- মোহাম্মদ আজম
গণমাধ্যম কথাটা আজ থেকে দুই দশক আগে বা এমনকি একযুগ আগেও যেভাবে বা যে তাৎপর্যে উচ্চারিত হত, এখনকার পরিস্থিতির সাথে তার ফারাক রীতিমতো আকাশ-পাতাল। এ বিষয়ক যে কোনো আলাপে যাওয়ার আগে ওই পার্থক্যের কথাটা পষ্ট করে তোলা থাকা জরুরি। কারণ, যারা এ ধরনের আলাপ করছেন, তাদের বেশিরভাগই পার্থক্যের বিষয়ে হুঁশিয়ার থেকে কথা তুলছেন না। নতুন প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ভাষার ধারণাও বেশ কতকটা বদলে গেছে। ছবি বা চলচ্ছবি আগেও ছিল। কিন্তু না মেনে উপায় নেই, আজকালকার গণমাধ্যমে লেখার তুলনায় কথা, আর স্থিরচিত্রের তুলনায় চলচ্চিত্রের উপস্থিতি আর ভূমিকা বিস্তর বেড়েছে। আমরা এ লেখায় আমাদের চালু ডিসকোর্সে বিদ্যমান কিছু বিষয় নিয়েই মূলত কথা বলব। তবে, তার জন্য বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা চাই – পার্থক্যের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা, আর ভাষা বলতে কোন ভাষার কথা বলা হচ্ছে সেদিকটা স্পষ্ট করে নিয়ে আলাপ করাটা জরুরি।
প্রথমেই বলা যাক, আজ থেকে দুই দশক আগেও গণমাধ্যম বলতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় বা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নজরদারি করা যায়, এমনসব মাধ্যমকেই বোঝানো যেত। এর দুইটি ফর্ম আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি পত্রিকা, অন্যটি টেলিভিশন। গণমাধ্যমের ভাষার বিতর্কটি আসলে পত্রিকার জমানায় একেবারেই ছিল না, বা খুব প্রান্তীয়ভাবে ছিল। ঢাকায় বা বাংলাদেশে এটি জোরদার হয়েছে মূলত টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ার প্রেক্ষাপটে এবং বিনোদন-উপকরণগুলোতে অপ্রমিত ভাষা ব্যবহারের কারণে। আমাদের হয়ত মনে পড়বে, ঢাকার চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার সংক্রমণ সম্পর্কে তার আগে আগে বা সমকালে বেশ জোরালো বিকর্ত ও প্রপাগান্ডা চলেছিল। সিনেমার মতো অতি-নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটা মাধ্যমের ক্ষেত্রে ওই অশ্লীলতা-বিরোধী প্রচারণা খুব ভালোভাবেই কাজ করেছে। কিন্তু তার – অশ্লীলতা-বিরোধী প্রচারণার – ফল যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য মোটেই ভালো হয়নি, তা আমরা এখন প্রায় হাড়ে-মজ্জায় বুঝতে পারছি। প্রায় অনুরূপ প্রচারণা টেলিভিশন নাটক সম্পর্কেও হয়েছিল। তা বেশ জোরালোও ছিল। কিন্তু সিনেমার মতো টিভি নাটকের ক্ষেত্রে ওই প্রচারণা খুব বেশি সাফল্য পায়নি।
ওয়ালটার বেনজামিন ফটোগ্রাফি সম্পর্কে এক মজার প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছেন, যখন ফটোগ্রাফি শুরু হল, তখন লোকে ফটোগ্রাফ শিল্প কি না, বা শিল্প হলে কতটা শিল্প – তা নিয়েই তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ-আলোচনা করছিল। আদতে যা গুরুতর ও কাজের প্রশ্ন – ফটোগ্রাফির আবির্ভাব মানুষের সামগ্রিক শিল্পবোধে ও শিল্পভোগে কী গভীর পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল, তা নিয়ে আসলে কোনো আলাপই হয়নি। বেনজামিনের এ কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ অর্থে যে, কেবল ফটোগ্রাফি নয়, প্রায় যে কোনো বিষয়েই জীবনযাপন সংলগ্ন জরুরি প্রশ্নগুলো উত্থাপন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে, এবং বেশিরভাগ সময়ে লোকে অজরুরি বিষয় নিয়েই খুব গুরুগম্ভীর আলাপ করে। গণমাধ্যমের ভাষা এরকমই একটা বিষয়।
