ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্র

  • বখতিয়ার আহমেদ

সম্পাদকের ভূমিকা: বখতিয়ার আহমেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান; সমাজ বিবর্তন- সম্পর্ক- ভাষা- কর্তৃত্ব – সহিংসতা- মতাদর্শ- রাষ্ট্র- রাজনীতি- শাসনপ্রণালীকে নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা করেন। নিচের প্রবন্ধটি ২০০৬ সালে একটি সেমিনারে পঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্রিকা, লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে লেখক ছোট একটি ভূমিকাসহ ফেসবুকে নোট আকারে প্রকাশ করেন। ‘রাষ্ট্রচিন্তা’য় প্রকাশিত সংস্করণটি সরাসরি তার ফেসবুক নোট থেকে নেয়া হয়েছে।

লেখকের ভূমিকা: লেখাটা সাত বছর আগের। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নিয়ে আমার প্রথম লিখিত বোঝাপড়া। ‘ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্র’ শীর্ষক একুশে ভাষা সেমিনার’২০০৬ এ মূল প্রবন্ধ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ মিলনায়তনে ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০০৬ ইং তারিখে পঠিত হয়। সেমিনারের সভাপতি ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, আলোচকবৃন্দ- সৈয়দ আবুল মকসুদ, রাশেদ খান মেনন, কামাল লোহানি, অধ্যাপক যতীন সরকার, সোহরাব হাসান, এবং উপস্থিত শ্রোতামন্ডলী প্রবন্ধটির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। লেখাটি একই সপ্তাহে প্রকাশ করে দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’ এবং পরবর্তীতে ‘মাওরুম’ পত্রিকার মার্চ’২০০৬ এর বিশেষ সংখ্যা ‘অপারাজেয় ভাষা সংকলন’। ধন্যবাদ সাইফ তারিককে সমকালে লেখাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়ার জন্য। ধন্যবাদ প্রাপ্য সেমিনারটির আয়োজক সংগঠন ‘মাওরুম’, ‘জুম’ ও ‘অপরাজেয়’র এবং ‘মাওরুম’ সম্পাদক দীপায়ন খীসার যিনি লেখকের উপর শেষ পর্যন্ত ধৈর্যশীল আস্থা রেখে প্রবন্ধটি লিখিয়ে নিয়েছেন।

আমি নিজে এই লেখার বিভিন্ন ধ্যান-ধারণাকে এই বছরগুলোতে ক্রমাগত পর্যালোচনার মধ্যে রেখেছি। তার মধ্যে অন্যতম একটা উপলব্ধি হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমি রাষ্ট্র আর তার মানবিক বিকাশ সম্ভাবনার উপর আরো আস্থা হারিয়েছি। লেখাটি লিখবার সময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা-নৃবিজ্ঞান পড়াই। শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় থাকার ফলে লেখাটার একটা ‘একাডেমিক’ চরিত্র আছে। তারপরেও টিকা-টিপ্পনিসহ লেখাটার আদিরুপটাই নোট আকারে তুলে রাখছি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুক বন্ধুদের সাথে আলাপের সুবিধার্থে।

বখতিয়ার আহমেদ

গৌরচন্দ্রিকা

সৃষ্টির আদিতে আল্লাহ বলিলেন “আলো হউক”। আলো হইল। … তিনি অন্ধকার হইতে আলো পৃথক করিয়া আলোর নাম রাখিলেন ‘দিন’ আর অন্ধকারের নাম রাখিলেন ‘রাত’। … অত:পর আল্লাহ বলিলেন “আমার মতন করিয়া, আমার সহিত মিল রাখিয়া এই ক্ষণে মানুষ সৃষ্ট হউক”। সৃষ্টি হইল। হাঁ, তিনি তাহার মত করিয়াই মানুষ সৃষ্টি করিলেন …। (পবিত্র তৌরাত শরীফ। ১ম সিপারা: পয়দায়েশ। রুকু-১। আয়াত ৩-৫, ২৬-২৭)

ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিস্বত্ত্বা নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু হতে পারে আদি কিতাবের এই আদ্যকথা থেকেই। নবী মুসার ভাষা হিব্রুতে আশ্রিত এই তৌরাত শরীফ থেকে শুরু করে নবী মোহাম্মদের ভাষা আরবিতে আশ্রিত কোরান শরীফ পর্যন্ত বর্ণিত সৃষ্টিজগৎ ও মানুষের পয়দায়েশগুলিরমধ্যে পার্থক্য আছে সামান্যই। নবী মুসার সময়, নবী ইসার জন্মেরও প্রায় পনেরশ বছর আগে থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রধান তিনটি সেমেটিক ধর্মালম্বী- ইহুদি, খ্রীস্টান ও মুসলমান জনগোষ্ঠির মানুষেরা সৃষ্টিজগতের আদি উৎস প্রশ্নে এই পয়দায়েশই বিশ্বাস করে আসছে। সেই মোতাবেক সৃষ্টিকর্তা তাঁর ছয়দিনব্যাপী সৃষ্টিযজ্ঞের শেষ দিনে, তাঁর নিজেরই আদলে মানুষ সৃষ্টি করে অপরাপর সৃষ্টির উপরে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেন। মানুষ হয়ে যায় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’।

তৌরাত শরীফের প্রথম সিপারার দ্বিতীয় রুকুর ষোল আয়াতে এসে আমরা প্রথমবারের মত সৃষ্টিকর্তার সাথে আদি মানব আদমের কথপোকথন দেখতে পাই। আল্লাহ আদমকে আদেশ করেন তাঁর সৃষ্ট স্বর্গোদ্যানের মাঝে শুভ-অশুভ ভেদবিচারি জ্ঞানবৃক্ষের ফল গন্দম খাওয়া থেকে বিরত থাকতে।

আমাদের জানা নাই আল্লাহর সাথে আদমের এই কথপোকথন কোন ভাষায় হয়ে ছিল। এই পবিত্র কিতাবসমুহেরও কোথাও বলা হয় নাই কোন সে ভাষা যাতে ‘কুন’ বলে সৃষ্টিকর্তা নিখিলের অজৈব অন্ধকার থেকে সৃষ্টি করলেন আলোকময় সঞ্চরণশীল জৈব-প্রাণ, সৃষ্টি করলেন বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড। কিতাবের বয়ান-বচনে শুধু পাওয়া যায় যে, তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন বজ্র আর বিদ্যূৎ রুপে। তৌরাতের দ্বিতীয় রুকুর উনিশ আয়াতে আমরা দেখি তিনি আদমকে তার সৃষ্টিযজ্ঞের সামনে এনে দেখছেন তাঁর সৃষ্টির কোনটিকে আদম কি নামে ডাকছেন। আমাদের এও নিশ্চিত জানা নাই যে, আদম কেন কোনটিকে কি নামে অভিহিত করেছিলেন। আমরা শুধু ভাবতে পারি, আদি এই ভাষাটি ছিল এমন একটি ভাষা যা একই সাথে আল্লাহ ও আদমের, সৃষ্টি ও স্রষ্টার ভাষা, এই ভাষিক যোগাযোগের মধ্য দিয়েই সৃষ্ট হয়েছে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড। দার্শনিক যুক্তি-পরম্পরার পরের ধাপে গিয়ে তখন ভাবা যেতেই পারে- তবে কি মানুষ এই ভাষিক যোগাযোগ তথা ভাষারই সৃষ্টি? ভাষাই কি তবে সেই আদ্যগুণ যা তাবৎ সৃষ্টির ‘নাম’ রেখে তার অধিপতি হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দিয়ে মানুষকে করেছে ইশ্বরের প্রতিরুপ? আদি কিতাবের পয়দায়েশ কি আমাদের এই ইশারাই দেয়?

