- লেখক:অর্জুন আপ্পাদুরাই, ভাষান্তর: সারোয়ার তুষার
[অর্জুন আপ্পাদুরাই(Arjun Appadurai) ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক গতিপ্রবাহ নিয়ে কাজে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন। জন সংস্কৃতি নামের একাডেমিক জার্নালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। American Academy of Arts and Sciences-এর ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন ১৯৯৭ সনে। বিশ্বায়ন অধ্যয়নে গুরুত্বপূর্ণ এই তাত্ত্বিকের “We are witnessing the revolt of the elites” শীর্ষক একটি লেখা ‘The Wire’ নামের ইন্ডিয়ান অনলাইন পোর্টালে গত ২২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই নিবন্ধের অনুবাদ করেছেন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট সারোয়ার তুষার। মূল প্রবন্ধের পরে অনুবাদকের মন্তব্যও যুক্ত করা হয়েছে। ]
নব্য এলিটদের গণতন্ত্রবিরোধী অভ্যুত্থান, ‘গনতন্ত্রের’ই নামে…
হোসে ওর্তেগা ওয়াই গ্যাসেট (Jose Ortega y Gasset) ছিলেন বিশ শতকের বিস্মৃতপ্রায় অপ্রথাগত স্পেনীয় চিন্তক ও দার্শনিক, যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাজ বিজ্ঞানের কাজ জনতার উত্থান(১৯৩০)। উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন ইন্ডিভিজুয়ালের ক্রমশ উধাও হতে থাকা এবং ‘উন্মত্ত জনতা’র আবিভার্ব তাকে উদ্বিগ্ন করেছিল।
ওর্তেগার ‘আম-জনতা’র ধারণা গরীব, নিঃস্ব কিংবা সর্বহারা জনগোষ্ঠীর নয়, বরং একই অভিরুচি, মূল্যবোধ, স্বভাব-চরিত্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা গড়পড়তা সাধারণ মানুষের চিত্র। এইভাবে, ওর্তেগা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের গণ-সমাজের সমালোচনার চেয়েও বেশি সাম্প্রতিক মার্কিনী সমালোচকদের কাছাকাছি ছিলেন। তবুও, উনিশ শতকের উদার আদর্শের বিপরীতে উন্মত্ত জনতার উত্থানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে (সেই ব্যাখ্যা যেমনই হোক) ওর্তেগা শুরুর দিককার কন্ঠই ছিলেন।
আমি এখন ওর্তেগায় ফিরে আসলাম কারণ আমি মনে করি নানা কিসিমের গণজাগরণেই বিশ শতক নিঃশেষ হয়েছে এবং আমরা ‘নব্য এলিটদের উত্থান’-এর এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এই উদীয়মান এলিটরাই নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, এরদোগান, জেইর বলসোনারো, বরিস জনসন, ভিক্টর ওর্বান এবং এমন আরো বহু নব্য স্বৈরাচারদের আবরণ হিসেবে কাজ করে। তাঁদের সমর্থন আর তোষামোদ করে। তাঁদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। নরেন্দ্র মোদী’সহ যেসব নব্য স্বৈরাচারদের নাম উল্লেখ করলাম, এরা এইসব নব্য এলিটদের উপর ভর করে এমন এক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উপর থেকে আরোপিত লোকরঞ্জনবাদ (populism)’। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমজনতা কেবল গণতন্ত্র থেকে ব্যাপকমাত্রায় নিষ্ক্রমণের উপকরণ মাত্র।
এইসব নতুন স্বৈরাচারী এলিটদের আচরণকে লুন্ঠনজীবী পুঁজিবাদ, পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কপ্রণালীর নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদের নতুন ছদ্মবেশ, দুর্যোগ পুঁজিবাদ না বলে ‘অভ্যুত্থান’ বলছি কেন? এই নব্য এলিটরা কারা? তাদের অভ্যুত্থানটাই বা কিসের বিরুদ্ধে?
