা এবং একে অন্যের প্রতি খেয়াল রাখার ব্যাপারে আমাদের মনোবলের বিষ্ময়কর ঘাটতি হিসেবে চোখে পড়ে। কানাডার হাসপাতালগুলো কখনও [রোগীতে] ভরে যাক বা না যাক, একটা আজিব ও ভীতিকর গূঢ় শক্তি ছড়িয়ে আছে বলে মনে হয়– [বেঁচে থাকার স্বার্থে] হাসপাতাল এবং সেখানের কর্মীদের অপরিহার্য বলে মেনে নেয়া হচ্ছে, এমনকি যখন ঘরে বসেই জিনিসগুলো আরও সহজে ও নিরাপদে মোকাবেলা করা যেতো। অন্যদিকে, তাঁর প্রবন্ধ “Disabling Profession”-এ ইলিচ দূরদৃষ্টিতার পরিচয় দেন। তিনি দাবি করেন, অতিবিস্তৃত পেশাদারিক হেজেমনি বা নেতৃত্বগুলো জনমানসের মনোবল নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং মানুষকে নিজেরই সামর্থ্য সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ করে তোলে।
“আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রকট স্বাস্থ্যসেবা সংকট” যেসব পদক্ষেপ বাধ্যতামূলক করে তুলেছে, সেগুলো নাগরিক স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত করেছে। বলা হয়েছে, জীবন বাঁচানোর খাতিরে এগুলো করা হয়েছে এবং একই দোহাই দিয়ে, মৃত্যু এড়ানোর খাতিরেও। মৃত্যুকে শুধু এড়ানোর-ই চেষ্টা করা হচ্ছে না, সেইসাথে তা চেপে যাওয়া এবং বে-আন্দাজ করে রাখা হচ্ছে। বছরখানেক Medical Nemesis-এর উপর একটা লেকচার শুনে হতবুদ্ধি হওয়া এক শ্রোতার গল্প শুনেছিলাম যিনি পরক্ষণেই তাঁর সঙ্গীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তিনি কী চান, মানুষ মরে যাক?” হয়তো আমার কিছু পাঠকও একই প্রশ্ন করবেন। বেশ, আমি নিশ্চিত যে অনেক বয়স্ক লোক আছেন যারা আমার সাথে গলা মিলিয়ে বলবেন যে, দুই-এক বছর বেশি হায়াতের জন্য তাঁরা কম-বয়সী প্রাণগুলোর সর্বনাশ করতে চাইবেন না। কিন্তু এর বাইরেও, “মানুষকে মরতে দেয়া” একটা জঘন্য হাস্যকর চিন্তা। কেননা, এটা বুঝায় যে, এই প্রশ্ন [কে বাঁচবে বা মরবে] করা মানে, যাকে এই প্রশ্ন করা হয়েছে তাঁর কাছে হায়াত-মওতের ফয়সালা করার ক্ষমতা তুলে দেয়া। সেই আমরা যাদের হাতে “মরতে দেয়া”-এর ক্ষমতা আছে বলে ধারণা করা হয়, তাঁরা নির্ভুল তথ্য এবং নিখুঁত প্রায়োগিক দক্ষতার এক আদর্শ জামানায় বিরাজ করি। এই দুনিয়ায় এমন কিছুই ঘটে না, যা স্থির করা হয়নি। যদি কেউ মারা যান, তাহলে বুঝতে হবে তাঁকে “মরতে… দেয়া” হয়েছে। রাষ্ট্র যেকোন মূল্যে অবশ্যই জীবন লালন-পালন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে– মিশেল ফুকো জৈব-রাজনীতি বলতে যা বুঝিয়েছেন এটাই তার সার-সত্তা, সেই রেজিম যা প্রশ্নাতীতভাবে আমাদের শাসন করে। মওতকে অবশ্যই চোখ ও মনের আড়ালে রাখতে হবে। এটা অবশ্যই অগ্রাহ্যকর পন্থা হতে হবে। কারও মওতের সময় আসে না— তাঁদের যেতে দেয়া হয়। New Yorker কার্টুনগুলোতে কৌতুককর চরিত্র হিসেবে The Grim reaper [যমদূত] টিকে থাকতে পারে, কিন্তু জনসাধারণের আলাপে সেটার স্থান নেই। এর ফলে মওতকে কারও অবহেলা থেকে বেশি কিছু বা কমপক্ষে, চিকিৎসার চূড়ান্ত পরাজয় হিসেবে তুলে ধরাটা এমনকি মুশকিলের হয়ে পড়ে। মওত মেনে নেয়া মানেই পরাজয় বরণ করা।