তর্জমা : পারভেজ আলম
ভূমিকা
ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের লেখা সর্বশেষ রচনা। নাজি অধিকৃত ফ্রান্স থেকে পালাবার পূর্বে এই লেখাটি তিনি লেখেন। ১৯৩২ সালে নাজি পার্টি জার্মানিতে ক্ষমতায় আসার সময়ই তিনি দেশ ত্যাগ করেন ও পরে ফ্রান্সে আশ্রয় নেন। ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখলের সময় নাজি বাহিনি তার বাড়িতে হানা দেয়ার মাত্র একদিন আগে তিনি প্যারিস থেকে পালাতে সক্ষম হন। এই রচনাটি তিনি লিখেছিলেন প্যারিসে তার শেষদিনগুলিতে।
বেনিয়ামিন ফ্রান্স ছেড়েছিলেন একটা রিফিউজি দলের সাথে, যাদের লক্ষ্য ছিল স্পেন ও পর্তুগালের পথ পার হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিজরত করা। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্স থেকে পালানো ইহুদি রিফিউজিরা সাধারণত স্পেন পার হয়ে মরোক্ক বা পর্তুগাল গমন করতেন সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোথাও হিজরত করার জন্যে। বেনিয়ামিনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। ফ্রাংকো সরকার সেই সময় স্পেনে আসা রিফিউজিদের গ্রেফতার করে ফেরত পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বেনিয়ামিনের দলটিকেও আটক করা হয়েছিল ফ্রান্সে ফেরত পাঠাবার উদ্দেশ্যে। নাজিদের হাতে পরার সম্ভাবনা দেখে এসময় তিনি আত্মহত্যার করেন। এই আত্মহত্যার ফলে যে গোলমালের সৃষ্টি হয়, তার ফলেই স্পেন সরকার রিফিউজি দলটিকে ছেড়ে দেয়। ফলে দলটি পর্তুগালে যাত্রা করতে সক্ষম হয়, এবং সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
এই রিফিউজি দলটির একজন সদস্য ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক হান্না আরেন্ট। বেনিয়ামিন ও আরেন্ট, উভয়েই জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল বা ক্রিটিকাল থিওরির ঘরানার সাথে সম্পর্কৃত ছিলেন। আরেন্টের হাত ধরেই বেনিয়ামিনের সর্বশেষ এই রচনাটি পৌছে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই রচনাটি বেনিয়ামিনের অন্যতম প্রভাবশালী লেখায় পরিণত হয়েছে। লেখাটি ইংরেজিতে On The Concept of History এবং Thesis on the Philosophy of History “ নামে প্রকাশিত হয়েছে, যারমধ্যে প্রথম নামটি মূল জার্মান নামের (Über den Begriff der Geschichte) প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ। এইখানে বাংলা অনুবাদ ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে– ও মূল জার্মান টাইটেলের অনুগামী।
ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে-র প্রধান বিষয়বস্তু ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ঐতিহ্যের মধ্যে হাজির থাকা ইতিহাসের ধারণা। বেনিয়ামিনের আমলের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ঐতিহ্য বহন করা বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষগুলো সরল রৈখিক সময়ের মধ্য দিয়ে ক্রমশ প্রগতির দিকে এগিয়ে যাওয়া যেই ধরণের ইতিহাসবাদী চিন্তায় আটকে গিয়েছিল, তা এই লেখার সমালোচনার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। বেনিয়ামিন ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে অন্য ইতিহাসবাদী পদ্ধতি থেকে আলাদা করতে চেয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন যে প্রগতি নির্ভর, সমসত্ত্ব ও শূন্য, ঘরির কাটায় মাপা সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা ইতিহাসের ধারণা ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করতে পারে না। মজলুমের ইতিহাস-ঐতিহ্য শাসক শ্রেণীর হাতে দখল হওয়া থেকে ঠেকাতে পারেনা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী হিস্টোরিয়গ্রাফি তৈরি করার জন্যে তাই ভিন্ন ধরণের সময়ের ধারণারও প্রয়োজন। এই লেখায় এমন একটি সময়ের ধারণাও তিনি হাজির করেছেন, যা একটা মুহূর্তকে, একটা অতীতকে ইতিহাসের ঘটনাক্রমের প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। এই বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াটা ঘটে অতীতের মধ্যে বর্তমানের নিজেকে চিনতে পারার প্রক্রিয়ার মধ্যে, যা ঘটে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ইতিহাস লেখক বা ঐতিহাসিক কর্তার মাধ্যমে যিনি অতীতের সেই ছবিকে আকড়ে ধরতে চান। যিনি অতীত ও বর্তমানের মিলিত দিগন্তে হাজির থাকা কনস্টেলেশন বা বা বিশেষ আকৃতি পাওয়া নক্ষত্রপুঞ্জটিকে দেখতে পান।
ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে লেখাটি একটি আধুনিক শিল্পও। এবং এই শিল্পের মধ্যেও পাওয়া যায় একটা বিশেষ সময়ের অভিজ্ঞতা। ৯ নম্বর থিসিসে বর্ণিত পল ক্লির পেইন্টিং নতুন ফেরেশতা (এঞ্জেলাস নোভাস)-এর মতোই এই রচনাটি দৃশ্য বর্ণনা করার চাইতে দৃশ্য উৎপন্ন করায় বেশি পারঙ্গম। প্রতিটা থিসিসই একেকটা আলাদা মুহূর্তের অভিজ্ঞতা দিতে পারে পাঠককে, যার সাথে পরিচিত হওয়ার মুহূর্তেই তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটা থিসিসকে আঁকড়ে ধরতে গেলে, বা তার মধ্যে মনযোগ দিলে অনেক ডালপালা গজায়, অনেক দৃশ্য হাজির হয়, রাজনৈতিক দার্শনিক তত্ত্বযুদ্ধের নানান ময়দান পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এই থিসিসের বিভিন্ন বাক্য, পরিভাষা, রূপক, দৃশ্য ও তত্ত্ব তাই দর্শন, সাহিত্য তত্ত্ব ও শিল্পচর্চার বিভিন্ন শাখায় প্রভাবশালী হয়েছে। যেমন ৮ নম্বর থিসিসে বর্ণিত “জরুরি অবস্থা”র ধারণাটি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রাষ্ট্র দর্শন ও রাজনীতির জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে
১
আমরাতো জানি যে একদা এমন একটা যন্ত্রমানব বানানো হয়েছিল যে কিনা একজন দাবা খেলোয়াড়ের প্রতিটা চালের বিপরীতে এমন পালটা চাল দিতে পারতো যে তার বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।১ বড় একটা টেবিলের উপরে রাখা একটা দাবার বোর্ডের সামনেপ্রক বসে থাকতো মুখে হুক্কা ও গায়ে তুর্কি পোশাকওয়ালা একটা পুতুল। কিছু আয়নার ব্যবহার করে এমন ভ্রম তৈরি করা হয়েছিল যে টেবিলটার চারপাশ খোলা মনে হইতো। কিন্তু আসলে একজন কুঁজো বামন – একজন দাবার মাস্টার –টেবিলের ভেতরে বসে সুতা টেনে টেনে পরিচালনা করতেন পুতুলটার হাত। কেউ চাইলে দার্শনিক ধারণার জগতে এমন একটা যন্ত্রের কথা কল্পনা করতে পারেন। যেমন, “ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” নামক পুতুলটার সব সময়ই জয় লাভ করার কথা। ধর্মতত্ত্বের সহযোগিতা নিয়ে যে কাউকেই সে খুব সহজে মোকাবেলা করতে সক্ষম, যদিও আমরা জানি যে, আজকের দিনে ধর্মতত্ত্ব একটা ছোট ও কুৎসিত জিনিস যাকে চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়।
২
লতসে লিখেছেন “মানবহৃদয়ের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অদ্ভুত ব্যাপারগুলার একটা হইল যে, ব্যক্তির মধ্যে বিস্তারিত স্বার্থপরতাগুলো বসবাস করে ভবিষ্যতের প্রতি বর্তমানের সাধারণ ঈর্ষার অভাবের সাথে”।২ এই পর্যবেক্ষণ মোতাবেক, সুখের যেই ছবি আমরা অন্তরে লালন করি, তা সম্পূর্ণরূপে সেই সময়ের রঙে রঞ্জিত যা আমাদের অস্তিত্ব আমাদের জন্যে বরাদ্দ করেছে।৩ যেই ধরণের সুখ আমাদের মধ্যে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলতে পারে সেগুলি অস্তিত্ববান থাকে শুধু সেই বাতাসে যাতে আমরা শ্বাস নিয়েছি, সেই মানুষগুলার মধ্যে যাদের সাথে আমরা কথা বলতে পারতাম, সেই নারীদের মধ্যে যারা আমাদেরকে বরমাল্য দিতে পারতেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাদের সুখের ধারণা নাজাতের ধারণার সাথে অবিচ্ছেদ্য। একই কথা খাটে অতীত সম্বন্ধে আমাদের ধারণার ব্যাপারেও, যাকে আমরা ইতিহাস বলি। অতীত এমন এক গোপন সময়সূচী বহন করে চলে, যা নাজাতের বরাত দিতে থাকে।৪ যেই বাতাসে আমরা শ্বাস নেই, তা কি আগেও ছিল না? যেই কন্ঠগুলা আমরা শুনি, তার মধ্যে কি থাকেনা অতীতের নিস্তদ্ধদের প্রতিদ্ধনিও? যেই নারীদের বরমাল্য আমরা কামনা করি তাদেরও কি আছে না বিস্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া বোন? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে প্রতিটা বর্তমান প্রজন্মের সাথেই তার অতীত প্রজন্মগুলার একটা গোপন চুক্তি থাকে। আমরা এই দুনিয়ায় অপেক্ষিত ছিলাম। আমাদের পূর্ববর্তী প্রতিটা প্রজন্মের মতো আমরাও জন্মগ্রহণ করি এক দুর্বল মাহদিয় শক্তি সহকারে, যেই শক্তির উপর অতীতের দাবি রয়েছে।৫ এবং এই দাবি সস্তায় মেটানো যায় না। একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তা ভাল করেই জানেন।
৩
যেই ঘটনাপঞ্জী লেখক ঘটনাসমূহের বর্ণনা করতে গিয়ে বড় ও ছোট ঘটনার মধ্যে পার্থক্য করেন না, তার কাছে এই সত্য পরিষ্কারঃ যা কিছু অতীতে ঘটেছে, তারমধ্যে কোনকিছুই ইতিহাসের আস্তকুড়ে হারিয়ে যেতে পারে না। অবশ্যই, কেবলমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত মানব সমাজের কাছেই তার অতীত পূর্ণাঙ্গরূপে ধরা পড়ে – যার অর্থ হলো, কেবলমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত মানব সমাজের পক্ষেই তার অতীতের প্রতিটা মুহূর্তের উদ্ধৃতি দেয়া সম্ভব হয়।৬ তার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তখন পরিণত হয় সেইদিনটির কর্মসূচীতে, যেই দিনটির নাম – শেষ বিচারের দিন।
৪
যদি খাদ্য বস্ত্রের সন্ধান করো আগে, তবেই
হেগেল, ১৮০৭
খোদার রাজ্য তোমায় দেয়া হবে।
শ্রেণী সংগ্রাম, যা কখনো একজন মার্ক্স শিক্ষিত ইতিহাসবিদের চোখের আড়াল হয় না, তা হইল স্থুল ও বস্তুগত সেইসবকিছুর জন্যে লড়াই যা ছাড়া সূক্ষ ও রুহানি কোনকিছুর অস্তিত্ব থাকেনা। কিন্তু এই দ্বিতীয় বিষয়গুলা শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে বিজয়ীর হাতে অর্জিত গনিমতের মালের ধারণা হিসাবে থাকেনা। বরং শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে তারা হাজির থাকে দৃঢ়তা, সাহস, হাস্যরস, চালাকি ও ধৈর্য হিসাবে, এবং তাদের প্রভাব পৌছে যেতে পারে সুদূর অতীতে। অতীত ও বর্তমানের, শাসক শ্রেণীর প্রতিটা বিজয়কে তারা প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফুল যেমন সূর্যের দিকে মুখ ফেরায়, তেমনই একটা গোপন হেলিওট্রপিজমের প্রভাবে অতীত সদাই সেই সূর্যের দিকে মুখ ফেরাবার সংগ্রামে রতো থাকে, যা ইতিহাসের আকাশে উদিত হইতেছে। সবচাইতে অদৃষ্ট এই পরিবর্তন সম্বন্ধে একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদীকে অবশ্যই সচতেন থাকতে হয়।