প্রথমত, তাঁদের এই উত্থান অন্য সমস্ত এলিটদের বিরুদ্ধে, যাদের তাঁরা হেয়, ঘৃণা ও ভয় করেঃ উদারনীতিবাদী এলিট, মিডিয়া এলিট, সেক্যুলার এলিট, কসমোপলিটান এলিট, “হার্ভার্ড” এলিট, ঝানু অর্থনৈতিক এলিট, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদ। সুতরাং, ‘অ্যান্টি-এলিট’ ডিসকোর্সের ছদ্মবেশে এটা আসলে নতুন এক এলিটিজম।
দ্বিতীয়ত, এই উত্থান তাঁদের বিরুদ্ধে যারা মনে করে প্রকৃত এলিটদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছেঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা, ভারতে মুসলিম আর সেক্যুলারপন্থীরা, ব্রাজিলে বামপন্থী ও এলজিবিটি সম্প্রদায়, রাশিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বী, এনজিও এবং সাংবাদিক, তুরস্কে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংখ্যালঘু, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নবাদীরা। এই প্রতি-অভ্যুত্থান তাঁদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে যারা মনে করে ‘দখলদার’ কিংবা ‘ভুয়া’ এলিটদের বিপরীতে তাঁরাই ‘প্রকৃত’ এলিট।
তৃতীয়ত, নব্য এলিটদের এই প্রতি-উত্থান লিবারেল গণতন্ত্রের যুগে নির্ণীত মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। কেবলমাত্র নিজেদের জন্য ব্যতিরেকে তাঁরা স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বকে স্রেফ ঘৃণা করে। কোন রকম বাধা ছাড়াই যা খুশি করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যকে(চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাঁরা ‘অবৈধ’ জ্ঞান করে। তাঁরা যে কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণকে ঘৃণা করে, বিশেষত কর্পোরেট সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে; কারণ তাঁরা একে মনে করে তাঁদের নিজস্ব এখতিয়ারের ক্ষেত্র পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। সর্বোপরি, তাঁরা বিবেচনা এবং পদ্ধতিগত যুক্তিবোধকে ঘৃণা করে। কারণ এগুলো অন্যের বক্তব্য শোনা, ধৈর্য এবং সম্মিলিত যুক্তিবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। কেবলমাত্র তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমমনাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, এমনকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও তাঁদের আস্থা নাই।
তার মানে, একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, নব্য এলিটদের এই প্রতি-অভ্যুত্থান আসলে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই, কিন্তু এক্ষেত্রে মোচড় বা টুইস্ট হলো এই প্রতি-অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছে জনতার নামে। অন্যভাবে বলতে গেলে, আধুনিককালের ‘জনতা’র ধারণা ‘গণ’ (demos) এবং গণতন্ত্র ধারণা থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে। এটি একটি অভ্যুত্থান—এই অর্থে যে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে উত্থান বরাবরই অভ্যুত্থান—আবশ্যিকভাবে বিপ্লব নয়। বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হওয়া। অন্যদিকে, এই অভ্যুত্থান কেবল এক এলিটের জায়গায় আরেক এলিটকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা।
উল্লেখিত সব কথাই মারাত্মকভাবে সরলীকরণের দোষে দুষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত মনে হবে যদি আমরা কিছু সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্নের পর্যালোচনা না করি। এই নতুন এলিটদের প্রকৃতি কী? তাদের আবির্ভাবের শর্তগুলো কারা ব্যাখ্যা করে? কে এদের পক্ষে কথা বলে? এদের সামাজিক শেকড় কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সামনে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্রকে হাজির করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, ট্রাম্প যে এলিটদের পক্ষে কথা বলেন এবং নিজে যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, তারা কেউই খুব বেশি শিক্ষিত নয়। তারা সেলফোন উদ্যোক্তা কিংবা রাজনীতিবিদ, রিপাবলিকান সিনেটের শাসক, হাউজের রিপাবলিকান অংশ, চায়ের পার্টি কিংবা রাজিনীতির প্রত্যেক স্তরেই উটকো, অনাহুত লোকজন। এছাড়াও, এই