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উন্মোচন করে আমরা কতটা সর্বাত্মকভাবে সিস্টেমের ভেতরে জীবন-যাপন করি, ঐক্যবদ্ধ নাগরিক হওয়ার চেয়ে বরং জনসংখ্যায় কতটা রূপান্তরিত হয়েছি, আমাদের নিজেদেরই তৈরি করা ভবিষ্যতেকে প্রতিনিয়ত বোকা বানাতে আমরা প্রয়োজনের তাগিদে কতটা পরিচালিত। ইলিচ যখন Tools for Conviviality এবং Medical Nemesis-এর মত বইগুলো লিখেছেন, তখনও তিনি আশা করেছিলেন যে জীবন গণ্ডির ভিতরে সম্ভব ছিল। পৃথিবীকে স্থানীয়, সংবেদ্য, সামাজিক মাপকাঠিতে রাখতে — যেখানে মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী হিসেবে থাকতে পারে, যেরকটা আমরা হব বলে এরিস্টটল ভেবেছিলেন— তিনি সেই সীমারেখা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন যেখানে প্রযুক্তিকে অবশ্যই ঠেকাতে হবে। আরও অনেকে একই সুরতের কল্পনা করেছিলেন এবং গত পঞ্চাশ বছরেও বেশি সময় ধরে অনেকে সেটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়েছেন। তথাপি আর কোনো সন্দেহ নেই, যে-দুনিয়ার কথা ইলিচ সাবধান করেছিলেন তা আমাদের দুয়ারে। এটা এমন এক দুনিয়া যেখানে জীবনগুলো প্রাথমিকভাবে বিমূর্ত অবস্থায় এবং প্রকল্পিত (hypothetical) এলাকায় বিরাজ করে, কায়েমী জরুরতের এমন এক দুনিয়া যেখানে পরবর্তী সংকটটা সবসময় ঘরের কোণে থাকে, এমন এক দুনিয়া যেখানে যোগাযোগের অবিশ্রান্ত বুদবুদ ভাষাকে টেনে-হিঁচড়ে খাদের কিনারে নিয়ে এসেছে, এমন এক দুনিয়া যেখানে অতি-বিস্তৃত বিজ্ঞান কুসংস্কার থেকে অভেদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কীভাবেই বা ইলিচের ধারণাগুলো সুবিধা করতে পারে, যে দুনিয়া দেখে মনে হয় তাঁর মাপকাটি, ভারসাম্য আর ব্যক্তিগত বোধ (meaning)-এর ধারণাগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সম্প্রতি আরোপিত সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মাত্রা সার্বজনিন ইম্যুউন সিস্টেমের— হারাওয়ের ভাষ্যমতে আমরা যেটার “জৈবিক উপাদান”— সমানুপাতিক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে কেবল মেনে নেয়াটা কারও পক্ষে উচিৎ নয় কি?
সম্ভবত থমাস ম্যুর, যদিও এটা একটা প্রাচীন সর্বজনবিদিত রাজনৈতিক নীতি যা প্লেটোতে পাওয়া যায় এবং আরও সম্প্রতি কানাডার দার্শনিক জর্জ গ্রান্ট-এরও একই বক্তব্য যে, আপনি যদি সর্বোত্তমটা অর্জন করতে না-ও পারেন, পারতপক্ষে সর্বনিকৃষ্টটা আটকান। এই মহামারীর দরুন নিশ্চিতভাবে অবস্থা বেগতিক হতে পারে। ইতোমধ্যে এটা একরকম আশঙ্কাজনক সাধারণ ধারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মহামারীটি একবার শেষ হওয়ার পর পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না। কেউ কেউ এটাকে এক অনুশীলন হিসেবে দেখেন এবং খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেন, যদিও এই বিশেষ মারী ঠেকাতে নেয়া পদক্ষেপগুলো পুরোপুরিভাবে যথেষ্ট না-ও হতে পারে, তবুও এসব পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের জন্য এবং সম্ভাব্য আরও বাজে মহামারী সামলাতে কাজের অভ্যেস গড়ছে। অন্যান্যরা এটাকে “হুশ জাগানিয়া ইশারা” হিসেবে দেখেন এবং আশা রাখেন যে, যখন এটা একেবারে বিদায় নিবে, বিপর্যয়ের মুখ থেকে ফিরে আসা এক বিশুদ্ধ মানবতার যাত্রা শুরু হবে। আমার ভাবনা এবং যেটা অনেকেই আলাপ করেছেন বলে বোধ করি, এটা আরও বর্ধিত নজরদারি এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, টেলিস্ক্রিন, টেলিপ্রেজেন্সিং এবং সর্বোচ্চ অবিশ্বাসের মনস্তত্ব পিছনে রেখে যাবে। এই মুহূর্তে, আশা নিয়ে প্রত্যকেই শারীরিক দূরত্বকে সংহতির রূপ হিসেবে তুলে ধরছেন, কিন্তু এটা একে অন্যের ক্ষেত্রে এবং এমনকি আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেও— “মুখমন্ডলে হাত দিবেন না”— সম্ভাব্য রোগ বাহক হিসেবে চর্চা বৈকি।
আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি এই মহামারী নিশ্চিতভাবে যে অন্যতম কাজটা করছে সেটা হচ্ছে- ঝুঁকি-কে জনমানসের গভীরে গেঁথে দিচ্ছে। কিন্তু, যেহেতু প্রকৃত বিপদের সাথে এত সহজে ঝুঁকি গুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই এই বিষয়টা বে-আন্দাজ করা সহজ হয়ে যায়। আমার মতে, দুটোর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে- প্রকৃত বিপদ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাস্তবিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়, যেখানে ঝুঁকি হচ্ছে জনসংখ্যা সংক্রান্ত পরিসংখ্যাগত নির্মাণ। ঝুঁকি-র ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রের অভিজ্ঞতা বা বাস্তবিক পর্যবেক্ষণের কোনো জায়গা নেই। সাধারণত কী ঘটতে পারে তাই সেটা জানাবে। এটা একটা জনসমষ্টির বিমূর্ত ভাব মাত্র, কোন ব্যক্তির প্রকৃত চিত্র বা সেই ব্যক্তির নিয়তির পথপদর্শক না। নিয়তি এমন এক ধারণা যেটা ঝুঁকির গহব্বরে কেবল মিইয়ে যায়, যেখানে সবাই একই রেখায় অনিশ্চিতভাবে নিবিষ্ট। যেটার সম্পর্কে ইলিচ বলছেন, প্রত্যেকটা অস্তিত্বের— বা আরও সহজ করে বললে, সেটার সার-সত্তার— “অস্পষ্ট বাস্তবিকতা” খারিজ হয়ে গেছে। এই মহামারী চলাকালে, ঝুঁকিপূর্ণ সমাজের প্রাসঙ্গিকতা চলে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, মডেল অনুযায়ী তৈরি ভয়ঙ্কর কর্তৃত্ববাদী অবস্থায় এটা অবধারিত— এমনকি যখন সবাই জানে যে তাঁদের নিশ্চিত অনুমানের থেকে একটু বাড়িয়ে তাঁদেরকে জানানো হচ্ছে। আরেকটা আলামত হচ্ছে- “রেখা নামিয়ে রাখা” নিয়ে মানুষজনের মাতামাতি, যেন এগুলো প্রতিদিনকার কাজ-কারবার— সম্প্রতি এ-সম্পর্কে একটা গানও শুনেছি। যখন জন-নীতি একটি ঝুঁকি রেখা-র মতো সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও গাণিতিক বিষয়াদি-নির্ভর বস্তু হয়ে দাঁড়ায়, নিশ্চিতভাবে বলা যায়— ঝুঁকিপূর্ণ সমাজ সামনের দিকে বড় আরেক ধাপ এগিয়ে এসেছে। ইলিচ বিমূর্তায়ন (disembodiment) বলতে যেটা বুঝিয়েছেন, বোধ করি এটাই সেটা— নিরাকার বস্তু আকার পায়, প্রকল্পিত বস্তু ধ্রুব হয়ে যায় এবং প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার দুনিয়ার সাথে বার্তাকক্ষে, ল্যাবরেটরিতে এবং পরিসংখ্যানিক নমুনায় সেটার উপস্থাপন অভেদ্য হয়ে দাঁড়ায়। সর্বকালেই মানুষ কল্পনার দুনিয়ায় বাস করে আসছে, কিন্তু এই অবস্থা, বোধ করি, ভিন্ন কিছু। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় ক্ষেত্রে এমনকি সবচেয়ে সরল বিশ্বাসীরও এই খেয়াল আছে যে, তাঁদের মাহফিলে তাঁরা যেসব-সত্ত্বার জিকির এবং প্রার্থনা করেন তাঁরা প্রতিদিনকার বিষয়াদি না। এই মহামারীর ডিসকোর্সে, প্রত্যেকেই এমন সহজভাবে বৈজ্ঞানিক অপচ্ছায়াগুলো নিয়ে মশগুল যেন সেগুলো পাথর ও গাছপালার মত বাস্তব।
বর্তমান চিত্রপটের আরেকটা প্রাসঙ্গিক চরিত্র হচ্ছে— বিজ্ঞান-কর্তৃক-শাসন(government-by-science) এবং এর দরকারি অনুষঙ্গ: ভিন্ন যেকোনো পাটাতনে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করা। এই জমিখানাও অনেক আগে থেকে চষা এবং বীজ বপনের জন্য তৈয়ার করা। Tools for Conviviality -তে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেই লিখেছেন যে, সমসাময়িক সমাজ “বিজ্ঞানের আবেশে বিমোহিত”। এই আবেশ নানা কিসেমের সুরত ধরে, কিন্তু এর সারমর্ম হচ্ছে: জটলাপাকানো, অসংখ্য বিজ্ঞানের সম্ভারের মাধ্যমে ধু-ধু মরুতে একমাত্র ত্রাতা নির্মাণ, যার সামনে সবাইকে মাথা নুয়াতে হবে। যখন আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয় “বিজ্ঞানের কথা মেনে চলুন” বা বলা হয় “গবেষণা (কী) দেখায়” বা “বিজ্ঞান (কী) বলে”, তখন এই বিশাল মরিচিকাকেই সাধারণত উস্কে দেয় হয়। কিন্তু বিজ্ঞান বলে আদতে কিছু নেই, কেবল বিজ্ঞানসমূহ (Sciences), প্রত্যেকটাই স্বতন্ত্র প্রাসঙ্গিকতা ও স্বতন্ত্র সীমাবদ্ধতা সমেত। যখন “বিজ্ঞান”-কে জ্ঞান উৎপাদনের সব পরিবর্তন ও লেশটুকু থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ত্রিকালদর্শী ভাগ্য-বিধাতা রূপে চড়ানো হয় যার পুরোহিতদেরকে তাঁদের সাজ-সজ্জা, জাঁকজমকপূর্ণ চাল-চলন ও চোখ জুড়ানো পরিচয়সূচক ডিগ্রি দিয়ে চিনতে পারা যায়, তখন যেটা সংকুচিত হয় সেটা হচ্ছে, ইলিচের মতে, রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা। দুনিয়ার জমিনে বিষয়াদি দেখতে যেরকম, সেই খালি চোখে ও উপস্থিত জ্ঞান দিয়ে যা ভালো মনে হয় তা আমরা করি না, বরং বিজ্ঞান বলে মোড়কে মুড়ে দিলেই সব ঠিকঠাক। Rationality and Ritual শিরোনামের একটা বইয়ে বিজ্ঞানের বৃটিশ সমাজবিজ্ঞানী ব্রায়ান ওয়েন ১৯৭৭ সালে ব্রিটিশ হাইকোর্টের একজন বিচারকের পরিচালিত গণ-জরিপ নিয়ে গবেষণা চালান। জরিপটির প্রশ্ন ছিল: কাম্ব্রিয়ান উপকূলের সেলাফিল্ডে অবস্থিত ব্রিটিশ নিউক্লিয়ার এনার্জি কমপ্লেক্সে একটি নতুন প্লান্ট সংযোজন করা হবে কি-না? ওয়েন দেখান যে, সেই বিচারক প্রশ্নটি এমনভাবে তৈরি করেছিলেন “বিজ্ঞান” যেটার জবাব— এটা নিরাপদ কি না?— নৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে বোঝাপড়া ছাড়াই দিবে। পুরাকল্পীয় বুলি আওড়িয়ে, যেরকমটা উপরে উল্লেখ করেছি, রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা উৎখাত করে বিজ্ঞানের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেয়াটা অনেক পুরনো একটি কাজ৷ এই উৎখাতের কাজটা এখন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এটার অন্যতম আলামত হচ্ছে: “বিজ্ঞান” যা করে তা থেকে “বিজ্ঞান” বেশি জানে, এই চিন্তা থেকে লোকজন কল্পনা করেন যে, তাঁরা যা করে তা থেকে তাঁরা বেশি জানে। প্রকৃত কোন জ্ঞানের এরকম আত্মবিশ্বাসকে সমর্থন করার প্রয়োজন নেই। রোগবিস্তার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা খোলাখুলিভাবে বলতে পারেন, যেমনটা অনেকেই বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সামনে এগোনোর জন্য শক্তশালী উপায় খুব সামান্যই আছে। কিন্তু এই চিন্তা রাজনীতিবিদদের এরকম আচরণ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি যেন তাঁরা বিজ্ঞানের নিছক কর্তব্যনিষ্ঠ অধীনস্ত৷ আমার মতে, যারা আক্রান্ত না তাঁদের আধা-সঙ্গনিরোধে রাখার নীতি গ্রহণ— যে নীতি খোয়ানো চাকুরি, বন্ধ হওয়া ব্যাবসা-বানিজ্য, হতাশাগ্রস্ত লোক এবং ঋণ জর্জরিত সরকারের ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর পরিণামের পিছনে থাকাটা সঙ্গত— একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সেইভাবেই তা আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজ্ঞানের প্রশস্ত উর্দির সব রাজনীতিবিদকে এই বিতর্ক থেকে আশ্রয় দিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যমান নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েও কেউ আওয়াজ পর্যন্ত তুলে না। সেসব সিদ্ধান্তের ভার বিজ্ঞানের উপর।