৫
ইতিহাসের সত্য ছবি ক্ষণস্থায়ী। অতীতকে পাকড়াও করা সম্ভব শুধু এমন একটা ছবি হিসাবে যা তার সাথে পরিচিত হওয়ার মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকের মতো হাজির হয়েই আবার উধাও হয়ে যায়।৭ “সত্য আমাদের থেকে পালাতে পারবেনা” : গটফ্রিড কেলারের এই বর্ণনা নির্দেশ করে ইতিহাসবাদিতার ইতিহাসের ছবির সেই বিন্দুর দিকে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যাকে বিদ্ধ করেছে। কারন তা অতীতের এমন একটা হারানো ছবি, যা উধাও হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে থাকে এমন প্রতিটা বর্তমানেই যা ঐ ছবির মধ্যে নিজের পরিচয় লাভ করতে ব্যর্থ হয়।
৬
ঐতিহাসিকভাবে অতীতকে বর্ণনা করা মানে এই নয় যে তাকে সেইভাবে চেনা “যেইভাবে তা আসলে ছিল”। বরং এর মানে হলো একটা বিপদের মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকের মতো হাজির হওয়া একটা স্মৃতিকে পাকড়াও করা। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অতীতের সেই ছবিকে আঁকড়ে ধরতে চায় যা একটা বিপদের মুহূর্তে ঐতিহাসিক কর্তার কাছে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাজির হয়।৮ এই বিপদ ঐতিহ্যের বিষয়বস্তু এবং তার সিলসিলা বহনকারী, উভয়কেই ঝুঁকির মধ্যে রাখে। উভয়ের জন্যেই, বিপদটা একইঃ আর তাহলো শাসক শ্রেণীর হাতিয়ারে পরিণত হওয়া। ঐতিহ্যকে পরাভূত করতে সক্রিয় থাকা আপোষকামিতার হাত থেকে তাকে ছিনিয়ে আনার নতুন সংগ্রামে সামিল হতে হয় প্রতিটা যুগকেই। মসিহ শুধু নাজাত দিতে আসেন না; তিনি আসেন দাজ্জালকে পরাজিত করার জন্যেও। শুধুমাত্র সেই ইতিহাসবিদই অতীতের মধ্যে আশার স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিতে পারেন যিনি নিশ্চিৎ যে, এই শত্রু বিজয়ী হলে এমনকি মৃতরাও নিস্তার পাবেনা। এবং আজতক এই শত্রুর জয়যাত্রা থামে নাই।
৭
ভাবো এই অন্ধকার, এই প্রবল শীত
ব্রেখট, দা থ্রিপেনি অপেরা।
এই রহস্য ধ্বনিত উপত্যকায়।
যে ইতিহাসবিদরা অতীতের কোন একটা যুগকে যাপন করতে চান, ফুস্তেল দে কুলনজে তাদেরকে ঐ যুগ পরবর্তি বাকী ইতিহাসকে মুছে ফেলার উপদেশ দিয়েছেন। যে পদ্ধতির মাধ্যমে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ভগ্ন করেছে, সেই পদ্ধতি চিত্রায়ন করার এর চাইতে ভাল উপায় নাই। এ হলো এক সহানুভূতির পদ্ধতি। এর উৎস হলো হৃদয়ের অলসতা, সেই বৈরাগ্য যা বিদ্যুৎ চমকের মতো হাজির হওয়া প্রকৃত ইতিহাসের ছবিকে চিনতে পেরে নৈরাশ্যে পতিত হয়। মধ্যযুগের ধর্মতাত্ত্বিকরা বৈরাগ্যকে সকল দুঃখের উৎস গণ্য করতেন। ফ্লোবার্ট, যিনি এর সাথে পরিচিত ছিলেন, লিখেছেন ”খুব কম লোকের পক্ষেই ধারণা করা সম্ভব যে কার্থেজকে পুনরুত্থিত করতে গেলে একজনের পক্ষে কতোটা বেদনায় আক্রান্ত হওয়া সম্ভব”। এই বেদনার প্রকৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠবে যদি আমরা জিজ্ঞাস করিঃ ইতিহাসবাদিতা কার প্রতি সহানুভূতিশীল? উত্তরটা অনিবার্যঃ বিজয়ীদের প্রতি। এবং সকল শাসকই পূর্ববর্তী বিজেতাদের উত্তরাধিকারী। অতএব, বিজয়ীদের প্রতি সহানুভূতি অবধারিতভাবেই বর্তমান শাসক শ্রেণীর জন্যে সুফল বয়ে আনে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী জানে এর মানে। যারাই বিজয়ী হয়েছেন, আজতক তারা বর্তমান শাসকদের সেই জয়রথে অংশগ্রহণ করে চলেছেন, যাতে শাসকদের পদতলে পিষ্ট হচ্ছে সেজদাবনতরা। ঐতিহ্যগত চর্চা অনুসারে, এই জয়রথে বহন করা হয় কিছু গনিমতের মাল। এদের নাম দেয়া হয়েছে “সাংস্কৃতিক সম্পদ”, এবং একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী এসবের দিকে তাকান সতর্ক নির্লিপ্ততা সহকারে। কারন প্রতিটা ক্ষেত্রেই এসব সম্পদের এমন এক সিলসিলা আছে যা অবলোকন করতে গেলে সে আতংকিত না হয়ে পারেনা। এসব সম্পদের অস্তিত্বের পেছনে কেবল কিছু প্রতিভাবান স্রষ্টার ভূমিকা ছিল তা-ই না, বরং ভূমিকা ছিল তাদের সময়ে জীবিত থাকা বহু বেনামা মানুষের শ্রমেরও। এমন কোন সাংস্কৃতিক দলিল নাই, যা একই সাথে বর্বরতারও দলিল না। এবং যেহেতু এই ধরণের কোন দলিলই বর্বরতা মুক্ত নয়, সেহেতু একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে তার হস্তান্তর প্রক্রিয়াও বর্বরতার দ্বারা দূষিত হয়। একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী এই কারনে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়া থেকে যথাসম্ভবত দূরত্ব বজায়ে রাখেন। ইতিহাসের তুলি শ্রোতের বিপরীতে টানাকে তিনি তার কাজ মনে করেন।
৮
মজলুমের ঐতিহ্য আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, যেই “জরুরি অবস্থা”য় আমরা বসবাস করি তা ব্যতিক্রম নয় বরং স্বাভাবিক নিয়ম। ইতিহাসের এমন এক ধারণায় আমাদের উপনিত হতে হবে যা এই বোধের সাথে খাপ খায়। তখন আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো যে আমাদের কাজ হলো একটা আসল জরুরি অবস্থার আনয়ন করা, এবং তাহলেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের অবস্থার উন্নতি ঘটবে। ফ্যাসিবাদের সাফল্যের অন্যতম একটা কারন হলো যে এর প্রতিপক্ষরা প্রগতির বরাত দিয়ে ফ্যাসিবাদকে একটা ঐতিহাসিক প্রবণতা হিসাবে গণ্য করে। আমরা যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এই বিংশ শতাব্দীতেও তা সম্ভব হচ্ছে বলে বিস্মিত হওয়াকে দার্শনিকতা বলা যায় না। যেমন বিস্ময় আমরা সম্প্রতি দেখছি। এই বিস্ময় কোন জ্ঞানের সূত্রপাত নয় – যদি না তা সেই জ্ঞান হয়ে থাকে যে যেই ইতিহাসের ধারণা এই বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে – তা অচল।
৯
উড়ালের জন্যে প্রস্তুত আমার ডানা
গেরহার্ড শোলেম, “গ্রেটিংস ফ্রম দা এঞ্জেলাস”
আমি ফিরতে চাই।
যদি আমি থাকতাম অনন্তকাল,
তাতে নিয়তি সামান্যই পাল্টাইতো।
“নতুন ফেরেশতা” (Angelus Novus) নামে ক্লি’র একটা পেইন্টিং আছে। এই ছবিতে একজন ফেরেশতাকে দেখা যায় যে যেনবা সরে যেতে চাচ্ছে কোন কিছুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা থেকে। তার চোখ দুটি বিস্ফারিত, মুখ খোলা, ডানা দুটি মেলে দেয়া। ইতিহাসের ফেরেশতা দেখতে এমন হওয়ার কথা। সে অতীতের দিকে মুখ করে আছে। আমারা যেখানে দেখি বহু ঘটনার ক্রম, সে দেখে সেখানে এক অবিরাম প্রলয়, যা একের পর এক ধ্বংসাবশেষ লুটিয়ে দেয় তার পায়ে। এই ফেরেশতা থাকতে চায়, মৃতদের পুনরুত্থান ঘটাতে চায়, যা ধ্বংসপ্রাপ্ত তাকে পুনর্নির্মান করতে চায়। কিন্তু বেহেশত থেকে আসা একটা তুফান তার ডানাগুলোকে আটকে ফেলেছে মেলে রাখা অবস্থায়; এই তুফান এতোই শক্তিশালী যে সে আর তার ডানা বন্ধ করতে পারছে না। এই তুফান তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সেইদিকে, যেইদিকে সে তার পিঠ ফিরিয়ে রেখেছে, সেইসাথে তার সামনের ধ্বংসতুপ জমা হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আমরা যাকে প্রগতি বলি তা এই তুফানের অপর নাম।
১০
মনাস্টিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রাদারদেরকে এমন ধ্যানের শিক্ষা দেয়া হইতো যেন তারা দুনিয়া ও দুনিয়াবি বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। যেই ধরণের চিন্তা আমরা এইখানে গড়ে তুলছি তার লক্ষ্য খানিকটা এমনই। ফ্যাসিবাদ বিরোধীরা যে নেতাদের উপর ভরসা করেছিল, এখন যখন তারা ধরাশায়ী হয়েছে, সংগ্রামের সাথে বেইমানি করে নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত করেছে, তখন বেইমানদের জ্বালে আটকে যাওয়া দুনিয়াবি রাজনৈতিক জীবেদের তা থেকে মুক্ত করার জন্যেই এই পর্যবেক্ষণগুলো তুলে ধরা দরকার। যা বলতে চাচ্ছি তাহলো যে, প্রগতির প্রতি এই নেতাদের অন্ধ বিশ্বাস, “জনভিত্তি” থাকা নিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস, আর একটা অনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বশ্যতা মেনে তাদের সেই যন্ত্রের নাটবল্টু হয়ে ওঠার ঘটনা, এই তিনটা মূলত একটা জিনিসেরই আলাদা আলাদা দিক। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই বোঝা যায় কতোটা চড়া মূল্য আমাদের দিতে হবে এমন এক ইতিহাসের ধারণা গড়ে তোলার জন্যে যা এই নেতাদের বিশ্বাসে হাজির থাকা ইতিহাসের ধারণার সাথে আপোষ করবেনা।
১১
যেই ধরণের আপোষকামিতা সোস্যাল ডেমোক্রেটদের মধ্যে প্রথম থেকেই হাজির আছে, তা শুধু তাদের রাজনৈতিক কৌশলের সাথেই না বরং তাদের অর্থনীতি সংক্রান্ত চিন্তার সাথেও জড়িত। তাদের রাজনৈতিক দলেটির ভেঙে পড়ার কারনও এইটাই। তারাও শ্রোতের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে, এই বিশ্বাস জার্মান শ্রমিক শ্রেণীকে যেইভাবে দূষিত করেছে, তেমন আর কোন কিছুই করে নাই। এই বিশ্বাস থেকে ঐ ভ্রম খুব দূরবর্তি কিছু ছিল না যা মোতাবেক কারখানায় শ্রম দেয়ার মাধ্যমে প্রযুক্তিক প্রগতিতে ভূমিকা রাখাও একধরণের রাজনৈতিক অর্জন। আসলে এর মাধ্যমে শ্রম সংক্রান্ত পুরাতন প্রটেস্টান্ট নৈতিকতাকেই জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সেকুলার চেহারা দিয়ে পুনরুত্থিত করা হয়েছে। খোদ গোথা প্রোগ্রামের মধ্যেই এই বিভ্রান্তির চিহ্ন পাওয়া যাবে, যেহেতু তা শ্রমকে “সম্পদ ও সংস্কৃতির উৎস” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল। ঘরপোড়ার গন্ধ পেয়ে মার্ক্স তখনই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন :` “নিজের শ্রমশক্তি ছাড়া আর কোন সম্পদ যেই মানুষের নাই” তার নিয়তিতো “মালিক শ্রেণী নামক মানুষদের দাস হওয়া”। কিন্তু এই বিভ্রান্তি ছড়াতেই থাকলো, এবং কিছুদিন পর জোসেফ ডিটজগেন তো ঘোষণাই করলেনঃ “আধুনিক সময়ের নাজাতদাতা হলো শ্রম। শ্রমব্যবস্থার…উন্নয়ন…যেই সম্পদের জন্ম দেয় তারপক্ষে আজ যা অর্জন করা সম্ভব, ইতিপূর্বে কোন নাজাতদাতাই তেমন কিছু অর্জন করতে পারেন নাই”। শ্রমের প্রকৃতি সম্পর্কে এমন স্থুল-মার্ক্সিয় ধারণা সাধারণত কখনোই ঐ প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামায় না যে, নিজেদের উৎপাদিত সম্পদ যেই শ্রমিক শ্রেণীর নাগালের বাইরে থেকে যায়, তারা কীভাবে সেই সম্পদের সুফল লাভ করবে? যেহেতু এই ধরণের চিন্তা কেবল প্রকৃতির উপর প্রভুত্বকে প্রগতি হিসাবে চিহ্নিত করে, এবং সমাজের অধঃপতনের দিকটাকে অগ্রাহ্য করে; সেহেতু এরমধ্যে সেই ধরণের টেকনোক্রেটিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা পরে আমরা ফ্যাসিবাদের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করতে দেখেছি। এসব বৈশিষ্টের মধ্যে প্রকৃতি বিষয়ে এমন কিছু ধারণা দেখা যায়, যা বিপদজনকভাবে ১৮৪৮ সালের পূর্বেকার সমাজতন্ত্রী ইউটোপিয়াগুলার মধ্যে হাজির থাকা প্রকৃতির ধারণা থেকে আলাদা। শ্রমের এই নতুন ধারণা এক হিসাবে এই দাবি করে যে, শ্রম হলো প্রকৃতির উপর শোষণেরই অপর নাম। সেইসাথে প্রকৃতির উপর শোষণ আর প্রলেতারিয়েতদের উপর হওয়া শোষণকে পরস্পর থেকে আলাদা করেছে শ্রমের এই ধারণা, যা আসলে সাধাসিধে আপোষকামিতা। এই ধরণের দৃষ্টবাদী চিন্তার চাইতে ফুরিয়েরের (Fourier) ফ্যান্টাসিগুলাগুলাকেও অনেক পরিপূর্ণ মনে হয়, যেসব ফ্যান্টাসি নিয়ে মস্করা কম হয় নাই। ফুরিয়েরের মতে, সমবায়ী শ্রম দক্ষতা এতোটাই বাড়িয়ে তুলবে যে একদিন রাতের আকাশ আলোকিত করে রাখবে এক হালি চাঁদ, মেরুর বরফ গলে যাবে, সাগরের পানি আর লবনাক্ত থাকবেনা, আর শিকারী পশুরা মানুষের নেতৃত্ব মেনে চলবে। কিন্তু এই কল্পনাগুলাও এমন ধরণের শ্রমের ছবি আঁকে, যা প্রকৃতির শোষণের উপর নির্ভরশীল না, বরং যা প্রকৃতিকে এমনভাবে লালন করবে যেন সে তার গর্ভে থাকা সৃষ্টিগুলাকে জন্ম দিতে পারে। অন্যদিকে যেই ধরণের প্রকৃতির ধারণা ডিটজগেন প্রচার করেছেন তা এক “মাগনা অস্তিত্ব”, এবং প্রকৃতির এই ধারণা শ্রমের দূষিত ধারণার সাথেই খাপ খায়।
১২
আমাদের ইতিহাস প্রয়োজন, কিন্তু জ্ঞানের বাগানে ভ্রষ্ট অকর্মাদের চাইতে আমাদের প্রয়োজনটা আলাদা।
নিৎসে, অন দি এডভান্টেজ এন্ড ডিসএডভান্টেজ অফ হিস্টোরি ফর লাইফ
ঐতিহাসিক জ্ঞানের কর্তা হলো খোদ সংগ্রামী, মজলুম শ্রেণী। মার্ক্সের উপস্থাপনে এই শ্রেণী পরিণত হয়েছে ইতিহাসের সর্বশেষ গোলাম শ্রেণীতে – সেই এভেঞ্জারে, অতীতের সকল দলিত প্রজন্মের স্বাধীনতার সংগ্রামকে যারা পূর্ণতা দেবেন। এই বিশ্বাসটা অল্প সময়ের জন্যে হলেও স্পার্টাকাস লীগের মধ্যে জেগে উঠেছিল, যা নিয়ে সোস্যাল ডেমোক্রেটরা সবসময় মন্দ কথা বলে এসেছে। মাত্র তিন দশকের মধ্যে তারা ব্লাংকির (Blanqui) নাম প্রায় সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলেছে, যেখানে গত শতকে এই নামের ধ্বনিতে ভুমিকম্প হইতো। সোস্যাল ডেমোক্রেটরা শ্রমিক শ্রেণীকে ভবিষ্যত প্রজন্মের নাজাতদাতার ভূমিকায় হাজির করেছিল, এবং এর মাধ্যমে এই শ্রেণীর সবচাইতে শক্তিশালী পেশিটিকেই কেটে ফেলে দিয়েছিল। এই মতাদর্শিক শিক্ষা শ্রমিক শ্রেণীকে ভুলিয়ে দিয়েছিল তাদের ঘৃণা, এবং ভুলিয়ে দিয়েছিল তাদের কোরবানির ইচ্ছা। কেননা এই দুইই পুষ্টি লাভ করে গোলামির জিঞ্জির পরা পূর্বপুরুষদের স্মরণ নেয়ার মাধ্যমে। মুক্তিপ্রাপ্ত নাতি-নাতনিদের স্বপ্নের মধ্যে অমন পুষ্টি নাই।
১৩
প্রতিটা দিনই, আমাদের লক্ষ্য আরো পরিষ্কার হয় এবং মানুষ আরো বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে।
জোসেফ ডিটজগেন, সোস্যাল ডেমোক্রেটিক ফিলসফি
সোস্যাল ডেমোক্রেটিক তত্ত্ব এবং আরো বিশেষভাবে বললে এই তত্ত্বের প্রয়োগ প্রগতির এমন এক ধারণার উপর নির্ভর করে বেড়ে উঠেছে যার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক সামান্যই, বরং ডগমাটিক দাবিদাওয়ার সাথেই এর সম্পর্ক বেশি। প্রথমত, সোস্যাল ডেমোক্রেটদের চিন্তায় প্রগতি হলো খোদ মানব প্রজাতিরই প্রগতি (কেবল মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন নয়)। দ্বিতীয়ত, এই প্রগতির ধারণার কোন সীমা নাই (মানবতার আদর্শায়নের অসীম সুযোগের ধারণার পাশাপাশি)। তৃতীয়ত, প্রগতিকে মনে করা হয় অনিবার্য – যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা সরল অথবা বাকা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। এই প্রত্যেকটা অনুমানই বিতর্কিত এবং সমালোচনার দাবিদার। কিন্তু যখন সিদুরে মেঘ দেখা যাচ্ছে, তখন সমালোচনাকে এইসব অনুমান ভেদ করে যেতে হবে, এবং এইসবের মধ্যে সাধারণ মিলটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। মানব জাতির ঐতিহাসিক প্রগতির ধারণাকে সমসত্ত্ব, শূন্য সময়ের মধ্য দিয়ে অগ্রগতির ধারণা থেকে বিচ্ছিন করা যায় না। এই ধরণের অগ্রগতির ধারণার বিচারের মধ্যে তাই স্বাভাবিকভাবেই খোদ প্রগতি ধারণাটির বিচারও উপস্থিত থাকে।
১৪
উৎসই লক্ষ্য
কার্ল ক্রাউস, ওয়ার্ডস ইন ভার্স, ভলিউম ১২২
