- উত্তরণ দাসগুপ্ত ; অনুবাদ : সৈয়দ ফরহাদ
সংঘাত নিয়ে স্থানীয় অথবা আন্তর্জাতিক- উভয়ক্ষেত্রেই জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গী থাকা খুব জরুরী, কারণ সংঘাত কৌশলের অংশ হিসেবে প্রায়ই নারীরা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
আমি ভালো করেই জানি, মণিপুরের যে ভিডিওটি এ সপ্তাহের শুরুতে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে কী আছে। তাই এটা আমার আর নতুন করে দেখার দরকার পড়েনি। দু’মাস আগে নতুন করে শুরু হওয়া জাতিগত সংঘাতে অন্তত ১৪২ জন নিহত এবং এর চেয়েও বেশি সংখ্যক আহত হয়েছে। এই সংঘাত থামার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি দেশব্যাপী এমন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে যে, এমনকি নরেন্দ্রো মোদি পর্যন্ত এ নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় নিন্দা জানিয়েছেন। অথচ উত্তর- পূর্ব রাজ্যের সংঘাত নিয়ে চুপ থাকার কারণে তিনি বিরোধিদের সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। রাজ্যের পুলিশ বাহিনী হামলার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে।
ব্রিটিশ নারীবাদী পন্ডিত সিন্থিয়া ককবার্ন বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন এই বলে যে- সংঘাত নিয়ে জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে যাওয়া তো যাবেইনা বরঞ্চ এটি “জরুরি প্রয়োজন”। যুদ্ধে সংঘটিত যৌন সহিংসতা যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে প্রায়ই ব্যবহৃত হয় যা “ওয়ার রেপ” হিসেবেও পরিচিত। এ ধরনের সহিংসতার প্রয়োগ আমরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে, রুয়ান্ডা এবং সিয়েরা লিয়োনের জাতিগত দাঙ্গায় এবং সাবেক যুগস্লাভিয়ায় দেখেছি ( ১৯৯১- ১৯৯৫)। যদিও লৈঙ্গিক সহিংতার বিরুদ্ধে সেই প্রাচীনকাল থেকেই আইন আছে এবং ২০০৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যৌন সহিংসতাকে গণহত্যার মতোই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আইন বিষয়ে পন্ডিত ব্যক্তিরা, যেমন- ভারত এইচ দেশাই এবং বলরাজ কে শিধু দেখিয়েছেন যে, আইনগুলোর বাস্তবায়ন সেই শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির রয়েছে।
আমেরিকান সাংবাদিক এবং উপন্যাসিক হেলেন বেন্ডিক্ট অত্যন্ত জোর গলায় দাবী করেন যে সারা বিশ্বে যুদ্ধে শত্রুপক্ষ থেকে শুরু করে বেসামরিক লোকজনের প্রতি এমনকি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও যৌন সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো ঘটার কারণ হল হাইপার মাসকুলিন সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি আবু গারীব কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যও দায়ী। এই বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশল শুধুমাত্র এক দেশের সাথে আরেক দেশের যুদ্ধের সময়ই নয়, বরং গৃহযুদ্ধেও ব্যবহৃত হয়। যেমনটি আমরা মনিপুরে দেখতে পাচ্ছি। ভারতে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী এবং জাতিগত সংঘাতে প্রায়ই ধর্ষন কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
শেখর গুপ্ত পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র বেন্ডিট কুইনে ডাকাত থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ফুলন দেবীর প্রতি যৌন সহিংসতাকে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। মালা সেন এর লেখা ফুলন দেবীর জীবনী থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে উত্তর প্রদেশের গ্রামে তাঁর প্রথম জীবন এবং ৭০ দশকে শেষদিকে ডাকাত হিসেবে তার কর্মজীবন তুলে ধরা হয়। উত্তর প্রদেশের একটা “নিচু” জাতের পরিবারে জন্ম নেওয়া দেবীকে (সীমা বিশ্বাস) কৈশোরেই এক বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং এরপর, আত্মীয়স্বজনের সাথে তিনি একের পর