কিন্তু ইশারাবাজি এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। নিজেকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘আমি/আমরা’ ভাবতে পারবার মুহূর্ত থেকে অদ্যাবধি মানুষের ‘মানবীয়তা’ সম্পর্কিত যে অভিজ্ঞান সেখানে ভাষার একটি অন্তর্লীন, কিন্তু গুরুতর রকমের কেন্দ্রীয় ভূমিকা আছে। এই ভূমিকা যাকে আমরা ব্যক্তির সাথে নিখিলের বা মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক হিসেবেও পাঠ করে থাকি, তার উম্মোচন প্রয়াস রয়েছে পৃথিবীর সব ধর্মদর্শনেই। নিজের সাথে নিখিলের সম্পর্ক নির্ণয়ে মানুষ এখানে সৃষ্টিকর্তার দ্বারস্থ। আদিকল্প ভিন্ন হলেও আধুনিক সাহিত্য, বিজ্ঞান বা শিল্পেরও কেন্দ্রীয় দার্শনিক তাড়না হচ্ছে ব্যক্তির সাথে নিখিলের এই সম্পর্কের উম্মোচন যেখানে ভাষাই সাম্প্রতিক সময়ে রয়েছে মনোযোগের কেন্দ্রে। ভাষা কিভাবে কোন কারণে মানুষের প্রজাতিগত অনন্যতা তথা ‘মানবীয়তা’র একটি মৌল-গাঠনিক উপাদান তার পুনরোপলব্ধি এই রচনার শিরোনামে ধার্য্য কর্তব্য পালনেও সহায়ক হবে।

প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের যে বৈশিষ্ট্যগুলি আর সব প্রাণরূপের থেকে মানুষকে অনন্য করে তোলে ভাষা তার কেন্দ্রীয় একটি। বস্তু আর শক্তি দিয়ে গড়া এই নিখিল যার পুরোটাই চলে প্রকৃতির নিয়ম বা অনিয়মে। এর মাঝে মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাকৃতিক সত্ত্বা যার রয়েছে স্বাধীন চিন্তা। এই চিন্তার শ্রমনিষ্ঠ প্রয়োগে সে প্রকৃতির রূপান্তর সূত্রকে বদলে রূপ দেয় সৃজনের, সৃষ্টি করে সংস্কৃতি। ভাবা যেতে পারে আদি-সংস্কৃতি কৃষির কথা যার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতির সাথে তার খাদ্য সম্পর্কটিও বদলে নিয়েছিল আজ থেকে প্রায় বারো হাজার বছর আগে। মানুষের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে কৃষি আবির্ভাবের ভূমিকা/তাৎপর্য আমাদের অজানা নয়। ভাষা কিন্তু মানুষের তারো বহু আগের অর্জন যার মধ্য দিয়ে বদলে গিয়েছিল এই প্রজাতির জৈবযুথবদ্ধতার যাবতীয় সূত্র আর শর্ত। যুথবদ্ধতার জৈবিক সূত্রকে ছাড়িয়ে মানুষ পা রেখেছিল এক প্রতীকী জগতে। যা কিছু ঘটমান বাস্তবে হাজির নেই তাকেও বাস্তবতার অনুষঙ্গ করে ফেলবার মানবীয় যে সামর্থ্য তাও মানুষ অর্জন করেছে ভাষার মাধ্যমে। চিন্তাশক্তি ছাড়া যে মানুষের অস্তিত্ব নেই এটা আমরা জানি কিন্তু ভাষার বাইরে যে চিন্তার আর কোন আশ্রয় নেই সেটা আমরা আমাদের ঘিরে সদাবিরাজমান বাতাসের বাতাবরণের মতই ভুলে থাকি। কিন্তু তারপরও ঘটনা এই যে, অদ্যাবধি মানবিক অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয় ভাষাই, ভাষাই মানবীয়তা, নাম ছাড়া নামীর অন্য আশ্রয় আর কিই বা হতে পারে?

ভাষার আবির্ভাব মানুষের প্রজাতিগত জৈবযুথবদ্ধতার সূত্র/শর্তগুলোকে বদলে দেওয়ার পরে মানুষের যুথবদ্ধতার ইতিহাস হয়ে উঠেছে ব্যক্তি, সমাজ, সভ্যতা আর রাষ্ট্রের ইতিহাস। নিজের প্রাকৃতিক সত্তার বিপরীতে একে আমরা মানুষের সাংস্কৃতিক ইতিহাস বলতেই পারি। সংস্কৃতি-চিন্তার ইতিহাসে সংস্কৃতিকে প্রকৃতির বিপরীতে ব্যাখ্যার সুদীর্ঘ একটি তরিকাগত রেওয়াজ চালু আছে।সেই মোতাবেক সংস্কৃতি সৃজনকে মানুষের প্রজাতিগত প্রতিভা জ্ঞান করে সংস্কৃতিকে সংজ্ঞার্থে মানবীয়তার একেবারে কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। জৈবিক বা প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত মানুষের স্বাধীন সত্তাজাত ক্রিয়াকলাপ বা এর ফলাফলই সংস্কৃতি। সাংস্কৃতিক মানুষ হচ্ছে তার ‘প্রাকৃতিক’ বা জৈবিকসত্তা হতে নিষ্ক্রমণের ফলাফল আর এই নিষ্ক্রমণ পথে মানুষের যুথবদ্ধ প্রয়াসের ভিত্তি কাঠামো নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক জ্ঞানের ভাষা নির্ভর বিস্তার। সাংস্কৃতিক মানুষের যা কিছু ঐতিহাসিক অর্জন, ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামোজুড়ে যে বিশাল সংস্কৃতির দেহ তার শিরা-উপশিরা-ধমনীজুড়ে ভাষার স্রোত নিরন্তর বয়ে চলে বলেই তা প্রাণবান।

ঠিক কি কারণে মানুষের আদিম সাম্যবাদী কৌম সমাজ ভেঙ্গে গিয়ে, কলিম খানের ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ‘ইষৎ অগ্নিপ্রাপ্ত আম’ হিসেবে ‘আমি’ তথা ব্যক্তি-মালিক ইন্দ্রের আবির্ভাব ঘটে গিয়েছিল সে আমাদের প্রাসঙ্গিক হলেও খানিকটা দূরের প্রশ্ন। কিন্তু তার আবির্ভাবই যে ভাষা আশ্রিত সংস্কৃতির সূত্র মুছে দিয়ে মানুষের যুথবদ্ধতার সূত্রগুলোকে বিন্যস্ত করেছিল ক্ষমতার বিন্যাসে, আধুনিক ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়। ফলত: সাংস্কৃতিক সমস্বত্ত্বতা বা বৈচিত্রের চেয়েও ক্ষমতার বিন্যাসই অনেক বেশি বিন্যস্ত করেছিল মানুষের আধুনিকতম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রকে। পশ্চিমা সভ্যতার ছায়ায় এই রাষ্ট্রের প্রকৃষ্টতম বিকাশটি আবার উপনিবেশিকতায় ভর করে পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের মানুষের অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়তি করে তুলেছে এই আধুনিক রাষ্ট্রকে। এনলাইটেনমেন্ট, রেনেসাঁ, ফরাসী বিপ্লব আর রুশ বিপ্লবের ঔরসপুত্র হিসেবে যে আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে পশ্চিমে, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিশ্বায়ন মানবীয়তার প্রতি তার তাবৎ প্রতিশ্রুতিকেই নির্জলা বাচনিকতায় পর্যবসিত করে এক সংঘাতময় বিশ্ব পরিস্থিতি এনে দিয়েছে আমাদের। বিশ্ব ইতিহাসের এই ছকে আমাদের জাতিসত্ত্বা আর জাতিরাষ্ট্রের স্বরুপ অনুধাবনের উপলক্ষ্য হিসেবে ‘একুশ’ কি আমাদের ভিন্নতর কোন উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে?

