- লেখক: সহুল আহমদ
বর্ণবাদী নাগরিক আইন সংক্রান্ত উদাহরণের জন্য এখন আর আমাকে ১৯৩৩-৪৫ সালের জার্মানির কাছে ধারস্থ হতে হবে না। আমাদের পাশের দেশ ভারত কিছুদিন পরপর বর্ণবাদী আইনকানুন প্রণয়নের টেক্সটবুক এক্সাম্পল হাজির করছে। ‘মুসলমান-বিরোধী’ সাম্প্রতিক পলিসি যেনো জলন্ত উদাহরণ। এই পলিসির খড়গ পড়বে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর।
ভৌগোলিক অবস্থান থেকে শুরু করে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভারতের পরিস্থিতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। ভারতে মুসলমান-বিরোধী বা যে কোনো ধরণের বর্ণবাদী আইনপ্রণয়ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকেও জটিল করে তুলে।
ভারতের এমন মুসলমান বিরোধী আইন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহ যোগায়, আবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলাকে ভারত তার আইন-কানুন তৈরির ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে। এই নতুন বিল প্রসঙ্গে অমিত শাহ যা বলেছেন তাতে এই ট্রাম্পকার্ডের কথা স্পষ্টভাবেই বলেছেন। দুই দেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি একে অপরকে শক্তি যোগায়, যদিও সামনা-সামনি দুই পক্ষই একেঅপরকে শত্রু বলেই চিহ্নিত করে।
ভারত রাষ্ট্র ও ভারতের জনগণ বা নাগরিক এক না। ‘রাষ্ট্র’ ও ‘জনগণ’কে গুলিয়ে ফেলা যাবে না, নাহলে বোঝাপড়াতে সমূহ বিপদ হাজির হবে। কোনো সন্দেহ নেই, মোদির ফ্যাসিস্ট রাজনীতিতে জণগণের অনেকেই ‘ফ্যাসিনেটেড’; তবু মনে রাখতে হবে, মোদির বিরুদ্ধেও ভারতের জনগণ বিভিন্ন প্ল্যটফর্মে লড়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পূর্বেই আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিল দেখেছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের উত্তাল হওয়ার খবর আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি।
এই কথাটা বললাম এই কারণে যে, রাষ্ট্র ও জনগণকে একাকার করে ফেললে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি্র পালেই হাওয়া লাগবে। ভারতের আইন-কানুনের ফলে বাংলাদেশে যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেখা দেয়, যদি সংখ্যালঘুর নির্যাতনের ঘটনা ঘটা শুরু হয়, তাহলে আখেরে লাভ যে মোদি সরকারেরই হবে, তা অমিত শাহের বক্তব্য থেকে আন্দাজ করতে পারা উচিৎ আমাদের।
ভারত ‘এক্সক্লুসিভ’ রাজনীতি করছে, এর বিরুদ্ধে লড়তে হলে আমাদের আরো বেশি ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতি করতে হবে। সচেতনভাবেই। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জবাব সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে হয় না; যদিও একস্থানের সাম্প্রদায়িকতা আরেকস্থানে সাম্প্রদায়িকতাকে উষ্কে দিতে পারে। ভারত রাষ্ট্র হিসেবে ‘মুসলমান বিরোধিতা’ করছে বলে আমরা যদি এখানে ‘হিন্দু বিরোধিতা’ করতে যাই তাহলে আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। তাই, একমাত্র সবধর্মের ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতিই হতে পারে ভারতের ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে মোকাবেলা করার সবচেয়ে বড়ো উপায়।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল, যে জবাব দেয়ার কথা ছিল তা বাংলাদেশ রাষ্ট্র করতে ব্যার্থ। আসামের এনআরসির সময় এটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাশপাশি পানি-চুক্তি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বাংলাদেশ তার অধিকার আদায় করতে পারছে না, উল্টো দুই দেশের মধ্যে বৈষম্যমূলক বিভিন্ন চুক্তি হওয়ারও খবর আমরা পেয়ে থাকি। প্রধানমন্ত্রীর শেষ সফরের ‘শীতল’ খবরতো ভারতের মিডিয়াই বলেছে। তবু, বাংলাদেশে কর্তাব্যক্তিগন দাবি করেন, এই আমলে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হিমালয়ের চূড়া স্পর্শ করেছে। বৈষম্যমূলক চুক্তিকে ‘স্বামী-স্ত্রী’র মান-অভিমান বলে অবিহিত করেন।
আশংকার কথা হচ্ছে এই যে, ভারতের আধিপত্যবিরোধী যে মনোভাব এখানে জনগণের মধ্যে রয়েছে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার বৈষম্যমূলক চুক্তি ও ভারতের বর্ণবাদী নাগরিক আইনকানুন প্রণনয়ণ -এসবের কারণে সেই মনোভাব ‘সাম্প্রদায়িক’ দিকে মোড় নিতে পারে। নেয়ার মতো শর্ত তৈরি হচ্ছে ও হয়েছে। তাই, আমাদের বোধহয় সাবধান থাকা উচিৎ যে, এক ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে আরেক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির যেনো জন্ম না দেই।(কোনো সন্দেহ নেই, আমরা ইতোমধ্যেই ফ্যাসিস্ট রাজনীতির কবলেই আছি)। এক বর্ণবাদের মোকাবেলা করতে গিয়ে আরেক বর্ণবাদে উষ্কানি যেনো না দেই। সর্বোপরি একটা ‘ইনক্লুসিভ’ রাজনীতি ছাড়া বোধহয় আমাদের উপায় নেই।