- সহুল আহমদ
The inner meaning of history […] involves […] an attempt to get to the truth, subtle explanation of the causes and origins of existing things, and deep knowledge of the how and why of events.
— Ibn-Khaldun
Paraphrasing the historian, Mr. Reagan said Ibn Khaldun postulated that ”in the beginning of the dynasty, great tax revenues were gained from small assessments,” and that ”at the end of the dynasty, small tax revenues were gained from large assessments.”
– ‘Regan Cites Islamic Scholar’, New York Times, 1981
খালদুন চর্চার রকমফের
দুটো উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি; একটি খোদ ইবনে খালদুনেরই, অন্যটি পত্রিকার বরাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের। ১৯৮১ সালে রিগান সাহেব ‘সাপ্লাই সাইড ইকনমিক্স’- এর তত্ত্ব উপস্থাপনকালে ইবনে খালদুনকে কেবল স্মরণই করেন নি, বরং তার তত্ত্বের স্বপক্ষেও খালদুনকে হাজির করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর শিরোনাম, ‘রিগান ইসলামিক পণ্ডিতকে উদ্ধৃত করেছেন’, দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়া খুব গুরুত্বসহকারে খালদুনকে উদ্ধৃত করার ঘটনাটা প্রকাশ করেছিল। আবার, প্রথমেই খালদুনের যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে সেটার ব্যবহার আমরা বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও গবেষক নুরুল কবীরের সাম্প্রতিক (২০২০) বইতে দেখতে পাই। তিনি ইবনে খালদুনের এই উদ্ধৃতি ও হাওয়ার্ড জিনের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে উনষত্ত্বরের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস লেখা শুরু করেন। পাঠকমাত্রই খেয়াল করবেন, রিগান সাহেবের নিওলিবারেলিজম বা নয়া-উদারনীতিবাদের অন্যতম হুজুর হিসাবে খ্যাতি রয়েছে, অন্যদিকে নুরুল কবীর বামপন্থি ও এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচত। কিন্তু, বিপরীতধর্মী দুজন ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাদের গবেষণা ও তত্ত্বের শুরুতেই নাম নিচ্ছেন একই ব্যক্তির; আবার একজন নিচ্ছেন অর্থনীতির সাথে জড়িয়ে, অন্যজন নিচ্ছেন ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে। ইবনে খালদুনের চিন্তা, কাজ ও প্রভাবের বিচিত্র গতিপথ সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ এতেই পাওয়া যায়। একজন খালদুন বিশেষজ্ঞ তো বলেই ফেলেন, ইবনে খালদুন যে একেকজনের কাছে একেকরকম ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হন এটা আসলে যেমন তাঁর মহত্বের পরিমাপক, তেমনি তাঁর দ্ব্যর্থতা বা অস্পষ্টতারও পরিমাপক।
পশ্চিমা একাডেমিয়াতে বিভিন্ন কারণেই ইবনে খালদুন ব্যাপক চর্চিত হয়েছেন; অরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী চর্চার সাথে ইবনে খালদুনের নাম এতো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে খালদুন গবেষক রবার্ট আরউইন তার বইয়ের ভূমিকায় মন্তব্য করেন, কেউ যদি উনিশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপের জ্ঞানজগতে কেবল খালদুনের উপর জিনিসপাতি তালাশ করেন, তাহলে তিনি অরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যবাদের অর্ধেক ইতিহাসই জেনে যাবেন।
ইউরোপের একেকস্থানে তাকে একেকরকম ভাবে পাঠ করা হয়েছে। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে ইবনে খালদুনের উপর বেশিরভাগ কাজ ফরাসিরাই করেছিলেন, তার কারণও স্পষ্ট : উপনিবেশায়ন। উপনিবেশের অংশ হিসাবে ফ্রান্সে ইবনে খালদুনকে চর্চার প্রায় একটা হিড়িক পড়েছিল। অনুবাদ প্রক্রিয়ার হাত ধরে ইবনে খালদুনের বয়ানকে ফরাসি উপনিবেশকরা নিজেদের ঔপনিবেশিক বায়নের মধ্যে আত্তীকৃত করেছিলেন। একাডেমিয়ার জগতের অনেকেই দাবি করেছিলেন, খালদুন প্রাচ্যবাদের ফসল ছিলেন, এবং তাঁর প্রতি প্রাচ্যবাদীদের যে আগ্রহ ছিল তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে কতটা মূল্যায়ন করা যাবে সেটাও নিশ্চিত না। অবশ্যই, উপনিবেশিত জনগণের ইতিহাস-আচার-আচরণ জানা ও শাসন উপযুক্ত নয়া বয়ান তৈরির জন্য উপনিবেশকের যে তাগিদ তাতে ইবনে খালদুন ও তাঁর টেক্সট খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হাজির করেছিল।
অন্যদিকে উপনিবেশায়নের কারণে ফ্রান্সে যে তরিকায় খালদুন ব্যবহৃত হয়েছেন সেভাবে জার্মান, ইংল্যান্ড বা আমেরিকাতে ঘটেনি; কিন্তু ফরাসী ভাষাতেই খালদুন বেশ আগ থেকে এবং ব্যাপকভাবে চর্চিত হওয়ার কারণে বাদবাকীরাও ফরাসী পাঠ দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত ছিলেন। পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী লুডভিগ গুমপ্লোভিচ এবং জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ অপেনহেইমার খালদুনকে সমাজতাত্ত্বিক হিসাবে পাঠ করেছিলেন। বহু পশ্চিমা পণ্ডিতই খালদুনকে সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সমাজবিজ্ঞানী আর্নেস্ট গেলনার মুকাদ্দিমায় প্রস্তাবিত তাত্ত্বিক মডেলের সাথে বিভিন্ন পশ্চিমা দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর চিন্তার যোগসূত্র তৈরি করেন। আবার ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি খালদুনের উচ্চকিত প্রশংসা করতেন। তিনি যখন অ্যা স্টাডি অফ হিস্টোরি-তে বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান পতনের কারণ তালাশ করছিলেন, তখন তিনি এই সিলসিলার পূর্বসূরীদের খোঁজ করছিলেন, যারা কিনা তাকে তার উচ্চবিলাসী প্রকল্পের বৈধতা দিতে পারেন। খালদুন ও মুকাদ্দিমা খুঁজে পেয়ে টয়েনবি পুলকিত হয়েছিলেন।
