- নাসরিন সিরাজ
বাংলাদেশে ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে হারকিউলিস নামে এক খুনীর আবির্ভাব হয়। খবরের কাগজ মারফত জানা যায় হারকিউলিস ১৭ জানুয়ারী থেকে ১ ফেব্রুয়ারী এই দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনটি খুন করে (তথ্যসূত্র-১)। তিনজন শিকার (যথাক্রমে, রিপন, সজল ও রাকিব) বাছাইয়ে হারকিউলিস যে মানদন্ড অনুসরণ করে সেটা হল তারা নারী-বলাৎকারের সাথে জড়িত ছিল এরকম অভিযোগ পাওয়া যায় এবং অভিযোগগুলো সেই সময়ে খবরের কাগজে টাটকা খবর হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছিল। খবরগুলো প্রকাশের সূত্র ধরে নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ব্যপকতা নিয়ে জনমনে দৈনন্দিন যে উদ্বেগ, আতংক ও হতাশা রয়েছে সেটা আবারো উচ্চকিত হচ্ছিল। হারকিউলিসের আবির্ভাব যেন সেই উৎকন্ঠাকে প্রশমিত করতেই ঘটেছিল; ভাবখানা এই তো সেই রক্ষাকর্তা যে ধর্ষণকারীদের হাত থেকে আমাদের মেয়েদের (পড়ুন: নারীর সতীত্ব) বাঁচাবে।
শিকার বাছাইয়ের পাশাপাশি হারকিউলিস নিজের পরিচয় প্রকাশে বেশ নাটুকেপনার আশ্রয় নেয়। খবরের কাগজ থেকে জানা যায় ক) মানুষগুলোর মৃতদেহ অসম্মানের সাথে ফেলে রাখা ছিল নির্জন জায়গায়, খ) তাদের মাথায়/কানের কাছে খুব কাছ থেকে করা গুলির আলামত ছিল, গ) তাদের গলায় ঝোলানো ছিল প্লাস্টিকে মোড়ানো অবস্থায় কম্পিউটারে কম্পোজ করা একটি চিরকুট। প্রথম দু’টি চিরকুট ছিল বেনামী। সেগুলোয় শুধু লেখা ছিল : “আমার নাম ….(হারকিউলিসের শিকারের নাম)। আমি…..(অভিযোগকারী নারীর নাম) এর ধরসক/ধরষক (চিরকুটে এরকমই ভুল বানান লেখা ছিল)। ইহাই আমার পরিণতি।” রাকিবের লাশের গলায় ঝোলানো চিরকুটেই প্রথম হত্যাকারী হিসেবে হারকিউলিস তার নিজের নাম এবং হত্যার উদ্দেশ্য – “ধরষকরা সাবধান” – প্রকাশ করে। ভাবখানা, হারকিউলিসের গুলির ভয়ে, মৃতদেহের ওপর অসম্মানের ভয়ে বাংলাদেশে ধর্ষণ নির্মূল হয়ে যাবে।
রিপন যে গণ-বলাৎকারের সাথে জড়িত ছিল বলে খবরে প্রকাশ পুলিশ সেই অভিযোগ প্রথমে গ্রহণ করেনি। তথাকথিত বলাৎকারের শিকার গার্মেন্টস শ্রমিক কিশোরীটি দু’দিন পর ৭ জানুয়ারী তার নিজ বাড়িতে মারা গেলে পুলিশ সাংবাদিকদের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ফলে পুলিশ অভিযোগটি আমলে নেয়। পরিবারের দাবী যে তাদের কণ্যা তার বন্ধু ও সহকর্মীর ‘প্রলোভনে’ বেড়াতে গিয়ে ধর্ষকদের খপ্পরে পড়ে। খেয়াল করুন, মেয়েটির বেড়াতে যাবার নিজের কোনো ইচ্ছা ছিল না অথবা থাকলেও সেটা ধর্ষণের অভিযোগকে হালকা করে ফেলতে পারে সেই আশংকায় হয়তো অভিযোগের বয়ান থেকে নেই করে ফেলা হয়েছে। পরিবারের আরও দাবী যে মেয়েটি ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। কিন্তু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মেয়েটির মৃত্যুর কারণ নির্ধারণ করতে পারেনি। রিপনের অপরাধটি নিয়ে এরকম নানা ধোঁয়াশার মধ্যে হারকিউলিস তাকে খুন করে ঢাকা জেলার সাভার থানার অধীনে, ১৭ জানুয়ারী।
সজল ও রাকিব-এর খুনের ঘটনাগুলো ঘটে ঝালকাঠি জেলার ভান্ডারিয়া থানার অধীনে। ১৪ জানুয়ারী তারা তাদের গ্রামের একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে বলাৎকার করে বলে থানায় অভিযোগ গ্রহণ করা হয় ১৭ জানুয়ারী। কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার অভিযোগকারী নারীর শরীর পরীক্ষা করে ধর্ষণের কোন আলামত খুঁজে পায়নি। সজল, রাকিবের পরিবারের দাবী তাদের ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে। আবারও অপরাধের সত্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা এবং ২২ জানুয়ারী