ইলিচ তাঁর শেষদিককার লেখালেখিতে একটা ধারণার অবতারণা করেন, যদিও পরে কখনও তা ঘষামাজা করেননি, যেটাকে তিনি “জ্ঞানবিদ্যক ভাবালুতা” (epistemic sentimentality) বলেন। সর্বসম্মতভাবে মনোযোগ আকর্ষিক শব্দবন্ধ না হলেও, আমি কিন্তু মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে যা চলছে এটা সেদিকে আলো ফেলে বৈকি। সংক্ষেপে বললে, তাঁর দাবি ছিল যে, আমরা “কল্পনার অস্তিত্ব” (fictitious substances) এবং “শাসন-পুষ্ট-প্রতিচ্ছায়া”-এর এক দুনিয়ায় বসবাস করি— প্রতিষ্ঠান-স্বীকৃত শিক্ষা থেকে ধরে “স্বাস্থ্য রক্ষায় রোগজনিত চিকিৎসা” হতে পাওয়া যেকোন পরিমাণের আবছা সেবা/পণ্য উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে— এবং তালগোল পাকানো চেচামেচিতে ভরা এই ভাষার [রাজনীতির] জামানায় Linus blanket [আশ্বাস এবং সান্ত্বনার জন্য নির্ভরশীল ব্যক্তি] হিসেবে ভক্তি দিতে আমাদের সামনে “কোন মহান ভক্তিবস্তুর” প্রয়োজন হয়। আমি যে প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছে, সেটার প্রাথমিক উদাহরণ হচ্ছে জীবন। “জ্ঞানবিদ্যক ভাবালুতা” নিজেকে জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয় এবং জীবন সেই ছাতা হয়ে দাঁড়ায় যার ছায়াতলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পগুলো এবং প্রযুক্তিসংক্রান্ত মরীচিকা তেজ ও তাক্বত লাভ করে। ইলিচ এটাকে জ্ঞানবিদ্যক ভাবালুতা এজন্যই বলছেন, কেননা এটার সাথে জ্ঞান নির্মিত উদ্দেশ্যের সম্পর্ক রয়েছে যার কিনা সেই “মহান ভক্তিবস্তুর” করুণাময় ছায়ায় স্বাভাবিকীকরণ করা ঘটে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা বেফানা হয়ে জীবন বাঁচাতে এবং আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রক্ষায় ব্যস্ত। এই মহান লক্ষ্য এমন এক মানসিকতার প্রবাহ ঘটায় যা রোধ করা কষ্টসাধ্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন আমাদের উদ্দেশ্যে প্রায় নিদারুণ কৃত্রিম ভাবাবেগপূর্ণ যে-সুরে আহ্বান জানান, বোধ করি, সেই আহ্বানে বিষয়টা একসাথে চলে আসে। কিন্তু এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার মর্মবেদনায় কে না আছে? আমরা একে অন্যের জন্য পরোয়া করার গভীরতা থেকে আমরা প্রত্যেকেই অন্যকে এড়িয়ে চলছি, এ কথা কেউ কি বলেনি? এটাই জ্ঞানবিদ্যক ভাবালুতা, শুধু এটা আমাদের প্রবোধ দেয় বলে এবং এক ভৌতিক পরিস্থিতিকে মানবিক বলে মনে করায় বলে না, বরং সেটা অন্য যা কিছু ঘটে সেগুলোও আড়াল করে দেয়– যেমন: সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক বশ্যতা সৃষ্টিতে গণহারে তালাশি; সামাজিকতা ও নির্দেশনার উপায় হিসেবে টেলিপ্রেজেন্সের বৈধতা; নজরদারি বৃদ্ধি, জৈব-রাজনীতির স্বাভাবিকীকরণ এবং সামাজিক জীবনের বুনিয়াদ হিসেবে ঝুঁকি সচেতনতার জোরদার করা।
আরেকটা ধারণা যেটা আমি বিশ্বাস রাখি যে, বর্তমান আলোচনায় আসা উচিৎ— “অগ্রসরতার ভারসাম্য”(dynamic balance)-এর ধারণা। ইলিচ Tools of Conviviality গ্রন্থে ধারণাটির অবতারণা করেন। চলমান মহামারী নিয়ে ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের ভিন্ন অবস্থানকে খন্ডিত করতে লেখা Chronicle of Higher Education শিরোনামের লেখাখানা সম্প্রতি পড়তে গিয়ে এই চিন্তা আমার মাথায় আসে। যে-সমাজ জীবনের আপন গতিপ্রবাহ থেকে “নেংটো জীবন” এর ধারণাকে মহান করে প্রতিষ্ঠা করে, তা পরিণামে মওতের থেকেও খারাপ নিয়তি বয়ে আনে দাবি করে আগামবেন নিয়ম-নীতির নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে আগেও লেখালেখি করেছেন— যেটা কি না মানুষকে নিঃসঙ্গ মওতের দিকে ঠেলে দেয় এবং এরপর শোকাবহতা উপড়ে ফেলে। তাঁর সহকর্মী দার্শনিক এনাস্তাশিয়া বার্গ দাবির প্রতিক্রিয়া আগামবেনের প্রতি সম্মান জানান, কিন্তু সেই সাথে তিনি দাবি করেন আগামবেন নিশানা ভুল