- লেখক: মোহাম্মদ আজম
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স পঞ্চাশ বছর হতে চলেছে, এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স একশ। এটা হয়ত কাকতালীয় নয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পর বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্য অনেক কারণের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক তৎপরতাকে ওই রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কথাটা আক্ষরিক অর্থে কতকটা, আর প্রতীকী অর্থে প্রায় সম্পূর্ণত সত্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল ১৯১১ সালেই। ওই বছর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন শাসকরা রদ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিময়ে। এ কথার একটা তাৎপর্য এই যে, শাসনগত স্বাধিকারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিনিময়যোগ্য বলে কেবল এ অঞ্চলের অভিজাত সমাজই মনে করেনি, এমনকি ব্রিটিশরাও ব্যাপারটাকে অন্তত সম্ভব বলেই গণ্য করত। তার মানেই হল, রাষ্ট্র বলে যে ধারণা আধুনিক জমানায় কেবল পশ্চিমেই বিদ্যমান ছিল, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা তখন পশ্চিম থেকে চুঁইয়ে পড়ে কলকাতায় বেশ একটা আসর জমিয়ে বসেছে ঔপনিবেশিক শাসনের কেন্দ্রে, অন্তত ধারণা হিসাবে তখনকার পূর্ববঙ্গীয় এলিটের কাছে ওই দুটোরই আদর-কদর বেশ কতকটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর অবশ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানজাগতিক কর্তৃত্বের দিক থেকে দেখার বা রাষ্ট্রতন্ত্রের আভ্যন্তর-ব্যবস্থাপনার জ্ঞানগত উৎস হিসাবে দেখার লক্ষণ কখনোই খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। কিন্তু শ্রদ্ধা-সম্মানের ব্যাপারটা ছিল। প্রশ্ন হল, বিশ্ববিদ্যালয়কে শ্রদ্ধা-সম্মান দেখিয়ে খাতির করার এই কেতা আমাদের মুলুকে এল কোত্থেকে, যেখানে পুরানা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি সাংস্কৃতিকভাবেই বিলুপ্ত হয়েছে, আর নতুন সংস্কৃতিও পয়দা হয়নি?
নিশ্চয়ই ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গবাসী বিশ্ববিদ্যালয়কে শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখানোর আদবটা রপ্ত করেছে পশ্চিমাগত শ্রুতি আর কলকাতার বর্তমান থেকে। আর এক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমানে একটা পরিষ্কার ভাগাভাগি ছিল। সাতচল্লিশের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পর্যায়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি জনগণের ওই অংশের জন্য জ্ঞানগত আশ্রয় হয়ে ওঠেনি, যেমনটা হয়েছে মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য। তার কারণ, পূর্ব বাংলার হিন্দু সমাজের সক্ষম অংশের সাথে কলকাতার কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল বেশ আগেই, এবং সেসূত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের; আর ওই যোগাযোগের জ্ঞানগত মাত্রার সাথে সাংস্কৃতিক এবং এমনকি ধর্মীয় মাত্রার যোগও ছিল অতি প্রবল। ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর অংশবিশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে নানাভাবে যুক্ত থাকলেও তাদের চূড়ান্ত রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু অন্তত পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আশ্রয় করা ছাড়া বিশেষ গত্যন্তর ছিল না। ঢাকার বুদ্ধিবৃত্তিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রবল প্রতাপ সে কথারই সাক্ষ্য বহন করছে।
কিন্তু একথাও জোরের সাথেই উচ্চারিত হওয়া দরকার, পূর্ববঙ্গবাসীর সাথে, বিশেষত এখানকার মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক জ্ঞানতাত্ত্বিক ছিল না। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎপাদিত জ্ঞান কোনোভাবেই তাদের বাস্তবকে প্রভাবিত করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন এবং বিশেষত এখানকার শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের তৎপরতা মূল গুরুত্বটা পেয়েছিল। শিখা গোষ্ঠীর উদাহরণ পর্যালোচনা করলে কথাটার একটা কিনারা করা যাবে। মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রচলিত প্রভাবশালী মূল্যায়ন মেনে নিয়েও বলা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ্ধতিমাফিক জ্ঞান-উৎপাদনের সাথে এর প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক ছিল না। আবার এও বলা যাবে, ওই ধরনের তৎপরতা ওই বিশের দশকের ঢাকায় কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই হতে পারত, আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, কেবল সলিমুল্লাহ মুসলিম হলেই হতে পারত; আর কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকরাই তার কর্তাপক্ষ হিসাবে ভূমিকা পালন করতে পারতেন। সংশ্লিষ্ট বহুজন সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন না – এরকম প্রত্যক্ষবাদী নাবালেগ তথ্য আশা করি এখানে উত্থাপিত হবে না। তার কারণ কেবল এই নয় যে, মূল কর্তাপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছিল। এও নয় যে, আয়োজনটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। কারণটা বরং এই যে, ভাবগতভাবে সংশ্লিষ্টরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছিলেন। ‘পশ্চাৎপদ’ সমাজের বাইরে এ ছিল এমন এক মোক্ষধাম যেখানে নতুন চিন্তা ও মূল্যবোধ প্রচারিত হতে পারে।