দুই-একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বলেছি, দুই দশকে গণমাধ্যমের ধারণা আমূল পালটে গেছে। এ বদলের স্বরূপ কী? দু-চার কথায় বলা মুশকিল। তবে সবচেয়ে গোড়ার পরিবর্তনটিকে বোধহয় এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, আগে প্রোডিউসার-এন্ডে অর্থাৎ উৎপাদন অংশে নিয়ন্ত্রণ ছিল; কিন্তু কনজুমার এন্ডে ছিল না। পত্রিকাওয়ালা কত পৃষ্ঠা পত্রিকা বের করবে, বা কোন ধরনের কাগজ বা লেখা পত্রিকায় দেবে, তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু একজন ক্রেতা তা কিনবে কি না, তা যেমন নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য, ঠিক তেমনি কেনা কাগজ দিয়ে সে কি মুদিবাজারের থলি বানাবে, নাকি জ্ঞানার্জন করবে, তারও কোনো ঠিকুজি রাখা সম্ভব নয়। আজকালকার গণমাধ্যমেও ভোক্তা-প্রান্তে প্রায় একই অবস্থা বিরাজ কাছে। প্রায় বললাম এ কারণে যে, বেশ কিছু বড় পার্থক্যও আছে। কিন্তু বড় বদলটা ঘটেছে উৎপাদক-প্রান্তে। সেখানে আর একচ্ছত্র বা নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রাখার কোনো কায়দা নাই। অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রণ আপনি করতে পারেন; কিন্তু তা কার্যকর হবে না। ফেসবুকের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করলেন; আরো দশ ধরনের ফেরকা উন্মোচিত হল, এবং নতুন নতুন – আপনার অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের অনভিপ্রেত – টেক্সট উৎপাদন চলতেই থাকল। নিয়ন্ত্রণ তো হয়ই; কিন্তু তার ধারণাটাই গেছে বদলে।
অন্যদিকে ভোক্তা-প্রান্তের বদলও হয়েছে খুবই ব্যাপকভাবে। ভোক্তারাই হয়েছে বড় উৎপাদক। এবং এমন ঘটনা হরহামেশাই হচ্ছে যে, উৎপাদকের উদ্দেশ্য বা মতিগতিকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়ে ভোক্তারাই কোনো রিপোর্ট বা কলামকে পুরোপুরি নতুন তাৎপর্যে পড়তে বাধ্য করছে। বর্তমান সরকারের আমলে এ ঘটনা বিস্তর দেখা যায়। হয়ত সরকারের সমর্থক কোনো বুদ্ধিজীবী সরকারের কোনো কর্মকা- বা কোনো সরকারি লোকের সাফাই গেয়ে কোনো প্রবন্ধ লিখল পত্রিকায়। কিন্তু অনলাইনে যাওয়ার সাথে সাথেই পাঠকসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ল তাতে; আর এত বেশি সংখ্যায় ভিন্নমত বা এমনকি গালিগালাজ বর্ষিত হল যে, মূল লক্ষ্যটা ভেস্তে গিয়ে ক্ষতির পাল্লাই অনেক বড় হয়ে উঠল। এ বিষয়ে আমরা পরে আবার কথা বলব। তবে, উৎপাদন ও ভোক্তা নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত যতটুকু বললাম, তাতেই আশা করি পরিষ্কার হয়েছে, গণমাধ্যম নিয়ে কথা বলার জন্য দুই দশক আগের জ্ঞান আর বস্তুত একবিন্দুও কাজ করবে না।
ভাষার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ভিজুয়াল সম্পর্কে মন্তব্য করা জরুরি। কারণ, মোবাইল ও কম্পিউটার স্ক্রিনে গণমাধ্যমের স্থানান্তরিত হওয়ার একটা প্রধান পরিণতি এই যে, লিখিত বয়ানের পাশাপাশি কিংবা লিখিত বয়ানের চেয়ে বেশি পরিমাণে ভিজুয়াল স্থান পাচ্ছে প্রায় যে কোনো উপস্থাপনায়। খরচের দিক বিবেচনা করলে আর সার্কুলেশনের বৈপ্লবিক বদলের কথা ভাবলে এর সুবিধার দিক এত বেশি পাওয়া যাবে যে, একে অনিবার্য ভাবতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। লিখিত রূপের মতোই এ ভিজুয়াল ভাষারও প্রমিত-অপ্রমিত আছে; আছে অনুমোদিত-অননুমোদিত রূপ। কিন্তু আজকের আলাপে আমরা সেদিকে কথা বাড়াব না। আমাদের দেশে গণমাধ্যমের ভাষা বলতে প্রধানত যা বোঝানো হয়, আমরা আলাপ তার মধ্যেই সীমিত রাখব।
গণমাধ্যমের ভাষা সম্পর্কে আমাদের দেশে প্রথম জোরালো আলাপ উঠেছিল প্রায় দুই দশক আগে, যখন টিভি নাটক বা অনুরূপ বিনোদন উপাদানগুলোতে এবং নতুন শুরু হওয়া রেডিও স্টেশনগুলোতে ব্যাপকভাবে অপ্রমিত ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তখন এ বাবদ রীতিমতো অপ্রমিতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসাবে সম্মানিত বা কুখ্যাত হয়েছিলেন। তখন সহকর্মীদের একটা দলের মধ্যে এ আলোচনা উঠলে লক্ষ করলাম, প্রত্যেকেই সাধারণভাবে গণমাধ্যমে আর বিশেষভাবে নাটকে ভাষা-দূষণের জন্য ফারুকীকেই দায়ী করছেন। আমি নিশ্চুপ ছিলাম। পরে অন্যরা আমার মত জানতে চাইলে বলেছিলাম, আপনারা বোধহয় একজন ব্যক্তিকে বা কয়েকজনকে বেশি পরিমাণ কৃতিত্ব দিয়ে ফেলছেন; কারণ, ভাষা এমন কোনো ব্যাপারই না যে, কেউ বা কেউ কেউ একে বদলে দেবে। বরং কথাটা এভাবে ভাবা উচিত, সমাজে বিদ্যমান বিচিত্র ভাষাভঙ্গির একটি বা একাধিক রীতি কেউ কেউ কোনো বিশেষ মাধ্যমে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রপথিকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন; তাতে তিনি যদি কৃতিত্ব পান তো ভালো, না পেলেও ক্ষতি নাই; কিন্তু আলোচনাটা এভাবেই হওয়া উচিত। বলে রাখা দরকার, উপস্থিত সহকর্মীরা আমার এ মত পছন্দ করেননি।
আরেকবার বেনজামিনের পূর্বোক্ত কথাগুলো স্মরণ করি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তোলাটা সবচেয়ে জরুরি কাজ। আমাদের প্রথমে আসলে গণমাধ্যমের ভাষা বলতে কী বুঝব, আর কোন অংশের ভাষা নিয়ে আলাপ করছি, তা নির্ধারণ করা উচিত। সাধারণভাবে গণমাধ্যমের ভাষা বলে কিছু থাকতে পারে না। কারণ, গণমাধ্যম যেমন এক রকমের নয়, ঠিক তেমনি একটি গণমাধ্যমেও এক রকমের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় না, বা এক ধরনের লেখালেখি হয় না। দুই দশক আগে যখন গণমাধ্যম হিসাবে টিভি বা রেডিওর প্রতাপ ছিল, তখনকার কথাই ভাবা যাক। টেলিভিশনে তখন আলাপটা হত প্রধানত নাটকের ভাষা নিয়ে। ওই আলাপ এখনো প্রায় একইভাবে করা হয়। কিন্তু টেলিভিশনে তো আরো অসংখ্য অনুষ্ঠান থাকে। কখনো কি এরকম হয়েছে যে, খবর বা আনুষ্ঠানিক কোনো উপস্থাপনায় অপ্রমিত ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে? এরকম ঘটনা কখনোই ঘটেনি, এবং ঘটার কোনো কারণও নাই। যদি সংখ্যা বা প্রচার-সময়ের হিসাব নেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে বা বেশির ভাগ সময়ে প্রমিত ভাষাই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিছু সংখ্যক বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানেই কেবল কথিত অপ্রমিত বা মিশ্র ভাষা ব্যবহার করা হয়। দুই-তিন দশক আগেও এ কথা সত্য ছিল, আর এখনো আছে। প্রশ্ন হল, এ অংশের ভাষা-ব্যবহার নিয়ে আমাদের শনাক্তি বা পর্যালোচনার ধরন কেমন হবে?
যে কোনো প্রচারমাধ্যমই মুখ্যত ভোক্তা-নির্ভর প্রতিষ্ঠান; আর উৎপাদকরা ভোক্তা-চাহিদা অনুসারেই ভাষা নির্ধারণ করে থাকে। এদিক থেকে বিচার করে বলা যায়, বিনোদনধর্মী অনুষ্ঠানগুলোর ভোক্তাসমাজের মধ্যে তুলনামূলক কম-বয়সীদের একটা প্রাধান্য থাকে। আর উৎপাদক শ্রেণি একেবারেই ব্যবসায়িক কারণে তাদের পছন্দের ভাষাভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে বাধ্য হয়। এর সমালোচনা যারা করেন, তারা মুখ্যত বয়সে জ্যেষ্ঠ, আর কেউ কেউ রুচিতে রক্ষণশীল। তারা সংখ্যায় যদি বেশি হতেন, তাহলে তাদের চাহিদা অনুযায়ীই অনুষ্ঠানের ভাষা নির্ধারিত হত। কিন্তু বাস্তবতা হল, সংখ্যার বিচারে এরা গরিষ্ঠ নন।
এরপর আরো দুটি প্রশ্ন বাকি থাকে। একটা হল রুচির প্রশ্ন; আরেকটা হল গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন। রুচি প্রসঙ্গে বলা দরকার, গণতান্ত্রিক হওয়া ছাড়া, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া রুচির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার আসলে আর কোনো উপায় নাই। বিশেষত, গণমাধ্যমের প্রশ্নে। আর দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে বলতে হয়, সংবাদ প্রচার বা অন্য আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামগুলোতে প্রমিত বা ‘রুচিশীল’ ভাষা ব্যবহার করে গণমাধ্যমগুলো বস্তুত দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই দিয়ে যাচ্ছে। এরচেয়ে বড় দায়িত্ব তাদের উপর চাপানো খুব ন্যায্য নয়।
আজকের দিনে গণমাধ্যমের যে কোনো ধারণা আমূল বদলে যাওয়ার পরেও পুরনো কথা তুলতে হল এ কারণে যে, পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি আজো আমাদের সমাজে অত্যন্ত প্রবল। নাটক ও বিনোদনধর্মী অনুষ্ঠানের ভাষা নিয়ে সমালোচনা এখনো খুব চোখে পড়ে। যদিও পরিমাণটা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কার্যকরতাও অনেক কমে গেছে। কারণ, গণমাধ্যমের যে ধরনের নিয়ন্ত্রণ বা বাছবিচার মাথায় রেখে এ অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয়ে থাকে, আজকালকার গণমাধ্যমের প্রধান রূপগুলোর কোনো বৈশিষ্ট্যই তার সাথে মেলে না।
টিভির কথাই ধরা যাক। এখনো টিভি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়; আর টিভির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও মোটামুটি একই আছে। কিন্তু ইন্টারনেট-নির্ভর বিভিন্ন মাধ্যমে, যেমন ফেসবুকে, টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেভাবে প্রচারিত হয়, তার সাথে আদি টিভি-সম্প্রচারের ধারণার কার্যত কোনো মিল নেই। তাছাড়া, বহুদিন হল, টিভি স্টেশনগুলো সরাসরি সম্প্রচারের তুলনায়, বা টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের তুলনায় ওয়েবসাইট থেকে বা অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে পরবর্তীকালীন প্রচারের মধ্য দিয়ে অনেক বেশি টাকা উপার্জন করে থাকে। কাজেই পুরনো ধারণা এখন আসলে একেবারেই কাজ করবে না।
এই না করার একটা প্রধান কারণ, মোবাইলে বা কম্পিউটার স্ক্রিনে আমরা যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অংশবিশেষ দেখি, তখন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নির্মাণ হিসাবে প্রথমে তাকে না দেখে উপস্থিত অসংখ্য উপাদানের একটা হিসাবে দেখি। এর মধ্যে আলাদা সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলকে চিহ্নিত করার সুযোগ অনেক কমে যায়। সারা দুনিয়ার এত বিচিত্র লিখিত বা ভিজুয়াল উপাদান প্রতি মুহূর্তে আমার সামনে হাজির হয়, যে বাছবিচারের পুরনো মাপকাঠি দিয়ে তার মূল্যবিচার করা আর সম্ভব হয় না। ভোক্তা-প্রান্ত এবং উৎপাদক-প্রান্ত – দুই দিক থেকেই লাইক, ভিউ, মন্তব্য ইত্যাদি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।
উপরে আমরা পুরো আলাপটা করলাম, আমাদের দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবণতাকে লক্ষ করে। এতে নিয়ন্ত্রণের বাসনাটা অত্যন্ত প্রবল; আর ভাষাকে রুচি বা মানের একটা বর্গে বিচার করার চিহ্নই প্রধান। এর বাইরে বেরুতে পারলে, বলা যাবে, এখনকার গণমাধ্যমের ভাষা মানুষের জন্য – এবং ভাষার জন্যও – বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। কথাটা তোলার জন্য প্রথমে উৎপাদন-প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
একসময় গণমাধ্যম খুব ব্যাপকভাবে একমুখী ছিল। পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা যেত। কিন্তু তাও ছাপা হত সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে। এখন যদি অনলাইন মাধ্যমগুলোকে – যেমন ব্লগ, অনলাইন পত্রিকা, লেখা-মত-ভিজুয়াল প্রকাশের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম, এমনকি বক্তৃতা বা ব্যক্তিগত মত উপস্থাপনের খুব ক্যাজুয়েল মাধ্যম ইত্যাদিকে – গণমাধ্যমের প্রধান ফর্ম ধরি, তাহলে বলতেই হয়, পূর্বতন একমুখী প্রবাহ এখন একেবারেই উল্টে গেছে। উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে এখন পার্থক্য আর আগের মতো নাই। এমনকি যে কারো পক্ষে সে সম্পর্ক উল্টে দেয়ার অবারিত সুযোগ এখন হাতের মুঠোয়। একে এক বিপুল ও গভীর গণতান্ত্রিকতা হিসাবে দেখাই বাঞ্ছনীয়। তার যতরকম অসুবিধাই থাকুক না কেন, মানুষের অংশগ্রহণমূলকতার দিক থেকে এর কোনো তুলনা বা এমনকি কল্পনাও দুই দশক আগে ছিল না।
এর ফলে সৃষ্টিশীলতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সক্রিয়তার যেসব অনন্য মাত্রা অর্জিত হয়েছে, সে সম্পর্কে এখানে আমরা আলাপ তুলব না। কেবল ভাষা-ব্যবহারের যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, তার ইশারা দেব। আমাদের এ আলাপে কথা বলাটাও অন্তর্ভুক্ত। আমরা লেখ্য ভাষা সম্পর্কে যে দুটো প্রধান পয়েন্ট তুলব, তা স্বাধীন গণমাধ্যমে প্রচারিত ‘কথা বলা’র ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ব্লগ, অনলাইন