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

আমাদের জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র: কি ছিল একুশের পলাশ-রাঙা বুক জুড়ে?

সংস্কৃতি সৃজনের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকেই সৃষ্টি করে চলে নিরন্তর। এই সৃজনযজ্ঞে মানুষ শুধু আমিই সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে আমরাও, সৃষ্টি করে পরিবার-কৌম-সমাজ-জাতির আদলে নিজেদের সামষ্টিক পরিচয়ের বহুবিধ রূপ। এই যুথবদ্ধ সৃজনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মানুষের নামের সাথে জুড়ে যায় আরো অনেকগুলো পরিচয়। ক্ষমতার ইতিহাস এই সৃজনযজ্ঞের নিয়ন্তা হয়ে উঠবার পরে এই ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশীলিত অর্জন হিসেবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র আবির্ভূত হয়। আধুনিক ব্যক্তি মানুষের অনিবার্য আইনি-পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় তার জাতিরাষ্ট্রের পরিচয়, বৈশ্বিক ক্ষমতা বিন্যাসেরও মৌলিক একক হয়ে দাঁড়ায় জাতিরাষ্ট্র। ব্যক্তি-পরিচয়ের পাশাপাশি এই রাজনৈতিক পরিচয়ের চর্চা বা এই দুই পরিচয়ের সম্পর্কটির চর্চা আধুনিক মানুষের অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর তাবৎ জাতিরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক সীমার ভেতরে এবং বাইরে এই পরিচয় চর্চার ইতিহাস এক নয়। কিন্তু তারপরেও বলা যায় মূখ্যত সাংস্কৃতিক সমস্বত্ত্বতার ধারণা এবং ক্ষমতার আর্থ-রাজনৈতিক বিন্যাস এই দুইয়ের দ্বান্ধিক ছকেই বিন্যস্ত হয় মানুষের এই পরিচয়টি।

কোন ভাষার কি এই জাতিরাষ্ট্র গঠন করবার ক্ষমতা আছে? আমাদের জাতিসত্ত্বা নিয়ে বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয় রাজনৈতিক দলজাত কূট-কথকতার ধোঁয়া জাল সরাতে পারলে ভাষার প্রশ্নটিই আমাদের জাতিগত পরিচয় নির্মাণের প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে নির্ণিত হয়। একারণেই এখনও ‘একুশ’ আমাদের জাতিসত্তাগত পরিচয়ের সবচেয়ে বড় প্রতীক, একুশের চেতনা আমাদের জাতিত্ববোধের আদি সোপান হিসেবে চিহ্নিত। সেই বিচারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব, একটি ভাষা কি করে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করে সেই প্রশ্নের সামনে নিয়ে এসেছিল রাষ্ট্রচিন্তুকদের, আমাদের জাতিরাষ্ট্রটি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করাটা আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে অভিনব ঘটনাই বটে। বিষয়টিকে বোধ করি আরেকটু তলিয়ে দেখবার প্রয়োজন আছে।

পৃথিবীর উত্তরের সভ্যতাগুলোর পরিবৃত্তে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাস যাই হোক না কেন, ঐতিহাসিকভাবে আমাদের আধুনিক রাষ্ট্র আর উপনিবেশিকতার অভিজ্ঞতা অভিন্ন। অনড় সাংস্কৃতিক প্রাচীর ঘেরা, অর্থনৈতিকভাবে অর্ন্তমুখীন প্রাচীন ভারতীয় গ্রামসমাজের যে দিকটি কার্ল মার্কসসহ সে সময়ের পশ্চিমা ইতিহাসবিদদের ভাবিয়েছে তা হলো কেন্দ্রীভূত কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি এই গ্রামসমাজগুলোর স্থবির নির্লিপ্ততা। গোড়ার দিকে কার্ল মার্কসও এই স্থবিরতার অবসানে একমাত্র সম্ভাব্য কার্যকর শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রের অস্ত্র-সজ্জিত ব্রিটিশ শাসনকেই। ব্রিটিশ শাসনেরও আগে, হিন্দু রাজবংশ বা মুঘল শাসন আমলেও এই গ্রাম সমাজের ‘আদার ব্যাপারীরা’ রাষ্ট্র ‘জাহাজে’র খোঁজ-খবরে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। বহিরাগত বা অনুপস্থিত শাসকদের খাজনা/নজরানা দিয়ে নিজেদের যাপিত জীবনটি নিরুপদ্রব ও নিরবিচ্ছিন্ন রাখাটাই ছিল এই গ্রাম সমাজগুলোর ঐতিহাসিক প্রবণতা। মার্কসের নিজস্ব ইতিহাসতত্ত্ব যত পরিশীলিত হয়েছে, ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে তাঁর পরিচয় যত গভীর হয়েছে ততই তিনি সরে এসেছেন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সঞ্জীবনী ভূমিকার প্রবক্তা অবস্থান থেকে। এসময়কালে তার অত্যন্ত স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘ব্রিটিশ শাসন একদিকে ভারতের নিজস্ব সমাজকাঠামোকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে, কিন্তু পরিবর্তে কোন বৈপ্লবিক গতিশীলতার সৃষ্টি হচ্ছে না। আধুনিক ইউরোপের পুঁজিবাদী রীতিনীতি, কলাকৌশল, রাষ্ট্রীয় গঠন প্রক্রিয়া, আইনকানুন, ধ্যানধারণা সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু দেশজ সমাজপ্রক্রিয়ার সংমিশ্রণে তা এক উদ্ভট চেহারা নিচ্ছে। ফলে ঔপনিবেশিক স্বার্থে ভারতবর্ষের মানুষের ওপর শোষণের চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু অন্য দিকে কোনও অগ্রসর সমাজ ব্যবস্থার ভিত রচিত হচ্ছে না।’

কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)

আমাদের রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি ও সমাজের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতারএকধরনের ব্যাখ্যা আমরা মার্কসের এই পর্যবেক্ষণ থেকে পেতে পারি। বাস্তবিক অর্থে উপনিবেশিকতা বা সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্ন কোন উপায়েই হোক, অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণ বরাবরই ছিল দখলেরই নামান্তর। ইতিহাসের সব দাপুটে পণ্য সভ্যতাই তার ঐতিহাসিক অধিকারভুক্ত পথে মুখোমুখি হওয়া সমস্ত পূর্বাপর সমাজকে চূর্ণবিচুর্ণ করে। কথাটিকে উল্টে বললে প্রাক-ধনতান্ত্রিক সমাজ ও তার অর্থনীতি ধনতান্ত্রিক সমাজের বাজারের কবলে পড়ে এত দুর্বল আর শক্তিহীন হয়ে পড়ে যে নিজের সনাতন সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র আর ধরে রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে এই টলায়মান সমাজগুলো, তার মানুষেরা ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে অধিকতর সক্ষম সংস্কৃতির মানদন্ড গ্রহণ করে। কিন্তু এই গ্রহণ তাদের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়, অনিবার্য ঐতিহাসিক পরিণতি। এই ‘টলায়মান উদ্বাস্তুদল’কেই স্ট্যানলি ডায়মন্ড উলেস্নখ করেন ‘পশ্চিমা সভ্যতার আবশ্যিক গ্রাহক’ হিসেবে।