সজলকে অপহরণ করা হয় সীতাকুন্ডে, এনা পরিবহন বাস থেকে। ২৬ জানুয়ারী তার লাশ পাওয়া যায়। ২৪ জানুয়ারী রাকিব অপহৃত হন নবীনগরের এক চা দোকান থেকে। ১ ফেব্রুয়ারী তার লাশ পাওয়া যায়। সজল ও রাকিবকে কারা অপহরণ করেছে এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনুসন্ধানী একটি প্রতিবেদনে জানা যায় অপহরণে ব্যবহৃত গাড়ী ও টেকনোলজির সাথে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর ঢাকাস্থ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে (তথ্যসূত্র -২)।
হারকিউলিসের শিকার বাছাইয়ের মানদন্ড, হত্যার তরিকা এবং হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে খবরের কাগজে তাৎক্ষনিকভাবে বেশ তোলপাড় হয়। প্রকাশিত প্রতিক্রিয়াগুলোর কেন্দ্রে ছিল মানুষ হত্যা করার (এবং বাঁচিয়ে রাখার) যে একচ্ছত্র ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা ও সামর্থ্য রাষ্ট্রতে অর্পণ করা আছে সেটা চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে কি হচ্ছে না সে নিয়ে উৎকন্ঠা। যেমন, রাষ্ট্রের আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বাহিনীর ওপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস আছে এমন মানুষ, যেমন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “তারা (পড়ুন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাবছেন হারকিউলিস একজন ব্যক্তি নন, বরং একদল মানুষ) সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে পারতো (পড়ুন: হারকিউলিস আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কেউ নয় তাই তাদের সন্দেহভাজন ধর্ষককে খুন করা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কেউ খুনটা করলে বিষয়টা তার কাছে গ্রহণযোগ্য হতো)”। এক সময়ের তত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টা বলেন, “এগুলো খুবই অশুভ ইঙ্গিত (পড়ুন: বিনা বিচারে সন্দেহভাজনকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়া অন্য কেউ হত্যা করলে রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাধর কারোর কাছে অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের কাছে পরাজয় মানতে হবে)”। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি বলেন, “আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কর্তৃত্ব কারো নেই (পড়ুন: হারকিউলিস আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিজেই পালন করে ফেলেছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়)”। রাষ্ট্রের আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা বাহিনীর ওপর আনুগত্য আছে এমন সাধারণ পাঠক হিসেবে কেউ কেউ এগুলোর পারদর্শিতা নিয়ে তাদের হতাশা প্রকাশ করেন আশাব্যঞ্জক মন্তব্য দিয়ে। যেমন, “নিশ্চয়ই আইন শৃংখলা পরিস্থিতির একদিন উন্নতি হবে আর হারকিউলিসের বদলে পুলিশই বাংলাদেশের মাটিতে বসবাসরত সকল প্রাণীর নিরাপত্তা বিধান করবে” (তথ্যসূত্র -৩)।
প্রতিক্রিয়াগুলোকে আরও দু’টি পরষ্পর সম্পর্কিত প্রবণতায় ভাগ করা যায়। দ্বিতীয় ধারার মতামতগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে যে মানুষজন হারকিউলিসের হত্যাকান্ডগুলোকে ন্যায্য বলে মনে করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই মতের মানুষেরা সহিংসতার ওপর রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রের বাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য ও অধিকারকে ছিনিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এরা মূলতঃ হারকিউলিসের কাজে