সমাজের পশ্চাৎপদতা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হবে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সাথে যুক্ত বিখ্যাত বিচারকাহিনি পর্যালোচনা করলে। এই বিচারকাহিনিকে আমরা মিথ হিসাবেই বিবেচনা করব; মনে রাখব যে, ‘পুরান’ ঢাকার ‘সামন্তবাদী’ মুসলমান অভিজাতশ্রেণির বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের ‘প্রগতিশীলতা’কে স্থাপন করে লতায়-পাতায় বেড়ে ওঠা বিচারের গল্পটি একটি সুস্পষ্ট অতিকথন; আর এই কাহিনি শিখা গোষ্ঠীর তৎপরতার সামাজিক বনিয়াদটি আবশ্যিকভাবে গোপন করে, কিছুতেই জানতে দিতে চায় না যে, ওই সমাজের প্রভাবশালীদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একাংশ প্রত্যক্ষত মুসলিম সাহিত্য সমাজের তৎপরতায় নানাভাবে শরিক ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে ওই মিথকে আমরা গুরুত্বের সাথেই নেব এ কারণে যে, এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রগতি সম্পর্কে বাংলাদেশ অঞ্চলের মানুষের গড়পড়তা ধারণার জোরালো প্রতিফলন আছে। সে অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্নতার। সে অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন ও অভিজ্ঞতা থেকে প্রকল্প গ্রহণ করে আবার জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে দেয়ার স্বভাবটা রপ্ত করেনি। চর্চার বিষয়টা ছিল সবসময়েই বহিরাগত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আবহটাও ছিল সেরকম। ফলে সমাজের সাথে তার সম্পর্কটা ছিল প্রগতি ও পশ্চাৎপদতার বৈপরীত্যের। প্রধানত কৃষককুলের ছেলে-মেয়েরা পশ্চাৎপদ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষিত-নাগরিক ব্যক্তি হিসাবে পুনরুৎপাদিত হয়েছে। তাদের সেবাখাতের চাকরির নিশ্চয়তার জন্য দরকার ছিল এমন রাষ্ট্রকাঠামো, যার নিয়ন্ত্রণ শ্রেণি বা জনগোষ্ঠী হিসাবে তাদের নিজেদের হাতেই থাকবে।
এ ব্যাখ্যার সরল দিকটাকে আপাতত বেশি গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবিচ্ছিন্নতার একটা নির্ণায়ক সূত্র হিসাবে পাঠ করা যাক। বর্তমান রচনায় আমাদের মূল প্রস্তাব এই যে, প্রতিষ্ঠার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো ন্যূনতম শর্তের ক্ষেত্রেও যাবতীয় যোগ্যতা হারিয়েছে, এবং প্রতিষ্ঠার প্রায় একশ বছর পরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কোনো প্রকার স্বীকৃত কাঠামোর দোরগোড়ায় পা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে – এ দুইয়ের কারণ অনুসন্ধানের একটা চেষ্টা রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের আলাপ দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। এই আলাপে ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বর্গ দুটিকে এক ধরনের ‘আদর্শ’ হিসাবেই ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোকে কোনো সাধারণ বাস্তবের বিবরণী হিসাবে বোঝার চেয়ে বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতার সূত্রায়ণ হিসাবে দেখাই সঙ্গত হবে।
২
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎপরতা সম্পর্কে একটি পরিচিত উদাহরণ পেশ করা যাক। রবীন্দ্রনাথ একবার বানান সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিশ শতকের বিশের দশকে প্রধানত সাহিত্যে অ-সংস্কৃত বাংলা শব্দ ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হলে বানানের বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা ভাষার প্রধানতম সাহিত্যিক অভিভাবকই কেবল নন, ব্যাকরণগত চর্চার দিক থেকেও প্রধান অভিভাবক। পরে আর কখনো রচিত হবে না এমন অনেকগুলো ব্যাকরণিক সন্দর্ভ তিনি আগেই সম্পন্ন করেছিলেন। ভাষার ব্যবহারিক দিকেও তাঁর কড়া নজর ছিল। স্বভাবতই বানানের বিশৃঙ্খলা তাঁর নজরে ভালোভাবেই এসেছিল। তাঁর লোকবল এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা ছিল। তিনি বানান-সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদি বড় উদ্যোগ নিলেন। নীতিমালা প্রণীত হল। ব্যবহারকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য তিনি নীতিমালার পক্ষে নামিদামি ব্যক্তিদের সমর্থনও জোগাড় করলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ স্বীকৃত বিদ্বানগণ বিবৃতি দিয়ে জানালেন, এই নীতিমালা কেবল ভালো এবং উপকারীই নয়, বাংলা ভাষার ব্যবহারিক সৌন্দর্য সাধনের জন্য দরকারিও বটে। তদুপরি তাঁরা নিজেরাও এ বিধিপত্র মান্য করতে প্রস্তুত। কিছুতেই কিছু হল না। এই বানানবিধির পক্ষে কোনোপ্রকার জন-সাড়া পাওয়া গেল না।
রবীন্দ্রনাথ গড়পড়তা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তুলনায় অধিকতর বুদ্ধিমান এবং বাস্তববাদী ছিলেন। সমস্যা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। তিনি বুঝেছিলেন, কাজটা ব্যক্তির নয়। এমনকি সে ব্যক্তি যদি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হন, তবুও নয়। আবার তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মিলে যদি সমষ্টি হয়, তাতেও একাজ হওয়ার নয়। এজন্য প্রতিষ্ঠান দরকার। দরকার এমন অবজেক্টিভিটি, যা জনগণ ব্যক্তির প্রভাবমুক্ত পদ্ধতিগত উৎপাদন হিসাবে গ্রহণ করবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর বিলক্ষণ সদ্ভাব ছিল। তিনি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বানানবিধি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে বললেন। উপাচার্য মহোদয় – আন্দাজ করা দোষের নয় – বিগলিত হয়ে বলেছিলেন, আমি আর কী উদ্যোগ নেব, দায়িত্বটা আপনিই নিন। নিজে না থাকার মতো কাণ্ডজ্ঞান রবীন্দ্রনাথের ছিল। বেশ বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞজনের একটা কমিটি গঠিত হয়েছিল। পরের ইতিহাস আমাদের কমবেশি জানা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বানানবিধি বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রায় সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং আজতক বাংলাভাষীরা একটু উনিশ-বিশ করে যে কেতায় বানান লিখে থাকে, তা এভাবেই আলোয় এসেছিল।