ইতিহাস হলো সেই বিষয়, যার নির্মানের এলাকা নয় সমসত্ত্ব, শূন্য সময়। বরং এ হলো ওয়াক্ত দিয়ে ভরাট করা সময়।৯ যেমন, রোবস্পিয়ারের কাছে প্রাচীন রোম ছিল ওয়াক্তের বারুদ ভরা একটা অতীত, ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্নিতায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে অতীতকে তিনি বের করে এনেছিলেন। ফরাসি বিপ্লব নিজেকে রোমের পুনরুত্থান হিসাবেই দেখতো। তা রোমের বরাত দিতো এমন ভাষায়, যে ভাষায় ফ্যাশন বরাত দেয় ভিন্টেজ কোন পোশাকের। ফ্যাশনের নাক বড় সমসাময়িক, মান্ধাতা আমলের যেই ঝোপের মধ্যেই সে আলোড়ন তুলুক না কেন, এ হলো অতীতের দিকে বাঘের লাফ। কিন্তু, সাধারণত এই লাফ মঞ্চায়িত হয় সেই স্টেডিয়ামে, যেখানে শাসক শ্রেণীর হুকুমত সুপ্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে ঐ একই লাফ যখন ইতিহাসের খোলা ময়দানে সংঘটিত হয়, তখন তা সেই দ্বান্দ্বিক লাফ যাকে মার্ক্স বিপ্লব বলে বুঝতেন।
১৫
বিপ্লবী শ্রেণীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তৎপরতার মুহূর্তে তারমধ্যে এই সচেতনতাটা উপস্থিত থাকে যে সে ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্নতায় বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে। মহাবিপ্লব একটা নতুন ক্যালেন্ডারের সুচনা ঘটিয়েছিল। প্রত্যেক ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটা ইতিহাসকে হাজির করে টাইম-ল্যাপ্স ফটোগ্রাফির মোডে। এবং এইটা আসলে একটাই দিন, যা ছুটির দিনের ছদ্মবেশে আবর্তিত হইতে থাকে, যেই দিনগুলা হলো স্মরণের দিন। ক্যালেন্ডার ঘড়ির মতো করে সময়ের হিসাব রাখেনা; তারা ঐতিহাসিক চেতনার এমন এক স্মৃতিস্তম্ভ, যার সামান্য চিহ্নও গত এক শতকের ইউরোপে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। জুলাই বিপ্লবের সময় এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যারমধ্যে এই চেতনার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। প্রথম রাতের লড়াইয়ের সময়, ঘটনাচক্রে ক্লকটাওয়ারের প্রতিটা ডায়ালে একই সময়ে, আলাদা আলদাভাবে প্যারিসের বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলি করা হয়েছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি হয়তো অন্তমিল দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন, লিখেছেন :
কী অবিশ্বাস্য! যেনবা ঘড়ির উপর ক্রুদ্ধ
নতুন ইউশারা, প্রতিটা টাওয়ারের নিচ থেকে
ঘড়ির কাটায় গুলি মেরে সময় করছে স্তদ্ধ।
১৬
এমন একটা বর্তমানের ধারণা ছাড়া একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী চলতে পারেন না, যা কোন মধ্যবর্তি অবস্থা না, বরং যখন সময় থমকে যায় এবং সমাপ্ত হয়। কেননা এ আসলে সেই বর্তমানেরই সঙ্গা যারমধ্যে বসে সে ইতিহাস লিখছে। ইতিহাসবাদিতা দিতে চায় অতীতের এক “অনন্ত ছবি”, অন্যদিকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ আমাদেরকে দেয় অতীতের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ইতিহাসবাদিতার বেশ্যালয়ে “আজ থেকে বহু বছর আগে” নামক বেশ্যার কাছে একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদী নিজেকে বিলিয়ে দেয় না। সে নিয়ন্ত্রন হারায় না, ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্নতায় বিস্ফোরণ ঘটাবার তাকত সে রাখে।
১৭
ইতিহাসবাদিতা স্বাভাবিকভাবেই স্বার্বজনীন ইতিহাসের রূপ ধারণ করে। হয়তো বস্তুবাদী হিস্টোরিয়গ্রাফি পদ্ধতিগত দিক থেকে সবচাইতে পরিষ্কারভাবে স্বার্বজনীন ইতিহাসের চাইতে আলাদা। স্বার্বজনীন ইতিহাসের কোন তাত্ত্বিক আর্মেচার নাই। এর কাজের ধরণ বেশ আশক্তিকর, প্রচুর পরিমান তথ্য যোগার করে তা দিয়ে সমসত্ত্ব শুন্য সময় ভরাট করা তার কাজ। অন্যদিকে, বস্তুবাদী হিস্টোরিয়গ্রাফি একটা গঠনমূলক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। চিন্তা করার মানে কেবল চিন্তাগুলার গতিশিলতাই নয়, বরং তাদের বিরতিরাও। চিন্তা যেখানে হঠাৎ করে উত্তাপে ভরপুর কোন কনস্টেলেশনে এসে থমকে যায়, তখন তা ঐ কনস্টেলেশনকে একটা ঝাকি দেয়, যারফলে চিন্তা দানা বেধে পরিণত হয় একটা মোনাডে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তখনই কোন ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহী হন যখন তা তার কাছে একটা মোনাডের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা। এই অবয়বের মধ্যে সে চিনে নিতে পারে ঘটনাবলির মাহদিয় গতিরোধের চিহ্ন, অন্যভাবে বললে, মজলুম অতীতের জন্যে লড়াই করার বিপ্লবী সুযোগ। সে এর ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করে, যেন সমসত্ত্ব সময়ের ধারাবাহিকতায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটা যুগকে বের করে আনা যায়, যেন একটা যুগের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বের করে আনা যায় একটা জীবনকে, আর একটা জীবনের কাজের মধ্যে একটা বিশেষ কাজকে। এই পদ্ধতির ফলাফল হলো যে, কাজের মধ্যে একটা জীবন, জীবনের মধ্যে একটা যুগ, আর যুগের মধ্যে পুরো ইতিহাসের গতিপথ রক্ষিত ও অঙ্গিভুত হয়ে যায়। ঐতিহাসিক বোঝাপড়ার যে পুষ্টিকর ফল, তার বিচি হলো সময়, যা মহামূল্যবান কিন্তু স্বাদহীন।