তৃপ্তি প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর কর্মদক্ষতার ও সততার ওপর তাদের আস্থা হারানোর অনুভূতি প্রকাশ করছেন হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য দিয়ে। ইংরেজী দৈনিক ডেইলীস্টারের অনলাইনে প্রকাশিত এরকম কিছু পাঠক মতামত বাংলা করলে দাঁড়ায় “কেন পুলিশের কার্যকলাপে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেই?”; “বাংলাদেশের পুলিশ হল উচ্ছিষ্ট পোড়া আলুর চিপ্স যারা কোন কাজের না এবং তাদের আস্তাকুঁড়েতে ফেলে দেয়া হয়েছে”; “আমরা ২০১৯-এ বসবাস করছি কিন্তু উন্নতির বদলে পুলিশ নিকৃষ্টতমের দিকে যাচ্ছে! বাংলাদেশের কেউ ন্যায়বিচার পাচ্ছেনা! আপনারা বুঝতে পারছেন না কারণ আপনারা পাবলিক পরিসরে দিনের আলোয় ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন না। বাংলাদেশের পুলিশ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধীরগতিসম্পন্ন কারণ তারা বেশীরভাগই অক্ষরজ্ঞাণ রাখে না এবং সে কারণেই অপরাধী আর ধর্ষণকারীরা বিশ্বজুড়ে যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে এবং দুঃখজনক যে বাংলাদেশের পুলিশ জেলে নারী-কয়েদীদের ধর্ষণ করে এবং জুনিয়র নারী-ইন্সপেক্টরদের ধর্ষণ করে এবং আপনারা সেটা জানেন না কারণ আপনারা ধর্ষণের কবলে পড়েছে বা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পায়নি এমন কারো সাথে কখনও কথা বলেননি। বিচারক যদি অন্ধ হয় তার মানে এই নয় যে মহান পরহিতব্রতী হারকিউলিস গদি আঁটা চেয়ারে বসা একটা আলুর মত আচরণ করবে বা বাকি সব মানুষের মত শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকবে” (তথ্যসূত্র -৪)।
তৃতীয় ধারার মন্তব্যকারীরা হারকিউলিস হত্যাকান্ডের সাথে বাংলাদেশের কোন সাধারণ নাগরিক জড়িত নেই বলেই মনে করেছেন। বরং তারা মনে করেছেন যে এ’টা রাষ্টের সশস্ত্র বাহিনীর কোন একটি অংশেরই কাজ। যেমন, পাঠক প্রতিক্রিয়া অংশে কেউ কেউ মন্তব্য করেন, “অনেক হাসি…হারকিউলিস আসলে আমাদের পুলিশ ছাড়া আর কেউই নয়”। আইন সালিশ কেন্দ্র নামে একটি এনজিওর নির্বাহী পরিচালক তাঁর মন্তব্যে হারকিউলিসের হত্যাকান্ডগুলোকে “বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড” হিসেবে অভিহিত করেন যে শব্দগুচ্ছটি রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতি ভঙ্গ করে করা হত্যাকান্ডগুলোকে বর্ণনা করতেই কেবল ব্যবহার করা হয় (তথ্যসূত্র-৪)।
হারকিউলিসের কীর্তিকলাপে আগ্রহী হয়ে আমি গুগলে “বন্দুক যুদ্ধ + ধর্ষক হত্যা + বাংলাদেশ” (gun fight + killing rapists + Bangladesh) দিয়ে একটা খোঁজ দিলে দেখতে পাই বিধি-বহির্ভূত ভাবে সন্দেহ ভাজন ধর্ষক হত্যা শুধু ২০১৯ সালের ঘটনা নয়। হারকিউলিস আবির্ভাবের আগে ও পরে এরকম বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের খবর প্রকাশ পেয়েছে। আর সেই বেআইনী হত্যাকান্ডগুলো ঘটিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো এবং সেগুলো তারা প্রচার প্রচারণা করেছে নিজ উদ্যোগে। নীচে আমার ছোট্ট পরিসরে করা সেই খোঁজটির একটা সারাংশ দিলাম (তথ্যসূত্র-৫)।
খবর প্রকাশের তারিখ | হত্যাকান্ডের স্থান | নিহত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরণ | হত্যাকান্ডে জড়িত বাহিনী ও খবর প্রেরক |
১৭/১০/২০১৭ | কক্সবাজার | ৩ বছরের শিশু ধর্ষণ | RAB-৭;কম্পানী কমান্ডার রুহুল আমীন |
২৩/২/২০১৮ | কক্সবাজার | ১০ বছরের শিশু ধর্ষণ | RAB -৭;কম্পানী কমান্ডার রুহুল আমীন |
২/৪/২০১৮ | কক্সবাজার | ৫ বছরের শিশু ধর্ষণ | RAB -৭;কম্পানী কমান্ডার রুহুল আমীন |