বাংলা বানান প্রমিতায়নের এ উদাহরণকে বলা যায় ব্যক্তি বনাম প্রতিষ্ঠানের দ্বৈরথের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভিতরের লোকজনের কেউ কেউ পরে কায়দা করে জানিয়েছেন, শান্তিনিকেতনের পরিসরে আগে যে বানানবিধি প্রণীত হয়েছিল, তার নথিপত্রসমেত লোকজন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়ে কাজ করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানসমিতির হয়ে। আজতক যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানবিধির বিরোধিতা করেছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকে বলেছেন, এই কমিটি ছিল রবীন্দ্রনাথের পকেট কমিটি, আর এর মধ্য দিয়ে আসলে বানান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাবনাচিন্তাই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পেল। বানান কমিটিতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তি ছিলেন, যিনি পরে অনেকগুলো বিধির ব্যাপারে ভিন্নমত গ্রহণ করে ব্যক্তিগত চর্চায় সরে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় বানানবিধি থেকে। তার মানেই হল, ব্যক্তির মত গণগ্রাহ্য হওয়ার জন্য তার প্রাতিষ্ঠানিক কেতায় পুনরুৎপাদনের প্রয়োজন হয়, যেমনটা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে। আবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎপাদিত মতের সাথে ব্যক্তি পরে একমত নাও হতে পারে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক মতের বৈধতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না, যেমনটা হয়েছিল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। সত্যের খাতিরে এখানে অবশ্য একথাও জানিয়ে রাখা দরকার, বানানসমিতি ব্যাপকভাবে সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের মত নিয়েছিল; আর সেসব মতকে গ্রাহ্য করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত দুটি নতুন সংস্করণ প্রণয়ন করেছিল। প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবহারকারী সাধারণের যোগসাজশের উদাহরণ হিসাবে এ ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়।
আমরা এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কেতায় উৎপাদিত ‘মতে’র উদাহরণ হিসাবে-যে ভাষার প্রমিতায়নের কথা তুললাম, তার আরেকটি কারণ আছে। প্রমিত ভাষার ধারণা ও বাস্তবতাকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের একরকম তত্ত্বায়ন করা সম্ভব এবং রাষ্ট্র বোঝার জন্য ওই পদ্ধতি যথেষ্ট উপকারীও বটে। প্রমিত ভাষার ধারণা একটি নিপীড়ক ধারণা, এই অর্থে যে, জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের শব্দসম্ভার ও উচ্চারণভঙ্গিকে যথেষ্ট পাত্তা না দিয়েই ভাষার প্রমিতরূপ কার্যকর থাকে। এমনকি সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে এবং অন্তরঙ্গ বিনিময়ের দিক থেকেও ভাষার প্রমিত রূপ ক্ষতিকর; কারণ আনুষ্ঠানিক রূপ কৃত্রিম হতে বাধ্য। কিন্তু ভাষার এ ধরনের নিপীড়ক একটি রূপ আমাদের সামষ্টিক ব্যবহারের জন্য জরুরিও বটে। কারণ, শিক্ষা, আদালত বা অফিস চালানোর জন্য ভাষার এক ধরনের সর্বজনগ্রাহ্য রূপ না হলে চলে না। ব্যাপারটা অনেকটা রাষ্ট্রের মতো। ‘দেশ’ বা অঞ্চলের বিচিত্র স্বাতন্ত্র্য অন্তত অংশত জলাঞ্জলি দিয়েই মানুষ রাষ্ট্র গঠন করে। রাষ্ট্রকে শর্তসাপেক্ষ নিপীড়নের অধিকার দেয়। সামষ্টিক জীবনযাপনের বৃহত্তর কল্যাণের আশাতেই মানুষ রাষ্ট্রের নিপীড়ক ভূমিকায় সম্মতি প্রদান করে। এ কারণেই রাষ্ট্র ও প্রমিত ভাষা – দুই ক্ষেত্রেই যথাসম্ভব অধিকতর মানুষকে আঁটিয়ে নেয়া, যথাসম্ভব সংবেদনশীল থাকা এবং অংশগ্রহণমূলক হওয়া তুলনামূলক কল্যাণকর অবস্থার সম্ভাবনা নির্দেশ করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র-যে ওই কল্যাণকর অবস্থা থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করে, তার হরেক প্রমাণের একটি এই যে, এখানকার কর্তাব্যক্তিরা ভাষার প্রমিতায়নের প্রায় কোনো পর্বেই দেশবাসীর ভাষাস্বভাব ও উচ্চারণভঙ্গিকে গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবেনি। তারা সবসময়েই একটি ‘ভালো ভাষা’ শেখাতে চেয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদের মূল উৎস।
এতক্ষণ ধরে, একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে – দুটিকে যথাসম্ভব কাছাকাছি রেখে – আমরা যে আলাপ করলাম তার মূল লক্ষ্য ওই দুটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করা। একে বলতে পারি প্রাতিষ্ঠানিকতা। দুটিই প্রতিষ্ঠান; তা তাদের ধরন, স্বভাব এবং কর্মপ্রণালি যতই আলাদা হোক না কেন। তদুপরি আমরা দেখতে ও দেখাতে চাই, দুই প্রতিষ্ঠানের কিছু ভাবগত ঐক্য আছে, এবং পারস্পরিকতা আছে। ফলে একটি দিয়ে আরেকটিকে বোঝার চেষ্টা ফলদায়ক হতে পারে।
৩
প্রতিষ্ঠান কী? শাস্ত্রীয় সংজ্ঞায় কোনোরূপ বিতৃষ্ণা পোষণ না করেই একটা কেজো সংজ্ঞায়ন এভাবে করতে চাই: প্রতিষ্ঠান একটা বিমূর্ত কাঠামো যেখানে কর্মপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির বা ব্যক্তিসমূহের সাবজেক্টিভিটি বা ব্যক্তিগততা শমিত হয়ে নৈর্ব্যক্তিক অবজেক্টিভিটি বা বস্তুনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিবেচনার সবচেয়ে জটিল দিক হল, একের অধিক ব্যক্তি মিলে সিদ্ধান্ত নিলেই বস্তুনিষ্ঠা হাসিল হয় না। সামষ্টিকতার নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, এবং এটা সম্ভবত ব্যক্তিগততার চেয়ে ভালো; কিন্তু কেবল সামষ্টিকতা থেকেই বস্তুনিষ্ঠতার শর্ত পূরণ হয় না।
সমষ্টি দল, গ্রুপ বা শ্রেণি যে আকারেই হোক না কেন, তার সাথে প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিকতার মূল ফারাক হল, সমষ্টিকে ব্যক্তি পরিচালনা করতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিচালিত নয়। ব্যক্তি যতই গুণান্বিত হোক না কেন, যতই কুশলী এবং যোগ্য হোক না কেন, ব্যক্তির পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকতা ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। আমরা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে যে ব্যক্তিকে দেখি সে আসলে নিজের কথা বলে না, নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে না; তার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠান কথা বলে বা কাজ করে। আবার ব্যক্তির মধ্যে সমষ্টির ভাবস্বভাবের প্রতিফলন ঘটলেই অবজেক্টিভিটি প্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, ওই সমষ্টি কোনো গোষ্ঠী বা দলের মতো আচরণ করতে পারে, তা যতই বড় দল বা গোষ্ঠী হোক না কেন। তাছাড়া, ব্যক্তি নৈতিকতা বা দায়িত্বশীলতার জিম্মাদার হিসাবে কিছুতেই নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। কারণ, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব কোনো স্থির ধারণা নয়, আর তা মাপার কোনো পদ্ধতিও আদতে নেই। মানবেতিহাসে এই উদাহরণ এত বেশি যে, এ সম্পর্কে কথা না বাড়ানোই ভালো। হিটলার বা মুসোলিনি আমাদের দৈনন্দিন ভাষায় আলঙ্কারিক নাম মাত্র।
প্রতিষ্ঠান হিসাবে যদি রাষ্ট্রের কথা তুলি তাহলে বলতেই হবে, রাষ্ট্রের শিরোদেশে স্থিত ব্যক্তি আসলে ভাসমান বরফখণ্ডের চূড়া মাত্র। নিচের নব্বই ভাগ দখল করে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যার মধ্যে বিকীর্ণ ক্ষমতারাশি, প্রভাবশালী ডিসকোর্স এবং ভাবাদর্শিক অ্যাপারাটাসগুলো একত্রে ক্রিয়াশীল থাকে। এটা শুধু আধুনিক রাষ্ট্রের মামলা নয়; চিরকালই রাষ্ট্র বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান এভাবেই কাজ করে গেছে। কথাটার পক্ষে তিনটি সুপরিচিত উদাহরণ পেশ করা যাক। কলিঙ্গের যুদ্ধে ব্যাপক রক্তপাত দেখে সম্রাট অশোক অহিংসার বাণী গ্রহণ করেছিলেন বলে প্রচার আছে। ব্যাখ্যাটা অকাজের। আদতে শাসনাধীন জনগোষ্ঠী ব্যাপকহারে বুদ্ধের অনুসারী হয়ে যাওয়ার পর শাসক হিসাবে টিকে থাকার জন্য বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া অশোকের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল রোমান সম্রাটদের ক্ষেত্রে। সাম্রারাজ্যের অধীন জনগোষ্ঠীর খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে রোমান অভিজাতরা খ্রিস্টের শরণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তৃতীয় উদাহরণটি নিচ্ছি বিতর্কিত মোগল সম্রারাট ঔরংজিবের জীবন থেকে। ঔরংজিব ব্রিটিশ আমলের হিন্দু-মুসলমানকেন্দ্রিক ইতিহাসতত্ত্বের অধীনে চিত্রিত-চিহ্নিত হয়েছেন ভারতীয় ইতিহাসের রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে বড় খলনায়ক হিসাবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেই ইতিহাস খুব সামান্যই ব্যাখ্যা করতে পেরেছে যে, ঔরংজিব আসলে সমকালীন ভারতবর্ষের ভাবগত ও রাষ্ট্রনৈতিক মতগুলোর অন্তত একটির প্রতিনিধিমাত্র; এবং তিনি আলেমসমাজ এবং রাজন্যবর্গের সমর্থনের সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন। প্রচলিত ইতিহাস হয়ত কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারবে না, কেন তাদের নির্মিত ঔরংজিব এমনকি মারাঠা এবং রাজপুত শিবিরের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন পেয়েছিল।
তবু একথা বলা যাবে যে, পুরানা রাষ্ট্র বা অপরাপর কাঠামোগুলোতে ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বেশি থাকার মূল কারণ প্রভাবশালী ধ্যানধারণাগুলোকে শাসনকাঠামোর আওতার মধ্যে নিয়ে আসার পদ্ধতি মানুষের যথেষ্ট পরিমাণে জানা ছিল না। তখন রাষ্ট্রের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শাসিত হত আল্লাহর প্রতিনিধিদের হাতে, এ অর্থে যে, রাজারা মূলত নিজেদের কোনো না কোনোভাবে প্রতিনিধি হিসাবেই উপস্থাপন করতেন। আর জীবনযাপনের বিভিন্ন অংশে নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতিতে শাসনকারী কর্তৃপক্ষ হিসাবে এ ধরনের ধারণার তোষণ ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। ‘আধুনিকতা’ কী বস্তু তা নিয়ে এন্তার তর্ক আছে এবং থাকাই স্বাভাবিক; কিন্তু নিজেদেরকে পরিচালিত করার জন্য উপরওয়ালার বরাতের বদলে ইহলৌকিক বরাত ব্যবহারের প্রাধান্য যে আধুনিকতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। এ বরাত আগে আসত ব্যক্তি থেকে – আসলে ব্যক্তি থেকে নয়, কিন্তু ব্যক্তি দাবি করত, সে এই অধিকার বা বাণী পেয়েছে উপর থেকে। আজকালকার এই ব্যক্তি কেবল প্রাতিষ্ঠানিকতার মুখপত্র হিসাবেই আসতে পারে। কারণ, তার জন্য উপরওয়ালার সাথে সম্পর্ক দাবি করার কোনো সুযোগ আর অবশিষ্ট নাই। সেদিক থেকে বলা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাস ব্যক্তিতন্ত্রতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিকতা বা কাঠামোতন্ত্রে উত্তরণের ইতিহাস। আধুনিক রাষ্ট্রে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিশুদ্ধ আইনি সম্পর্ক। আইনের মূল বৈশিষ্ট্য এর নৈর্ব্যক্তিকতা; আর আইন বৈধ থাকতে পারে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই। কারণ, আইনের ব্যাখ্যা এবং ফাঁক থাকায় ব্যক্তির হাতে আইন কখনোই নিরাপদ থাকতে পারে না – ব্যক্তি সহজেই সেই ফাঁক গলে হারিয়ে যেতে পারে।
রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, রাষ্ট্র ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছায় – অন্তত সে চেষ্টা থাকাটা রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মধ্যেই পড়ে, কিন্তু রাষ্ট্র ব্যক্তিদের সমষ্টি নয়। রাষ্ট্র কাজ করে বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি বা গোষ্ঠী নিয়ে। সে এ কারণে নয় যে, ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছানো দুরূহ বা একপ্রকার অসম্ভব; বরং প্রধান কারণ হল, ব্যক্তিদের সাবজেক্টিভিটি আমলে এনে সামষ্টিক কাঠামো পরিচালনা করা সম্ভব নয়। যে কোনো ছোট ইউনিটে ব্যক্তিগততা শমিত হয়ে সামষ্টিক আকার পায়, আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার গড় তৈরি হয়, কোন আকাঙ্ক্ষাটা উপস্থাপনযোগ্য আর কোনটি নয় তার একটা যাচাই-বাছাই হয়। রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং কাজ করে বস্তুত এই গড়সমূহের গড় নিয়ে।