করেছেন। মানুষজন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বাদ দিয়ে দিচ্ছে, রোগীকে একা রাখছে এবং একে অন্যকে এড়িয়ে চলছে কেবলমাত্র এজন্যই না যে নিছক টিকে থাকাই জনসাধারণের নীতির একমাত্র লক্ষ্য, যেমনটা আগামবেন দাবি করেছেন; বরং একটা প্রীতিপূর্ণ ত্যাগী মনোভাব থেকে মানুষজন এসব করছে, যেটা সম্পর্কে খেয়াল করতে আগামবেন অনুভূতিশূন্য ও তত্ত্বে বুদ হয়ে আছেন। দুটো অবস্থানই কঠোরভাবে বিপরীত মেরুর বলে প্রতীয়মান হয় এবং সিদ্ধান্তটা হয়/অথবা রূপে হাজির হয়। কেউ হয়তো এনাস্তাশিয়া বার্গ-কে বিবেচনায় নিয়ে, সামাজিক দূরত্বকে [সামাজিক] সংহতির আপাতত-বিপরীত ও ত্যাগ-প্রবণ রূপ হিসেবে দেখে, অথবা কেউ আগামবেনকে বিবেচনায় নিয়ে এটাকে [সামাজিক দূরত্ব] এমন এক দুনিয়ায় বাধ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখে, যেখানে জীবনের সহজাত প্রবাহ যেকোন মূল্যে টিকে থাকার তত্ত্বে বিলীন হয়ে যায়। Tools for Conviviality-তে যে বিষয়টা ইলিচ আলাপের টেবিলে আনার চেষ্টা করেছিলেন সেটা হচ্ছে: জনসাধারণের নীতিকে সবসময় অবশ্যই বিপরীত এলাকা, বিপরীত যুক্তি ও বিপরীত গুণাবলীর মধ্যে একটা ভারসাম্য নিয়ে আসবে। পুরো বইটি সেই বিন্দুটি উপলব্ধি করার একটা প্রচেষ্টা যে বিন্দুতে সেবাযোগ্য যন্ত্রপাতি—উপকারের জন্য যন্ত্র— সেরকম যন্ত্রে পরিণত হয় যেগুলো নিজের স্বার্থেই চলে এবং তাদের ব্যবহারকারীদের চালনা শুরু করে। একই উপায়ে তিনি বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাবোধকে, গণমাধ্যমের তৈরি করা বাগাড়ম্বর থেকে সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে বলা কথার এবং প্রাতিষ্ঠানিক আচার থেকে স্বভাষা চর্চার পার্থক্য টানার চেষ্টা করেন। প্রচেষ্টা চালানো এসব অনেক পার্থক্য-ই অদ্যাবধি “সিস্টেমের” একচ্ছত্রতায় হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমার মনে হয় এই ধারণাটা এখনও সহায়ক হবে। এটা আমাদের প্রশ্ন করতে উদ্ধুদ্ধ করে, কী যথেষ্ট? ভারসাম্যের বিন্দু কোন জায়গায়? এই মুহুর্তে এই জিজ্ঞাসা করা হয় না, কেননা আমরা যে পণ্য/সেবা গ্রহণ করি তা সাধারণত অসীম বলে ধরে নিই– অনুমান করে নিই, আমরা অনেক বেশি শিক্ষা, অনেক ভালো স্বাস্থ্য, অনেক ভালো আইন, বা অত্যধিক অন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য যেসবের উপর আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও অস্তিত্বের অপব্যয় করি তা লাভ করতে পারব না।
কিন্তু যদি প্রশ্নটি পুনরুত্থাপন করা হয় তখন? এটা আমাদের প্রশ্ন করতে প্রয়োজন পড়বে কীভাবে বার্গ-এর যুক্তি টেবিলে রেখেও আগামবেন সঠিক হতে পারেন? হয়তো ভারসাম্যের কোন বিন্দু পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেজন্য চতুর্মাত্রিক চিন্তা থাকার সক্ষমতা – হানা আরেন্ডের(Hannah Arendt) মতে যা চিন্তার খাস আলামত— একইসাথে রাজনৈতিক বিচারবোধের পুনরুজ্জীবনও প্রয়োজন পড়বে। রাজনৈতিক বিচারবোধের এরকম অনুশীলন চলমান সংকটে কী হারিয়েছে এবং কী অর্জিত হয়েছে সেসব আলোচনা নিয়ে আসবে। কিন্তু সংকটকালে কে-ই বা বিচার-বিবেচনা করে? সর্বাত্মক সংহতি , সামগ্রিক আবেশায়ন, সবকিছু পাল্টে যাওয়ার অনুভূতি, সাধারণ অবস্থা থেকে বরঞ্চ এক ব্যতিক্রমী অবস্থায় বাস করার নিয়তি— এসব কিছু রাজনৈতিক বিচারবোধের বিরুদ্ধে কাজ করে। এটা একটা দুষ্টচক্র: আমরা বিচার-বিবেচনা করতে পারি না, কারণ আমরা এক সংকটে আছি; আবার, আমরা এক সংকটে আছি, কারণ আমরা বিচার-বিবেচনা করতে পারি না। এই চক্র থেকে বের হওয়ার পথ কেবল সেই উপায়ের মধ্যেই নিহিত— যে অনুমান সৃষ্ট উপায় এতই বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে তা সংশয়াতীত বলে মনে হয়।