২৪/৪/২০১৮ | চট্টগ্রাম | ১০ বছরের শিশু ধর্ষণ | RAB -৭;সহকারী পরিচালক লেফটেন্যান্ট আশেকুর রহমান এবং মিমতানুর রহমান। |
১৭/১- ২/২, ২০১৯ | হারকিউলিস-হত্যাকান্ড | ||
২৯/৪/২০১৯ | চট্টগ্রাম | নিজের কোচিং সেন্টারে শিক্ষারত নবম শ্রেণীর এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ | RAB-৭; মাশকুর রহমান |
৭/৫/২০১৯ | রংপুর | সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, মাদকদ্রব্য চোরাচালান, নারী অপহরণ ও ধর্ষণের মত ১৪টি মামলা। | পুলিশ বাহিনী; অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট (সার্কেল-এ) সাইফুর রহমান সাইফ |
১১/৫/২০১৯ | মেহেরপুর | একজন স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ ও একজন নারীকে এসিড নিক্ষেপ | পুলিশ বাহিনী; গাংনি থানার সাব-ইন্সপেক্টর সাজেদুল ইসলাম |
খেয়াল করুন যে ওপরে দেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় র্যাব-৭ বাহিনীটি ধর্ষণের অভিযোগে মানুষ/বাংলাদেশের নাগরিক খুনের ঘটনায় এগিয়ে আছে। কিন্তু এ লেখায় এই বাহিনীর এই ইউনিটকে বিশেষভাবে হারকিউলিস হিসেবে সন্দেহ প্রকাশ করা, দোষী সাব্যস্ত করা বা বাহাবা দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। যদিও এই বাহিনীর এই ইউনিটের বিরুদ্ধেই ২০১৮ সালের ২৮ মে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একরামুল হক নামে সরকারের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সাথে জড়িত অভিযোগে সাজানো বন্দুক যুদ্ধে খুন করার অভিযোগ রয়েছে (তথ্যসূত্র-৬)। আমি বরং ওপরের টেবিলে যে বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা হল হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর পাঠানো বার্তায় নিহত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরণে। সেখানে অভিযুক্ত ব্যাক্তি যে অমানুষ এবং সে যে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের শত্রু তাই বিন্দুমাত্র দয়া দাবী করতে পারে না এবং তাকে মেরে ফেলা যায় সেরকম একটি সামরিক ভাবনার আলামত রয়েছে। অর্থাৎ, বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে দেশ রক্ষায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে “অপর”কে নিধনের যে আদর্শে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীকে লালন পালন করা হয় সেটা বিস্তৃত হয়েছে “নিজ”-দেশের “নিজ”-নাগরিকের ক্ষেত্রেও। এ’ধরণের সামরিকায়নের প্রতি জনসমর্থনের আলামত হারকিউলিসের আবির্ভাবের পর পাওয়া যায়। একে আনুষ্ঠানিকভাবে আইন করার আলামতও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিদ্যমান।
যেমন, ২০১৬ এবং ২০১৮ বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই নারী ও শিশু নির্যাতনকারীকে যেন সাজানো বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয় এমন প্রস্তাব উঠেছে পার্লামেন্টে। দুইবারই প্রস্তাবটি তুলেছে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশিদ। তার দলটি জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের একই সাথে মিত্র ও বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্বপালন করছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত সংসদ সদস্যটির বক্তব্য লক্ষ্যনীয় কারণ এ’র মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ স্বপক্ষে তার নিজের যুক্তি যেমন প্রকাশিত হয় তেমনি প্রতিফলিত হয় জনসাধারণের মাঝে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিয়ে জনপ্রিয়তাও। যেমন, ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কাজী ফিরোজ রশিদ বলে, “সমাজের যদি সভ্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে আইনে এরকম পশুদের জন্য কোনো জায়গা থাকা উচিত নয়” (তথ্যসূত্র-৭)। একই প্রতিবেদন থেকে পাই যে এই সংসদ সদস্য সরকারের তথাকথিত ‘ইসলামপন্থী জঙ্গী’ বিরোধী অভিযানের ধরণটির প্রশংসা করে এবং নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের প্রতি সরকারের একই রকম ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান কামনা করে। ২০১৮ সালে এপ্রিলে সংসদে আবারো এই সংসদ সদস্য ধর্ষণকারীদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দেবার প্রস্তাব করে। তার ভাষায়, “দেশের প্রচলিত আইন দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না”, “দেশের মানুষ দ্রুত বিচার চায়”। তথাকথিত ‘ইসলামপন্থী জঙ্গী’দের বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকলাপের সে আবারো প্রশংসা করে এবং ধর্ষণকারীদের বিনা বিচারে হত্যা করার জন্য র্যাব বাহিনীকে পুরষ্কার দেবার দাবী করে (তথ্য সূত্র -৮)।
নৃবিজ্ঞানী হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণায় আমি দেখেছি যে শিশু ধর্ষণের খবর নিয়ে আলাপ করলে সাধারণ মানুষও অভিযুক্ত ধর্ষণকারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে চায় না। এরকম ভাবনার পেছনে রয়েছে ১, সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গীয় বৈষম্যভিত্তিক কাঠামোকে দেখতে না পাওয়া, যে সামাজিক কাঠামো তথাকথিত স্বাভাবিক যৌন আচার আচরণকেও প্রভাবিত করে; ২, লিঙ্গীয় বৈষম্যকে শুধু লিঙ্গীয় সহিংসতা (যেমন, বউ পেটানো, এসিড ছুড়ে মেয়েদের ‘সৌন্দর্য’ নষ্ট করা, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি) দিয়ে চিনতে পারা; এবং ৩, ধর্ষণকে স্রেফ একক এক ব্যাক্তির বিকৃত যৌন আচরণ হিসেবে দেখা। এরকম ভাবনায় ধরে নেয়া হয় যে শিশু যেহেতু যৌন আকর্ষণ তৈরী করার মত বস্তু নয় তাই তাকে ধর্ষণ করার মত আচরণ স্রেফ নরাধম বা পশুরাই করতে পারে, বা সঠিক হুঁশ জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ করতে পারে না। এই একই ভাবনার ফলাফল হল তথাকথিত তরুন নারীকে যৌন আকর্ষনীয় প্রাণী হিসেবে দেখা এবং পুরুষকে নারীর চেয়ে অধিক যৌন আকাংখা ও ক্ষমতা সম্পন্ন প্রাণী হিসেবে দেখা। ধর্ষককে অপরাধী প্রমাণের আইনী রাস্তাগুলোতেও এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। ফলে ধর্ষণের মামলায় ফরিয়াদী নারীকে খাঁটি নিষ্পাপ হিসেবে নিজেকে আদালতে প্রমাণ দিতে হয়, যে সে হয় শিশু, নয় পুরুষটিকে যৌন আকর্ষণের শিকার করেনি, পুরুষটির করা ‘যৌনসঙ্গমে’ নারীটির স্পষ্ট অসম্মতি ছিল। খেয়াল করুন, ধর্ষণকে লিঙ্গীয় বৈষম্যভিত্তিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে একজন ব্যাক্তির জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম হিসেবে দেখার প্রবণতা সমাজে রয়েছে, পাশাপাশি নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছাকেও সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গীয়, শ্রেণীগত, জাতিগত ইত্যাদি ক্ষমতা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হচ্ছে। যেমন, গার্মেন্টস নারী শ্রমিকটির অভিযোগের বয়ান থেকে মেয়েটির নিজ ইচ্ছায় সহকর্মীদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কথাটি গায়েব করে ফেলা।
সংক্ষেপে, আমি বলতে চাচ্ছি যে ওপরের টেবিলে বর্নিত র্যাব -৭ -এর ঘটানো বন্দুকযুদ্ধগুলোর বিষয়ে একটা গণসম্মতি আদায় করতেই এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীটি তাদের লক্ষ্যবস্তুকে নিষ্কাম শিশু ধর্ষণকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আর সমাজে যেহেতু এই ধারণাটি প্রবলভাবে চালু আছে যে ধর্ষণ স্রেফ একটা অপরাধ, লিঙ্গীয় বৈষম্য ভিত্তিক সহিংতা নয় এবং অপরাধীকে জেলেপুরে বা ফাঁসী দিয়ে সমাজকে ধর্ষণ মুক্ত করা যাবে (যে ভাবনার ধারাকে ‘কারসেরাল’ নারীবাদ হিসেবে অনেকে বিশ্লেষণ করেছেন) তাই এই উপস্থাপন কৌশলটি হয়তো খানিকটা ফলপ্রসূও হয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা দেখছি র্যাবের পরে পুলিশের মত একটি বেসামরিক বাহিনীও বন্দুকযুদ্ধের মত সামরিক কৌশলে ধর্ষক নিধন করছে। পরে আর বন্দুকযুদ্ধের বিষয়টি শুধু শিশু ধর্ষকে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেমন সরকার বন্দুকযুদ্ধ করছে তেমন চলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধ। হারকিউলিস, র্যাব, পুলিশ, পার্লামেন্ট, জনমত, সামাজিক আন্দোলন, সবই এই ভাবনায় প্রভাবিত হচ্ছে, মতামত প্রকাশ করছেন, কার্যকলাপ করছেন। এই প্রক্রিয়ায় চাপা পড়ে গেছে যে বন্দুকের গুলির লক্ষ্যবস্তুটি আসলে বস্তু নয় সে একজন মানুষ এবং সে বাংলাদেশের নাগরিক, সে বহিঃশত্রু নয় কিংবা নয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জকারী আভ্যন্তরীন কোন বাহিনীর সদস্য। ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলার সামরিক ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়া ও সে সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আরও চাপা পড়ে গেছে যে বাংলাদেশের কোথাও কোন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে না কিন্তু ক্রমেই জনজীবনে স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে সার্বক্ষনিক নজরদারী করার সামরিক যন্ত্রপাতির (যেমন সিসিটিভি ক্যামেরা, মেটাল ডিটেক্টর, স্ক্যানার, ড্রোন, ইত্যাদি) দৈনন্দিন ব্যবহার এবং র্যাব এর মত একটি প্যারামিলিটারী ফোর্সের সবজায়গায় সরব উপস্থিতি। আমার বিশ্লেষণে এই পুরো প্রক্রিয়াটাকেই আমি ধর্ষণ নির্মূলের এজেন্ডার সামরিকীকরণ বলছি। এটাকে শুধু বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্যকে ধর্ষক হত্যার কাজে নামিয়ে দেয়া হয়েছে এরকম বুঝলে চলবে না। এখানে সামরিকীকরণ বলতে বুঝতে হবে ‘বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও অনুমানের এমন একটি ঝাঁক যেটা জোর দেয় যে সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে উপযুক্ত ও ফলপ্রদ উপায় হল জোরজবরদস্তি করা ও সহিংসতার হুমকী দেয়া। এই ভাবনা প্রক্রিয়া সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক হাতিয়ার হিসেবে সামরিক শক্তি, সংগঠন, যন্ত্রপাতি, কার্যক্রম এবং কলাকৌশলের ওপর গুরুত্বারোপ করে’ (তথ্যসূত্র -৯)। সামরিকীকরণ বলতে সামরিক বাহিনীর ঐতিহ্যগত ভূমিকার বাইরে সামরিক মতাদর্শের প্রয়োগ করাকেও বোঝায় (তথ্যসূত্র -৯)। এই বোঝাবুঝির আলোকে আমার মনে হয় ধর্ষণকারীকে গুলি করে হত্যা করাকে স্রেফ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বেআইনী কাজ হিসেবে বিশ্লেষণ করার সীমাবদ্ধতা থেকে বাংলাদেশী নারীবাদীদের বের হবার সময় হয়েছে। ধর্ষককে গুলি করে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী বরং এটাই দেখাচ্ছে যে তারা যাচ্ছোতাই করার ক্ষমতা রাখে। এর ফলে আর যাই হোক ধর্ষণ সমস্যার সমাধান একেবারেই হচ্ছে না।
তথ্যসূত্র:
১. খবরগুলোর জন্য নীচের লিংকগুলো দেখুন।
Man accused of gang-raping teenager found dead, Nadim Hossain, Savar correspondent of Dhaka Tribune, 18/1/2019
Another rape suspect found dead with a note, SM Rejaul Karim, Jhalakathi correspondent of Dhaka Tribune, 26/1/2019.
‘Rapists beware’: Three men killed by apparent vigilante in Bangladesh, Josh K. Elliott of National Online Journalist, International Global News, 4/2/2019.
‘Hercules’ vigilante kills suspected rapists in Bangladesh: Rights groups fear extrajudicial killings after at least three rape suspects found murdered in the past two weeks. Faisal Mahmud, Aljajeera, 5/2/2019
২. প্রথমআলোর ইংরেজী অনলাইন সংস্করণে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন লিংকে।
৩. উক্তিগুলো পাবেন: Home minister criticises killings of rape suspects, vows to crack ‘Hercules’ mystery, Senior correspondent, bdnews24.com, 8/2/2019
৪.পাঠক মন্তব্যগুলো পড়তে ক্লিক করুন নীচের লিংকে।
Who is this Hercules? Third rape suspect found dead with note hanging around neck, Staff correspondent, The Daily Star, 2/2/2019.
৫. সারাংশটি তৈরী করেছি নীচের খবরগুলোর ভিত্তিতে
Alleged rapist killed in Cox’s Bazar ‘gunfight’, Abdul Aziz, Coxs Bazar correspondent of Dhaka Tribune, 17/10/2017.
Suspected rapist killed in ‘gunfight’, Staff correspondent, 23/2/2018.
Minor girl’s ‘rapist’ killed in gunfight, Daily Asian Age correspondent, 2/4/2018.
‘Child rapist’ killed in Ctg ‘gunfight’, 24/4/2018
Alleged rapist killed in Ctg gunfight, Chattogram Correspondent Daily-Bangladesh, 24/4/2018.
Rape accused killed in Chittagong ‘gunfight’, Anwar Hussain, Chittagong correspondent of Dhaka Tribune, 29/4/2019.
Accused rapist killed in ‘gunfight’ at Chattogram, 29/4/2019. News Bangladesh.
Top terrorist, rapist killed in gunfight in Gangachara, 7/5/2019.
Rape suspect killed in alleged shootout with police in Meherpur, Meherpur Correspondent, bdnews24.com.11/5/2019.
‘Rapist’ killed in Meherpur ‘gunfight’, Staff Correspondent, The Daily Sun. 12/05/ 2019.
৬. এ নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট পড়তে ক্লিক করুন নীচের লিংকে
In Recording, Chilling Proof That Hasina’s War on Drugs Involves Extra-Judicial Killing, Tasneem Khalil, The Wire. 16/6/2018.
৭. খবরটি রয়েছে নীচের লিংকে
Bangladesh MP proposes women and children abusers killed in ‘shootouts’, Parliament Correspondent, bdnews24.com, 28/9/2016.
৮. খবরটি রয়েছে নীচের লিংকগুলোতে
MP favours killing rapists in gunfight!, Staff correspondent, Prothom Alo, 11/4/ 2018.
Bangladesh opposition MP wants extra-legal killings of rapists, Parliament correspondent, bdnews24.com, 11/4/ 2018.
৯. Kraska, P. B. 2007. Militarization and policing: Its relevance in 21st Century police, Policing, 1, page 501-13
১০. Jones, R and Johnson, C. 2016. Border militarization and the re-articulation of sovereignty, Transactions of the institute of British Geographers, 41, page 187-200
[প্রবন্ধটি পূর্বে ঠোটকাটা-তে প্রকাশিত হয়েছিল।]