তার মানেই হল, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হল বিভিন্ন স্বার্থ ও মতের মধ্যকার সমঝোতা। এ সমঝোতা অর্জিত হতে পারে কেবল সংলাপের মধ্য দিয়ে। বস্তুত ‘আদর্শ’ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পরিচয় হবে – এটি একটি সংলাপমুখর প্রতিষ্ঠান। এ সংলাপ এক প্রাত্যহিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন স্বার্থ ও মত প্রতিনিয়তই নতুন বিন্যাস লাভ করবে। সেগুলোর সমঝোতা নিশ্চিত করে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের কল্যাণকরতা আর বৈধতা অব্যাহত থাকতে পারে কেবল অব্যাহত সংলাপের মধ্য দিয়েই।
৪
বিশ্ববিদ্যালয়-যে প্রতিষ্ঠান তা খালি চোখেই দেখা যায়, আর তুলনামূলক কম পরিশ্রমে বোঝা যায়। তবে প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাষ্ট্রের সাথে এর আসলে কোনো তুলনা হয় না। রাষ্ট্র আকারে বড়, প্রকারে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত, আর গঠনের দিক থেকে আসলে ছোট-বড় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি। বিশ্ববিদ্যালয় সে তুলনায় ক্ষুদ্র, উন্নাসিক এবং প্রায়শই জনবিচ্ছিন্ন। তবে রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গভীর মিল আছে দুই জায়গায় – দুটিই সংলাপমুখর এবং নৈর্ব্যক্তিক।
বিশ্ববিদ্যালয় উদার এবং গ্রহিষ্ণু হবে এবং ব্যক্তি-শিক্ষার্থীকে আলাদা করে মূল্য দিতে পারবে, আমাদের আকাঙ্ক্ষা হিসাবে এটা হয়ত ঠিকই আছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ব্যক্তিবিশেষের মতের এই কদরটা করতে পারে না। যার মত পড়ানো হবে তার তরফেও নয়, যে পড়বে তার দিক থেকেও নয়। সরল করে বললে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার অর্থ দাঁড়ায় : যে বিষয়টি পড়ছি তার সাথে যুক্ত [অন্তত] প্রভাবশালী মতগুলোর সাথে পরিচয়, এবং সে মতগুলোর উৎপাদনপদ্ধতির সাথে পরিচয় – কিছুতেই নিজের মত উৎপাদন নয়। ‘তোমার মত কী?’-ধরনের প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নাজায়েজ না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎপর্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই যে বহুমতের সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেগুলো পরিপ্রেক্ষিতসহ উপস্থাপন করতে পারা, এর বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অপরিসীম। এটি বিকল্পের ধারণা দৃঢ়মূল করে মৌলবাদকে নিরুৎসাহিত করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা নিশ্চিত করে। বহুমতের সহাবস্থান ভাবতে অভ্যস্ত করে যে, সমাধান কোনো একক মতে নেই, বরং আছে বহুমতের পর্যালোচনায়। কিন্তু যে ব্যক্তি এ ধরনের পর্যালোচনায় অভিজ্ঞ, তার পক্ষে উপস্থিত সমস্যার মীমাংসা করা খুবই সম্ভব। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দিক থেকে বহুমতের সহাবস্থানের তাৎপর্য এই যে, বহুমতের সংলাপের মধ্য দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন সহজতর হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর এবং তৎপরবর্তী পর্যায়ের পড়াশোনা মূলত গবেষণা-নির্ভর; আর গবেষণা পদ্ধতিগতভাবেই সংলাপধর্মী এবং প্রাতিষ্ঠানিক। গবেষণায় আমরা পূর্ববর্তী মতের সাথে সংলাপে রত হই, আর সম্ভাব্য পরবর্তী মতের সাথে সংলাপের জন্য প্রস্তুত থাকি। উদ্ধৃতি ওই সংলাপের আনুষ্ঠানিক চিহ্ন মাত্র। যে কোনো থিসিস বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎপাদিত হয় একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সেখানে দশের সম্মতির প্রয়োজন হয়; দশের সাথে বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ব্যক্তিগত কেতাব বা গবেষণার সাথে এ প্রক্রিয়ার এন্তার ফারাক আছে। ব্যক্তিগত কাজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতেও পারে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানদান ও জ্ঞান-উৎপাদনের ভিত্তি। ফলত, এটি রাষ্ট্রের মতোই সংলাপমুখর এবং নৈর্ব্যক্তিক।
৫
রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় দরকার হয়। রাষ্ট্র চালানোর জন্য দরকার দক্ষ লোকবল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এ ধরনের জনবল আর কোথায় পাওয়া যাবে? মানুষ সামষ্টিকভাবে ভালো থাকার জন্য আজ পর্যন্ত যত রকম ব্যবস্থাপনাগত পদ্ধতির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, রাষ্ট্র হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে আভিজাত্যের এবং সর্বোত্তম কুশলতার যোগ অতি নিবিড়। এ দুইয়ের জোগান একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই মিলতে পারে। কোনো বিষয়ে কুশলী হওয়া বলতে কী বোঝায়? বোঝায় ওই বিষয়ের পরিভাষা ও কলাকৌশল রপ্ত করা এবং ওই বিষয়ের ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা। কৌশল রপ্ত করার পর গ্র্যাজুয়েটরা প্রবেশ করবে কর্মক্ষেত্রে। ছড়িয়ে পড়বে বৃহৎ সমাজের প্রাত্যহিক জীবনে। এদের কুশলতা প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগবে রাষ্ট্রের। কিন্তু এই প্রত্যক্ষতার বাইরে পরোক্ষ আরেকটি দিক আছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য আরো বেশি দরকারি। এই তরুণ-তরুণীরা ছড়িয়ে পড়বে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। সাথে থাকবে তাদের অর্জিত পাঠ-সংস্কৃতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা আগেই বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিষয়ে পড়া মানে আসলে সংশ্লিষ্ট মতগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া, লিপ্ত হওয়া। বিভিন্ন মতের সহাবস্থান নিয়ে বিদ্যমান থাকার নামই আসলে গণতান্ত্রিক হওয়া। গণতন্ত্রের গভীরতর দার্শনিকতা তো আসলে ভিন্নমতের উপস্থিতি এবং ন্যায্যতা সম্পর্কিত সচেতনতা। এই সংস্কৃতি একমাত্র সেই সমাজেই সম্ভব, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনযাপনকারী জনগোষ্ঠীর একটা প্রতাপ আছে। এ মন্তব্য চরমপন্থি মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য এই যে, রাষ্ট্র মাত্রই গণতান্ত্রিক আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চাগত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর প্রতাপ নেই এমন জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র কিছুতেই সফল হতে পারে না।
স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অন্য ছোট একটি অংশ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রবেশ করবে নতুন জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়। এ অংশটিও রাষ্ট্রের জন্য জরুরি। একটু বেশিই জরুরি। কারণ তারা রাষ্ট্রের বা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের নিরিখে নানা প্রকল্প তৈরি করে, সে প্রকল্প সম্পাদনের জন্য পদ্ধতিমাফিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি উৎপাদন করে। যে কোনো সচল রাষ্ট্রই আসলে এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজে খাটায়।
কিন্তু কাজে খাটানোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে রাষ্ট্রের বড় সম্পর্ক নয়। মূল ব্যাপার হল, বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফতোয়া তৈরি করে। ফতোয়াটা রাষ্ট্রের জন্য দরকার। রাষ্ট্র প্রত্যক্ষত পরিচালনা করে সরকার। যাকে আমরা বিরোধীদল বলি, তাও আসলে একই ক্ষমতাকাঠামোর অংশ। এই প্রত্যক্ষ ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে রাষ্ট্রের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আছে আরো বহু ক্ষমতাপ্রয়োগকারী পক্ষ। ক্ষমতার সাথে নিপীড়নের প্রত্যক্ষ যোগ আছে। নিপীড়নের ব্যাপারে সম্মতি উৎপাদিত না হলে ক্ষমতাপ্রয়োগ ব্যর্থ হতে বাধ্য। তদুপরি, কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকাঠামো থেকে শুরু করে প্রান্ত পর্যন্ত সকল পক্ষকে নানা ধরনের উদ্যোগ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ভবিষ্যতের জন্য নানা প্রকল্প নিতে হয়। এসব প্রকল্পে সম্মতি আদায় করার জন্য এবং নিপীড়নে সম্মতি আদায়ের জন্য দরকার হয় বরাত। পুরাকালে এই বরাত আসত ধর্মীয় পক্ষগুলোর হাত ধরে। বর্তমানের সেক্যুলার জমানায় এই ফতোয়া আসবে সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইতিহাস-ঐতিহ্য-আভিজাত্যের কারণে এবং পদ্ধতিমাফিক জ্ঞান-উৎপাদনের নজিরের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল সে ধরনের ফতোয়ার জোগান দিতে পারে যার বরাতে রাষ্ট্র জনগোষ্ঠীকে বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে আশ্বস্ত করতে পারে। নাসার প্রকল্প, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, ব্রিটিশ ভারতের প্রাচ্যবাদ এবং পরবর্তীকালীন জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়েই ওই আস্থা উৎপাদন করতে পারে, রাষ্ট্রীয় স্থিতির জন্য যে আস্থা জরুরি। বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় আসলে তৈরি করে রাষ্ট্রের জন্য দরকারি ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রীয় উপচার, যা না হলে রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য হয়।
৬
এই আলোচনায় আমরা রাষ্ট্রের নিপীড়ক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোনো আলাপ তুলছি না। দুনিয়ার প্রভাবশালী এবং কার্যকর রাষ্ট্রগুলো নিজ সীমানায় বসবাসকারী জনগণের একাংশকে কিংবা ভিন্ন মতাবলম্বীদের যেভাবে নস্যাৎ করে, সে উদাহরণগুলোও আমরা এখানে আমলে আনব না। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক চর্চার নানামাত্রিক সীমাবদ্ধতাকেও আমরা এখানে মুলতুবি রাখব। কারণ, আমরা রাষ্ট্র গড়তে ব্যর্থ হয়েছি, আর পশ্চিমা অর্থে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ও আমরা তৈরি করতে পারিনি। দুই ক্ষেত্রেই, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তেমনি, প্রতিষ্ঠান অকার্যকর হলেই তার নিপীড়নকারী এবং অপরাপর সীমাবদ্ধতা অধিকতর প্রকট হয়।
বাংলাদেশের জনসংস্কৃতিতেও প্রাতিষ্ঠানিকতার কোনো মহিমা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানই এখানে কাজ করছে না, বরং সর্বত্রই ব্যক্তির একচ্ছত্র প্রতাপ। লক্ষণ দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের ভদ্রলোকসমাজও এই ব্যক্তিতন্ত্রের বিপদ সম্পর্কে সচেতন নয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জিয়া হায়দার রহমান পুরস্কৃত হওয়ার পর ঢাকায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করতে গিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা বলেছিলেন। তিনি টিআইবির পক্ষ হয়ে কাজ করার জন্য আগে নয় মাস ঢাকায় ছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পরে দুটি সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করেছিলেন। এক. ঢাকায় লোকে কী বলে সেদিকে কেউ নজর দেয় না, নজরটা পড়ে কে বলছে তার দিকে। দুই. এখানে ব্যক্তির অধীনে ব্যক্তি কাজ করে, কাঠামোর অংশ হিসাবে কাঠামোর অধীনে নয়। কথাসাহিত্যিক হওয়ার বাড়তি অন্তর্দৃষ্টিজনিত সুবিধা জিয়া রহমান নিশ্চয়ই পেয়েছেন। তাছাড়া অন্য দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হয়েছেন বলে তিনি খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাপারগুলো শনাক্ত করতে পেরেছেন, যা আমরা এর মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করা মানুষেরা হয়ত সারা জীবনেই বুঝতে পারি না। কারণ যাই হোক, জিয়া হায়দার রহমান তাঁর ওই দুই মন্তব্যে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সবচেয়ে গভীর দুই রোগ শনাক্ত করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। তুলনামূলক ছোট প্রতিষ্ঠান থেকে একে যদি রাষ্ট্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা যায় তাহলে বাংলাদেশের সার্বিক চিত্রটা পাওয়া যাবে।