১৮
একজন আধুনিক জীববিজ্ঞানী লিখেছেনঃ “পৃথিবীতে জীবের আবির্ভাবের ইতিহাসের সাপেক্ষে যে সামান্য পঞ্চাশ হাজার বছরের ইতিহাস হোমো স্যাপিয়েন্সদের, তা অনেকটা একটা চব্বিশ ঘন্টার দিনের শেষ দুই সেকেন্ডের সমান। এই মাপকাঠি অনুসারে, সভ্য মানুষের ইতিহাস হলো শেষ ঘন্টাটির শেষ সেকেন্ডের পাঁচভাগের একভাগ“। ওয়াক্ত, যা মাহদিয় সময়ের একটা মডেল, তা মানবজাতির পুরো ইতিহাসের একটা প্রকাণ্ড সংক্ষেপণ, যা মহাবিশ্বের সাপেক্ষে মানব জাতির ইতিহাসের চেহারার সাথে খাপ খায়।
সংযোজন
অ
ইতিহাসবাদিতার কাজ হলো ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করা। কিন্তু কারণ বলেই কোন ঘটনা ঐতিহাসিক হয়ে যায় না। তা ঐতিহাসিক হয় মরণোত্তর, এমন সব ঘটনার মাধ্যমে যার সাথে তার দূরত্ব হাজার বছরের। যে ইতিহাসবিদ এই বোধের জায়গা থেকে তার কাজ শুরু করেন, তিনি একটার পর একটা তবজির গুটি গোনার মতো ইতিহাসের ঘটনাক্রম বর্ণনা করেন না। বরং তিনি আকড়ে ধরেন সেই কনস্টেলেশন, যা তার নিজের যুগ অতীতের অন্য একটা যুগের সাথে মিলে আকার দিয়েছে। এইভাবে, বর্তমানের এমন একটা ধারণা তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন, যা মাহদিয় সময়ের স্প্লিন্টার ভরা একটা ওয়াক্ত।
আ
সময় ভবিষ্যতের জন্যে কী সঞ্চিত রেখেছে, এই প্রশ্নের উত্তর যেই গনকেরা জানতে পেরেছেন তারা নিশ্চয় সমসত্ত্ব অথবা শূন্য হিসাবে তার অভিজ্ঞতা লাভ করেন নাই। যারা এই ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন তারা হয়তো ধারণা করতে পারবেন কীভাবে আগের কালে স্মরণের অভিজ্ঞতা লাভ করা হইতো, অর্থাৎ, ঠিক এইভাবেই। আমরা জানি যে ইহুদিদের জন্যে ভবিষ্যত নিয়ে অনুসন্ধান করা নিষিদ্ধ ছিলঃ তাওরাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্মৃতিচারণার। এর উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতের জাদুমুক্তি, যার রাজত্য জারি থাকে তাদের উপরে যারা গণকদের কাছে সত্যের সন্ধান করেন। এর মানে কিন্তু এই নয় যে, ইহুদিদের জন্যে ভবিষ্যত পরিণত হয়েছিল সমসত্ত্ব শূন্য সময়ে। যেহেতু প্রতিটা সেকেন্ডই ছিল মসিহের আগমনের একেকটা ছোট দরজা।
টীকা-নির্দেশ
১ বেনিয়ামিন যে যন্ত্রমানবের কথা বলছেন, তা তৈরি করা হয়েছিল ১৭৭০ সালে। তুর্কি পোশাক পরিহিত এই যন্ত্রমানব পরিচিত ছিল দা তুর্ক, মেকানিকাল তুর্ক ইত্যাদি নামে। নেপোলিয়ন ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের মতো ঐ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকদেরও এই যন্ত্রটা দাবা খেলায় পরাজিত করেছিল। ঐ আমলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ধরণের এমন কোন প্রযুক্তি ছিলনা যার মাধ্যমে একটা যন্ত্রের পক্ষে দাবা খেলা সম্ভব হতে পারে। মূলত যন্ত্রটির আড়ালে লুকিয়ে থেকে দক্ষ দাবাড়ুরা চালগুলো দিতেন।
২ হার্মেন লতসে (Hermann Lotze)
৩ অস্তিত্ব = Daseins (জার্মান)।
৪ নাজাত = Erlösung (জার্মান), redemption, ressurection (ইংরেজি), জার্মান এরলোসুং শব্দটির অর্থ নাজাত ছাড়াও পুনরুত্থান হতে পারে। “ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে”র বিভিন্ন ইংরেজি অনুবাদে হয় রিডেম্পশন অথবা রেজারেকশন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, ধর্মতাত্ত্বিকভাবে নাজাতের ধারণা পুনরুত্থান ও তাজাল্লির ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। খ্রিষ্টিয় ধর্মতত্ত্ব মোতাবেক শেষ জমানায় পুনরুত্থান ও তাজাল্লি (ট্রান্সফিগারেশন) লাভ করেই মানুষ নাজাত লাভ করবে। অন্যদিকে ইসলাম ও ইহুদি ধর্মতত্ত্বে, বিশেষ করে তাসাউফ ও কাব্বালায় পুনরুত্থান ও তাজ্জালির ধারণা বর্তমান সময়েই একজন সাধকের নাজাত বা মুক্তির ধারণার সাথেও যুক্ত।
৫ দুর্বল মাহদিয় শক্তি = schwache messianische Kraft (জার্মান)। সাধারণত এর ইংরেজি করা হয় “উইক মেসিয়ানিক ফোর্স”। মেসায়া শব্দের আক্ষরিক বাঙলা হয় মসিহ। কিন্তু মেসিয়া ও মেসিয়ানিক (জার্মানঃ মেসিয়ানিস্ক) বেনিয়ামিনের লেখায় মূলত দার্শনিক ধারণা হিসাবে হাজির। বিভিন্ন কারনে বাঙলায় মেসিয়ানিক কথাটিকে মাহদিয় হিসাবে অনুবাদ করাই যথার্থ মনে করি। বাঙলা ভাষায় মাহদি শব্দটির পরিচিতি এর অন্যতম প্রধান কারন। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে মসিহ ধারণাটি ঈসার জন্যে বরাদ্দ, এবং মসিহ ধরণের ঐতিহাসিক চরিত্রদেরকে সাধারণত মাহদি বলা হয়। খ্রিষ্টিয় ধর্মতত্ত্বে যেখানে একজনই মসিহর ধারণা পাওয়া যায়, সেখানে ইহুদী ও ইসলাম ধর্মের ইতিহাস ও ধর্মততত্ত্ব মোতাবেক মসিহ চরিত্র হলেন দুইজন। মসিহের ধারণা যেখানে আখেরাতের ধারণার সাথে অবিচ্ছেদ্য, মাহদিকে সেখানে ইতিহাসের অন্তর্গত চরিত্র হিসাবে চিহ্নিত করা সহজ। মাহদি আসেন মসিহের আগে, এবং তিনি মসিহের আবির্ভাবের রাস্তা পরিষ্কার করেন। বেনিয়ামিন এখানে যে মসিহি শক্তির কথা বলছেন, তাও মানুষ মাত্রই বহন করে। এই কারনেও মাহদিয় শক্তি অনুবাদটি অধিক অর্থময়। দুর্বল (schwache) কথাটিকে ইটালিক করার মাধ্যমে তিনি আলাদা করেছেন। একজন ব্যক্তির মধ্যে সবলরূপে হাজির হওয়া মাহদিয় শক্তির ধারণা নয়, বরং গণতান্ত্রিক বৈপ্লবিক শক্তির কথাই এখানে তিনি প্রচার করেছেন বলে মনে হয়