দেখা যাচ্ছে বিভিন্নজনের হাতে খালদুন বিভিন্ন চেহারায় হাজির হচ্ছেন। কেউ কেউ খালদুনের সেকুলার চিন্তা ও ইতিহাসের আধুনিক ধারণার উপর জোরারোপ করেছেন। কেউ খালদুনকে ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতে হাজির করার চেষ্টা করেছেন, সেক্ষেত্রে খালদুনের বিশ্বাস, ফকিহ হিসাবের তার পরিচয়ের উপর জোর দিয়েছেন; কেউবা ইবনে খালদুনের উপর প্রাচীন গ্রিক দর্শনের প্রভাবের উপর জোর দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ খালদুনের সাথে ইউরোপীয় চিন্তার ফারাকটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। খালদুনের দিকে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতেও তাকানো হয়েছে, আরবের হারানো ঐতিহ্য উদ্ধারে তাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রতিটি চিন্তাস্কুলেরই সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়েও আলাপ বিদ্যমান। আবার, বর্তমান সময়ে কোনো গবেষক সমাজবিজ্ঞানের ইউরোসেন্ট্রিক ধারার সঙ্কট চিহ্নিত করে এর বিপরীতে সমাজবিজ্ঞানের খালদুনিয়ান ধারা তৈরির প্রস্তাবও করেন। রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, দার্শনিক, এথনোলজিস্ট এবং অর্থনীতিবিদ সবার মধ্যেই তারা যা চর্চা করেন তার বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বসূরী বা পূর্বপুরুষ খোঁজার তাগিদ লক্ষ্য করা যায়।
এই প্রবন্ধে খুব সংক্ষেপে ইবনে খালদুনের সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনার মূলসূত্র তুলে ধরা হবে। আমরা আধুনিক অর্থে যেভাবে রাষ্ট্রকে বুঝে থাকি, নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিকভাবেই সেটা খালদুনের আমলের চাইতে ভিন্ন। ইসলামি চিন্তা ঐতিহ্যে বা খালদুনের লেখালেখিতে যাকে ফধষিধয বা রাজ্য বা ডাইনেস্টি বলা হয়েছে তাকে আমরা রাষ্ট্র – অর্থাৎ, এমন এক রাজনৈতিক সংগঠন যার মাধ্যমে বিভিন্ন গোত্র জনগোষ্ঠীর ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে – হিসেবে পাঠ করতে পারি। ইবনে খালদুনের সে সংক্রান্ত বিশ্লেষণকেই আজকে আমরা রাষ্ট্রভাবনা হিসেবে পাঠ করবো। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সমাজকে আলাদা করে পাঠ করার যে রেওয়াজ আছে, সেটাও খালদুনের জমানায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই দুটোকে বিবেচনায় নিয়েই আমরা খালদুনের সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনা হাজির করবো।
এক নজরে খালদুন
ইবনে খালদুন ১৩৩২ সালে আফ্রিকার তিউনিসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৪৮ সালে উত্তর আফ্রিকায় ভয়াবহ প্লেগ মহামারি শুরু হলে তিনি পিতা, ভাই সব বহু বন্ধুবান্ধবদের হারান। এই মহামারি ও ধ্বংসস্তুপ ইবনে খালদুনের মনে স্থায়ী জায়গা করে নেয়, যার প্রভাব বিভিন্ন ভাবে তার কাজে-কামে-তত্ত্বে ছড়িয়ে পড়ে। খালদুন তার জীবনে তৎকালীন বিভিন্ন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। তৎকালীন বাস্তবতায় বলা যায়, তিনি সবসময় নিজের জান হাতে করে কাজ করে গিয়েছেন। উত্তর আফ্রিকায় সিংহাসন নিয়ে যে লড়াই সেখানে খালদুন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে নিজেকে হাজির করেছিলেন। তার এই রোমাঞ্চকর জীবন থেকে কিছুদিন বিরাম নিয়ে ১৩৭৫ সালে পশ্চিম আলজেরিয়ার ক্বালাত বানু সালামে বিখ্যাত মুকাদ্দিমা গ্রন্থ লেখা শুরু করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান পতনের শিকার হয়ে ১৩৮৩ সালে মিসরের কায়রো গমন করেন। সেখানেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৪০৬ সালে খালদুন ইন্তেকাল করেন।
মুকাদ্দিমা ও ইতিহাসবিদদের ভুল
মুকাদ্দিমা হচ্ছে ইবনে খালদুনের সবচেয়ে মশহুর গ্রন্থ। নানা ভাষায় অনূদিত এই গ্রন্থের ওপরই বলা যায় খালদুনের যাবতীয় সুখ্যাতি নির্ভরশীল। মূলত তাঁর বিশালকায় ইতিহাসের কিতাব ‘ইবার’ এর ভূমিকা হচ্ছে এই মুকাদ্দিমা। এটাকে তাঁর তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা বলা যেতে পারে : তিনি যে দীর্ঘ ইতিহাস লিখতে যাচ্ছেন, সেটার গুরুত্ব কী, কেনইবা সেটা অন্যদের চাইতে আলাদা, পূর্বের কাজগুলোর দুর্বলতা কী মূলত এসব নিয়েই তিনি বাৎচিত করেছেন। মোটাদাগে ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই দীর্ঘ তাত্ত্বিক প্রস্তাবনাতে তিনি মানবসমাজ, রাষ্ট্র, খেলাফত, সাম্রাজ্য, যাযাবরীয় সমাজ, নগরভিত্তিক সমাজ, বাণিজ্য, অর্থনীতি, প্রযুক্তিগত কলাকৌশল ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পশ্চিমে যখন ইবনে খালদুন চর্চা হয় তখন তাকে এমন ‘জিনিইয়াস’ হিসেবে ধরে নেয়া হয় যিনি কিনা তার সময়ে ‘একা’ এবং ‘ব্যতিক্রম’। তিনি আধুনিক, কারণ ‘ইউরোপীয় যুক্তির ধারা’ তার লেখাতে পাওয়া যায়, কিন্তু তার স্থান-কাল অনাধুনিক। যেমন অস্ট্রিয়ান আরববাদী আলফ্রেড ভন ক্রেমার মনে করতেন, ইবনে খালদুন ছিলেন আরব দুনিয়ায় ‘অনন্য’, কোনো পূর্বসূরী নেই এবং পুরোদমে মৌলিক। তিনি তাঁর সময়ের পূর্বেই