এ জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রের ব্যাপারে আকাঙ্ক্ষাটা অবশ্য আছে। তার প্রধান কারণ এই যে, রাষ্ট্রই আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং কার্যকর অস্তিত্ব। আমাদের প্রাত্যহিকতা এবং কল্পনার ভবিষ্যত রাষ্ট্রের উপরই নির্ভরশীল। ঐতিহাসিকভাবে এই জনগোষ্ঠী নিজেদের রাষ্ট্রের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে প্রাণপণ করেছিল এক ব্যাপক মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠান হিসাবে বা প্রতিষ্ঠানসমূহের সমষ্টি হিসাবে রাষ্ট্র গড়ে তোলার কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য উদ্যোগ আসলে আমরা গ্রহণ করিনি। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য আবেগ দেখিয়ে এবং ব্যক্তিদের হাতে নিজেদের ভাগ্য সমর্পণ করে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সমঝোতাও আসলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাষ্ট্র চলে বহিরাগত ফতোয়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎপাদিত ফতোয়ায় নয়। যে কথা একেবারে শুরুতেই বলেছিলাম, সে কথাটা আরেকবার স্মরণ করা যাক। আমরা রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল্যবান ভেবেছি পশ্চিমের অনুকরণে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানগতভাবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে আমাদের যোগ নিবিড় করেনি, বরং বিচ্ছিন্ন করেছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিমাগত জ্ঞান আমাদের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে মূলত অলঙ্কার হিসাবে। ফলে জনবিচ্ছিন্ন শ্রেণি হিসাবে আমরা যখন নিজেদের রাষ্ট্র চেয়েছি, তখন তাতেও জনমুখী কোনো লক্ষ্য প্রধান হয়ে ওঠেনি।
বাস্তবে শাসকশ্রেণির স্বৈরাচার আর স্বাধিকারজনিত অহমিকার বাইরে রাষ্ট্রের যদি গণকল্যাণমূলক কোনো ভূমিকা থেকেই থাকে তবে তা এই যে, রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রভুক্ত পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা যায় এবং খালি চোখে অব্যবহিত লাভ হিসাবে দেখা যায় না এমন সুদূরপ্রসারী প্রকল্প হাতে নেয়া যায়। জনবিচ্ছিন্নতার কারণে প্রথম দিকটির প্রতি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের খুব একটা মনোযোগ দেখা যায়নি। দ্বিতীয়টি যে হয়নি, তার এক প্রমাণ এই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে শিক্ষায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেনি। শিক্ষাই ওই ধরনের প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী যেগুলোর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। এ দুই ধরনের প্রকল্পই কার্যকরভাবে আসতে পারে কেবল বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে এই স্থানটা দখল করেছে ডোনার এজেন্সিগুলো; আর এর ফল আমরা নিত্যই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে যাচ্ছি।
৭
কিন্তু দেশের আর্থিক অবস্থার কিছু বদল হয়েছে। দেশে ও বিদেশে দরিদ্র মানুষের শ্রম বিক্রি করে এবং আইটি সেক্টরে ভাড়া খেটে বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের প্রায় কোনোরকম সহায়তা ছাড়াই, ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধ মোকাবেলা করে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার ভরাট করে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে এমন উদ্যোগ নেয়া খুবই সম্ভব হয়ে উঠেছে, যা বৃহৎ মানুষের জীবনযাপনে দ্রুত বৈপ্লবিক বদল আনতে পারে। আমাদের প্রস্তাব, এ কাজ শুরু করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কারণ, রাষ্ট্রের অন্য অংশগুলো বহু মানুষের অব্যবহিত স্বার্থের সাথে যুক্ত। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ নিয়ে, যেখানে সংশ্লিষ্ট লোকজনের অব্যবহিত স্বার্থের বিঘ্ন ঘটানোর সম্ভাবনা কম। নিচে শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাপেক্ষে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনায় কার্যকর পরিবর্তনের লক্ষ্যে কিছু প্রাথমিক প্রস্তাব উত্থাপন করা হল।
এক অর্থে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সম্পদ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বদল আসলে এই ছাত্রছাত্রীদের সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের বদল। এ ব্যাপারে বড় উদ্যোগ দরকার।
ক. বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের সমস্ত ক্লাস চল্লিশ জনের মধ্যে সীমিত রাখা জরুরি। একমাত্র এই আকারের [বা এর চেয়ে ছোট] শ্রেণিকক্ষেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দিয়ে পড়ানো সম্ভব।
খ. বিভাগওয়ারি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। সরাসরি বাজারের চাহিদার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোনো বিষয়েই এক ইউনিট অর্থাৎ চল্লিশ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। অন্যদিকে দেশীয় ও বিশ্ববাজারের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন বিভাগগুলোতে একাধিক ইউনিট [দুই, তিন, চার বা তারো বেশি] খোলা যেতে পারে। গড়ে তিনটি করে কোর্স পড়ালে শিক্ষকের সংখ্যা খুব বাড়াতে হওয়ার কোনো কারণ নাই।