তালিকায় আরো রয়েছে ক্ষমতার বিমারে বিকারগ্রস্ত সিইও(CEO, যেমন পিটার থিয়েলের মতো সিলিকন ভ্যালি আইকন) , টেলিভিশন ও রেডিও মিডিয়ার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এবং বর্ণবাদী ও লোভী ধর্মপ্রচারক যাজক, গীর্জা এবং দাতাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এর সাথে যোগ করুন ডানপন্থী থিংক ট্যাঙ্কের ক্যারিয়ারবাদী ভাড়াটে লেখকদেরও। কোনও সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক শিকড় ছাড়াই এলিটদের এই নেটওয়ার্কের একেবারে গভীরে কাজ করছে ফেডারেল সোসাইটির ওপাস দেই’য়ের(Opus Dei) মতো ট্রান্সন্যাশনাল গ্রুপগুলোর গোপন নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কগুলো হলো সুবিধাবাদ, লোভ এবং মুনাফাগন্ধীর নেটওয়ার্ক, যাদের কোন ঐতিহ্যগত বন্ধন কিংবা মূল্যবোধের বালাই নেই।
ভারতের বর্তমান রেজিমের এলিটদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র আঁকা যেতে পারে, কেবলমাত্র নির্বাচন ছাড়া তাঁরা বাদবাকি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই চরম ঘৃণা পোষণ করে। এটি অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ, ক্যারিয়ার জোচ্চোর, একচেটিয়া কায়-কারবার, তদবির ও খুল্লামখুল্লা দুর্নীতির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করা লুন্ঠনজীবী ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং নির্লজ্জ অপরাধী রাজনীতিবিদ ও আইনপ্রণেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। এদের প্রতি-অভ্যুত্থান নেহরুবাদী সমাজতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ও বহুত্ববাদে বিশ্বাসী যেকোন ব্যক্তি কিংবা গ্রুপের বিরুদ্ধে।
এটি নব্য এলিটদের এমন এক সংঘ যারা মনে করে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরাই ভারতীয় ইতিহাসের একমাত্র ত্রাতা এবং এই তথাকথিত ‘ত্রাতা’রা মোঘল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল এবং কংগ্রেসের দীর্ঘশাসনের পর নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠেছে। এই জোট ভয়াবহভাবে মুসলিমবিদ্বেষী মতাদর্শ, নীতিনির্ধারণ ও গণহত্যা সংঘটনের ক্ষেত্রে নিজেদের অত্যন্ত কার্যকর শক্তি মনে করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়মুক্তি ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে এই নব উত্থিত এলিটদের মধ্যে কোন শ্রেণীগত ঐক্যও নেই। ট্রাম্পের এলিট অংশীদারদের মতোই এই ভারতীয় এলিট সম্প্রদায়ও সুবিধাবাদ আর সক্রিয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নিদারুণ অবজ্ঞায় পরিপূর্ণ।
যদিও আমি এরদোগান, পুতিন, বলসোনারো কিংবা দুতের্তের মতাদর্শিক লেঠেল বাহিনী ও মোসাহেবকূলের সামাজিক উৎস সম্পর্কে সেইভাবে অবগত নই, তারপরেও আমি অনুমান করতে প্রস্তুত যে এই প্রত্যকটি ক্ষেত্রে নব্য এলিট সম্প্রদায় কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য বহন করে : চিরাচরিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এলিটদের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা, উদারনৈতিক কার্যপ্রণালীর প্রতি নিদারুণ অবহেলা, বুদ্ধিজীবী-গবেষক-শিল্পী-অ্যাক্টিভিস্ট-সমাজতন্ত্রী-নারীবাদীদের প্রতি চরম ঘৃণা, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে ততক্ষণ পর্যন্ত পুঁজিবাদের বন্দনা এবং জনগণ নয় বরং নিজেদের ভোটারদের কাল্ট অনুসরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা।
হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওর্বান তাঁর ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করেছে। ট্রাম্প রিলিফ চেকে তাঁর নাম মুদ্রণ এবং বর্তমান সংকটে একক নির্বাহী ক্ষমতাবলে যেকোন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মোদী মোটাদাগে নিজেকে সংবিধানের ঊর্ধে ঘোষণা করেছেন এবং ট্রাম্প, নেতানিয়াহু ও বলসোনারোর মত গণশত্রুদের ভারতে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছেন। তিনি কোভিড-১৯ এর সংকটময় পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে গোটা ভারতে কারফিউসম ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করেছেন, পুলিশী পিটুনি, ভুয়া কারণ দেখিয়ে কারাগারে প্রেরণ এবং ইতোপূর্বে কাশ্মীরে পরীক্ষিত কাছাখোলা দমন-পীড়ন নীতিকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করেছেন।
এই সমস্ত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে, এই নেতারা অন্ধ সমর্থক এবং সহযোগীদের নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল, যারা মনে করে ‘সুপ্রিম লিডার’-এর তালে তাল মিলিয়ে চলার মধ্যেই তাঁদের নিজেদের এবং জাতির সমৃদ্ধি নিহিত। তাহলে, পূর্ববর্তী এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানরত এই নব্য এলিটবৃন্দ, যারা বর্তমান দুনিয়ার লোকরঞ্জনবাদী স্বৈরতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর, যাদের এই ক্যু লিবারেল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে; অনুসারীগোষ্ঠী, বুনিয়াদি শক্তি, ভোটার, এমনকি যে ‘জনগণ’-এর নাম ও দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটা অনন্ত ‘যুদ্ধ’ চালানো হচ্ছে, এই সমস্ত কিছু সমেত এই নব্য এলিটদের আমরা কীভাবে ‘পাঠ’ করব? কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
এই অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রশ্নের কিছু গড়পড়তা উত্তর আছে। একটি হলো এই স্বৈরশাসকেরা আবেগ-অনুভূতির (প্রেম, ক্ষত, ত্যাগ, ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ) গুরুত্ব বোঝে এবং এগুলোকে হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষরা এমন সব তত্ত্ব, মূল্যবোধ, যুক্তি বিষয়ক আধা-বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কে ডুবে থাকে, যেগুলোর আজকাল গণ আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়টি হলো আকাঙ্ক্ষার প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী উত্থান (বিজ্ঞাপন, ভোক্তা পণ্য, সেলেব্রিটি কাল্ট, কর্পোরেট সংস্কৃতি), যেটি কিনা উদারনৈতিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়াগুলোর ধীরগতির প্রতি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণী ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। তাঁরা এখন সমৃদ্ধি ও মর্যাদা চায় এবং এই লোকরঞ্জনবাদী নেতারা তাঁদেরকে সেগুলো নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আরও একটি যুক্তি হলো ক্রমাগত বাদ পড়া, দরিদ্র থাকা এবং অপমানের শিকার হওয়া নিম্ন শ্রেণীগুলোকে এতটাই বিদ্বিষ্ট করেছে যে তাঁরা এখন এইসব লুটেরা নেতাদের মধ্যেই নিজেদের পরিচয়কে জুড়ে দিতে চায় (যেসব নেতারা যা চায়, ঠিক তাই হাতিয়ে নিতে সক্ষম)। ফলে তারা মুসলিম, শরণার্থী, চৈনিক, জিপসি, ইহুদি, অভিবাসী এবং এমন আরও অনেক ‘অপর’-এর প্রতি আতঙ্কের দিকে আমজনতার মনোযোগ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় বাস্তবতায় এই যুক্তিগুলো কিছুটা হলেও বোধগম্য।
তবে আমি মনে করি, ওর্তেগা গ্যাসেটের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের এটা বুঝতে সহায়তা করে যে আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে আম-জনতার অভ্যুত্থান এলিটদের প্রতি-অভ্যুত্থান দ্বারা বেদখল হয়ে গেছে। এই বেদখল হওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বৈরাচারদের দ্বারা ঘনঘন ব্যবহার হতে থাকা এটাই উন্মোচন করে যে, এই ‘জনতা’ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এইসব নব্য এলিটদের উত্থান মূলত তাঁদেরই উত্থান এবং তাঁদের সর্বোচ্চ করণীয় হচ্ছে, এইসব বীভৎস দানবীয় নেতাদের উত্থানের উদযাপন করা (সম্ভব হলে অনুকরণ করা)। সামাজিক পরিস্থিতি ও বিন্যাসের অর্থবহ বৈপ্লবিক কিংবা গণমুখী পরিবর্তনের চেয়ে এইসব নেতাদের মুহুর্তের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে ফেলার ফাঁপা কারিশমার প্রতি তাঁদের অধিক আস্থা।
কথা বলার ধরনে মনে হয় যেন এই নব্য ভোটারু (electoral) জনতা মনে করে বসে আছে তাঁদের নেতাদের সীমাহীন লুন্ঠনের সুফল তাঁদের দিকেও চুইয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণীর আম-জনতার কাছে কেবল তাঁদেরই অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলির পাঁঠা অংশকে খুন করা, অঙ্গহানি করা এবং লাঞ্ছিত করার নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি ছাড়া আর কিছু চুইয়ে পড়েনি। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চতর আয় এবং নিরাপদ শহরের মতো প্রাত্যহিক প্রয়োজনগুলো চুইয়ে পড়ার জন্য পিরামিডের একেবারে তলানিতে পড়ে থাকাদের সীমাহীন ধৈর্য ও অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু তাঁরা এই আশায় বাঁচে যে, যদি তাঁদের কাছে ঘৃণা চুইয়ে পড়তে পারে, তাহলে হয়তো সমৃদ্ধিও চুইয়ে পড়বে।
অনুবাদকের মন্তব্য
এই নিবন্ধে অর্জুন আপ্পাদুরাই বিশ্বজুড়ে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী, ডানপন্থী রাষ্ট্রপ্রণালী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আমরা মনে করছি অপেক্ষাকৃত ন্যায্য, গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা যারা বলেন, সমাজ-সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সক্রিয় থাকেন; অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই পর্যবেক্ষণ তাঁদের আমলে নিতে হবে। কারণ বর্তমানে আমরা এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমাজ বিন্যাসে আছি, যা প্রতি মুহুর্তে নিজেকে হালনাগাদ করছে, কৌশল বদলাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষীপ্র এই ব্যবস্থাকে যারা মোকাবেলা করছেন, তাঁরা তদ্রুপ ক্ষীপ্রতা অর্জন করতে না পারলে, আধিপত্যশীল ব্যবস্থা সম্পর্কে শত শত বছরের স্থবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকলে, কখনোই সমাজ-সম্পর্কের পরিবর্তন আশা করা সম্ভব না।
আপ্পাদুরাই বলছেন, বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটদের মধ্যেই এক নতুন এলিট সম্প্রদায় এর উত্থান ঘটেছে। যারা বদলে দিয়েছে পুরোনো হিশাব নিকাশ। একে আমরা বলতে পারি, এলিটদের বিরুদ্ধে নব্য এলিটদের পাল্টা-অভ্যুত্থান।
দেখা যাচ্ছে যে, এই নব্য এলিট সম্প্রদায় কোন কোন ক্ষেত্রে, যারা জনগণ কেন্দ্রীক রাজনীতির কথা বলে তাঁদের চেয়ে বেশি জনসংশ্লিষ্ট। নব্য এলিটদের এই রাজনীতি-ধর্ম ব্যবসা-সংস্কৃতি কারখানার পেছনে আছে ব্যাপক জনসমর্থন। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হবে। প্রথাগত এলিটরা যেসব উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী মূল্যবোধকে স্বীকার করত অন্তত নিজেদের শ্রেণীর মধ্যে, এরা এমনকি সেইসব মূল্যবোধের প্রতিও বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল না। এদের কোন ছদ্মবেশ নেই। মহৎ মহৎ কথার কোন ফুলঝুরি নেই, তারা যা করতে চায়, তা অত্যন্ত খুল্লামখুল্লাই করে।
বুর্জোয়া মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, উদারনীতির সমন্বয়ে যে রাষ্ট্রপ্রণালী প্রচলিত ছিল, যেগুলো অন্তত কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় কাজ করত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ছিল, ক্ষমতার অন্তত লোকদেখানো বিভাজন ছিল; তার কিছুই আজকে আর অবশিষ্ট নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, এমনকি বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে। যেন এক সর্বত্র এক সর্বব্যাপ্ত মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে।
যারা প্রচলিত এলিট সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, উদারনৈতিকতার বিরুদ্ধে এক অনন্ত ‘ক্যু’ সংঘটিত করে চলেছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হলো, আগেকার যে কোন স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদের সাথে আজকের দুনিয়ার এই নব্য এলিট সম্প্রদায়ের নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদের পার্থক্য হলো, বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুর পেছনেই এক আপাত বিপুল জনসমর্থন আছে।
কী করে সম্ভব হলো এই পরিস্থিতি? বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট-শিল্পী-নারীবাদী-সমাজতন্ত্রী-পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে এত বিপুল ক্ষোভ ও ঘৃণা উৎপাদনের কারণ কী? কী করে জনগণকে তাদের আসল বাস্তব প্রাত্যহিক সমস্যা-সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে নানা রকম ফাঁপা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শিক চর্চায়? কী করে জনগণকে পরিণত করা যাচ্ছে ‘উন্মত্ত মব’-এ?
এই প্রবন্ধের প্রাথমিক পাঠে মনে হতে পারে যেন, অর্জুন আপ্পাদুরাই জনগণের উপরেই সমস্ত দায় চাপাচ্ছেন। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে পাঠ করলেই এটা পরিস্কার হবে যে, তিনি মূলত বলছেন, বর্তমান কালের নব্য এলিটরা ‘জনতা’র ধারণাতেও ক্যু সংঘটিত করে চলেছে। ‘জনতা’র নামে তারা মূলত এমন এক কাল্ট[গোষ্ঠীতন্ত্র] , এমন এক ক্রোধান্মত্ত মব তৈরিতে সক্ষম হয়েছে, যারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হতে হতে, নানা ধরনের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে, শেষমেষ নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, কোন এক ‘অতি-মানব’ সুপারলিডারে আস্থা রাখা ছাড়া, জিহাদি জোশ সম্বলিত কোন মতাদর্শের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবেনা।
ফলে এইসব ‘অতি-মানব’ স্বৈর-শাসকদের নির্মিত ‘কল্পিত শত্রু’র বিরুদ্ধেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিতে উদ্যত। স্বৈর-শাসকদের সৃষ্ট বাস্তব সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ঘৃণা, বিভাজন উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যখন আমরা করোনাভাইরাস মহামারীতে সরকার-রাষ্ট্রপ্রণালীর নিদারুণ ব্যর্থতা, উন্নয়নের রোলমডেল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাতের অকল্পনীয় অব্যবস্থাপনা (যার শিকার হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ), মাসখানেকের লকডাউনে সমস্ত কিছুতে ধস, তীব্র খাদ্যাভাব প্রত্যক্ষ করছি; ঠিক তখন ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ এর মত অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার মত চরম অসংবেদনশীলতাও দেখতে পাচ্ছি।
অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের লেখার সার কথাটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করব যে, জনগণকে নানা মতাদর্শে, চিন্তার বৈচিত্র্যকে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিণত করা, স্বীয় নলেজ সিস্টেমকে অন্য নলেজ সিস্টেমের উপর চাপিয়ে দেয়ার এই প্রবণতা বর্তমান কালের নব্য এলিটদের প্রধানতম সার্থকতা।
আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল রাখা দরকার, এমনকি শতাব্দী পুরোনো ‘শ্রেণী’ বিশ্লেষণ দিয়েও আজকের পরিস্থিতি পুরোটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিট কমপ্লেক্সে পূর্ব অনুমিত অবধারিত কোন শ্রেণীগত ঐক্য নেই। একই শ্রেণীতে অবস্থিত সমস্ত পক্ষই একই মূল্যবোধে দীক্ষিত নয়।
যদি তাই হতো, তাহলে লিবারেল গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের বিরুদ্ধে একই শ্রেণীগত অ্যান্টি-লিবারেল, অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট, অ্যান্টি-ডেমোক্রেটিক ফ্যাসিস্ট এলিটদের উত্থান দেখতে হতোনা আজকের পৃথিবীকে। শ্রেণীবাদী রাজনীতি-অর্থনীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে, কিন্তু চিরাচরিত যুক্তি-বিশ্লেষণ দিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে আমরা পরিস্থিতির গুণগত নেতিবাচক পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হব। এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান রত নব্য এলিটদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবো।
সেই সাথে চরম প্রতিক্রিয়াশীল-প্রলয়ঙ্করী নয়া উদারনৈতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে স্রেফ ভোক্তা-ভোটারে পরিণত করার মাধ্যমে বাদবাকি সমস্ত সক্রিয়তা, কর্তাসত্তাকে ‘নাই’ করে দিতে পারে, সেটা অনুধাবন করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, সেই আলাপটাও জরুরি।