জীবদ্দশার শেষ বিশ বছরের দিকে ইলিচের এমন এক দুনিয়ার উপলব্ধি হয়েছিল যে দুনিয়া “সিস্টেমের এক তত্ত্ববিদ্যা”-র কয়েদে বন্দী; এক দুনিয়া দয়া-মায়া থেকে দূরে, মওত থেকে বিচ্ছিন্ন এবং যেকোন পরিণাম এড়াতে কর্তব্য পালনে পুরোপুরিভাবে ধাতস্থ— এমন এক দুনিয়া, যেমনটা তিনি একবার বলেছিলেন, যেখানে ” উত্তেজনাকর, আত্ম-দখলকারী বিমূর্তায়ন দুনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও সত্ত্বার উপর বালিশের প্লাস্টিকের ওয়াড়ের মত দখল নিয়ে নিয়েছে”। নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি আপাতত কোনো পথ দেখায় না। নিয়ম-নীতি সময়ের সংকটের নিরিখে সেই মুহূর্তে তৈরি হয়। ইলিচ মানুষের উপলব্ধির, চিন্তার ও অনুভূতির প্রণালী সম্পর্কে আলাপ করছিলেন, যা মানুষের ভেতর বেশ গভীরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতেই, আশা করি, যে-ই এই পর্যন্ত লেখাটা পড়েছেন ভাববেন না যে আমি নিছক নীতিমালা তৈরির প্রস্তাবনা দিয়ে আসছি। বরং আমরা সবাই যে নিয়তি ভোগ করছি সেটা আলোচনার চেষ্টা করেছি। পরন্তু আমি যা লিখেছি তা থেকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার ধারণা প্রায় যথেষ্ট পরিষ্কার। আমার মনে হয়, আমরা যে সুড়ঙ্গে পা রেখেছি— শারীরিক দূরত্বের, [আক্রান্ত ও মৃতের] রেখাচিত্র ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের– তা থেকে উত্তরণ বেশ মুশকিলের হবে— হয় আমরা শিগগিরই এসব তুলে ফেলি এবং সেসব সম্ভাবনার মুখোমুখি যেগুলো বেহুদাই ছিল অথবা এসব আরও বাড়িয়ে দিই যেটা আমাদের রোধ করা ক্ষয়ক্ষতি থেকে আরও বেশি খারাপ হতে পারে। বলা হচ্ছে না যে, আমাদের কিছুই করা উচিৎ না। এটা একটা মহামারী। কিন্তু আমার মতে, চেষ্টা করা ও তা চালিয়ে যাওয়া এবং স্পষ্টভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ও তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র ব্যবহার করলে আরও ভালো পরিস্থিতি হতো। আবদ্ধ বেজবল স্টেডিয়াম এবং হকির বিশাল মাঠে, যেকোন উপায়ে, ছোট ছোট ব্যবসা খোলা রাখা হয় এবং ক্রেতাদের মধ্যে জায়গা ফাঁকা রাখার চেষ্টা করা হয় একইভাবে, যে দোকানগুলো খোলা আছে সেগুলো যেমনটা করছে। তখন কি বেশি মৃত্যু ঘটবে? হয়তো, কিন্তু এটা স্পষ্ট থেকেও স্পষ্টতর। ঠিক এটাই আমার যুক্তি: কেউ জানে না। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির ইউরোপীয় সেন্টারের পরিচালক সুইডেনের অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক এরিক্সন সুইডেনের লকডাউন-বিহীন বর্তমান সতর্কতা নীতির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে একই দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “লকডাউনের তত্ত্ব অপরীক্ষিত”— যেটা সত্য— এবং ফলস্বরূপ, — “সুইডেন সেই রাষ্ট্র না যেটা জনসাধারণের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এটা অন্য সব রাষ্ট্র করছে।”