পত্রিকা, অসংখ্য উপলক্ষে করা মন্তব্য (কমেন্ট), আর ফেসবুকের মতো তুলনামূলক ‘ব্যক্তিগত কিন্তু সামষ্টিক’ পরিসরে মানুষের লেখার যে অবারিত সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা আমাদের উপলব্ধির জগতে রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এগুলো ভাষারই কারবার; অর্থাৎ কাজটা ভাষার মধ্য দিয়েই হচ্ছে। এর প্রত্যেকটিরই নানান ‘অপকারিতা’ আছে; এমনকি মানুষের বৈশিষ্ট্য হিসাবে দোষের ভাবা হয়, এমন অনেক কিছু উসকে দেয়ার অভিযোগও সবগুলোর বিরুদ্ধে তোলা যাবে। কিন্তু যদি শুধু ভাষা ব্যবহারের দিক থেকে দেখি, তাহলে বলতে হবে, লেখ্য ভাষা ব্যবহারের এ বাস্তবতা কিছুদিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। কোনো সন্দেহ নাই, প্রত্যেক উৎপাদনেরই শ্রেণিগত ও অন্যান্য ভিত্তি আছে; আর লেখাগুলোর বিচলনের সাথে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, অবস্থান ও অন্যান্য বর্গের গুরুতর সম্পর্ক আছে। তবু, যদি ডাটা হিসাবে ধরি, তাহলে যে কোনো ভাষাই এখন উৎপাদন করে চলেছে সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি মানুষের লেখ্য ভাষা। এর অনেকগুলোই মানুষের খুব অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে বলে তার মধ্যে মানুষের লেখ্য ভাষায় যতদূর সম্ভব হয় ঠিক ততটা অন্তরঙ্গ ভাষারূপ প্রকাশিত হচ্ছে। কোনো ভাষা সম্পর্কে, ধরা যাক বাংলা ভাষা সম্পর্কে, যদি সত্যিকারের কোনো ধারণা করতে হয়, যদি গবেষণা করতে হয়, বা যদি ভাষার কোনো গণতান্ত্রিক রূপের কথা ভাবতে হয়, তাহলে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় তার উপলব্ধি গভীরভাবে অর্জন করা এখন অনেক বেশি সম্ভব হচ্ছে। অনুমান করি, মানুষের ভাষা-সম্পর্কিত বহু ধারণা এর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে।
দ্বিতীয় আরেকটি প্রসঙ্গ তুলতে চাই। কথা বলার সময়, যদি সেটা যথেষ্ট আনুষ্ঠানিক না হয়, মানুষ সাধারণত খুব সতর্ক হয় না। কিন্তু লেখার সময় তাকে সতর্ক হতেই হয়। কেবল বানান বা বাক্যের গড়নের দিক থেকে নয়; শব্দ ব্যবহার এবং চিন্তা যথোপযুক্তভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি সতর্ক হয়। এমনকি যদি সেটা দৈনন্দিনতার খুব ছোট অনুল্লেখ্য ব্যাপার হয়, তবু। মানুষ অন্যের সামনে উপস্থাপিত হওয়ার কালে যেমন তুলনামূলক সতর্কতার সাথে পোশাক ও পরিচ্ছদ নির্ধারণ করে, ঠিক তেমনি ঘটনা ঘটে লেখার ক্ষেত্রে। এ চর্চা ও সতর্কতা তার লেখার ভাষার যে ক্রম-উন্নতির কারণ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। গণমাধ্যমের এসব নতুন রূপ এভাবে তুলনামূলক আনুষ্ঠানিক ভাষার বিকাশ ও অংশগ্রহণমূলকতায়ও আমাদের সচেতনতার বাইরেই বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। একে ‘ইতিবাচক’ হিসাবে না দেখার কোনো কারণ নাই।
প্রথম প্রকাশ : দেশকাল পত্রিকা, অক্টোবর ২০২২-মার্চ ২০২৩