কার্ল মার্ক্সের রাষ্ট্র ও আইন প্রসঙ্গে নির্বাচিত রচনা

কার্ল মার্ক্সের রাষ্ট্র ও আইন প্রসঙ্গে নির্বাচিত রচনা

অনুবাদ : জাভেদ হুসেন

রাষ্ট্র নিয়ে মার্ক্সের ভাবনার সূত্রপাত ঘটে হেগেল পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে। এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্য ছিল বিকাশমান পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ও বিদ্যমান রাষ্ট্রের মাঝের ফারাক তুলে ধরা। এই পর্যায়ে মার্ক্স হেগেলের অধিকার দর্শনের পর্যালোচনা করেছেন। রাষ্ট্র এখানে মানুষের বিচ্ছিন্ন দশার সব চাইতে স্পষ্ট নমুনা, একটা রাজনৈতিক বিমূর্তকরণ, যাতে সমস্ত বাস্তব সংঘাত ধরা-ছোঁয়ার অতীত এক প্রতিষ্ঠানের সামনে মাথা নত করে তাকে বুঝতে না পেরে। পরবর্তী রচনাতে মার্ক্স সমাজে রাষ্ট্রের কার্যকলাপের ওপর জোর দেন। প্রাথমিক রচনাতে রাষ্ট ও সমাজের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্র এখানে শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার–আধুনিক রাষ্ট্রের নির্বাহীরা সমগ্র বুর্জোয়াদের সাধারণ কাজ সামলানোর একটা কমিটি ছাড়া কিছু নয় (কমিউনিস্ট ইশতেহার)।

মার্ক্সের মতে, অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতোই রাষ্ট্রের উৎপত্তির উৎস হচ্ছে শ্রম বিভাজন। সমাজের সমস্ত সদস্যদের বাস্তব স্বার্থের সংঘাত হিসেবে রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। রাষ্ট্র একটা বিভ্রমপূর্ণ সম্প্রদায়ের মতো, যা শ্রেণীগুলোর মাঝের সংঘাতকে আড়াল করতে পারার মতো কাজ করে। ইতিহাসে উৎপাদনের স্তর অনুযায়ী রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। সেই সংগঠন ঐ সমাজের দাপুটে শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতো। জর্মন ভাবাদর্শে মার্ক্স বলছেন–রাষ্ট্র সমস্ত সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানগুলোর গড়ে ওঠায় মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করে এবং তাদের একটা রাজনৈতিক রূপ দেয়। ফলে এমন একটা ধোকা তৈরী হয় যে, মনে হয় আইন যেন ইচ্ছার ওপর, মানে বাস্তব ভিত্তি হতে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন ইচ্ছার ওপর প্রতিষ্ঠিত। একইভাবে ন্যায় বিচারের বেলায় তা শুধু আইনে পর্যবসিত হয়।

মার্ক্স লক্ষ্য করেছেন যে, রাষ্ট্র কখনো কখনো সমগ্র শ্রেণীর বদলে ঐ শ্রেণীর একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। একটা শ্রেণী অন্য শ্রেণীর স্বার্থে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমনটা তিনি ইংল্যান্ডে দেখেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থে হুইগদের রাষ্ট্র পরিচালনায়।

মার্ক্স এও ভেবেছিলেন যে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে রাষ্ট্র স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে। একই ঘটনা ঘটতে পারে সামন্ততন্ত্র হতে বুর্জোয়া স্তরে উত্তরণকালে। কিছু এশীয় দেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি রাষ্ট্রের দাপুটে ভিন্ন অন্য চরিত্রের সম্ভাবনার কথাও সম্ভব বলে ভেবেছেন। যেমন, ভারত, চীন, রাশিয়ার পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কিছু জায়গায় স্বৈরতান্ত্রিকেরা অসংখ্য ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের পিতা হিসেবে আবির্ভূত হতো। আর তা দিয়ে তাদের সাধারণ ঐক্যের প্রকাশ ঘটাতো। (Pre-Capitalistic Economic Formations, ডেভিড ম্যাকলেলানের The Thought of Karmarx-এর ২য় সংস্করণের ২১০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত)।

আইন প্রসঙ্গে আলাদা করে কোনো লেখা লেখেননি। তাঁর মনোযোগ ছিল আইন কী করে সৃষ্টি হয়, সেদিকে। পূঁজিতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক চরিত্র নির্ধারিত হয় ব্যক্তিসম্পত্তি দিয়ে। আর তা সম্পত্তির ব্যবহার আর মালিকানার একগুচ্ছ আইনি অধিকার মাত্র। সেই সমাজে পুঁজি ব্যক্তিসম্পত্তি। এই অধিকারের বলে পুঁজির মালিক অন্যের শ্রম কিনে উদ্ধৃত মূল্য সৃষ্টি করে।

আইনের অন্যতম কাজ হলো ক্ষমতা-সম্পর্ক আড়াল করে রাখা। এভাবে, আইন দেখায় যে দুই পক্ষ স্বেচ্ছায় চুক্তিতে আসে। কিন্তু এও এক ধোঁকা, কারণ চুক্তির দুই পক্ষের দর কষার ক্ষমতা সমান থাকে না। আইনি কাঠামো একটা জামার মতো। আইন বলে সে সবার জন্য সমান। কিন্তু দুই পক্ষের শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে ক্ষমতার পার্থক্য, তাদের বাস্তব অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে আইন নিশ্চুপ। এই ব্যবধানগুলো লুকিয়ে রাখতে আইন জামার কাজ করে।

ক্ষণিকের জন্য হলেও কনভেনশন দারিদ্র্য নির্মূল করার নির্দেশ দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিল। তবে তা ‘জনৈক প্রুশিয়ান’ যেমন তার রাজার কাছে দাবী করেছেন আদতে তেমন ‘তাৎক্ষণিক’ নয়, কেবলমাত্র জননিরাপত্তা কমিটিকে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনা তৈরীর দায়িত্ব দেওয়ার পর, আর সেই কমিটি ফ্রান্সের দারিদ্র্যের বিস্তারিত অনুসন্ধান কাজে লাগানোর পর, তারা বারিয়ে’র মাধ্যমে জনস্বার্থ তহবিল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে। কনভেনশনের অধ্যাদেশ জারি করার ফল কী হলো? হলো এই যে, দুনিয়াতে আরো একটা অধ্যাদেশ বাড়ল আর এক বছর পর উপোস থাকা তাঁতিরা  কনভেনশন দখল করে নিল।

তবু কনভেনশন রাজনৈতিক ক্ষমতা, শক্তি আর বুঝদারির চূড়ান্ত দেখিয়েছে।

পৃথিবীতে কোনো সরকারই প্রথমে তার আমলাদের সাথে পরামর্শ না করে তাৎক্ষণিকভাবে দারিদ্র্য সংক্রান্ত কোনো রেগুলেশন তৈরী করতে পারেনি। ইংলিশ পার্লামেন্ট আসলেও––সমস্ত য়ুরোপীয় দেশগুলোতে নিঃস্বতা থেকে রেহাই পেতে কে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে কমিশনার পাঠিয়েছিল। রাষ্ট্র যদি দারিদ্র্য নিয়ে আদৌ মাথা ঘামায় তাহলে তারা প্রশাসনিক আর দাতব্য স্তরেই বা তারও নীচেই থেকে যায়।

রাষ্ট্র কি তবে অন্য কোনোভাবে কাজ করতে পারে? জনৈক প্র“শিয়ান যেমন দাবী করেন, তেমন করে রাষ্ট্র কখনোই সামাজিক খুঁতের কারণ ‘খোদ রাষ্ট্র এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের’ মাঝে খুঁজবে না। আর রাজনৈতিক দলগুলো এ রকম শয়তানির কারণ খুঁজে পায় যেখানে, তা হলো এই যে––তারা চালাচ্ছে না, চালাচ্ছে তাদের বদলে বিরোধী দল। এমনকি র‌্যডিক্যাল এবং বিপ্ল­বী রাজনীতিবিদেরাও এই অশুভত্বের উৎস রাষ্ট্রের স্বভাবের মাঝে না খুঁজে রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট আঙ্গিকে খুঁজে বেড়ান, যে আঙ্গিকটাকে তারা অপর আঙ্গিক দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান।

রাজনীতির অবস্থান হতে রাষ্ট্র এবং সমাজের গঠন দুটো আলাদা জিনিস নয়। রাষ্ট্র হলো সমাজের গঠন। রাষ্ট্র যদি সামাজিক অশুভত্বের অস্তিত্ব মেনেও নেয়, তাহলে তার দোষ চাপিয়ে দেয় প্রাকৃতিক আইনের ঘাড়ে যার বিরুদ্ধে মানুষের কিছু করবার ক্ষমতা নেই। নয়তো দোষ চাপে ব্যক্তি জীবনের ওপর যা রাষ্ট্র হতে স্বাধীন, অথবা প্রশাসনের ঘাটতির ওপর যা তার অধীনস্থ। এভাবে ইংল্যান্ডে দারিদ্র্য ব্যাখ্যা করা হয় প্রাকৃতিক বিধি দিয়ে, যার মতে জনসংখ্যা সব সময় রুজি-রোজগারের চাইতে দ্রুত গতিতে…। ইংল্যান্ড দারিদ্র্যকে ব্যাখ্যা করে গরিবের বদ মতলবের ফলাফল হিসেবে, ঠিক যেমন প্র“শিয়ার রাজা একে ব্যাখ্যা করেন ধনীদের অখ্রিষ্টানসুলভ অভিপ্রায় দিয়ে, আর কনভেনশন একে ব্যাখ্যা করে সম্পত্তি মালিকদের সন্দেহবাদী, প্রতিবিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। সেই হিসাব মতেই, ইংল্যান্ড শাস্তি ও খাঁড়া নামায় গরিবের ওপর, প্র“শিয়ার রাজা ধনীদের নসিহত করেন আর কনভেনশন সম্পত্তি মালিকদের গলা কাটে।

শেষ ভরসা হিসেবে প্রত্যেক রাষ্ট্র কারণটা খুঁজতে চায় প্রশাসনের আকস্মিক বা মতলবি খুঁতের মাঝে। কেন? সোজা কথায়, কারণ প্রশাসন হচ্ছে খোদ রাষ্ট্রের নিজের সাংগঠনিক কাজ কারবার।

একদিকে প্রশাসনের লক্ষ্যও শুভ অভিপ্রায়, অপরদিকে তার জন্য প্রয়োজনীয় মাল-সামান (resource)–এই দুইয়ের বিরোধিতা রাষ্ট্র নিজেকে বিলোপ না করে সমাধান করতে পারে না, কারণ রাষ্ট্র টিকেই থাকে এই সংঘাতের ওপর ভর করে। রাষ্ট্রের জš§ হয়েছে পাবলিক ও প্রাইভেটের মাঝের, সাধারণ ও বিশেষ স্বার্থের মাঝের সংঘাতের ওপর। অতএব, প্রশাসনকে অবশ্যই নিজের কার্যক্রম একটা ফর্মাল ও নেতিবাচক বলয়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে হয়, কারণ যেখানে সিভিল জীবন তার কাজ শুরু করে সেখানেই প্রশাসনের ক্ষমতা বলতে কিছু থাকে না। সিভিল সমাজের জীবনের অসামাজিক চরিত্র, ব্যক্তি সম্পত্তি, বাণিজ্য, শিল্প, সিভিল সমাজের বিভিন্ন দলের পারস্পরিক খেয়োখেয়ির জীবনের যে অসামাজিক চরিত্র, তার মাঝ হতে যা সব বের হয়ে আসেÑ তার সামনে প্রশাসনের তকদির হচ্ছে অক্ষম হয়ে যাওয়া। সিভিল সমাজের এই বিভাজন, এই নীচতা আর দাসত্ব হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার স্বাভাবিক ভিত্তি, ঠিক যেমন সিভিল সমাজ ছিল দাস প্রথার স্বাভাবিক ভিত্তি যার ওপর প্রাচীনকালের রাষ্ট্র টিকে ছিল। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আর দাসত্বের অস্তিত্ব অবিচ্ছেদ্য। প্রাচীনকালে রাষ্ট্র আর দাসত্ব  (ফ্রঙ্কীয় ধ্রুপদী এন্টিথিসিস) আধুনিক রাষ্ট্র আর আধুনিক বাণিজ্য জগতের মতো এত নিবিড়ভাবে গাঁটছাড়ায় বাঁধা ছিল না (লোক দেখানো পবিত্র খ্রিষ্টীয় অ্যান্টিথিসিস)। আধুনিক রাষ্ট্র যদি তার প্রশাসনের অক্ষমতা ঘোচাতে চায় তাহলে সে ব্যক্তি জীবনের বর্তমান অবস্থা বিলোপ করতে বাধ্য। আর রাষ্ট্র যদি ব্যক্তি-জীবনের এইসব অবস্থার বিলোপ ঘটাতে চায় তাহলে তাকে একই সাথে নিজেরই অস্তিত্বের বিলোপ ঘটাতে হবে, কারণ তাদের সম্পর্কের সাপেক্ষেই সে নিজে টিকে থাকে।

আর্টিকেল-১ (১৮৪৪)

রাষ্ট্র যত শক্তিশালী হয়, আর তাই দেশ যত বেশী রাজনৈতিক হয়, সামাজিক অশুভের ভিত্তি আর তাদের সাধারণ ব্যাখ্যা খোদ রাষ্ট্রের নিজের নীতি, মানে সমাজের গঠনে (রাষ্ট্র যার সক্রিয়, সচেতন এবং অফিসিয়াল প্রকাশ) খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম হয়। রাজনৈতিক চিন্তা বাস্তবিকই  রাজনৈতিক এই দৃষ্টিতে যে, চিন্তাটা ঘটে রাজনীতির ছকের ভেতর। রাজনৈতিক চিন্তা যত স্বচ্ছ ও সতেজ, সামাজিক অশুভের স্বভাব বুঝতে সে তত অক্ষম। রাজনৈতিক চিন্তার ধ্র“পদী কাল হলো ফরাসি বিপ্লব। সামাজিক খুঁতের উৎস খুঁজতে রাষ্ট্রের নীতির ধারেকাছে না গিয়ে, ফরাসি বিপ্ল­বের বীরেরা রাজনৈতিক অশুভের উৎস খুঁজলেন খুঁতওয়ালা সামাজিক সংগঠনে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এভাবে রোবোসপিয়ের চরম দারিদ্র্য আর চরম প্রাচুর্যের সহাবস্থানে কেবল খাঁটি গণতন্ত্রের একটি প্রতিবন্ধকতা দেখতে পেলেন। তাই  তিনি এক সার্বিক স্পার্টান কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। রাজনীতির নীতি হচ্ছে ইচ্ছা। রাজনৈতিক চিন্তা পক্ষপাতী, আর তা যত নিখুঁত হয়ে ওঠে, ইচ্ছার সর্বশক্তিমানতার ওপর তার বিশ্বাস তত প্রবল হয়, ইচ্ছার স্বাভাবিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা ততই সে কম দেখতে পায়, সামাজিক অশুভের উৎস আবিষ্কারে তার সক্ষমতা তত কমতে থাকে।

আর্টিকেল-১ (১৮৪৪)

দেখানো হচ্ছে যে, আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি কেবল অতীত রাষ্ট্রের দাসত্বের স্বীকৃতির সমন বহন করে। অতীত রাষ্ট্রের ভিত ছিল দাসত্ব; আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত হলো সিভিল সমাজ এবং সিভিল সমাজের ব্যক্তি স্বার্থ এবং অচেতন স্বাভাবিক প্রয়োজন, মজুরি শ্রমের নিজ ও অপরের স্বার্থপর অভাবের দাসত্ব। আধুনিক রাষ্ট্র নিজের এই স্বাভাবিক ভিতকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানুষের সার্বিক অধিকারে। তবে তা কিন্তু এই রাষ্ট্রের তৈরী করা নয়। পুরাতন রাজনৈতিক শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে আসা, নিজের বিকাশে নিজে চলতে বাধ্য সিভিল সমাজের উৎপন্ন হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্র মানুষের অধিকারের ঘোষণা দিয়ে নিজের জš§ পরিচয়ের আর ভিতের স্বীকৃতি দেয় মাত্র।

পবিত্র পরিবার (১৮৪৫)

হাল জমানার ‘পাবলিক অ্যাফেয়ার্স’ মানে বিকশিত আধুনিক রাষ্ট্রের এই কাজ কারবার, সমালোচনা ঘরানা যেমন করে ভাবে, মোটেই তেমন সামন্ত আনুকূল্যের (privilege) সমাজ নয়। এটা বরং এমন এক সমাজ যেখানে আনুকূল্য উচ্ছেদ হয়েছে, নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এ এক বিকশিত সিভিল সমাজ যেখানে আনুকূল্যের রাজনৈতিক শেকলে বাঁধা উপাদানগুলো মুক্ত হয়ে গেছে। কারোর গায়ে, এমনকি পাবলিক অ্যাফেয়ারের শরীরেও কোনো আনুকূল্যের এই তকমা লাগানো থাকে না। মুক্ত শিল্প এবং মুক্ত বাণিজ্য তেমন করে আনুকূল্য পাওয়া ছিটমহল উচ্ছেদ করে। আর তার জায়গায় নিয়ে আসে সকল রকম আনুকূল্য হতে মুক্ত ব্যক্তি। এই অবস্থা ব্যক্তিকে সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায় হতে আলাদা করে, আবার একই সাথে তাকে ক্ষুদ্রতর আলাদা সম্প্রদায়ে সংযুক্ত করে। যে ঐ আর এমনকি চোখের দেখার দিক দিয়েও অপর মানুষের সাথে কোনো সাধারণ বন্ধনে জড়িত নয়, যে মানুষের সাথে মানুষের স্বতন্ত্রের সাথে স্বতন্ত্রের সাধারণ দ্বন্দ্ব তৈরী করে। এমনি করে সমস্ত সিভিল সমাজই কেবল এমন সব স্বতন্ত্রের পারস্পরিক সংঘাত যারা আর তাদের স্বতন্ত্রতা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে চিহ্নিত হতে পারে না। এ কেবল আনুকূল্যের শেকল হতে মুক্ত স্বতন্ত্র জীবন শক্তির সার্বিক দোলাচল। গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র সিভিল সমাজের মাঝের বিরোধিতা, জনগণের সামাজিক জীবন এবং দাসত্বের ধ্র“পদী বিরোধিতার নিখুঁত রূপ। আধুনিক পৃথিবীতে প্রতিটি ব্যক্তি একই সময়ে দাসত্ব এবং সমাজ জীবনে অংশ নেয়। কিন্তু সিভিল সমাজের দাসত্বকে দেখলে মনে হয় এ যেন স্বাধীন, কারণ তা সেই সব স্বতন্ত্রের বাস্তবায়িত স্বাধীনতার চেহারা নিয়ে হাজির হয় যাদের কাছে সাধারণ শেকল মানুষের আরোপিত সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত, সম্পত্তি, শিল্প আর ধর্মের মতো তার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের জন্য পাগলা দৌড়ই তার নিজের মুক্তির দাবী, যখন কি না এসব আসলে তার পরম দাসত্বের এবং নিজের মানব চরিত্র হারিয়ে ফেলা ছাড়া কিছু নয়। এখানে আনুকূল্যের জায়গা নিয়েছে অধিকার।

পবিত্র পরিবার (১৮৪৫)

মোদ্দা কথা সহজভাবে বললেÑ সিভিল সমাজের সদস্যরা অণু নয়। অণুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকা আর ফলশ্র“তিতে তার বাইরের কোনো অপর সত্তার সাথে নিজের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক কোনো সম্পর্ক না থাকা, অণুর নিজের কোনো অভাব নেই, সে আত্ম-সম্পূর্ণ; বাইরের জগৎ এক সম্পূর্ণ শূন্য, যার না আছে আধেয় না আছে সংবেদন, যার নেই মানে, কারণ অণুর খোদ নিজের ভেতরই সব আছে। সিভিল সমাজের অহংবাদী স্বতন্ত্র হয়তো প্রাণহীন, হাওয়াই ধারণা থেকে নিজেকে অণুর সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারে, মানে নিজেকে এমন এক সত্তা ভাবতে পারে যে সম্পর্কহীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ, কোনো অভাবহীন, পরমভাবে নিখুঁত এবং তৃপ্ত। কিন্তু নোংরা সংবেদনগত বাস্তবের কাছে এসব কল্পনার কানাকড়িও মূল্য নেই। ব্যক্তিকে তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় জগৎ এবং অপর ব্যক্তিদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে; আর তার নোংরা পেট থেকে শুরু করে সব কিছু প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয় যে বাইরের জগৎ কোনো শূন্যতা নয়, বরং এই জগৎই তার উদরপূর্তি করে। তার প্রতিটি কাজ এবং বৈশিষ্ট্য, তার প্রতিটি ব্যাকুল বাসনা হয়ে পড়ে একেকটি অভাব, একেকটি প্রয়োজন। এই প্রয়োজন, এই অভাব তার অহংসর্বস্বতাকে তার বাইরের জিনিস আর মানুষের প্রতি বাসনায় বদলে দেয়। একজন ব্যক্তির অভাব, সেই অভাব মেটাতে পারা অপর অহংবাদী ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে প্রতিটি ব্যক্তি অপরের প্রয়োজন এবং প্রয়োজনের বিষয়গুলোর মাঝে নিজেকে, বলতে গেলে এক দালাল বানানোর সম্পর্কে দেখতে বাধ্য হয়। এটা তাই এক স্বভাব প্রয়োজন, মানুষের আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য। যত বিজাতীয় চেহারা নিয়েই আসুক না কেন, সিভিল সমাজের সদস্যদের একত্রে ধরে রাখে স্বার্থ, তাদের বাস্তব বন্ধন গড়ে তোলে রাজনৈতিক নয় সিভিল জীবন। এমনি করে সিভিল সমাজের অণুগুলোকে রাষ্ট্র একত্রে ধরে রাখে না; আসলে এই অণুগুলো কেবল ভাবনায়, কল্পনার আকাশেই অণু, বাস্তবে তারা অণুর চাইতে একদম ভিন্ন রকম সত্তা। তারা দেবতার মতো অহংশালী নয়, বরং অহংসর্বস্ব মানুষ। বর্তমানে শুধু রাজনৈতিক কুসংস্কারই মনে করে যে, রাষ্ট্রের অবশ্যই উচিত সিভিল জীবনকে একত্রে রাখা। বাস্তবে সিভিল জীবনই রাষ্ট্রকে ধারণ করে।

পবিত্র পরিবার (১৮৪৫)

নেপোলিয়ন সিভিল সমাজ এবং তার নীতির বিরুদ্ধে শেষ বিপ্ল­বী সহিংসতার প্রতিনিধি। একই রকমভাবে এই সিভিল সমাজ ও তার নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল বিপ্ল­ব। সন্দেহ নেই নেপোলিয়ন ইতোমধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝে ফেলেছিলেন; তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে, এই রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে সিভিল সমাজের স্বাধীন বিকাশ, ব্যক্তি স্বার্থের অবাধ খেলা, এইসব।

তিনি এই ভিত্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে রক্ষা করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি দূরদর্শী বিপ্লবী ছিলেন না। তবু তিনি রাষ্ট্রকে নিজেই নিজের লক্ষ্য আর সিভিল সমাজকে নিজের ইচ্ছাহীন নিছক এক অধঃস্তন খাজাঞ্চি বলে গণ্য করেছিলেন। তিনি সহিংসতার চর্চা করেছিলেন স্থায়ী যুদ্ধকে বসিয়ে। ফরাসি জাতীয় অহংকে সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে তিনি তার বদলে জয় করে নেওয়ার রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করতে যতবার দরকার ততবার সিভিল অ্যাফেয়ার, আমোদ, ধন-সম্পদ ইত্যাদির কোরবানি দাবী করলেন। খাঁটি স্বৈরশাসকের ঢঙে তিনি প্রতিদিনের চর্চার উদারতাবাদকে দাবিয়ে রাখলেন। যখনই তার নিজের রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে সংঘাত বাধিয়েছে ততবার তিনি এই সমাজের, এমনকি সবচেয়ে আবশ্যিক বস্তুগত স্বার্থকেও (বাণিজ্য ও শিল্প) রেহাই দেননি। ভাবাদর্শবাদীদের প্রতি তাঁর তীব্র বিরাগের সাথে তিনি যোগ করেন ব্যবসায়ীদের। অভ্যন্তরীণ বিষয়েও সিভিল সমাজের, যারা ‘রাষ্ট্র নিজেই নিজের লক্ষ্য’ ধারণাটির বিরোধিতা করে তাদের, বিরুদ্ধে তিনি লড়ে যান। এমনি করে ‘ক’সে দ্যতা’তে তিনি ঘোষণা করেন যে, বড় জমি মালিকদের জমিদারিতে চাষ করবার সিদ্ধান্ত বিষয়ে তাদের হুজুগ গ্রাহ্য করা হবে না। এমনি করে সড়ক পরিবহন জাতীয়করণের প্রকল্পও ছিল তাঁর, লক্ষ্য ছিল যাতে বাণিজ্য রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়। নেপোলিয়নের ক্ষমতাতে  প্রথম যে ঘটনা আঘাত হানে তার কারিগর ফরাসি বণিকেরা। পারী’র ফটকারা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের আন্দাজ দেখিয়ে সম্রাটকে বাধ্য করে রাশিয়া অভিযান দুই মাস পিছিয়ে দিতে। অভিযান যখন শুরু হয় তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

নেপেলিয়ান নামের ব্যক্তিটিতে নতুন যৌবন পাওয়া বিপ্লবী সন্ত্রাসের মুখোমুখি হওয়া উদার বুর্জোয়ারা এরপর পড়ল বুর্বো এবং রেস্টোরেশনের চেহারা নেওয়া প্রতিবিপ্লবের সামনাসামনি। শেষে ১৮৩০ সালে বুর্জোয়ারা তাদের ১৭৮৯-এর উদ্দেশ্য হাসিল করলো। তবে এতে একটা ভিন্নতা ছিল। নিজেদেরই রাজনৈতিক তালিম হাসিল করবার পর উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের কাছে সাংবিধানিক প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র আর আদর্শ রাষ্ট্র বলে গণ্য হলো না, অথবা তারা নিজেদেরই জগতের পরিত্রাণ আর সাধারণ মানব লক্ষ্য অর্জনের কাবিল বলে মনে করা শুরু করলো। ঐ রাষ্ট্রের বদলে তারা স্বীকৃতি দিল নিজের আলাদা ক্ষমতার অফিসিয়াল প্রকাশ আর তার ব্যক্তি স্বার্থের রাজনৈতিক স্বীকৃতিকে।

১৭৮৯ সালে শুরু হওয়া বিপ্লবের একটি উপাদান যখন খোদ নিজের সামাজিক গুরুত্বের চেতনায় টইটম্বুর হলো, বিজয় লাভ করলো ১৮৩০ সালে Ñ তার সাথে বিপ্লব কিন্তু শেষ হয়ে গেল না।

পবিত্র পরিবার (১৮৪৫)

যেহেতু ব্যক্তিরা শুধু তাদের নির্দিষ্ট স্বার্থ খোঁজে, যা তাদের সাধারণ স্বার্থের সাথে সমাপতিত নয় (কারণ, সাধারণ কল্যাণ সম্প্রদায়-জীবনের একটা মায়া আঙ্গিক), সেহেতু সাধারণ স্বার্থটা চাপানো হয় তাদের কাছে ‘বিজাতীয়’ আর তাদের হতে স্বাধীন এক স্বার্থ হিসেবে, যাকে পাল্টা খোদ নিজে একটা বিশেষ ‘সাধারণ’ স্বার্থ; নয়তো ব্যক্তিদের এই মতানৈক্যে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। যেমনটা ঘটে গণতন্ত্রে। অপর দিকে, এইসব নির্দিষ্ট স্বার্থের ব্যবহারিক লড়াই (যা সর্বদাই সম্প্রদায় ও মায়াবী সম্প্রদায় স্বার্থের বাস্তবিক সংঘাতে মেতে থাকে) ব্যবহারিকভাবে নাকগলানো শুরু করে আর রাষ্ট্রের চেহারা নেওয়া মায়াবী ‘সাধারণ’ স্বার্থের মাধ্যমে যা দরকার তা নিয়ন্ত্রণ করে। সামাজিক ক্ষমতা (মানে শ্রম বিভাগ দিয়ে নির্ধারিত বিভিন্ন ব্যক্তিদের সহযোগে বহুগুণ বেড়ে যাওয়া উৎপাদনী শক্তি) এই ব্যক্তিদের কাছে আর নিজেদের সম্মিলিত ক্ষমতা বলে মনে হয় না (যেহেতু তাদের সহযোগ স্বেচ্ছা নয়, স্বাভাবিক)। বরং এই ক্ষমতাকে  তাদের কাছে মনে হয় তাদের বাইরে বসত করা কোনো বিজাতীয় শক্তি যার উৎস আর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা অজ্ঞ, ফলে যা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তা বরং উল্টো নিজের যথার্থ স্তর ও পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পার হয়, মানুষের ইচ্ছা এবং কাজ-কারবারের তোয়াক্কা না করে, এমনকি মনে হয় তা যেন এই ইচ্ছা ও কাজ কারবারকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ভাবাদর্শ (১৮৪৬)

যেহেতু রাষ্ট্রের কোনো শাসক শ্রেণীর স্বতন্ত্রেরা তাদের সাধারণ স্বার্থ জাহির করে, যে রাষ্ট্রে কোনো পুরো সিভিল সমাজ কাটছাঁট হয়ে থাকে, সেহেতু এটা বোঝা যায় যে, সম্প্রদায়গত সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ক্রিয়া করে, আর এই প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক আঙ্গিক পায়। তাই এই অলীকমায়া তৈরী হয় যে, আইন ইচ্ছার ভিত্তিতে প্রোথিত, আর আদতে এর বাস্তব ভিত্তি হতে বিচ্ছেদ পাওয়া ইচ্ছাতে––স্বাধীন ইচ্ছাতে। একইভাবে এর নিজের পাওয়া আইনতত্ত্ব বাস্তবে আইনে সংকুচিত হয়।

স্বাভাবিক জনসম্প্রদায়ের কাঠামো বিযুক্তি হতে ব্যক্তি সম্পত্তির সাথে যুগপৎভাবে সিভিল আইন বিকশিত হয়। রোমানদের সাথে ব্যক্তিসম্পত্তি আর সিভিল আইনের বিকাশ কোনো পরবর্তী শিল্প বাণিজ্যিক ধারাবাহিকতা পায়নি; কারণ তাদের পুরো উৎপাদনের ধরন পাল্টায়নি। আধুনিক মানুষের কাছে যেখানে সামন্ত সম্প্রদায় শিল্প ও বাণিজ্য দ্বারা সমন্বয় হারাচ্ছিল, সেখানে ব্যক্তি সম্পত্তি আর সিভিল আইনের উত্থানের মধ্য দিয়ে তা এমন নতুন স্তর পেল যার পরবর্তী বিকাশ সম্ভব। যে আমলাফি শহর মধ্যযুগে প্রথম বড়সড় বাণিজ্য নির্বাহ করেছিল তারাই নৌ আইন বিকশিত করেছিল। প্রথম ইতালি, পরে অন্যান্য দেশে যখনই শিল্প আর বাণিজ্য ব্যক্তি সম্পত্তিকে আরো বিকশিত করলো, তখনই রোমান সিভিল আইন পরিমার্জিত আঙ্গিকে আবার গ্রহণ করা হলো, এই আইন কর্তৃত্বে উন্নীত হলো। পরে বুর্জোয়ারা এত ক্ষমতা অর্জন করলো যে, রাজ-রাজড়ারা সামন্ত অভিজাতদের উৎখাত করতে তাদের সহযোগিতা নিতে আগ্রহী হলো। তখন সব দেশে (ফ্রান্সে ষোড়শ শতাব্দীতে) আইনের বাস্তব বিকাশ শুরু  হলো, যা ইংল্যান্ড ছাড়া সব দেশে অগ্রসর হয়েছিল রোমান পুঁথির ভিত্তিতে। ইংল্যান্ডেও রোমান আইনি নীতি অনুপ্রবেশ করাতে হলো সিভিল আইনের আরো বিকাশের জন্য (বিশেষ করে ব্যক্তিগত অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে)। ধর্মের মতোই আইনের সামান্যই স্বাধীন ইতিহাস আছে একথা ভুলে গেলে চলবে না।

ভাবাদর্শ (১৮৪৬)

ব্যক্তিগত ভূমি-সম্পত্তি সম্পর্কে হেগেলের ব্যাখ্যার চেয়ে আর কিছুই বেশী হাস্যকর হতে পারে না। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, মানুষ একক ব্যক্তি হিসেবে তার এষণাকেই অবশ্যই ঋদ্ধ করবে ব্যস্ততার সাহায্যে বাহ্য প্রকৃতির আত্ম হিসেবে, এবং তাকে করবে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই যদি হয়, ‘একক ব্যক্তির’ ভবিতব্য, তা হলে একজন জমিদার জমির অবাধ ব্যক্তিগত মালিকানা, একটি অতিসাম্প্রতিক সৃষ্ট, হেগেলের মতে, একটি সামাজিক সম্পর্ক নয়, পরন্তু একজন ব্যক্তি হিসেবে মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক, সব কিছুকে আত্মসাৎ করার মানুষের চূড়ান্ত অধিকার (Hegel, Philosophie des Rechts, Berlin, 1840, S. 79) । অন্তত এটা পরিষ্কার: ব্যক্তি কেবল তার ‘এষণা’ দিয়ে আরেক ব্যক্তির এষণার বিরুদ্ধে  নিজেকে পোষণ করতে পারে না, যে একইভাবে একজন বাস্তব ব্যক্তি হতে চায় ঐ একই জমির টুকরোর জোরে। নিশ্চয়ই কেবল সদেষণা ছাড়া আর কিছু আবশ্যক হয়। অধিকন্তু এটা নির্ণয় করা চূড়ান্তভাবে অসম্ভব কোথায় ব্যক্তি তার এষণাকে উপলব্ধ করার সীমা টানবে––এর জন্য কি লাগবে গোটা একটা দেশ, নাকি কয়েকটা দেশের একটা গোটা গোষ্ঠী, যা আত্মসাৎ করে ‘জিনিসটির উপরে আমার আধিপত্যের অভিব্যক্তি ঘটবে’। এখানে হেগেল এক পুরোপুরি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। ‘আত্মসাৎ করাটা হচ্ছে একটা অত্যন্ত বিশেষ ধরনের; আমি আমার দেহ দিয়ে যতটা স্পর্শ করতে পারি, তার চেয়ে বেশী কিছুর দখল এই না; কিন্তু অন্য দিকে এটা পরিষ্কার বা বাহ্য জিনিসগুলি বেশী বিস্তৃত, আমি যতটা ধরতে পারি, তার চেয়ে। এইভাবে, এই ধরনের একটি জিনিসের দখল নিয়ে, অন্য কিছু জিনিস তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। আমি আত্মসাৎকরণের কাজটি সম্পাদন করি আমার হাতের সাহায্যে, কিন্তু তার পরিধি বাড়ানো যায় (পৃ. ৯০)। কিন্তু এই অন্য জিনিসটি আবার আরো একটি জিনিসের সঙ্গে যুক্ত এবং অতএব যে-সীমানার মধ্যে আমার এষণা, আত্ম হিসেবে, মাটির মধ্যে প্রবিষ্ট হবে, তা অন্তর্হিত হয়ে যায়। ‘যখন আমি কিছু দখল করি, তখনি আমার মন চলে যায় এই ধারণায় যে, কেবল আমার প্রত্যক্ষ দখলে সেটা আছে, সেই সম্পত্তিটাই নয়, সেই সঙ্গে যা কিছু সেটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাও আমার। এখানে ধনাত্মক অধিকারই হবে সিদ্ধান্তের নিয়ন্তা, কেননা ‘ধারণাটি’ থেকে আর কোনো সিদ্ধান্ত টানা যায় না (পৃ. ৯১)। এটা ‘ধারণাটির’ একটি অসাধারণ রকমের সরল স্বীকৃতি এবং প্রমাণ করে যে, যেটি গোড়াতেই বুর্জোয়া সমাজের অন্তগর্ত ভূমিগত সম্পত্তির এক অতি নির্দিষ্ট আইনগত মতকে চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করার মতো বিরাট ভুল করেÑ স্বীকৃতি এই ঘটনায় যে সেটি এই ভূমিগত সম্পত্তির কিছুই বোঝে না। একই সঙ্গে এর মধ্যে এই স্বীকৃতিও অন্তর্ভুক্ত যে ‘ধনাত্মক অধিকার’ করতে পারে এবং অবশ্যই করে সামাজিক তথা অর্থনৈতিক বিকাশের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে, তার নির্ণয়সমূহের পরিবর্তন সাধন।

পুঁজি ৩-এর ১ (পৃ.১৫৭-১৫৮, পাদটীকা)

ঐতিহাসিকভাবে যে তাত্ত্বিকেরা শক্তিকে আইনের ভিত্তি বলে বিবেচনা করেছেন, হবসের মত, সেই সব তাত্ত্বিক যারা ইচ্ছাকে আইনের ভিত্তি বলে দেখেছেন…শক্তিকে যদি আইনের ভিত্তি বলে ধরে নেওয়া হয়Ñ তাহলে আইন ও আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিধিবদ্ধ আইন কেবল সেই সব অপর পরিস্থিতিগুলোর লক্ষণ বা প্রকাশ যার ওপর রাষ্ট্র ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তির বস্তুগত জীবন নিঃসন্দেহে নিছক তাদের ইচ্ছা; তাদের উৎপাদানের ধরন আর তাদের মেলামেশার আঙ্গিকের ওপর নির্ভর করে না, যা পারস্পরিকভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করে। এই বস্তুগত জীবনই রাষ্ট্রে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। এই বস্তুগত জীবনই রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি। যে প্রতিটি স্তরে শ্রম বিভাগ ও ব্যক্তি সম্পত্তি এখানে আবশ্যক, এই বস্তুগত জীবন সেখানে ব্যক্তিদের ইচ্ছা হতে একেবারেই স্বাধীন। এসব বাস্তব পরিস্থিতি রাষ্ট্র ক্ষমতার হাতে তৈরী হওয়া নয়; এই শক্তিই বরং রাষ্ট্র তৈরী করে। যেসব ব্যক্তি এসব পরিস্থিতির অধীনে, তাদের ক্ষমতাকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে হবে––এই সত্য হতে তারা একেবারে আলাদা হয়ে শাসন করে, তাদের অবশ্যই নিজেদের ইচ্ছাকে (যেহেতু তা এসব নির্দিষ্ট পরিস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত) রাষ্ট্রের ইচ্ছা হিসেবে, আইন হিসেবে এক সাধারণ অভিব্যক্তি দিতে হয়। এই অভিব্যক্তির আঙ্গিক সর্বদাই এই শ্রেণীর পরিস্থিতি দিয়ে নির্ধারিত, যেমনটা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে সিভিল ও অপরাধ আইনে প্রকাশিত। ব্যক্তির শরীরের ওজন যেমন তার আদর্শ ইচ্ছা বা খাম-খেয়ালের ওপর নির্ভর করে না, তেমনই তারা তাদের নিজ ইচ্ছা আইনে প্রতিফলিত করলো কিনা, আর একই কালে, ব্যক্তি স্বাধীনতা দিল কিনা তা তাদের ওপর নির্ভর করে না। তাদের ব্যক্তি আধিপত্য অবশ্যই একই কালে এক সাধারণ আধিপত্য গড়ে তোলে। তাদের ব্যক্তি ক্ষমতা সেই অস্তিত্বের অবস্থার ওপর ভর করে থাকে যা সমাজ অবস্থা হিসেবে বিকশিত আর যার অনুবৃত্তি তাদের দেখাতেই হয় তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্তর্ভুক্ত করেও সবার জন্য বৈধ করার খাতিরে। আইন হলো তাদের সাধারণ স্বার্থ দিয়ে শর্তায়িত এই ইচ্ছার প্রকাশ। এটা ঠিক স্বাধীন ব্যক্তি ও তাদের ইচ্ছার সংগ্রাম––যা এই ভিত্তিতে একে অপরের প্রতি তাদের আচরণে আবশ্যিকভাবেই অহংসর্বস্ব, যা আইন এবং আবশ্যিক আইন নিয়মের মাধ্যমে আত্ম-অস্বীকৃতি তৈরী করে, বা ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে অপর আত্ম-অস্বীকৃতি তৈরী করে, বা ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে অপর আত্ম-অস্বীকৃতি তৈরি করে…শাসিত শ্রেণীর জন্যও অনুরূপকেই ভালো বলে ধরে নেওয়া হয়, যাদের ইচ্ছার ওপরও আইন এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব একই রকম সামান্যই নির্ভর করে। যেমন, যতক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদনী শক্তিগুলো প্রতিযোগিতা প্রয়োজনাতিরিক্ত করতে অপর্যাপ্ত রকম বিকশিত, যার ফলে প্রতিযোগিতা সর্বদাই পুনরাবির্ভূত হয়, ততক্ষণ প্রজা শ্রেণী যদি প্রতিযোগিতা নির্র্মূল করে, তার সাথে রাষ্ট্র ও আইনকেও নির্মূল করবার ‘ইচ্ছা’ করে তবে তা হবে এক অসম্ভর ইচ্ছা। তদুপরি যতক্ষণ না অবস্থা এমন বিকশিত হচ্ছে, যেখানে তারা তাদের এই ইচ্ছা উৎপাদন করতে পারছে, ততক্ষণ তা কেবল ভাবাদর্শীদের কল্পনাতেই বিরাজ করে। অবস্থা একবার তা উৎপাদন করবার মতো পর্যাপ্ত রকম বিকশিত হয়ে গেলে, ভাবাদর্শীরা একে নিখাদ খাম-খেয়ালি, আর তাই যে কোনো কালে পরিস্থিতিতে ধারণাযোগ্য বলে কল্পনা করতে পারেন। অপরাধ হচ্ছে দাপুটে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একক ব্যক্তির সংগ্রাম। আইন নিজে যতটা খেয়ালের ফসল, অপরাধ নিজে তারচেয়ে বেশি খেয়ালের ফসল নয়। আইনের মতো অপরাধও বরং একইভাবে শর্তায়িত। এই একই দূরদৃষ্টিবানেরা, যারা আইনের মধ্যে সহজ আইন ভাঙা দেখতে পাবেন। রাষ্ট্র কোনো দাপুটে ইচ্ছার ওপর ভর করে টেকে না, রবং ব্যক্তিদের বস্তুগত জীবন ধরন হতে উঠে আসা রাষ্ট্রের নিজেরও এক দাপুটে ইচ্ছার চেহারা আছে। এই ইচ্ছা যদি তার দাপট হারায়, তাহলে তার মানে শুধু এই নয় যে ইচ্ছা বদলে গেল, তার মানে একই সাথে এও যে ব্যক্তিদের ইচ্ছা সত্ত্বেও জীবন বদলে গেছে। আইন ও বিধানের স্বায়ত্তশাসিত বিবর্তন থাকা সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে তা নিখাদ ফর্মাল এবং আর আধিপত্যকারী নয়, যেমনটা রোমান ও ইংলিশ আইনি ইতিহাসের বহু তাক লাগানো দৃষ্টান্তে দেখা যায়। ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি দার্শনিকদের কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে কেমন করে ব্যক্তি আর চিন্তার ভিত্তি তাদের বাস্তব সম্পর্ক হতে চিন্তাকে আলাদা করার মাঝ দিয়ে শুদ্ধ চিন্তার এক ইতিহাস উঠে আসতে পারে। বর্তমান ক্ষেত্রেও আইনকে এর বাস্তব ভিত্তি থেকে আলাদা করা যায়, আর তার ফলে আমরা এমন এক ‘শাসক ইচ্ছা’য় পৌঁছাতে পারি যার বিভিন্ন কালে ছিল বিভিন্ন প্রকাশ আর যার সৃষ্টিতে, আইনে আছে এর নিজস্ব স্বাধীন ইতিহাস। এই উপায়ে রাজনৈতিক ও সিভিল ইতিহাস ভাবাদর্শিকভাবে আত্ম-বিকশিত আইনের আধিপত্যের এক ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

ভাবাদর্শ (১৮৪৬)

…পুরোপুরি অসম্ভব না হলেও, এমন নীতি প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে যাতে নিজের সভ্যতার মহিমায় থাকা কোনো সমাজে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায্যতাকে দাঁড় করানো যায়। সাধারণভাবে শাস্তিকে সমর্থন করা হয় শুধরানো, নয়তো ভয় দেখিয়ে বশে রাখবার উপায় হিসেবে। এখন কথা হলো––অন্যকে শুধরানো বা বশে রাখার জন্য আমাকে শাস্তি দেওয়ার কোনো অধিকার তোমার আছে? তাছাড়া, ইতিহাস, পরিসংখ্যান বলেও একটা ব্যাপার আছে––যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখানো যায় যে, কাবিলের কাল হতে শাস্তি দিয়ে জগৎকে শোধরানোও যায়নি, বশেও রাখা যায়নি। বরং উল্টো। অমূর্ত আইনের দৃষ্টিতে, শাস্তির একটা মাত্র তত্ত্ব আছে যা অমূর্ততে মানুষের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়। আর তা হলো কান্টের তত্ত্ব, বিশেষ করে এর মাঝে হেগেলের দেওয়া আরো আঁটসাঁট ফর্মুলা। হেগেল বলেছেন :

শাস্তি হলো অপরাধীর অধিকার। শাস্তি তার নিজের ইচ্ছার ক্রিয়া। অধিকার লঙ্ঘন করাকে অপরাধী নিজের অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। তার করা অপরাধ হলো অধিকারের নেতিকরণ। শাস্তি হলো সেই নেতিকরণের নেতিকরণ, ফলে তা অপরাধীর নিজেই নিজের ওপরে ধার্য করা এবং চাপিয়ে দেওয়া অধিকারের ইতিকরণ।

হেগেলের ক্ষেত্রে, অন্তত এই ফর্মুলায়, সন্দেহ নেই বেশ খোলামেলা একটা ব্যাপার আছে। অপরাধীকে নিছক বিষয়, ন্যায়বিচারের দাস হিসেবে দেখার বদলে এখানে তাকে স্বাধীন আর আত্ম-নির্ধারিত সত্তার পর্যায়ে তুলে আনা হয়েছে। তবে ব্যাপারটাকে আরো গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, অন্যান্য দৃষ্টান্তের মতোই জর্মন ভাববাদ এখানে বহাল সমাজশাসনকে একটা অতীন্দ্রিয় মর্যাদা দিয়ে দিয়েছে। খোদ ব্যক্তিটাকেই তার বাস্তব অভিপ্রায়, তার ওপরে চেপে থাকা সামাজিক পরিস্থিতি, ‘স্বাধীন ইচ্ছা’র অমূর্তায়নের (মানুষের নিজের জন্য মানুষের অনেক গুণের যা একটা মাত্র) সঙ্গে বদলে ফেলা একটা প্রবঞ্চনা নয় কি? শাস্তিকে অপরাধীর নিজের ইচ্ছার ফলাফল হিসেবে গণ্য করা এই তত্ত্ব––সেই পুরানো চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত, রক্তের বদলে রক্তের ধারণার এক অধিবিদ্যক প্রকাশ মাত্র। এসব কচকচি বাদ দিয়ে সোজা কথায় বললে শাস্তি সমাজের সব চাইতে স্পর্শকাতর শর্ত লঙ্ঘনের চরিত্র থেকে নিজেকে বাঁচানোর একটা উপায় ছাড়া আর কিছু নয়, সেই লঙ্ঘনের চরিত্র যেমনই হোক। এখন, যে সমাজের নিজেকে রক্ষার জন্য জল্ল­াদের চাইতে ভালো কোনো কৌশল জানা নেই, যে বিশ্বের সবচাইতে সামনের সারির জার্নালে নিজের বর্বরতাকে চিরন্তন আইন বলে ঘোষণা করা হয়––তার দশাটা কী?

আইন বলে যাকে ঘোষণা করা হয় তার দশাটা কী?

জনাব এ, কোয়তেলে তাঁর বিদগ্ধ রচনা, L`Homme st is Facultes-এ বলেছেন:

একটা বাজেট আমরা আতঙ্কিতরকম তাড়াহুড়ো করে পরিশোধ করিÑ আর তা হলো জেলখানা আর ফাঁসী কাঠের বাজেট… আমরা এমনকি প্রায় বার্ষিক জš§ ও মৃত্যু হার আগাম জানানোর মতো করেই আগাম ধারণা করতে পারি সামনের বছর কতজন তার সঙ্গের মানুষটার রক্তে হাত রাঙাবে, কতজন জালিয়াতি করবে, ক’জন বিষ খাবে।

১৮২৯ সালে ছাপা হওয়া অপরাধের সম্ভাবনার হিসেরে কোয়েতলে বাস্তবিকই চমকে যাওয়ার মতো নিশ্চিতভাবে ১৮৩০ সালে ফ্রান্সে সংগঠিত অপরাধের শুধু পরিমাণ নয় সেই সাথে অপরাধের ধরনও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সাধারণভাবে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের মৌলিক শর্তগুলোর মতো কোনো দেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কোনো প্রদত্ত সমাজের জাতীয় ভগ্নাংশে একটা নির্দিষ্ট হারে অপরাধ উৎপাদন করে না, এটা দেখা যেতে পারে ১৮২২-২৪ সালের জন্য কোয়েতলের তৈরী করা সারণিটি থেকে। আমেরিকা এবং ফ্রান্সের একশ জন সাব্যস্ত অপরাধীর মাঝে দেখা যায়:

বয়স                                       ফিলাডেলফিয়া                                     ফ্রান্স

২১ বছরের নীচে                   ১৯                                                          ১৯

২-৩০ বছর                           ৪৪                                                           ৩৫

৩০-৪০ বছর                        ২৩                                                          ২৩

৪০ এর ওপরে                        ১৪                                                           ২৩

মোট                                       ১০০                                                       ১০০

যদি পরিমাণ, শ্রেণী বিভাগ আর শারীরিক মাত্রার দিক থেকে নিয়মমাফিকভাবে এত ব্যাপক মাত্রায় অপরাধ সংগঠিত হয়, যদি জনাব কোয়েতলের মতানুযায়ী, দুটোর মধ্যে (বস্তুগত জগৎ এবং সমাজ ব্যবস্থা) কোনো কার্যকর কারণ্টার সবচেয়ে নিয়মিতভাবে প্রভার ফেলে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়Ñ তাহলে জল্লাদের গুণগান (যে বহু অপরাধীকে ফাঁসীতে ঝোলায় শুধুমাত্র নতুন চালানের জায়গা করে দিতে) করার বদলে, যে ব্যবস্থা এই অপরাধের জš§ দেয় সেই ব্যবস্থাকে বদলানোর কথা গভীরভাবে ভাবা জরুরী নয় কি?

নিউইয়র্ক (১৮ ফেব্রুয়ারী ১৮৫৩)

(Footnotes)

১ নির্বাচিত এই অংশ নেওয়া হয়েছে টমাস বটোমর এবং মাক্সমিলিয়ান রুবেল সম্পাদিত Karl Marx: Selected Writings in Sociology & Social Philosophy হতে। ভাষান্তরের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ১৯৬৪ সালের ম্যাকগ্রহিল সংস্করণ।