৬ নাজাতপ্রাপ্ত = erlösten (জার্মান), যার অর্থ পুনরুত্থিত অথবা তাজাল্লিপ্রাপ্তও হতে পারে।
৭ “বিদ্যুৎ চমকে”র রূপকটি সুফিতত্ত্বে ও কাব্বালায় সুপরিচিত। যেমন শাইখুল ইশরাক সোহরাওয়ার্দির লেখায় ঐশ্বরিক সত্য উন্মোচনের মুহুর্তে (ওয়াক্ত) বিদ্যুৎ চমকের মতো হাজির হয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গের বিভিন্ন অংশে এই রূপকের যে ব্যবহার তা সরাসরি মুসা মাইমুনের লেখা থেকে ধার করা বলে মনে হয়। মুসা মাইমুন এবং সোহরাওয়ার্দি উভয়েই রূপকটি ধার করেছিলেন অবশ্য দার্শনিক ইবনে সিনার বই আল ইশারাত ওয়াল তানবিহাত থেকে। মুসা মাইমুনের লেখায় ইবনে সিনার এই প্রভাব নিয়ে শ্লোমো পাইন্স লিখেছেন মুসা মাইমুনের গাইড ফর দা পারপ্লেক্সড-এর অনুবাদের ভূমিকায়। মুসা মাইমুন মূল বইটি লিখেছিলেন ক্লাসিকাল আরবীতে, যাতে ঠিক ইবনে সিনার ব্যবহার করা পরিভাষাগুলাই রক্ষিত আছে। তার সময়কার অন্যান্য শিক্ষিত ইহুদি তরুনদের মতো বেনিয়ামিন বইটি পড়েছিলেন এই সম্ভাবনা প্রবল। এর বাইরে, সলোমন মাইমুন রচিত আত্মজীবনিতেও মুসা মাইমুনের একটা চিঠি আছে যাতে একই ধরণের রূপক ও বর্ণনা পাওয়া যায়। বেনিয়ামিন এই বইটি পড়েছিলেন তার প্রমান আছে। ইবনে সিনা লিখেছিলেন যে দার্শনিক দিব্যজ্ঞানীদের (আরিফুন) কাছে খোদায়ি সত্যের আলো বিদ্যুৎ চমকের মতো হাজির হয়ে নাই হয়ে যায়। যে মুহূর্তে এ ঘটনাটি ঘটে তাকে বলা হয় ওয়াক্ত। তবে ওয়াক্তের এই ধারণাটি ইবনে সিনা তার পূর্ববর্তি সময়ের সুফিদের থেকে নিয়েছিলেন ও নতুন করে তত্ত্বায়ন করেছিলেন। ইবনে সিনার তত্ত্বায়নের অনেক আগেই ওয়াক্তের ধারণার সাথে স্বীকৃতি (ইসবাত/এজবাত) এবং মুছে যাওয়ার (মাহু) ধারণা যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। লালনের গানের নাফি-এজবাতও কাছিকাছি ধারণা। বেনিয়ামিন তাই এইক্ষেত্রে একজন ঐতিহাসিক বস্তুবাদীর কাজকে খানিকটা একজন একজন সুফি, আরিফুন বা কাব্বালা সাধকের কাজের সাথে তুলনা করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় খেই হারাবার বদলে একটা বিশেষ মুহূর্তে হাজির হওয়া ঐতিহাসিক সত্যকে যিনি চিনতে ও ধরে রাখতে চান।
৮ “বিপদের মুহূর্ত কথাটির বহু অর্থ হতে পারে। গাইড ফর দা পারপ্লেক্সড-এ মুসা মাইমুন যে বিপদের কথা লিখেছেন, তা একদিকে দার্শনিক জ্ঞানের কাছ থেকে ধর্মতন্ত্রের আক্রান্ত হওয়ার বিপদ, এবং তার প্রতিক্রিয়ায় দার্শনিকদের আক্রান্ত হওয়ারও বিপদ। দার্শনিকদের বিপদ নিয়ে লিও স্ট্রাউসও লিখেছেন, বিশেষ করে আল ফারাবির আল মদিনা আল ফাদিলা -র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। ফারাবির বরাতে, তিনি লিখেছেন যে দার্শনিকরা নগরে সবসময়ই বিপদের মধ্যে থাকে। লিও স্ট্রাউস বেনিয়ামিনের পরিচিত ছিলেন, এবং বেনিয়ামিন তার লেখালেখির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। বেনিয়ামিন তার নিজ সময়ের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দার্শনিকদের প্রধান বিপদ হিসাবে দেখেছেন শাসক শ্রেণীর হাতে মজলুমের ঐতিহ্য দখল হয়ে যাওয়ার বিপদকে। অবশ্য ওয়াক্ত ধারণাটিও সুফি এবং কাব্বালা তাত্ত্বিকরা একটা বিপদের সময়ের রূপকে বর্ণনা করেছেন। এর বাইরে, বেনিয়ামিন নিজেই এই রচনাটি লেখার সময় বিপদের মধ্যে ছিলেন।
৯ ওয়াক্ত = Jetztzeit (জার্মান)। Jetztzeit শব্দটির আক্ষরিক অনুবাদ “বর্তমান-সময়”(now-time)। হান্নাহ আরেন্ট এর সাথে নুংক স্টান্স এবং জর্জো আগাবমবেন কায়রস নামক ধর্মতাত্ত্বিক সময়ের ধারণার তুলনা করেছেন। তবে ওয়াল্টার বেনিয়ামিন এই সময়ের ধারণাটিকে পুরো লেখার যে তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে হাজির করেছেন তার সাথে ইবনে সিনা ও মুসা মাইমুনের লেখায় বিদ্যুৎ চমকের মতো সত্য ধরা দেয়ার মুহূর্ত হিসাবে যে ওয়াক্তের ধারণা পাওয়া যায়, তারই বেশি মিল পাওয়া যায়। এছাড়াও সুফি তাত্ত্বিকরা ওয়াক্তকে দুইধারী তলোয়ার ও ধারালো সময় হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন আল-হুজুইরি কাশফুল মাহজুবে লিখেছেনঃ “ওয়াক্ত এক ধারালো তলোয়ার”। কাব্বালা শাস্ত্রে, যেমন জোহারেও এমন দুইধারী তলোয়ারের (হেরেভ পিফিয়ট) রূপক পাওয়া যায়। ওয়াক্ত এমন একটা ধারালো সময়ের ধারণা যা অতীত ও ভবিষ্যত থেকে বর্তমানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। বেনিয়ামিন এইক্ষেত্রে ওয়াক্তকে দিয়েছেন বারুদভরা বিস্ফোরক বৈশিষ্ট, যা ইতিহাসের প্রবাহে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একতা মুহূর্তকে বের করে আনতে পারে।
- প্রথম প্রকাশ : রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ৬ সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি ২০২২