প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের মধ্য দিয়ে আমরা আবশ্যিক গ্রাহক হিসেবে পশ্চিমা সভ্যতার যে প্রধান সাংস্কৃতিক মানদন্ডটি গ্রহণ করতে পেরেছি তা হলো আধুনিক রাষ্ট্র। পৃথিবীর প্রথম বহুজাতিক ব্যবসাদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং তার অব্যবহিতকালে ব্রিটিশরাজের শাসন ভারতের কৃষিজ উদ্বৃত্ত নির্ভর অভিজাতদের বড় অংশটিরই চিন্তা, মনন ও মানসে ধনতান্ত্রিক ইউরোপিও সভ্যতাকে মোহনীয় করে তুলেছিল। ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সবচেয়ে উদ্ভিন্ন রূপটিকে স্থানিক ক্ষমতা কাঠামোতে নিজের অবস্থানের সাথে মেলাতে গিয়ে এই অংশটির মনে উপ্ত হয়েছিল একটি স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আদতে পাশ্চাত্য সভ্যতার রস-নিষিক্ত এই অভিজাত সম্প্রদায়টির পশ্চিমা অংশীদার বিবর্জিত কিন্তু পাশ্চাত্য ধাঁচের ‘নিজের’ একটি রাষ্ট্রকাঠামোর অধিকর্তা হয়ে উঠবার আকাঙ্ক্ষারই রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সে অর্থে ভারতে ব্রিটিশ বিপ্লবেরই ফলাফল।

কলোনিয়ালিজম

উপলব্ধিটি একটু অস্বস্তিকর হতেই পারে। কিন্তু ‘রাষ্ট্র’ ধারণাটির সাথে আমাদের বৃহদাংশ গণ-মানুষের চৈতন্যগত ছেদটি মূলত ‘আধুনিক রাষ্ট্র’ ধারণার সাথে তার সাংস্কৃতিক ছেদ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ধারায় পরবর্তীতে কিভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ এসে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল সে আমাদের জানা প্রসঙ্গ। কিন্তু ধর্মকে আশ্রয় করেও নব প্রতিষ্ঠিত দুটি রাষ্ট্রই কেন তার জনগণের সাথে সাংস্কৃতিক যোগ সাধনে ব্যর্থ হল সেটা প্রচলিত জাতীয়তাবাদী ইতিহাসগুলোতে কখনই তলিয়ে দেখা হয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক মানচিত্রের যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ক্ষেত্রে একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য মুসলমান জাতিসত্তাকে পুঁজি করে জন্ম নেওয়া পাকিস্থানের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠার তৃতীয় বছরেই মুসলমান জাতিসত্ত্বার ধারণাকে ছাপিয়ে এর পূর্ব অংশটির জনগণ ভাষাকে কেন্দ্র করে ভিত গড়ে ফেলল স্বকীয় একটি জাতিসত্ত্বার যা বাষট্টি, উনসত্তর, সত্তরের গণআন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে আশ্রয় খুঁজে পেল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে।

অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা থেকে মানবিক মুক্তিই রাষ্ট্র বিপ্লবে জনগণের সম্পৃক্ততার সবচেয়ে বড় ভিত্তি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আয়োজনে শোষণ যখন মানবিক অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে তোলে তখনই মানুষ বিদ্রোহ করে প্রচলিত ক্ষমতা বিন্যাসের বিরুদ্ধে। মানুষের ইতিহাস তখন কথা বলে সংঘবদ্ধ মানুষের স্বরে। কোন ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এদেশের মানুষেরা নিজেদের জাতিত্ববোধের নিশান হিসেবে বেছে নিয়েছিল মাতৃভাষাকে? বাংলার ঐক্যবদ্ধ মানুষের কন্ঠস্বরে ইতিহাসের কোন সম্ভবনা উঁকি দিয়েছিল বায়ান্ন’র একুশে ফেব্রম্নয়ারীতে? ইতিহাসে প্রথমবারের মতন রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির ঐতিহাসিক ছেদ ঘুচিয়ে দিতেই কি সেদিন ভাষাকে নিয়ে আসা হয়েছিল আর্থ-রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের নিশান বানিয়ে? মানুষের রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতাকে ভাষার সূত্রে গেঁথে ইতিহাস কি আরো মানবিক কোন রাষ্ট্র-সমাজের স্বপ্ন দেখেছিল সেই ফেব্রুয়ারীতে?

উনবিংশ শতকের শেষভাগেই নিজ ক্ষমতা কাঠামোর আয়োজনে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসম সামাজিক বিন্যাসের অভিভাবকত্ব এবং পরবর্তীতে ব্যক্তি মানুষের মানবিক-অস্তিত্ব হন্তারক ভূমিকা পালনের অভিযোগে আধুনিক রাষ্ট্র একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি হারাতে থাকে, খোদ পাশ্চাত্যেই। মাতৃভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাবের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির মানবিকীকরণের একটি ঐতিহাসিক সম্ভবনার সৃষ্টি হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অর্থনৈতিক পরিমন্ডল, একটি ভাষা এবং একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র পরিচয়- যেগুলোকে তাদের বলে অন্যরা স্বীকৃতি দেবে- এই মানবিক রাষ্ট্র-কল্পনার মধ্য দিয়েই আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। সাবেক উপনিবেশিত পৃথিবীর মানচিত্র জুড়ে আর দশটি উত্তর-উপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রের মত নিজ গণমানুষের সাথে সাংস্কৃতিকযোগহীন পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিক রাষ্ট্র গড়বার বদলে নিজের মানবসত্ত্বার উদ্ভাসে মানবিক একটি রাষ্ট্র গড়বার প্রত্যয়ই ঘোষিত হয়েছিল একুশের লাল জমিনে। কোন ধর্ম বা বর্ণের পরিচয়ে নয়, সংকীর্ণ কোন জাতীয়তাবাদ নয়, ভাষাকে যুথজীবিতার সূত্র করে একুশের পলাশ রাঙা বুক জুড়ে ইতিহাস পৃথিবীর মানবিকতম রাষ্ট্রটির স্বপ্নই দেখেছিল সেদিন।

আমাদের জাতি রাষ্ট্র: ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত

কিন্তু হয়নি, অগ্রসরতর কোন মানবিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি একুশের গর্ভ থেকে। গণমানুষের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত ইতিহাসের আকাঙ্ক্ষা অবিশ্রুতই থেকে গিয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে। একুশের চেতনার এই মানবিক অনুধাবনের প্রস্তুতি বা সামর্থ্য কোনটিই ছিল না আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির। একাত্তরে এসে একুশের চেতনার উত্তাপ আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে সত্যি কিন্তু সে রাষ্ট্রও তার নাগরিকের সাথে মানবিক কোন যোগ-সাধনে সমর্থ হয়নি। উপনিবেশিক আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে দেশজ সমাজ প্রক্রিয়ার সংমিশ্রণে যে ‘উদ্ভট চেহারা’র কথা মার্কস লিখেছিলেন ভারত ইতিহাস প্রশ্নে, আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটিও তার প্রতিরুপ হয়ে গিয়ে আর দশটি উত্তর-উপনিবেশিক দেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিণতিকেই বরণ করে নিল। আমাদের জাতিরাষ্ট্রের তৎপরবর্তী ইতিহাস একটি মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস।

মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠন নিছক কোন কল্প-বিলাসিতা নয়। একটি উত্তর উপনিবেশিক দেশের বাস্তবতায় আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তি মানুষের ঐতিহাসিক ছেদ মোচনের পথটি মূলত মাতৃভাষার রাষ্ট্রিক বিকাশের পথই। কেন্দ্রীভূত কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা-বিমুখ ভারতের গ্রাম সমাজের মানুষেরা উপনিবেশিকতার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন-প্রণালী, আইনি-ব্যবস্থা, অগ্রসরতর শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদির হাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে হতেই এই রাষ্ট্রকে নিজের রাজনৈতিক নিয়তি হিসেবে বুঝে নিয়েছিল। স্বনির্ভর অর্থনীতির গ্রামসমাজ যখন ধনতান্ত্রিক বিকাশের ধারায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল, নিজের অর্থনৈতিক নিয়তিকে মোকাবেলার তাগিদ থেকেই এই মানুষেরা অংশীদার হয়েছিল রাষ্ট্র-বিপ্লবের। ভারতের ঐতিহাসিকভাবে দরিদ্রতর নিম্নবর্গীয় মুসলমান জনগোষ্ঠি ধর্মকে আশ্রয় করে পাকিস্তান রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে তার পরিবর্তিত আর্থ-রাজনৈতিক নিয়তি তথা আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে সাংস্কৃতিক যোগ-সাধন ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের অভিজাত মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব অধিকতর মুসলমানিত্বের যুক্তিতে নতুন জাতিরাষ্ট্রে ভাষাসহ তাবৎ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে পশ্চিমের উর্দূ সংস্কৃতিকেই চাপিয়ে দিতে চাইল সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠির উপর। আধুনিক রাষ্ট্র ধারণার মাঝে নিজের আর্থ-রাজনৈতিক নিয়তির সাথে যুঝতে থাকা পূর্ববঙ্গের মানুষেরা নব্য রাষ্ট্রের বুর্জোয়া অধিপতিদের এই আধিপত্যকামী আকাঙ্ক্ষার জবাব কিভাবে দিয়েছিল জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার সুবাদে তা আমাদের সবার কাছেই সুবিদিত।

ধর্ম-ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ছাপিয়ে ভাষাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের সাথে নিজের সম্পর্কের ফয়সালা করবার ব্যাপারটি শুধু একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদের আবির্ভাবের চেয়ে অনেক গভীরতর বিষয়। শাসন-প্রণালী, আইনি-ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক উৎপাদন, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ আধুনিক রাষ্ট্রের যা কিছু অর্জন, যুথবদ্ধ মানুষের আর সব অর্জনের মতই তারও আদি ও মৌলিক আশ্রয় যে ভাষা, ফারসি-ভাষী মুঘল ও ইংরেজি-ভাষী ব্রিটিশ রাষ্ট্রের সাথে যুঝতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষের ইতিহাসবোধে এই উপলব্ধি এসে গিয়েছিল। ধর্ম-ভিত্তিক জাতীয় একাত্মবোধের ধারণা পাকিস্তান রাষ্ট্রের উষালগ্নেই হোঁচট খাওয়ায় সেই বোধ আরো পোক্ত হয়েছিল। তার ফলেই নিজের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পথে আমাদের প্রথম অনড় রাজনৈতিক প্রতিরোধের ক্ষেত্র হয়ে উঠল রাষ্ট্রকাঠামোর ভাষা হিসেবে মাতৃভাষাকে অধিষ্ঠিত করবার সংগ্রাম।

শিল্পী : মিতা মেহেদী সূত্র: ফেসবুক

বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব তার উপনিবেশিক অনুষঙ্গের ফেরে পড়ে গণ-মানুষের এই সংগ্রাম থেকে একটি অনেক বেশি মানবিক জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাকে নিষ্কাশন করতে ব্যর্থ হলেন। একুশের চেতনা আমাদের জাতিসত্ত্বাগত পরিচয়ের ‘টোটেম’ হিসেবে উদযাপনে উদযাপনে গরিয়ান ও মহিয়ান বলে প্রতিপন্ন হল বটে, কিন্তু তাতে রাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক পরিসীমায় মানুষের যাপিত জীবনে মাতৃভাষার স্রোতধারা সঞ্জননী হল না এতটুকুও। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও শিক্ষা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপনিবেশিক অবশেষের পুনরুজ্জীবনের ফলে রাতারাতি বাংলা ভাষায় শিক্ষাকে জনগোষ্ঠির দরিদ্র ও শাসিত অংশটির জন্য বরাদ্দ রেখে অধিপতি অংশটি প্রত্যাবর্তন করলেন ইংরেজি শিক্ষার পেলব আভিজাত্যের মাঝে। শিল্প-উৎপাদন বিমুখ শ্রম-বাজার নির্ভর জাতীয় অর্থনীতি ক্রমাগত মজুরি আর দোকানদারির অর্থনীতিতে পর্যবসিত হওয়ার ভিতও রচিত হয়ে গেল এর মধ্য দিয়েই। কারণ একটি উৎপাদন-মুখর জাতীয় অর্থনীতির পূর্বশর্তই হচ্ছে সেই জাতি বা জনগোষ্ঠির শিল্প-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধন। কিন্তু মাতৃভাষার বিকাশকে এড়িয়ে কোন জাতির পক্ষেই সম্ভব নয় এই উৎকর্ষ সাধন করা। একটি বিজ্ঞান শেখা মানে সেই বিজ্ঞানের ভাষাটি শেখা। স্বভাবতই আমাদের বিজ্ঞান চর্চার মৌলিকত্বও বাধা পড়ে গেল মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কোন কার্যকরী প্রেক্ষাপটের অভাবে। কাগুজে আইনে সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলনের যে বাধ্য-বাধকতা তার ফলাফল হিসেবে খোদ বাংলা ভাষারই বাক্য সঞ্জননী কাঠামোটিকে গ্রাস করে ‘উদ্ভট চেহারা’র এক জাতীয় বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটিয়ে ফেলা হল। উদাহারণ হতে পারে সরকারী নথিতে প্রচলিত বাংলা ভাষাটি যেখানে উপনিবেশিক প্রশাসনিকতার বাংলা অনুবাদ ঘটাতে গিয়ে আমাদের আমলাতন্ত্র তার সনাতন প্রভূর ভাষা ইংরেজির মাপে কেটে ছেটে নিয়েছে বাংলা ভাষার বাক্য উপপত্তির স্বাভাবিক সূত্রাবলি।

শুধু আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিকতাই নয়, এই একই পরিস্থিতি জুড়ে বসল বা রইল আমাদের এই জাতিরাষ্ট্রের প্রতিটি মৌল গাঠনিক উপাদান থেকে শুরু করে বিকাশের তাবৎ শর্তাবলির মধ্যেও। আমাদের সংবিধান, আইন-কানুন ও বিচারালয় যতটুকু বা যে মানের বাংলায় চলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ভাষার সাথে তার আদৌ কোন যোগসূত্র নেই। এই যোগসূত্রহীনতার ফলে যোজক হিসেবে আইনের ভাষ্যকার তথা আইনজীবিদের রুটি-রুজির সংস্থান হয় বটে, রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির যোগাযোগ রয়ে যায় সেই যোজন দূরত্বেই। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রশ্নে আমরা পশ্চিমা দাতাদের ‘প্রযুক্তি হস্তান্তরে’র মূখাপেক্ষী হয়ে থেকেছি, নিজেদের ভাষাকে বিজ্ঞান চর্চার উপযোগী করে তুলে নিজেদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিজ্ঞান চর্চার উদযোগ নেইনি। উত্তর উপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে সাম্রাজ্যিক ইতিহাসের বাঁধা ছকের বাইরে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার অপার সম্ভবনা নিয়ে জন্ম নিয়েও আমাদের জাতিরাষ্ট্রটি আজ স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের মত পশ্চিমা সাম্রাজ্যিক সভ্যতার অধঃস্থনতার ঐতিহাসিক নিয়তিকেই মেনে নিয়েছে, প্রায় নিঃশব্দেই।

ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের মানবিক আদ্যগুণ নিয়ে উদ্ভূত আমাদের এই জাতিরাষ্ট্রটির এই ঐতিহাসিক প্রতিসরণ যে কেবল রাষ্ট্রের গঠন ও বিকাশের প্রশ্নটিকেই উপেক্ষা করে গেছে তাই নয়, একটি ভাষা এবং একটি স্বাধীন ভূখন্ডের মানবিক দাবিকে কেন্দ্র করে জন্ম নিলেও এই রাষ্ট্র তার ভূ-রাজনৈতিক সীমার ভেতর আর সব প্রান্তিক কিন্তু স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বাকে এই নূন্যতম মানবিক স্বীকৃতিটুকুও দেয়নি। এই রাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্মমতম প্রহসন হচ্ছে এই, যে বাংলা ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে নিজেদের মানবিকতম পরিচয়টি গড়তে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল এই জনপদের মানুষেরা, সেই বাংলা ভাষাই আবার ধনতান্ত্রিক সভ্যতার তল্পিবাহক জাতীয় রাজনীতির ফেরে পড়ে দাপুটে চেহারা নিয়ে চড়াও হয়েছে মানচিত্রের প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠিগুলোর ভাষার উপরে। সাঁওতাল, উরাও, মুন্ডা, পাহাড়ী, পাহান, মণিপুরী, মান্দি, হাজং, বোম, ম্রু, চাকমা, তঞ্চঙ্গা, মারমা, ত্রিপুরা, চাক, পাংখুয়াসহ আর সব প্রান্তিক ভাষাগোষ্ঠি আজ এই জাতিরাষ্ট্রেরই রাজনৈতিক আয়োজনে বাংলা ভাষার আধিপত্যের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ঘিরে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মানবিক রাষ্ট্রের অভ্যূদ্যয়ের যে আকাঙ্ক্ষা ইতিহাসে ঝলকে উঠেছিল সেই ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্তের এও এক অনেপনীয় দিক।

মুক্তিসংগ্রাম, শিল্পী: জয়নুল আবেদীন

‘ভূবন গাঁয়ের ভাষা-যুদ্ধ’: ‘একুশে’ যে কারণে মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্মারক হল

আমাদের জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাস এর চেয়ে ভিন্ন কি হতে পারতো শুধু এই আফসোসই নয়, অন্য কোন কারণেই ইতিহাসের চাকা উল্টা ঘোরেনা বলেই তা ইতিহাস। কাজেই আমাদের জাতিরাষ্ট্রের হতে পারত রূপটি নিয়ে যে কোন প্রলম্বিত আহাজারিই এখন অর্থহীন। এই শতকে এসে বিশ্ব-ইতিহাসে জাতিরাষ্ট্র আর মানুষের জন্য অমোঘ কোন প্রতিষ্ঠান নয়, বদলে গেছে/যাচ্ছে মানুষের যুথবদ্ধতার আধুনিকতম সূত্রাবলিও। বিশ্বমানবসভ্যতার দ্রুত ধাবমান ট্রেনটিতে আমাদের রাষ্ট্রটির মত আর সমস্ত পেছনের বগিতে জাতিসত্ত্বা-জাতিরাষ্ট্র ধারণারই পরিস্কার কোন ফয়সালা না হলেও, অগ্রণী জাতিগুলোর মধ্যে ভুবনগ্রাম, বিশ্বসমাজ, বিশ্বায়নের মত ধারণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়ে গেছে অঘোষিত ছায়াযুদ্ধ। ধনতান্ত্রিক পণ্য-সভ্যতার হাত ধরেই হোক আর মানবিকতার সূত্রে গাঁথা বিশ্বমানবের আকাঙ্ক্ষাতেই হোক, জাতিরাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে মানুষ এখন ভুবনীকরণের আবর্তেই মুখোমুখি হচ্ছে নিজ পরিচয়ের। নিজ পরিচয় নির্মাণের ইতিহাস জুড়ে নিজেকে ঘিরে যত সহস্র প্রাচীরই মানুষ গড়ে থাকুক না কেন, একার্ণবের এই যুগে এসে একে একে ধ্বসে পড়ছে এর প্রায় সবগুলোই।

মানুষের সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষার আদি উৎস নিয়ে মনোজেনেসিস আদিকল্পে যে একীভূত আদি মানব সমাজের দেখা মেলে, ইতিহাসের আবর্তে সেই সমাজই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে ভূগোল জুড়ে মানুষের মানচিত্রকে অভূতপূর্ব বৈচিত্র এনে দিয়েছিল বলে জানা যায়। আধুনিক সভ্যতার ছায়ায় জাতি রাষ্ট্রের ধারণা পেরিয়ে সেই সমাজ এখন অখন্ড ও একাকার প্রবণ হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা, বিশ্বমানবের পরিচয়ে একাকার হয়ে যাওয়ার মানবিক তাড়নার ইতিহাস আসলে আরো অনেক পুরনো। প্রাক-আধুনিক যুগে ধর্মগুলোও চাইত সব মানুষকে একই পরিচয়ের নিয়ে আসতে। আধুনিক সভ্যতার অন্যতম রূপকার খ্রীস্ট ধর্ম চেয়েছিল ‘সুসমাচারে’র মধ্য দিয়ে তাবৎ মানব জাতিকে ইশ্বরপুত্রের আশীর্বাদে সিক্ত করতে। ইসলাম ধর্মও চেয়েছিল স্বাধীনতা, সাম্য আর ক্ষমাশীলতার জমিনে, সৃষ্টিকর্তার অভিভাবকত্বে তাবৎ মানবজাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে। একই বাসনা ছিল বৈদিক ও বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনেও কিন্তু তারপরও ধর্মের পক্ষে সম্ভব হয়নি এই বিশ্বসমাজ গড়ে তোলা। ধর্মীয় আন্তর্জাতিকতা ব্যর্থ হওয়ার পর পাশ্চাত্যের সেক্যুলার দর্শন থেকে উৎসরিত হয় আধুনিক আন্তর্জাতিকতার ধারণা। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকও সেই আধুনিকতারই সন্তান- আপাতত ব্যর্থতার মোহর পড়ে রয়েছে যার গায়েও। ফলে আধুনিক রাষ্ট্রের মতই, ভুবনীকরণেরও অভিভাবকত্ব পেয়ে গেছে ধনতান্ত্রিক পশ্চিমের পণ্যবাহী সভ্যতা যা মানুষ বলতে একটি অর্থনৈতিক জীব, সমাজ বলতে বাজার এবং উৎপাদন বলতে কেবল পণ্যই বোঝে।