এখানে কথাটা আবার বলার পেছনে নিয়ম-নীতির সাথে বাহাসে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য না। বরং উদ্দেশ্য সেইসব চর্চিত বাধ্যবাধকতাগুলোর উপর আলো ফেলা যেগুলো আমাদের বর্তমান নিয়ম-নীতিগুলোকে প্রশ্নাতীত করে তোলে। শেষ একটা উদাহরণ আপনাদের দিই। সম্প্রতি টরেন্টোর এক পত্রিকার কলামিস্ট ধারণা দেন যে, চলমান সংকটটাকে “অর্থনীতি বাঁচানো” নাকি “বৃদ্ধদের বাঁচানো” এ দুটির মধ্যে একটা সিদ্ধান্ত হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধারণায় দুইটি প্রধান বাধকতাকে একটিকে অন্যটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমরা যদি এই কল্পনাপ্রবণ চিন্তাগুলোকে প্রশ্নযোগ্য নির্মাণের বদলে বাস্তব ধারণা বলে ধরে নিই, তাহলে আমরা কেবল বৃদ্ধদের লাশের মূল্য ধার্য্য করে খালাস হব। এর চেয়ে বরং, আমি বলব, ভিন্নভাবে চিন্তা করা ও চেষ্টা করা উচিৎ। সম্ভবত, মডেল-সর্বস্ব ও ব্যবস্থাপনার দুনিয়া কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া উত্তরণের অসম্ভব দুয়ারগুলো একটা ইঙ্গিত বহন করে যে, বিষয়াদিকে ভুলভাবে গঠন করা হয়েছে। আমাদের সামনে কি কোন পথ খোলা আছে, যা বয়স্ককে “জনসংখা বিষয়ক [নিছক] সংখ্যা” থেকে একজন ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে, যাতে তাঁদের জীবনের সড়কের শেষ অব্দি শুশ্রূষা, আরাম ও সঙ্গ দেয় যায়; কোন পথ কি আছে, যা এই অর্থনীতিকে চুড়ান্ত বিমূর্তায়ন থেকে রাস্তার উপর সেসব দোকানে নিয়ে যেতে পারে যেখানে কেউ তাঁর সব সম্বল বিনিয়োগ করেছে এবং এখন যা খোয়াতেও পারে। বর্তমানে, “এই সংকটটা” বাস্তবতাকে তার বদ্ধ ও বায়ুশূন্য সিস্টেমের ভেতর জিম্মি ও বন্দি করে রেখেছে। সেই পথ সম্পর্কে বলাটা বেশ মুশকিলের যে-পথে জীবন অন্যকিছু এবং একটা সম্পদের থেকে বেশি কিছু, যেটাকে আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্যের সাথে পরিচালন, সংরক্ষণ এবং অবশেষে, রক্ষা করতে হবে। তথাপি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যে বিষয়গুলোর খোলাসা হয়েছে সেগুলোর উপর সতর্ক নজর দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি: চিকিৎসা বিজ্ঞানের “ব্যতিক্রম মুহূর্তে সিদ্ধান্ত” নেয়া এবং পরে ক্ষমতা হাতে নেয়া; যা বাস্তবে ঘটেছে তার পুনর্নিমাণে মিডিয়ার ক্ষমতা, যখন সেটা নিজেরই এজেন্সিকে অস্বীকার করছে; বিজ্ঞানের তোপে রাজনীতির উবে যাওয়া, এমনই যখন বিজ্ঞানের ছিটেফোঁটাও নেই; রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাবোধের নিষ্ক্রিয়তা; ঝুঁকি সচেতনতার শক্তিপুষ্ট ক্ষমতা; এবং নতুন সার্বভৌমত্ব হিসেবে জীবনের উত্থান। সংকট ইতিহাস পাল্টে, কিন্তু ভালোর জন্য হবে তা জরুরি না। এই ঘটনাটাকে কী অর্থে বিশ্লেষণ করা হবে সেটার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। আমি যে বাধকতাগুলোর চিত্র এঁকেছি সেগুলো যদি প্রশ্নের সম্মুখীন করা না হয়, পরিণামে যে একমাত্র সম্ভাব্য ফল আমি দেখতে পাই, সেটা হচ্ছে— সেগুলো আমাদের মগজে নিজেদেরকে আরও পোক্তভাবে গেঁথে ফেলবে এবং সেগুলো সংশয়াতীত, অদৃশ্য এবং প্রশ্নাতীত হয়ে দাঁড়াবে।
____________
৩রা মার্চ, ২০২০
দোহাইঃ
https://www.spectator.co.uk/article/The-evidence-on-Covid-19-is-not-as-clear-as-we-think
https://off-guardian.org/2020/03/17/listen-cbc-radio-cuts-off-expert-when-he-questions-covid19-narrative/ (This story is misheaded – Duncan McCue doesn’t cut off Dr. Kettner – it’s because Kettner gets to make so many strong points that the item is valuable.)
https://www.journal-psychoanalysis.eu/coronavirus-and-philosophers/ (Agamben’s view can be found here along with a lot of other interesting material.)
Giorgio Agamben’s Coronavirus Cluelessness (Anastasia Berg’s critique of Agamben)
https://www.spectator.co.uk/article/no-lockdown-please-w-re-swedish (Frederik Erixon)