গ. চাহিদার সাথে দূরবর্তী সম্পর্কও নাই এমন বিভাগগুলোতে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী ভর্তি না করানোই ভালো। এগুলো অন্য বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের স্ট্রিম হিসাবে চালু থাকা উচিত। আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত বিভাগের একই গড়ন কেবল শিক্ষকদের চাকরি বাঁচানোর জন্য বজায় রাখা এবং ব্যক্তি-শিক্ষকের আগ্রহে নতুন বিভাগ চালু করা ন্যাক্কারজনক চর্চা, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুদিন ধরে চলছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার।
ঘ. বিদ্যমান বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলা উচিত একটি দ্বিভাষিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পড়বে এবং পরীক্ষা দেবে। প্রত্যেক বিভাগের কোর্সগুলো এভাবে বণ্টিত হওয়া উচিত। শুধু ইংরেজি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞান-অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। শুধু বাংলা জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব এবং বাজারের চাহিদার দিক থেকে অপ্রতুল গণ্য হবে।
ঙ. কুশলী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের অন্তত তিনটি ভাষা শেখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা দরকার। বাংলা, ইংরেজি এবং আইটি। এজন্য আলাদা ইনস্টিটিউট খুলে পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং কাঠামোর ব্যবস্থা করা দরকার, যেন যে কোনো শিক্ষার্থী এর সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রয়োজনে আবশ্যিক বা আধা-আবশ্যিক কোর্স হিসাবে এগুলো সব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে, যেগুলো শিক্ষার্থীরা সম্পন্ন করবে ওই ওই ইনস্টিটিউটে।
চ. বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলোকে উপযোগী করে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে।
স্নাতকোত্তর পর্বের জন্য ভালো হয়, যদি এম এ শ্রেণির ডিগ্রি কেবল নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ হিসাবে বিদ্যমান থাকে। যদি সামাজিক চাহিদার কারণে তা করা সম্ভব নাও হয়, ডিগ্রিটির রূপ বদল করা জরুরি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আসলে একটা প্রলম্বিত স্নাতক ডিগ্রি মাত্র। কোর্স-পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে এবং গবেষণা-সংশ্লিষ্টতা বাড়িয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিকে দুনিয়ার অন্য জায়গার মতো ঢেলে সাজানো দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের এবং বাইরের শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ তৈরি করা আবশ্যিক।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা গবেষণা ও উচ্চডিগ্রি। এখানকার গবেষণা সংখ্যায় কম এবং মানের দিক থেকে অনুল্লেখ্য। এ অবস্থার নিরসন সহজ নয়। প্রায় যাবতীয় পরিস্থিতিই প্রতিকূল। অথচ এ অবস্থার অবসান না হলে বিশ্ববিদ্যালয় কিছুতেই ওই আভিজাত্য হাসিল করতে পারে না, যা একটা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকরভাবে ভূমিকা পালনের জন্য জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান গবেষণা-কার্যক্রম সহসা বদলে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ বহুলোকের জীবন-জীবিকা-রাজনীতি এবং আধিপত্যের সাথে তা যুক্ত। তবে একটা কাজ করা সম্ভব, যা বিদ্যমান কাঠামোকে সরাসরি স্পর্শ করবে না, কিন্তু পুরো পরিস্থিতিতেই আমূল বদল ঘটাবে। সেটা হল, একটা সম্পূর্ণ পূর্ণকালীন পিএইচ ডি প্রোগ্রাম চালু করা। ডিপার্টমেন্টভিত্তিক নয় কিছুতেই – অনুষদভিত্তিক। প্রাথমিক পরিকল্পনাটা হতে পারে এরকম :
১। প্রতি বছর একশ জন করে তিন বছরে মোট তিনশ জনকে ভর্তি করা হবে। তিন বছরের মধ্যেই প্রথম ব্যাচ ডিগ্রি শেষ করবে। ২। ভর্তিকৃতরা সপরিবার আবাসিক সুবিধা পাবে [ইন্টারন্যাশনাল হলের মতো নতুন একটি হলই যথেষ্ট]। ৩। নতুন চাকরিতে যে ধরনের বেতন দেয়া হয় [সরকারি, প্রথম শ্রেণি], সে পরিমাণ বৃত্তি বরাদ্দ করা হবে। ৪। দেখভাল করবে: ক) সারাদেশের গবেষক-শিক্ষকদের একটা দল; খ) বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশে কর্মরত গবেষক-শিক্ষকদের একটা দল; গ) বিদেশি গবেষক-শিক্ষকদের একটা দল। এঁদের নিযুক্ত করার জন্য বছরে দুইবারে দুই মাসের বেতন, দুই মাসের আবাসন আর যাতায়াত খরচ বহন করাই যথেষ্ট।
এ ধরনের একটি পরিকল্পনাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন যুগে প্রবেশ করাতে পারে।
৮
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমূল সংস্কারের প্রস্তাব আমরা এখানে করলাম, তার আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ কিন্তু বস্তুত সবচেয়ে জরুরি বদল ঘটাবে শিক্ষার মাধ্যমের ব্যাপারে একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষার মাধ্যম হবে প্রথমত এবং প্রধানত বাংলা, এবং আবশ্যিকভাবে দ্বিতীয়ত ইংরেজি। এর বাইরে আইটির ভাষাকেও আবশ্যিক ভাষা হিসাবে গণ্য করতে হবে শিক্ষার সকল স্তরেই। উচ্চশিক্ষা নিজের ভাষায় করা আর না করার মধ্যে ফারাক দেখতে পাব পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভারতের জনগোষ্ঠীর ফারাক লক্ষ্য করলেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-প্রকল্প যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রকল্প হিসাবেই এখানে হাজির করছি, সেহেতু মাধ্যমের আলাপটা অন্য যে কোনো আলাপের চেয়ে জরুরি।
যে পরিবর্তন-প্রস্তাব আমরা এখানে আনলাম, তা খুবই সম্ভব। অনেকের আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও এ বস্তু আছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটবে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে, আশা করা যায়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্র হয়ে ওঠায়।
- প্রকাশিত হয়েছে ত্রৈমাসিক সাম্প্রতিক দেশকাল; মার্চ ২০২০