এই অমানবিক ভূবণীকরণের বিরুদ্ধে বিশ্বের নানা প্রান্তেই মানবিক রাজনীতি রুখে দাঁড়ালেও ইতিহাসের ছক-মাফিকতা এই ভুবণীকরণের পক্ষেই থাকছে। গত শতকের শেষ দশকে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় পুঁজিকে পেছনে ফেলে কর্পোরেট পুঁজির বৈশ্বিক বিস্তার টান দিয়েছে মানুষের পূর্বাপর সমস্ত সাংস্কৃতিক শেকড় ধরে। এই প্রতিযোগিতামূলক দৃশ্যমান বা অদৃশ্য সব যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে নির্মম লড়াইটি চলছে ভাষা নিয়ে। যেহেতু জাতি মাত্রেরই সমস্ত অর্জিত সম্পদের আদি ও প্রধানতম কোষাগার হচ্ছে তার ভাষা, ভাষা চলে গেলে তো তার কীর্তি, সংস্কৃতি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-দর্শন সবই চলে যাবে। কোন জাতির ভাষাকে মেরে ফেললে পরে সেই ভাষাহীন জাতিটিকে আর না মারলেও চলে। নতুন অধিপতি সভ্যতায় সে তখন অনায়াসেই বিলীন হয়ে যায়। কাজেই, বিমানবিক ভুবনীকরণের যুগে মানবিক অস্তিত্ব রক্ষার যত রকম সংগ্রাম চলছে তার মধ্যে ভাষার লড়াইটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সর্বাপেক্ষা সিদ্ধান্তমূলক।

কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানীদের বরাতে এই লড়াইয়ের যে সংবাদ মিলছে তা রীতিমতো লোমহর্ষক এবং এক অশনি সংকেতই বটে। তারা জানাচ্ছেন আগামী শতাব্দীতেই মানুষের মাঝে প্রচলিত প্রায় ৫০০০ ভাষার মধ্যে শতকরা ৯০টি অর্থ্যাৎ প্রায় ৪৫০০ ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতে বহু ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ভাষাভাষীর সংখ্যা দশ হাজারেরও কম এরকম বিলুপ্ত-প্রায় ভাষার তালিকাটিও আশঙ্কাজনকভাবে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যেই পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা কমে অর্ধেকে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন ভাষাবিদরা। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৬০০ কোটি ধরলে এর মধ্যে ৫৭০ কোটি জনসংখ্যাই কথা বলে একশটিরও কম ভাষায়। ভাষাযুদ্ধের এই চিত্র ভূ-ভাগের এই অংশেও কম ভীতিকর নয়। অবিভক্ত ভারতে প্রচলিত ১৫০০ ভাষার মধ্যে ৪৩৩ টি ভাষারই নাম উঠে গেছে বিপন্ন ভাষার তালিকায়। এর মধ্যে বোন্দা, গোরাম, লাই, গাতা প্রভৃতি ভাষা আর কখনই উচ্চারিত হবে না মানবিক ইথারে। আন্দামানি ভাষার বক্তাসংখ্যা এখন পাঁচজন এবং খামি ও লুঙ্খুল ভাষার বক্তাসংখ্যা একজনমাত্র মানুষ যাদের মৃত্যুর সাথে সাথে পৃথিবী থেকে মিলিয়ে যাবে একটি মানবগোষ্ঠির তাবৎ সাংস্কৃতিক অর্জন, আমাদের কখনই জানা হবে না ভবিষ্যত বিশ্বসমাজে যোগ করবার মতো কি অমূল্য ধনই হয়তো ছিল এই সব সংস্কৃতির কোষাগারে।

আর্টওয়ার্ক: ইনডিজিনার পিপল

পণ্য সভ্যতা পরিবাহিত বাজার সংস্কৃতি কোন ভাষা তথা জাতিস্বত্তার টিকে থাকবার প্রশ্নে নির্মম কিছু শর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। পণ্যের দেহ অলংকৃত করে মুনাফা নিয়ে আসবার দাপট নিয়ে বিশ্ববাজারের ‘মাস্তান-ভাষা’গুলোর (যেমন ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি প্রভৃতি) সমকক্ষ হয়ে না উঠতে পারলেই যেন কোন ভাষারই আর অস্তিত্ববান থাকবার অধিকার নেই। বেঁচে থাকতে হলে সব ভাষাকেই হয়ে উঠতে হবে তাদের মত সর্বগামী ও সর্বজনগ্রাহ্য, হয়ে উঠতে হবে কম্পিউটার, কমোডিটি আর কনজুমার ফ্রেন্ডলি। বিশ্ববাজারে তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠবার মুরোদ না হলেও ঘরের ভেতরে বাংলা ভাষাও বাদবাকি প্রান্তিক ভাষাগুলোর উপর চড়াও হয়েছে একই রুস্তমি-চালে। একটি রাষ্ট্রের জন্মস্মৃতি বিস্মরণের এরচেয়ে বড় নজীর আর কি হতে পারে?

আধুনিকতার আয়োজনে মানবিক ভূবণীকরণের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল জাতিসংঘ। তারই অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দিয়েছে সম্প্রতি। ভাষাযুদ্ধের নির্মম পটভূমিতে যখন মাতৃভাষার অগ্নিহুতি ঘটছে অবিরাম তখন আমাদের ‘একুশে’ হয়ে উঠেছে মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্মারক। নিছক প্রচলিত জাতীয়তাবাদী উচ্ছাসে উদযাপনের মধ্যেই একুশের এই নব-মাহত্মকে বেঁধে রাখাটা হবে ১৯৫২ সালের একুশের সাথে আমাদের চেতনাগত ছেদেরই পুনরাবৃত্তি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ‘একুশে’র অভিষেক আদতে সাম্রাজ্যিক বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াইরত মানবিক রাজনীতিকে একটি শক্ত পাটাতন তৈরী করে দিয়েছে, শানিত করেছে এই চেতনাকে যে ভাষা ও জাতিস্বত্ত্বার অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার সব মানব গোষ্ঠিরই আছে। জাতিত্ববোধের ইতিহাসে একুশকে ঘিরে আমাদের অনুধাবন যাই হোক না কেন, আন্তর্জাতিকতায় অভিষিক্ত হওয়ার পরে, একুশের উত্তরাধিকারী জাতিটিরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব বর্তায় নিজের জাতিরাষ্ট্রের পরিসরে তাবৎ সাংস্কৃতিক জাতিস্বত্ত্বার ভাষা ও জাতিসত্ত্বাগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করবার। একুশের চেতনার এমনতর উপলব্ধি উপযোগবাদীতা হলেও ক্ষতি কিছু নেই, কারণ ভুবনগাঁয়ের বিশ্বমানবের আবির্ভাবের লক্ষ্যে যে মানবিক রাজনীতি, তাকে সমর্থন যোগানোটা এই উপলব্ধির ইপ্সিত উপযোগই বটে।

টিকা/হদিস:

১। কিতাবুল মোকাদ্দস। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি। ঢাকা।