এক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। অভিযোগ আছে যে, এই আত্মীয়স্বজনরাই তাঁর পারিবারিক জমি দখল করে। এতে আরও দেখানো হয়- দেবীকে একদল ডাকাত অপহরণ করে। যখন ডাকাত সর্দার বাবু গুজ্জার তাকে বার বার ধর্ষণ করতে থাকে, ঠিক তখন আরেকজন ডাকাত সদস্য বিক্রম মাল্লা দেবীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এই বিক্রম মাল্লাই ডাকাত সরদারকে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে দেবী এবং বিক্রমের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কিন্তু ডাকাত দল এর প্রধান সরদার ঠাকুর শ্রীরাম জেল থেকে ছাড়া পেলে দেবীর দিকে তার নজর যায় এবং বিক্রম মাল্লাকে তিনি হত্যা করেন। এরপর দেবী অপহৃত হন, লাঞ্ছিত হন এবং বেহমাই গ্রামে আটকবস্থায় শ্রী রাম এবং অপরাপর ডাকাত সদস্যদের দ্বারা উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হন। মুক্তি পাওয়ার পর দেবী আরেক ডাকাত মান সিং এর সাথে মিলে নিজের ডাকাত দল গড়ে তোলেন। দেবী এবং সিং মিলে যেহেতু “সম্ভ্রান্ত” জাতের গ্রাম থেকে লুট করে দলিত এবং “নিচু” জাতের মানুষদের সহায়তা করতেন, ফলে দেবীকে নিয়ে বুন্দলখান্ড উপত্যকায় কিংবদন্তী ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিক ম্যারি অ্যান ওয়েভার দি আটলান্টিকে লেখেন “আট শতাব্দি ধরে ভারতের ডাকাতরা এমন সব বাটপারিতে আচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু ফুলনের চাইতে বেশি চতুর আর কেউই ছিলনা”। তিনি উল্লেখ করেন “গোটা জাতির কল্পনা যেন ফুলনের কাছে বন্দী ছিল”।
১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেবী খবর পান; বেহমাই গ্রামে ঠাকুরের বিয়ের অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। খবর পেয়ে দেবী তার দলবল নিয়ে গ্রামে যান এবং অন্তত ২০ জনকে গুলি করে হত্যা করেন। ধারণা করা হয় যাদের অনেকেই তাকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করেছিল। এই ঘটনায় উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়, যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং পুলিশ দেবীকে আটক করতে সাঁড়াশি অভিজান চালায়। তবে দেবী, শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
এ ঘটনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে ওয়েভার লেখেন “যখন তার আত্মসমর্পণের এক জমকালো আয়োজনের ঘোষনা এলো, নয়া দিল্লিতে অবস্থানরত প্রায় সমস্ত বিদেশি সাংবাদিক এবং প্রায় সমান সংখ্যক ভারতীয় সাংবাদিক, টেলিভিশন ক্রু, মানবাধিকার কর্মকর্তা, নারীবাদী এবং বিশিষ্ট লোকজন ভিন্ড গ্রামে ছুটে যান” “অবশ্যই কেউই জানতোনা কে এই ফুলন দেবী, আমাদের কেউই কোনদিন ডাকাত রানী দেখেনি আগে। এমনকি পুলিশের কাছেও তার কোন ফটোগ্রাফ পর্যন্ত ছিলনা।”
যদিও দেবীকে কখনোই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং মুক্তির আগ পর্যন্ত দেবী প্রায় এক যুগ কারাবন্দী ছিলেন। ২০০১ সালের ২৫ জুলাই, খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সমাজবাদী পার্টি থেকে পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। অভিযুক্ত খুনী শের সিং রানা ২০১৪ সালে দোষী সাব্যস্ত হন, যদিও দিল্লী হাইকোর্ট থেকে ২০১৬ সালে জামিন পেয়ে যান। তার জীবনও খুব শীঘ্রই বায়োপিকের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
বেন্ডিট কুইন চলচ্চিত্রটি প্রাথমিকভাবে সমাদৃত হয়। কিছু কিছু সমালোচক এটাকে শ্রিন্ডার লিস্ট এবং ব্রাজিলিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক গ্লোবার রোচার এর আন্তোনিয় দাস মোর্টেস এর সাথে পর্যন্ত তুলনা করেন। হিন্দি ভাষার সেরা ফিচার চলচ্চিত্র হিসেবে বেন্ডিট কুইন ৪৩ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেয় এবং সীমা বিশ্বাস জিতে নেন সেরা অভিনেত্রী পুরষ্কার। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ৬৭ তম একাডেমি এওয়ার্ডে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র ক্যাটগরিতে ভারতের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। যদিও দেবী এবং সেন দুজনেই এতে যে যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে সে বিষয়ে তাদের আপত্তি জানান। সে সময় অরুন্ধতী তার বহুল আলোচিত “The Great Indian Rape Trick I” এবং “The Great Indian Rape Trick II” প্রবন্ধে চলচ্চিত্র পরিচালকের কঠোর নিন্দা করেন। রায় লেখেন- “তাঁর (ফুলনের) কোন সুনির্দিষ্ট, দ্ব্যার্থহীন এবং লিখিত সম্মতি ছাড়াই” ধর্ষণ এবং লাঞ্ছনার যেন পুনঃমঞ্চায়ন করা হয়। তখনও অরুন্ধতী রায় বুকার পুরুষ্কার জেতেননি। প্রবন্ধে রায় আরও উল্লেখ করেন “আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এটা কোন ফৌজদারী অপরাধ নয়”।
অরুন্ধতীর এই যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত লেখেন “চলচ্চিত্রটি যৌন নিপীড়নকে ফুলনের ডাকাত রানী হয়ে উঠার কারণ হিসেবে দেখাতে গিয়ে এর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটকে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং পুরো বিষয়টিকে ধর্ষণ এবং প্রতিশোধের সরল বৃত্তে আটকে ফেলেছে”। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ রঞ্জনী মজুমদার ৮০’র দশকের ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার আদর্শ ফর্মূলা হিসেবে চিহ্নিত করেন। দিক্ষীত আরও উল্লেখ করেন, ২০১২ পরবর্তী ধর্ষণ বিরোধী সময়ে “নারীর কর্তাসত্ত্বা নিয়ে অন্তত পাবলিক ডিবেট সম্ভব”। নয়াদিল্লীতে, ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ২৩ বছর বয়সী প্যারামেডিকেল ছাত্রী ধর্ষণ এবং খুনের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে ব্যাপক আকারে প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং যৌন অপরাধ সংক্রান্ত আইনের মৌলিক পরিবর্তন হয়।
“ব্যান্ডিট কুইন” ঘিরে বিতর্ক এবং এ সপ্তাহে মনিপুরের এইসব ভয়াবহ ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার মাঝে তিন দশক পেড়িয়ে গেছে। সংঘাতে নারীর শরীরকে লক্ষবস্তুতে পরিণত করাও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। ২০০৪ এর জুলাই মাসে ১৩ জন নারী এক চমকপ্রদ প্রতিবাদের মাধ্যমে সারাবিশ্বকে হতবাক করে দেয়। তারা ৩২ বছর বয়স্ক এক নারীর প্যারামিলিটারি সৈন্য দ্বারা ধর্ষিত এবং খুন হওয়ার প্রতিবাদে ইম্ফালের আর্মি ক্যাম্পের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের হাতে ছিল ব্যানার। ব্যানারে লেখা ছিল “ইন্ডিয়ান আর্মি আমাদের ধর্ষন করেছে”। মণিপুর কয়েক দশক ধরে জাতিগত এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সহিংতায় উত্তাল ছিল এবং সেখানে সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৫৮ কার্যকর ছিল। নারীবাদী পন্ডিত পারমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন প্রতিবাদের “এই শান্ত অথচ তীব্র ধরণ ভারত রাষ্ট্রের তার নিজের নারী নাগরিকদের প্রতি হিংস্র আচরণকে তুলে ধরে”। এই প্রতিবাদ ঘটনার গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলে এবং এক মৌলিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়।
সাংবাদিক প্রিয়াংকা দুবে তার No Nation for Women গ্রন্থে লিখেছেন (২০১৯), “পিতৃতন্ত্র এই সমস্ত সংকটের গোড়া এবং অন্যান্য বিষয়গুলো (শ্রেণী, জাত, ধর্ম) যেগুলো নারীর প্রতি সহিংসতায় ভূমিকা রাখে সেগুলো একে ঘিরে ঘুরপাক খায়। নারীর প্রতি সহিংসতায় প্ররোচক হিসেবে ভূমিকা রাখা এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করা খুবই জরুরী। কারণ নারীর প্রতি সহিংসতা দ্বন্দ সংঘাতের ফলাফল নয়, বরং সংঘাতের এক চিরস্থায়ী দশা।
- উত্তরণ দাসগুপ্ত নয়াদিল্লী ভিত্তিক একজন লেখক ও সাংবাদিক। তিনি সোনিপাতের ওপি জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ান।
- সৈয়দ ফরহাদ, গায়ক, গীতিকার ও কবি।
মূল প্রবন্ধের হদিস : বিজনেস স্টান্ডার্ড, ২২ জুলাই ২০২৩