জন্মেছিলেন। আবার, ইতিবাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি মনে করতেন, খালদুন একাধারে ‘আলোকিত’ এবং ‘অন্ধকার’। কিন্তু সৈয়দ ফরিদ আলাতাস এমন মতের বিপরীতে বলেন, ইসলামি চিন্তাচর্চায় তৎকালে যে ধরনের এরিস্টটলীয় এনালজিক্যাল রিজনিং চালু ছিল তাঁর মধ্যে demonstration ও dialectics পদ্ধতি ইবনে খালদুন ব্যবহার করেছিলেন। যারা মনে করতেন ডেমোন্সট্রেটিভ পদ্ধতি হচ্ছে সত্য উদঘাটনের সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি ইবনে খালদুন ছিলেন সে দলে। মুকাদ্দিমাতে প্রধানত তিনি এই পদ্ধতি ব্যবহার করলেও তাঁর সময়ের বিভিন্ন ইতিহাসবেত্তাদের কাজকে পর্যালোচনা করতে এবং মানবসমাজ সম্পর্কে তাঁর এই নতুন বিজ্ঞানকে তুলে ধরার জন্য তিনি উপর্যুক্ত দুই পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ফলে, খালদুনের পদ্ধতি নতুন ছিল না, বরঞ্চ বস্তুবাদী ঝোঁকের কারণে তাঁর অভিমুখের মধ্যে নতুনত্ব ছিল। অর্থাৎ, তিনি নরম্যাটিভ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেষ্টা করতেন। তিনি যে কোনো ঘটনাকে কোনো নির্দিষ্ট এক্টর বা নায়ক বা ধারণার ভূমিকা দিয়ে ব্যাখ্যার করার পরিবর্তে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক প্রভাবকের আলোকে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী গবেষকগণ তাঁর এই ধরনের স্ট্রাকচারাল মনোভঙ্গির ওপর জোরারোপ করেছেন। তিনি ইতিহাসকে ভালো ও মন্দের লড়াই হিসাবে দেখতেন না; বরঞ্চ মনে করতেন, নগরভিত্তিক (সেডেন্টারি) ও যাযাবরীয় জীবন যাপনের মধ্যকার ডায়ালেক্টিক সম্পর্কই সক্রিয় সামাজিক ইতিহাস তৈরি করেছিল। তাঁর এই মনোভঙ্গি বা এই বিষয়বস্তু যে নতুন, বা এটা যে একেবারে নতুন বিজ্ঞান, যা আগে কখনো কেউ আলোচনা করেননি, সেটা তিনি মুকাদ্দিমাতে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই কারণে সৈয়দ ফরিদ বলেন, খালদুনের অভিনবত্ব আসলে জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যায়ে বা পদ্ধতিগত জায়গায় পাওয়া যাবে না; সেগুলো তাঁর কালের অন্যান্য মুসলমান দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্তাদের লেখালেখিতেও পাওয়া যাবে। বরঞ্চ খালদুন যেভাবে এই পদ্ধতিগুলোকে তাঁর কালের ইতিহাসচর্চাকে পর্যালোচনা করতে ব্যবহার করেছেন এবং নতুন পথ বাতলে দিতে প্রয়োগ করেছেন সেখানে অভিনবত্ব পাওয়া যাবে।
মুকাদ্দিমার শুরুতেই খালদুন প্রশ্ন তুলেছেন, ইতিহাসবিদরা কেন ভুল করেন। এই প্রশ্নে যাওয়ার আগে মুখবন্ধে তিনি ইতিহাসের দুটো স্তরের কথা বলেন : উপরিভাগ ও অন্তর্নিহিত অর্থ। দীর্ঘ হলেও তাকে উদ্ধৃত করতে পারি:
For on the surface history is no more than information about political events, dynasties, and occurrences of the remote past, elegantly presented and spiced with proverbs. It serves to entertain large, crowded gatherings and brings to us an understanding of human affairs. (It shows) how changing conditions affected (human affairs), how certain dynasties came to occupy an ever-wider space in the world, and how they settled the earth until they heard the call and their time was up. The inner meaning of history, on the other hand, involves speculation and an attempt to get at the truth, subtle explanation of the causes and origins of existing things, and deep knowledge of the how and why of events.
অর্থাৎ, উপরিভাগে কেবল রাজনৈতিক ঘটনা, ডাইনেস্টি ও সুদূর অতীতের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞাত করা এবং আমজনতাকে বিনোদন দেয়া। এটা দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বিষয় ও বস্তু সবকিছু নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে; কীভাবে রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব ঘটছে ও কীভাবে তার পতন ঘটছে। অন্যদিকে, ইতিহাসের অন্তর্নিহিত অর্থের ভেতর ঘটনার পূর্বাপর, কারণ, বিকাশ ও বিনাশের মৌলিক উপাদান ও সত্য খোঁজার তাগিদ থাকে। একটা ঘটনা ঘটার পিছনে কারণ কী? কোন কোন বাস্তবিক পরিস্থিতি ঘটনার জন্ম দিয়েছে? এর আসল উদ্দেশ্য কী? ফলে খালদুনের মতে, ইতিহাস হিকমতের বিষয় হিসেবে গন্য করা উচিৎ। খালদুন হিকমত ব্যবহার করলেও, ইংরেজি অনুবাদক রোজেন্থাল ‘দর্শন’ অনুবাদ করেছেন। মুকাদ্দিমার বাংলা অনুবাদক গোলাম সামদানী কোরায়শী টীকাতে বলেছিলেন, এককালে দর্শন ও বিজ্ঞান একীভূত ছিল। কিন্তু পরে এটা আলাদা হয়, ফালাসাফা দিয়ে দর্শন বোঝানো হতো। তিনি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এই হিকমত-কে সমাজবিজ্ঞান হিসেবেই বিবেচনা করেন।
ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার এই দুই স্তরের সাথে সহজেই মার্কসীয় পরিভাষার ‘উপরিকাঠামো’ (superstructure) ও ‘ভিত্তিকাঠামো’ (base /or substructure) মিল খুঁজে পাওয়া যায়; এবং কোনো কোনো খালদুন-গবেষক খালদুনকে মার্কসের পূর্বসূরী হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। আবার, অনেকে খালদুনের এমন ভাবনার ওপর তার সুফিবাদী দর্শনের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। অ্যালেন ফ্রমহের্জ তাঁর ইতিহাসের দর্শনের গঠনে সুফিবাদের ভূমিকার ওপর জোরারোপ করেছেন। তাঁর মতে, ইতিহাসের অন্তর্নিহিত সত্য অনুসন্ধানের সাথে সুফিবাদী দর্শন সমান্তুরাল। খালদুনের ইতিহাসের দুই স্তরকে সুফিবাদী ভাষায় বলা যায়, জাহেরি ও বাতেনি স্তর। সুফিবাদই ঐতিহাসিক ঘটনার জাহেরি অবস্থানকে ছাড়িয়ে ঘটনাসমূহের বাতেনি অবস্থানের দিকে নজর দিতে উৎসাহ দিয়েছিল। খালদুন এটাও বলেন, ঐতিহ্য/প্রথার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস মানুষের স্বভাবজাত। এবং এটা ইতিহাসবিদ্যার জন্য মোটেও ফায়দাকর নয়।
ইতিহাসবিদরা কেন ভুল করেন এই প্রশ্নের উত্তরে খালদুন মোট সাতধরনের ভুলের কথা বলেন। এক. কোনো একটা মত বা গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব ইতিহাসবিদকে ভুল পথে পরিচালিত করে। দুই. ইসলামের ইতিহাসে ধারাবর্ণনাকারীর গুরুত্ব সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। বিশেষ করে হাদিসের শুদ্ধতা নির্ধারণে এটা খুব কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। খালদুনের দ্বিতীয় আপত্তি হচ্ছে এটা নিয়েই: এদের ওপর অতিরিক্তি নির্ভরশীলতাও ভুলের একটা কারণ। তিন. ঘটনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বেখবর থাকা। চার. ভ্রান্ত পূর্বানুমানের ভিত্তিতে সত্যে পৌছানোর চেষ্টা করা। পাঁচ. বাস্তবতার সাথে পরিস্থিতি কীভাবে খাপ খাচ্ছে সে বিষয়ে অজ্ঞ থাকা। ছয়. শাসকগোষ্ঠী ও উচ্চাসনের পদাধিকারদের খুশি করার মনোবাসনা। সাত. মানব সমাজের অবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে বেখবর থাকা। অর্থাৎ, মোটাদাগে পক্ষপাতিত্ব, সহজে কোনো কিছুকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার ঝোঁক এবং অন্তর্নিহিত জ্ঞানকে ধরতে ব্যর্থ হওয়াটাই ইতিহাসবিদকে ভুল সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করে। ফলে খালদুনের সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নও ইতিহাসের সত্য খুঁজে বের করার বাসনা থেকে।
সামাজিক জীবন, রাষ্ট্র ও আসাবিয়া
সমাজের দরকার কী? তৎকালের অন্যান্য দার্শনিকদের মতো মুসলিম দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকরাও সমাজের জরুরতকে স্বীকার করতেন। মানুষ একা একা যথেষ্ট নয়, সবাইকে নিয়েই তাকে বসবার করতে হয়। মানুষের প্রকৃতিই হচ্ছে সমাজে বেঁচে থাকার জন্য একে অপরকে সহযোগিতা করতে হয়, একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হয়। তবে, যদিওবা মানুষের সহযোগিতার জরুরতকে স্বীকার করা হতো, এটাও দাবি করা হতো যে, কিছুটা বিধিনিষেধ না থাকলে সহযোগিতার বিষয়টিও ঘটতো না। মানুষ প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন, বর্বর এবং তীব্র বাসনা দ্বারা তাড়িত। একা একা ছেড়ে দিলে মানুষ নির্মমভাবে কেবল নিজের স্বার্থের পিছনেই ছুটবে। হবস এর মতো পশ্চিমের চিন্তকরা যেভাবে মানুষের প্রাকৃতিক অবস্থাকে কদর্য ও নিষ্ঠুর বলে বিবেচনা করতেন, তাঁর সাথে তৎকালের মুসলিম চিন্তকদের চিন্তার মিল খুঁজে পান গবেষকরা। এমন অবস্থা থেকে আইন/ল জরুরি হয়ে উঠে। অর্থাৎ, এসব রোধ করার জন্য এক ধরনের কর্তৃত্ব বা অথোরিটি প্রয়োজন। এটা অনিবার্য। তবে, খালদুনের মধ্যে এর কিছুটা বিপরীত ভাবনাও দেখতে পাবো। খালদুন মনে করতেন, মানুষ যত প্রকৃতির কাছে থাকে, ততদিন সে খাটি থাকে, তার উচ্চ চরিত্রের অধিকারী থাকে, শহুরে জীবন যাপন তাকে উল্টো নষ্ট করে।
খালদুনও যখন সমাজ পাঠে প্রবেশ করেন তখন তারও দুটো পূর্বানুমান ছিল। প্রথমত, তিনি মানব সমাজকে দরকারি বলে সাব্যস্থ করেছিলেন। মানুষের সাহচর্য ও মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের মিলেমিশে বসবাসের প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি এটা সহযোগিতার প্রতি তাদের সহজাত প্রবণতা থেকেও আসে। দ্বিতীয়ত, খালদুন মনে করতেন মানুষ ও সমাজ ভৌত পরিবেশ ও ভূগোল দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। ফলে, মানুষ যেহেতু পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাদের চিন্তা করার সক্ষমতা বিভিন্ন ধরনের কলা-কৌশল ও জীবন ধারণের নানা উপায় উদ্ভাবন ঘটায়, সেহেতু একেক পরিবেশ একেক ধরনের জীবন ধারণের উপায় তৈরি করে। খালদুন এই মোড অফ লিভিং এর ভিত্তিতে দুই ধরনের সামাজিক জীবনের ধারণা হাজির করেছিলেন : উমরান বাদাউই, মানে গ্রামীন ও সহজ সংস্কৃতি, এবং উমরান হাদারি, মানে শহুরে ও জটিল সংস্কৃতি। এই দুটো ধারণা দিয়ে তিনি যাযাবর (নোমাডিক) জীবন ও সেডেন্টারি বা স্থায়ীভাবে একটা নির্দিষ্ট স্থানে বসবাসকারীদের জীবনযাপনের পার্থক্যকে নির্দেশ করেন। উমরান বাদাউই দিয়ে মোটাদাগে যাযাবর, আধা-যাযাবর, বেদুইন, শহর থেকে দূরে পাহাড়-পর্বতে বসবাসকারীদের বোঝানো হয়েছে, অন্যদিকে উমরান হাদারি দিয়ে শহুরে, আধা-শহুরে, বা নগরবাসীর জীবনযাপন ও সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়েছিল। তাঁর কাছে এই দুই জীবনের মধ্যে একধরনের ধারাবাহিকতা আছে। এমন না যে এই দুই ধরনের সমাজ একেবারে ভিন্ন যারা কিনা সহাবস্থান করে এবং একে অপরের মোলাকাত করে। বরঞ্চ, আমরা পরে দেখবো, যেহেতু শহরগুলোর বাসিন্দারা বেদুইন সমাজ থেকে আগত, সেহেতু যাযাবর বা বেদুইন সমাজ হচ্ছে শহুরে জীবনের অগ্রদূত।
সমাজের উপর্যুক্ত দুই রূপের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে ইবনে খালদুনের পুরো ইতিহাস ও সমাজচিন্তা জুড়ে বিরাজ করছে। এবং এই দুই সমাজ সম্পর্কে তাঁর পূর্বানুমানগুলো অন্যান্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রধান সিড়ি। আমাদের কাছে এগুলো তাঁর রাষ্ট্র ও সমাজভাবনার মূলসূত্র। খালদুনের মতে, সেডেন্টারি বা শহুরে বাসিন্দাদের তুলনায় যাযাবর বা বেদুইনরা নৈতিকভাবে ভালো। কেননা, আত্মার জন্ম হয় প্রাকৃতিক অবস্থায়, কিন্তু সামাজিকায়নের মাধ্যমে ভালো-মন্দ আয়ত্ত্ব করে। বেদুইনরা তুলনামূলকভাবে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি বসবাস করেন। প্রয়োজনের বেশি তারা কিছু ব্যবহার করেন না। তাদের আত্মা কম কলুষিত। বেদুইনদের কঠিন পরিস্থিতিতে বসবাস করতে হয়, ফলে তারা যেমন মানসিক, শারিরীক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী ও দৃঢ় হোন তেমনি উন্নত চরিত্রেরও অধিকারী হোন। অন্যদিকে শহুরে বাসিন্দারা বিলাসি ও দুনিয়াবি চাকচিক্যের মধ্যে বসবাস করার ফলে তাদের আত্মা খুব তাড়াতাড়ি কলুষিত হয়ে পড়ে। তাদের সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় তাদের জিন্দেগী তুলনামূলকভাবে সহজ। এই কারণে বেদুইনদের তুলনায় তারা ভীরু ও কম সাহসী। তারা নিজেরা নিজেদের রক্ষা করেতে পারেন না, সুরক্ষার জন্য উচ্চ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন পড়ে। এদেরকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে সহজে বশ করা যায়। অন্যদিকে বেদুইনরা নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেরাই করেন।
ইবনে খালদুনের মতে, আইনের ওপর অতি-নির্ভরশীলতা সেডেন্টারি বা শহুরে বাসিন্দাদের আরেকটি সমস্যা। এই সমাজের প্রকৃতিই এমন যে, এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর সংখ্যালঘু আধিপত্য বিস্তার করে। যখন এই আধিপত্যের সাথে ভীতি ও জুলুম যুক্ত হয়, তখন এটা সাধারণ মানুষের বীরত্ব ও প্রতিরোধের দৃঢ়তাকে ধ্বংস করে দেয়। শাস্তি হিসেবে আইন প্রয়োগ জনগোষ্ঠীর সাহসিকতাকে কমিয়ে দেয়, কেননা এটা বেইজ্জতি ঘটায়। যে আইনগুলো মানুষকে শিক্ষা ও নির্দেশনা দেয়ার লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করা হয় সেগুলোও অনিচ্ছাকৃতভাবে মানুষের সাহসিকতাকে হ্রাস করতে পারে, কারণ মানুষ নিজস্ব সক্ষমতার চাইতে উক্ত আইন-কানুনের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, খালদুন বারেবারে এর সাথে সাহসিকতার দিকে ইঙ্গিত করেন। নৈতিকতা ও সাহসিকতার জন্য খালদুন শহুরে বাসিন্দাদের তুলনায় বেদুইনদের তারিফ করেন। এমনকি, বেদুইনদের গোষ্ঠী সংহতি প্রবল।
এই গোষ্ঠী সংহতি বা আসাবিয়া হচ্ছে খালদুনের সমাজ ও রাষ্ট্রভাবনার দ্বিতীয় কিন্তু সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। মুকাদ্দিমার একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয় হচ্ছে আসাবিয়া : মরুভূমির কঠিন ও প্রতিকূল পরিবেশে বেদুইন বা যাযাবর গোত্রগুলোর ভেতর যে সংহতি গড়ে উঠে। মধ্যযুগের আরবি অভিধান অনুযায়ী, আসাবিয়া মানে হচ্ছে ‘একটি শক্ত বন্ধন যা কয়েকজন ব্যক্তিকে সমস্বার্থ বা মতের ভিত্তিতে একত্রিত করেছে’। রবার্ট আরউইন বলেন, মরুভূমির বাসিন্দারা যে ধরনের পারষ্পরিক নির্ভরশীল জীবন যাপনে অভ্যস্থ ছিলেন সেটাকেই খালদুন আসাবিয়া বিবেচনা করেছিলেন। যাযাবরদের মধ্যকার পরষ্পর-নির্ভরশীলতার কথা আরও অনেকে বলেছেন। বেদুইনরা গোত্রভিত্তিক সমাজে বসবাস করতেন। সে সমাজে সবাই কোনো না কোনোভাবে আত্মীয় বা রক্তের বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ। যে কোনো প্রয়োজনে ব্যক্তি তাঁর গোত্রের পাশেই দাঁড়ায়, ব্যক্তির পাশেও গোত্র দাঁড়ায়। গোত্রের প্রতি তাদের আনুগত্য ব্যক্তি-আনুগত্যের চেয়ে বেশি থাকে। মরুভূমিতে আসলে এই কাঠামোর বাইরে কোনো ব্যক্তি নিরাপত্তা নেই। খালদুন একজন এথনোগ্রাফারের মতো মরুভূমির বাসিন্দাদের ভেতরকার এ সংহতিকে খেয়াল করেছেন এবং বলা যায়, একে তত্ত্বায়নও করেছেন।
ইবনে খালদুনের কাছে আসাবিয়া হচ্ছে সাধারণ হেতু ও নিয়তির বোধ, কুটুম্বিতার ওপর নির্ভরশীল আনুগত্যের বাঁধন; তবে, কুটুম্বিতাই একমাত্র নয়। আসাবিয়া শক্তিশালী হবে নাকি দুর্বল হবে সেটা যেমন প্রধানত নির্ভর করে কুটুম্বিতার ওপর, তেমনি ধর্মও শক্তিশালী সংহতি তৈরি করতে পারে। আবার, আসাবিয়ার সাথে বাণিজ্যের মতো দিকগুলো জড়িত রয়েছে।
ইবনে খালদুনের চিন্তায় আরেকটি গুরুত্বভাবনা হচ্ছে রাজকীয় কর্তৃত্ব বা মুল্ক; আমরা একে রাষ্ট্রও বলতে পারি। লিডারশিপের সাথে মুলক-এর পার্থক্য রয়েছে। নেতা বা লিডার তার শাসন মানার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে পারেন না, কিন্তু যিনি মুলক প্রতিষ্ঠা করবেন তাঁর সেই সক্ষমতা আছে। তাঁর সেই সক্ষমতা আসবে আসাবিয়া এর মাধ্যমে। অর্থাৎ, রাজকীয় কর্তৃত্ব অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে নেতাকে তাঁর অনুসারিরা মেনে চলবে; এই মেনে নেয়ার বিষয়টি ঘটে আসাবিয়ার কারণে।
ইবনে খালদুনের কাছে আসাবিয়া কোনো স্থিতিশীল ঘটনা নয়, বরঞ্চ এটা গতিশীল। এটা কোনো একটি যাযাবর বা বেদুইন গোষ্ঠীকে ক্ষমতা বা মুলক প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়। সেদিক থেকে আসাবিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য বা অভিমুখ হচ্ছে dawlah বা রাজ্য বা ডাইনেস্টি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আসাবিয়া ধারণার সাথে উপর্যুক্ত দুই সামাজিক জীবনের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে; অথবা আমরা বলতে পারি, আসাবিয়া এর কারণেই এক সমাজ থেকে আরেক সমাজের উত্তরন/অবনমন ঘটে।
যাযাবর বা বেদুইনদের মধ্যে এই গোষ্ঠী সংহতি বা আসাবিয়া শক্তিশালী থাকে। তাঁদের মধ্যকার যে একতা ও পরষ্পর-নির্ভরশীলতা, সেটা ওই সংহতির কারণেই। যে নেতা যথেষ্ট শক্তি ও ক্ষমতাবান গোত্রের আসাবিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি একটি মুলক তৈরি করে ফেলতে পারেন। বেদুইনদের দৃঢ় নৈতিকতা, সাহসিকতার সাথে আসাবিয়ার যুক্ততা তাঁদেরকে সামরিক সুবিধা প্রদান করেছিল। ফলে, শক্তিশালী আসাবিয়া সম্বলিত বেদুইনরা অলস শহুরে ‘সিভিলাইজেশন’ বা সভ্যতাকে দখল করে নতুন মুলক বা কর্তৃত্ব স্থাপন করে। কিন্তু কয়েক বছর পর শক্তিশালী বেদুইনরা শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন, অলস হয়ে পড়েন, তাদের সামরিক, রাজনৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা হারিয়ে যায়। তাঁদের আসাবিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। সহজ নাগরিক জীবন তাদেরকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। বেদুইন থাকা অবস্থায় তারা যেভাবে নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে পারতেন, এখন আর সেটা করতে পারেন না। ফলে প্রতিরক্ষার জন্য নির্ভর করতে হয় ভাড়াটে সৈনিকের ওপর। এই সৈনিকদের বেতন-ভাতার জন্য এমন কর আরোপ করা হয় যা জনগণের জন্য জুলুম হয়ে উঠে। মুলক-কে ধীরে ধীরে দুর্নীতিগ্রস্থ ও অপচয়কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পুরো শাসনব্যবস্থা নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায় তিন/চার প্রজন্ম বা ১০০-১২০ বছরের মাথায় তারা আরেকটি শক্তিশালী আসাবিয়া সম্বলিত বেদুইন শক্তির কাছে পরাজিত হন। উত্থান-পতনের এই চক্র এভাবেই চলতে থাকে। ইবনে খালদুনের বিখ্যাত চক্রাকার ইতিহাস-তত্ত্বের এটাই গোড়ার কথা। খালদুন এই যে মডেল বা উত্থান-পতনের তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেটাকে ইসলামের প্রথম যুগের শাসনামল, মধ্যযুগের উত্তর-আফ্রিকার ইতিহাস, একাদশ-দ্বাদশ শতকের আলমোরাভিদদের উত্থান-পতনে প্রয়োগ করা যায়।
আসাবিয়ার অবক্ষয় দু’ভাবে ঘটতে পারে। প্রথমত, ক্ষমতা গ্রহণের বা মুলক প্রতিষ্ঠার এক প্রজন্মের পরই দেখা যায় আগের সেই বেদুইন সমাজে শহুরে সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে, একদিকে বিলাসিতা অন্যদিকে আলস্য তাদের ঘিরে ফেলে। তাদের মধ্যে এক ধরনের হায়ার্কি দেখা দেয়, বিভিন্ন দফতরের বিভিন্ন পদে একেকজন আসীন হন। আগে যেখানে সবাই একত্রে গৌরবের অংশীদার থাকতেন, এখন কেবল রাজাই সেই গৌরবের অধিকারী হোন। এভাবে ধীরে ধীরে সংহতি কমতে থাকে, এবং তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্মে একেবারে শূন্যের কোটায় চলে যায়। অর্থাৎ, ইবনে খালদুন বিলাসিতাকে আসাবিয়ার অবক্ষয়ের গুরুতর কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন। দ্বিতীয়ত, রাজা বা ক্ষমতাসীন গোত্র-প্রধান যখন নিজের পরিবার ও গোত্রের লোকদের সম্ভাব্য গদি-দখলকারী বিবেচনা করে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ ও দফতর থেকে সরিয়ে নেন, তখন তিনি আসলে জনগণের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হাসিল করেন। কিন্তু গোত্রের সাথে অংশীদারিত্ব ভাগাভাগি না করে কেবল নিজের নামেই রাজকীয় কর্তৃত্ব কায়েম করেন। তিনি তখন নিজেদের লোকদের ওপর ভরসা না করে অন্যান্য গোত্রের লোকদের ভাড়া করেন। ফলে একধরনের পৃষ্ঠপোষক-খরিদ্দার সম্পর্ক তৈরি হয়। কুটুম্বিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আসাবিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শক্তিশালী আসাবিয়ার আরেকটি বেদুইন গোত্র সেটা দখল করে নতুন রাজ্যের পত্তন ঘটায়।
ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী আসাবিয়া থেকে মুলক যে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা লাভ করে সেখানে ধর্মও সহায়ক উপাদান হতে পারে। ধর্ম ও আসাবিয়া একত্রিত হয়ে বৃহৎ আকারের প্রতিপক্ষকেও পরাজিত করে ফেলা যায়। ধর্মের সম্ভাব্য শক্তির কথা স্বীকার করে নিয়েও খালদুন মনে করেন, ধর্ম যদি রাষ্ট্রগঠনে ভূমিকা রাখতে চায় সেক্ষেত্রেও আসাবিয়ার জরুরত রয়েছে। খালদুন তাঁর এই অবস্থান বিভিন্ন হাদিস দিয়ে জায়েজ করতেন।
খালদুন রাজকীয় কর্তৃত্ব বা Kingship-কে সহজাত ও অনিবার্য বলে মনে করতেন। এর পিছনে প্রধান যুক্তি হচ্ছে মানুষকে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ-ফ্যাসাদ মেটানোর জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাউকে প্রয়োজন হয়। যার শক্তিশালী আসাবিয়া রয়েছে তিনি সেটা করতে পারবেন। আমরা দেখেছি, রাজকীয় কর্তৃত্ব বা তৎকালীন অথোরিটির সাথে আসাবিয়ার সম্পর্কটি জটিল। একদিকে আসাবিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুলক বা রাষ্ট্র স্থাপন করা, অন্যদিকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে সেটা জনগণের আসাবিয়াকে নষ্ট করে ফেলে। তাঁর মতে, রাজকীয় কর্তৃত্ব মানেই হচ্ছে ক্ষমতাবলে বা শক্তিবলে শাসন; ওয়েবারের রাষ্ট্রের সংজ্ঞার মতোই – human community that (successfully) claims the monopoly of the legitimate use of physical force within a given territory…। যখন জনগণের আসাবিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে তখন কর্তাব্যক্তিরা সহজে শাসন করতে পারেন। তদপুরি আসাবিয়া দুর্বল হয়ে পড়লে দিনশেষে খোদ রাষ্ট্রই দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যভাবে বললে, ‘পুঁজির ভেতর যেমন লুকিয়ে থাকে পুঁজির ধ্বংসের সূত্র’ তেমনি আসাবিয়ার ভিতরে লুকিয়ে আছে আসাবিয়া ধ্বংসের সূত্র।
যদিও এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা গোষ্ঠী সংহতির ফসল তবু, খালদুন অর্থনীতির ভূমিকার কথাও আলাপ করেন। যখন গোষ্ঠী সংহতি দুর্বল হওয়ার সাথে অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যায় তখন কর্তৃত্বের পতন ঘটে। অর্থাৎ, রাজনৈতিক পতনের সাথে অর্থনৈতিক পতনের দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। মুল্ক প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে কেবল ধর্মীয় আইন দ্বারা অনুমোদিত কর আরোপ করা হয়। নতুন ক্ষমতাসীনদের মধ্যে তখনো মরুভূমিতে গড়ে ওঠা সদগুন বিরাজ করে। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অনীহা থাকে। কিন্তু শহুরে জীবন যাপন জনিত বিলাসিতা আগের সদগুনগুলোকে দুর্বল করে দেয়। নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ভাড়াটে সৈনিকদের বেতন-ভাতার জন্য জোরজবরদস্তি করে বেশি করারোপের দিকে শাসকগোষ্ঠী ধাবিত হয়। যেহেতু শুল্ক বেড়ে যায়, এমতাবস্থায় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজে যুক্ত হতে অনীহা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে রাজস্ব কমতে থাকে। এমনকি, শাসনব্যবস্থা তখন এতই কাহিল হয়ে পড়ে যে, সে দূর-দূরান্ত থেকেও কর আদায় করতে পারে না। আগে যেখানে কর কম থাকা সত্ত্বেও রাজস্ব বেশি আয় হতো, পরে কর বেশি হলেও রাজস্ব কমে যায়। কর আদায়ে জুলুম বেড়ে যায়। এই সময়ে, অর্থাৎ, চূড়ান্ত পর্বে, শাসক তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে অর্থ ব্যায় করেন। খালদুন লিখেন :
After their prosperity is destroyed, the dynasty goes farther afield and approaches its other wealthy subjects. At this stage, feebleness has already afflicted its (former) might. (The dynasty) has become too weak to retain its power and forceful hold. The policy of the ruler, at this time, is to handle matters diplomatically by spending money. He considers this more advantageous than the sword, which is of little use. His need for money grows beyond what is needed for expenditures and soldiers’ salaries. He never gets enough. Senility affects the dynasty more and more. The people of (other) regions grow bold against it. At each of these stages, the strength of the dynasty crumbles. Eventually, it reaches complete ruin. It is open to domination by (any) aggressor. Anyone who wants to attack it can take it away from those who support it. If this does not occur, it will continue to dwindle and finally disappear – like the wick of a lamp when the oil is exhausted, and it goes out.
উল্লেখ করা দরকার, ইবনে খালদুন তার সময়ের অন্যান্য চিন্তকদের তুলনায় অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি করেছেন। তবে, অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো খালদুনের অর্থনৈতিক চিন্তার বেলাতেও নৈতিক বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। খালদুন ব্যাবসা-বাণিজ্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। বাণিজ্য বৈধ, কিন্তু এর চর্চা ও পদ্ধতিতে প্রতারণা এবং জুয়ার উপাদান রয়েছে বলে তিনি মনে করতেন। রবার্ট আরউইন এও বলেন যে, পুঁজির অতিরিক্ত পুঞ্জিভবনের নিন্দাও করতেন খালদুন।
মিল-অমিল-প্রভাব
ইবনে খালদুন তাঁর উত্তাল রাজনৈতিক জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তাঁর কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে বহু গোত্রের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। তিনি কেবল মধ্যস্থতাই করতেন না, বিভিন্ন ট্রাইবাল গোষ্ঠীর যুদ্ধে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ফলে, তিনি নিজে শহুরে সংস্কৃতি মানুষ হলেও মরুভূমির যাযাবর বা বেদুইনদের সম্পর্কে তিনি প্রচুর সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। মানবসমাজকে এভাবে ব্যাখ্যা করার রসদ বোধহয় তিনি তাঁর এই অভিজ্ঞতা থেকেই পেয়েছিলেন।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, খালদুনের চিন্তায় মোড অফ লিভিং এর ভিত্তিতে সমাজকে ভাগ করা, গোষ্ঠী সংহতি এবং ইতিহাসের চক্রীয় মডেল সবকিছু একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। খালদুন পরবর্তী বহু চিন্তক খালদুন দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি খালদুনের চিন্তার এই উপাদানগুলোকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আধুনিক জমানাতেও অনেকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন নিয়ে যখন ইতিহাস লিখেছেন তখন তারা খালদুনের দিকে তাকিয়ে ইতিহাসের চক্রাকার মডেলকে গ্রহণ করেছেন। যেমন, চক্রাকার তত্ত্বের হদিস পাওয়া যায় অসওয়ার্ল্ড স্প্লেংলারের দি ডিক্লাইন অফ দিয় ওয়েস্ট গ্রন্থে। খালদুনের মতো স্প্লেংলারও শহুরে জীবন যাপন ও সংস্কৃতির প্রতি বিরোপ ছিলেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি খালদুন দ্বারা প্রচণ্ড প্রভাবিত ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, খালদুনের সন্ধান পেয়ে টয়েনবি পুলকিত বোধ করেছিলেন।
রবার্ট আরউইন মনে করেন যে, ইতিহাসের চক্রীয় তত্ত্বসমূহের একটি বৈশিষ্টই হচ্ছে নৈরাশ্যবাদ। এটাকে তিনি অবশ্য খালদুনের যুগ-বৈশিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেন। ফলে কেবল যে নৈরাশ্যবাদই ছিল তা নয়, তাদের মধ্যে এক ধরনের যায় দিন ভালো ধরনের মনোভঙ্গিও ছিল। খালদুন যে পরিস্থিতিতে লেখালেখি করছিলেন, তখন একদিকে চলছিল রাজবংশগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতা, অন্যদিকে মহামারিতে স্বজন হারানোর ধাক্কা। আরবদের গৌরবময় দিনগুলো তখন শেষ হওয়ার পথে। চতুর্দশ শতকের আরব দুনিয়ার কোনো বাসিন্দার লেখালেখিতে নৈরাশ্যবাদী উপাদান থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।
অনেকে ইবনে খালদুনের সাথে পনের শতকের ইতালীয় দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির তুলনা করেছেন। খালদুনকে যেমন এক জটিল রাজনৈতিক পরিবেশে কাজ করতে হয়েছিল, ম্যাকিয়াভেলিকেও করতে হয়েছিল। দুজনকে তৎকালীন রাজ্যের কূটনৈতিক মিশনে অংশ নিতে হয়েছিল। মুকাদ্দিমার মতো দি প্রিন্স-এ ইতিহাস ছিল কেন্দ্রীয় গুরুত্বের জায়গায়। রাজনীতির জন্য ইতিহাসের মধ্যে খুড়োখুড়ি করতে হয়েছিল। রবার্ট আরউইনের মতে, মুকাদ্দিমার মতো দি প্রিন্সও বিষণ্ণ ও নৈরাশ্যবাদী কাজ। তবে দুজনের মধ্যে অমিলও প্রচুর। ম্যাকিয়াভেলির কাছে ইতিহাস অধ্যয়ন রাজ্যপরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা প্রদানের নিমিত্তে, খালদুন ইতিহাসের বাতেনি রূপ ধরতে চেয়েছিলেন। ম্যাকিয়াভেলি শাসনের মনস্তত্ব, গৌরবের সন্ধান এবং উচ্চ রাজনীতিতে ব্যক্তিত্বের ভূমিকা নিয়ে আগ্রহী হলেও খালদুন এসব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না। দি প্রিন্স-এ ক্ষমতা অর্জন ও ধরে রাখার বিষয়ে ‘সুযোগ’ এর ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। ম্যাকিয়াভেলির কাছে শাসনের প্রয়োজনে অনৈতিক আচরণ করার যৌক্তিকতা ছিল, কিন্তু খালদুন এক্ষেত্রে প্রচণ্ড নৈতিকবাদী।
বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে গতায়াত
আমরা এই প্রবন্ধে খুব সংক্ষেপে ইবনে খালদুনের রাষ্ট্র ও সমাজভাবনার ওপর আলোকপাত করলাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা কেন খালদুনকে পাঠ করতে গেলাম? অবশ্যই, খালদুন যে জমানা নিয়ে লিখেছিলেন আমরা সেটা ছেড়ে বহুদূর চলে এসেছি। আমরা বর্তমানের কোনো সমস্যার সমাধান মধ্যযুগের কোনো চিন্তকের কাছে খুঁজতে যাবোনা। কিন্তু ‘আধুনিকতা’র ইতিহাসেও যদি আমরা খেয়াল করি তাহলে দেখবো, আধুনিকতার বিকাশ ইউরোপে ঘটলেও, এবং পরবর্তীতে এটাকে কেবল ইউরোপের একক বস্তু/ফসল হিসেবে ইউরোপ দাবি করলেও, আদতে এতে মিশে ছিল নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তিগত উপাদান। ইউরোপে যখন আধুনিকতা তৈয়ার হচ্ছিল তখন বাকি দুনিয়া অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল – এই বক্তব্য/দাবি আদতে ইউরোপের আধুনিক হয়ে ওঠার পরের বক্তব্য, সেটা অন্য ইতিহাসের গল্প, সে গল্প ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসের সাথে যুক্ত। তদপুরি সতর্ক থাকা দরকার, সেই অ-ইউরোপীয় সূত্রসমূহকে ‘আধুনিকতা’র প্রাথমিক ধাপ হিসেবে পাঠ করার কোনো মানে হয়না। বরঞ্চ বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সিলসিলার সাথে সহজাত গতায়াত এর একটি নজির হিসেবে আমি এটা উল্লেখ করলাম। ইবনে খালদুনকে পাঠ করা দরকার এই কারণে যে, বিভিন্ন সংস্কৃতির অজস্র চিন্তকের সাথে আমাদের মোলাকাত দরকার। নিজেদের জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণ মানে দুয়ার বন্ধ করে কেবল নিজেকে নিয়ে ভাবা নয়, বরঞ্চ নানাবিধ চিন্তার সংমিশ্রণ ও বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির মধ্যকার স্বাভাবিক গতায়াত জরুরি। এই জায়গা থেকে মনে করি, ইবনে খালদুনের চিন্তাভাবনা থেকেও আমরা রসদ খুঁজে যথাযথ এস্তেমাল করতে পারবো।
সহায়ক গ্রন্থ :
Aditya Nigam, Decolonizing Theory : Thinking Across Tradition, Bloodburry, 2020
Ibn Khaldun, The Muqadimah, [Tr. Franz Rosenthal] Princeton University Press, 2005
Nurul Kabir, Deposing of a Dictator: Revisiting a Magnificent Mass Uprising After 50 Years, Samhati Prokashan, 2020
Patricia Crone, Mediaval Islamic Political Thought, Edinburgh University Press, 2005
Syed Farid Alatas, Applying Ibn Khaldun : The Recovery of a Lost Tradition in Sociology, Routledge, 2014
Zaid Ahmad, The Epistemology of Ibn Khaldun, Routledge, 2010
ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, [অনু. গোলাম সামদানী কোরায়শী], দিব্য প্রকাশ, ২০০৭
রবার্ট আরউইন, ইবনে খালদুন : জীবন, চিন্তা ও সৃজন, [অনু. সহুল আহমদ] দিব্য প্রকাশ, ২০২০
সহুল আহমদ, খালদুন-চর্চা, উপনিবেশবাদী পাঠ ও অন্যান্য, শুদ্ধস্বর, ২০২২
- প্রথম প্রকাশ : রাষ্ট্রচিন্তা, দশম সংখ্যা (বর্ষ ৭, সংখ্যা ২)