২। ‘পয়দায়েশ’ বাংলা ভাষায় ‘ভিসাপ্রাপ্ত’ ফারসি শব্দ যার ইংরেজি প্রতিশব্দ জেনেসিস। সাম্প্রতিক বিজ্ঞানে মানুষ এবং ভাষার আদি উৎস নিয়ে তর্কের দুইটি ধারা রয়েছে- মনোজেনিসিস আর পলিজেনিসিস। প্রথমটিতে মনে করা হয় এক অভিন্ন উৎস থেকে পৃথিবীর তাবৎ মানব/ভাষাগোষ্ঠির উদ্ভব। দ্বিতীয়টিতে মনে করা হয় বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন মানব/ভাষাগোষ্ঠি উদ্ভূত হয়েছে। ভাষার ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত ধারার ভাবুকেরা মানবেতিহাসের আদিতে একটি পরমা-ভাষার (ল্যাংগুয়েজ ইউনিভার্সেল) অস্তিত্বের কথা মাথায় রেখে ভাষা নিয়ে ভাবেন। এই ধারার সাম্প্রতিক দুই চিন্তুকের কাজের সাথে আমার সামান্য চিন-পরিচয় আছে। প্রথম জন কলিম খান, যিনি মহাত্মন হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ ভিত্তি করে, প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার ক্রিয়া-ভিত্তিক শব্দার্থ বিধি প্রয়োগ করে ভারতীয় পূরাণসমূহের এমন এক পাঠ-সম্ভবনা দাঁড় করাচ্ছেন যা সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের পরমা-ভাষা সংক্রান্ত গবেষণায় অভিনব এক অধ্যায়ের সূচনা করতে সক্ষম। তাঁর ভাষা-চিন্তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে মাথায় কিছু অমিমাংসিত সংশয় পুষে রাখলেও ভাষাতত্ত্বের জটিল জমিনে আমার প্রথম পদার্পন কলিম খানের ‘মারফতি’ ভাষাতত্ত্বের হাত ধরেই। দ্বিতীয় জন প্রখ্যাত ইতালীয় ভাবুক, উপন্যাসিক ও প্রতীকার্থবিদ উমবার্তো ইকো, যিনি হিব্রু ভাষার ঠিকুঝি তালাশের মধ্য দিয়ে পরমা-ভাষা সংক্রান্ত চিন্তাকে উসকে দিয়েছেন দারুণভাবে। বলা বাহুল্য সংস্কৃত ও হিব্রু, এই ভাষা দুটি ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীদের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার গোড়া থেকেই।  দেখুন:

কলিম খান। ২০০১। পরমা ভাষার সংকেত: ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ও ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত। প্যাপিরাস। ঢাকা।

কলিম খান। ২০০২। পরমা ভাষার বোধন-উদ্বোধন:ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং। অফবিট পাবলিশার্স। কলকাতা।

Umberto Eco. The Search for the Perfect Language.1995. FontanaPress. London.

৩। এ প্রশ্নে স্মর্তব্য ইমানুয়েল কান্ট আর জর্জ ডব্লিউ এফ হেগেলের নাম। কান্ট মনে করতেন সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের সেই সামর্থ্য যার মাধ্যমে সে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারী’ (আরবিট্রারি) প্রতিরুপ প্রতিষ্ঠা করে। এই স্বেচ্ছাচারিতার মূল সূত্রটি রয়েছে মানুষের ভাষাতেই। ভাষায় শব্দ বা চিহ্ন প্রতীকের সাথে তৎসংশ্লিষ্ট অর্থের কোন প্রাকৃতিক কার্যকারণ সম্পর্ক নেই (যদিও ক্রিয়াভিত্ত্বিক শব্দার্থবিধিতে মনে করা হয় আছে)। সেই বিচারে সংস্কৃতি হচ্ছে স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপাদানের রূপান্তর এবং তার প্রতীকি প্রতিরূপ নির্মাণের মানবিক সামর্থ্য। অন্যদিকে হেগেল সংস্কৃতিকে দেখেন নিজের প্রাকৃতিক স্বত্ত্বা থেকে মানুষের ক্রমাগত নিষ্ক্রমণের প্রক্রিয়া হিসেবে। সংস্কৃতি এখানে নিজের প্রাকৃতিক স্বত্ত্বার বাইরে পা রাখবার সামর্থ্য।

দেখুন:George W F Hegel. 1967. The Phenomenolgy of Mind. Herper& Row Publishers. New York. (Trans. George Lichtheim)

Immanuel Kant. 1798. Anthropology from a Pragmatic Perspective. as quoted in Allessandro Duranti. 1997. Linguistic Anthropology. Cambridge University Press. Cambridge.

৪। পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২০০০। ‘বাংলার গ্রাম সমাজ সম্পর্কে কার্ল মার্কস’, ইতিহাসের উত্তরাধিকার। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা।

৫। এই ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা দৃশ্যমান আমাদের প্রাত্যহিক কথকতাতেও। দেশ বলতে আমরা যেমন এখনও খুলনা, রাজশাহী, বরগুনা, বরিশাল বা চট্টগ্রাম বা অন্য কোন অঞ্চলের এক গ্রামীণ জনপদকে যতটা বুঝি ততটা সামষ্টিক একটি দেশকে বুঝি না। ‘সরকারকা মাল দরিয়ামে ঢাল’ জাতীয় কথকতাও জাতির সাথে জাতিরাষ্ট্রের এই ঐতিহাসিক ছেদেরই বহিঃপ্রকাশ।

৬। তালাল আসাদ উদ্ধৃত।

দেখুন: Talal Asad, “Conscripts of Western Civilization,” chapter 17 in Christine Ward Gailey (ed) Civilization in Crisis. Anthropological Perspectives.Dialectical Anthropology. Essays in Honor of Stanley Diamond, Gainesville: University Press of Florida, 1992। ‘পশ্চিমা সভ্যতার আবশ্যিক গ্রাহক’ শিরোনামে রেহনুমা আহমেদের অনুবাদ।

৭। তালাল আসাদের পূর্বোক্ত রচনাটির অন্যতম একটি উপলব্ধি এটি। কিন্তু নিঃসন্দেহে এটি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ চেহারা নয়। শুধু অভিজাত অংশ নয়, ভারতের নিম্নবর্গীয় বিশাল জনগোষ্ঠির সম্পৃক্ততা ছাড়া এই আন্দোলন কখনই কোন সফল রূপ পেত না। কিন্তু সে সম্পৃক্ততার ধরন ছিল ভিন্ন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিম্নবর্গের সম্পৃক্ততার স্বরূপ নিয়ে সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ ধারার যে ইতিহাস চর্চা তাতেও আসাদের এই উপলব্ধিরই প্রতিধ্বনি ঘটে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠির সম্পৃক্ততায় যতনা স্থানিক ক্ষমতা বিন্যাস ক্রিয়াশীল ছিল একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের ধারণা ততটা স্পষ্ট ছিল না। ফলে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নামেই এই নিম্নবর্গীয় কৃষকেরা ১৯২১ সালে চৌরিচৌরায় থানা আক্রমণ করেছিল গান্ধিজীর নামে জয়ধ্বনি দিয়েই। যার ফলশ্রুতিতে গান্ধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকেও পিছিয়ে আসতে হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন থেকে। কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকাগুলোও সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল গান্ধীজির এ ধরনের ‘আনঅফিসিয়াল ক্যানোনাইজেশনে’র বিরুদ্ধে। দেখুন:

শাহিদ আমিন। গান্ধী যখন মহাত্মা। গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টপাধ্যায় (সম্পাদিত)। ১৯৯৭। নিম্নবর্গের ইতিহাস। আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড। কলকাতা।

গৌতম ভদ্র। ১৯৯৪। ইমান ও নিশান:উনিশ শতকে বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায়। সুবর্ণরেখা। কলকাতা।

৮। ভাষাযুদ্ধের এই ‘বডি-কাউন্ট’ বিবরণটির জন্য দেখুন: কলিম খান। ২০০১। পরমা ভাষার সংকেত: ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ও ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত। প্যাপিরাস। ঢাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *