- লেখক: আর রাজী
সম্প্রতি কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প আর টেকনাফে কিছু সময় কাটিয়েছি। সে সময়ের কিছু খসড়া নোট:
১. ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা আর হিংস্রতা থেকে পালিয়ে আসার স্মৃতি শিশুদের ছাড়া রোহিঙ্গাদের সবার মধ্যেই মনে হয় তাজা। হত্যা দেখেছে, নির্যাতন দেখেছে-সয়েছে, আগুনে সব পুড়ে যেতে দেখেছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অধিকাংশই।
২. বাংলাদেশে আসার পরও খারাপ লোকদের পাল্লায় পড়েছে। কিন্তু মোটের ওপরে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতাটা বোঝা যায়।
৩. এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে এক বড় অংশ, অনেকেই বলেছেন, উদ্বাস্তুদের প্রায় ৪০ ভাগ হবে, তারা বেশ সচ্ছল ছিলেন মায়ানমারে। ভাল ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি ছিল। এরা এখানে খুবই কষ্টে আছেন।
৪. প্রায় বিশ-পঁচিশ-ভাগ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না, তারা এখানে খারাপ নাই। দেশে ফেরার ব্যাপারে এদের আগ্রহ/অনাগ্রহ কিছু বুঝে ওঠা মুশকিল।
৫. বাকি মাঝারি, নিম্ন-মাঝারি আর্থিক অবস্থার যারা, তারা এখন যেমন আছেন তার চেয়ে শতগুণ ভাল থাকতেন, পড়তেন। পর্যাপ্ত জমিজমা, পুকুর, মুড়া, মাছের ঘের, গরু-মহিষ, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাদের অনেকেরই। কিন্তু এদের কারোরই জান-মাল-সম্পত্তির কোনো নিরাপত্তা ছিল না।
৬. রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে ঘরগুলোতে তারা থাকে সে ঘরে ঢোকার দরজা মতো একটা পথ আছে, কোনো জানালা নাই। মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। এই গ্রীষ্মকালে দিনের বেলাতে ঘরগুলোতে গুমট তপ্ত গরম আর অন্ধকার। টানা ২০ মিনিট সেসব খুপড়ি ঘরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।
৭. যেদিন রোদ থাকে সেদিন এই বৃক্ষ-শূন্য পাহাড়গুলোতে সূর্যের তাপ সহ্য করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকার এই মানুষগুলো নতুন অবস্থার সাথে যুঝছে।
৮. সন্ধ্যা নেমে গেলে রোহিঙ্গাদের জীবন সেই সব জানালাহীন খুপড়ি ঘরগুলোতে গুমোট অন্ধকারের সাথে মিশে যায়। সকালের সূর্য উঠলে পর আর একটা দিন বেঁচে থাকার আশা নিয়ে যার যার নিত্য কাজ শুরু করে তারা।
৯. নারীদের ওই ঘর ছাড়া আর কোথাও চলাচল বা যাওয়ার জায়গা নাই। আমাকে কিছু তরুণী বলেছেন, তাদের স্নান টয়লেট আর রান্না করার ভয়ানক কষ্টের কথা। দৃশ্যত সব আয়োজনই ক্যাম্পে আছে, কিন্তু মোটামুটি ভদ্রঘরের, পর্দামানা নারীদের জন্য এসব আয়োজন তাদের বিব্রতই করে কেবল।
১০. নারী আর কিশোর-কিশোরীদের সারাদিন কিচ্ছু করার নাই। বসে থাকা আর আড্ডা দেওয়ার একঘেয়ে জীবন। খেলাধুলা/বিনোদন নাই। তাদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নাই। অথচ পাইলট, ডাক্তার, মিলিটারি হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের অনেকের। এখন অজানা আগামী আছে কেবল।
১১. তরুণ-তরুণীরা বেশ উদ্বিগ্ন। তারা বোঝে এভাবে ভবিষ্যৎ চলতে পারে না। অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। তারা ভাবছে সুযোগ পেলে কোনো একটা উপায়ে চলে যাবে সে সব দেশে। ওই সব প্রবাসী আত্মীয়দের আর্থিক সহায়তা অব্যাহত আছে।
১২. অনেকেই রিলিফের নামে যা পায় তার কিছু বাজারে বিক্রি করে দেয়। সেই টাকা দিয়ে কেনে শার্ট প্যান্ট, সালোয়ার কামিজ এমন নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। ঢাকা-চট্টগ্রামের ফুটপাতে বাচ্চাদের যে প্যান্ট/জামা দুশ টাকা দামও হবে না, ক্যাম্পে তা বিক্রি হয়েছে/হচ্ছে আটশ-হাজার টাকায়।
১৩. বয়স্ক আর তরুণদের অনেকেরই মোবাইল ফোন আছে। ফোন তারা আগেও ব্যবহার করতো। এখন খুব সাবধানে ব্যবহার করে। রবি নাম্বার বেশিভাগেরই। ফেসবুক টুইটারের গুরুত্ব তারা জানে। কিন্তু মোবাইল চার্জ করার বিদ্যুৎ ক্যাম্পে দুর্লভ।
১৪. রোহিঙ্গা শিশু কিশোর তরুণদের ইংরাজি ভাষার প্রতি আগ্রহ খুব বেশি। তারা কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শেখার জন্য বেশ চেষ্টা করে। বাঙলা বলে না, পড়তে চায় না, বাঙলা কথা বোঝেও না তেমন।
১৫. যাদের সাথেই কথা বলেছি, নিজ দেশে ফিরতে চায় প্রায় সবাই। ক্যাম্পের জীবন যে মানুষের জীবন না, এ কথা বলার সময় অধিকাংশের গলা ধরে আসে, চোখ ছলছল করে। ফিরতে তো চায় কিন্তু মায়ানমারে যে জীবনের নিরাপত্তাটুকুও নাই!
১৬. পরিবার প্রতি সন্তান সংখ্যা বেশ বেশি। আমার বাবা-মা’রা যেমন আট/দশ ভাই-বোন ছিলেন, তেমন। ওদের কারও কারও সাথে কথা বলে মনে হলো, “কওমের সংখ্যা” বৃদ্ধি করা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভাবনার অংশ।
১৭. আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগ নাই। পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক, গ্রামের সম্পর্ক ওরা মিস করে তীব্রভাবে।
১৮. তরুণ-তরুণীদের অনেকের শিক্ষাদীক্ষা বেশ ভাল। অনেকে যুদ্ধ ছাড়া নিজেদের ভূমি ফিরে পাওয়া যাবে না বলে মনে করতে শুরু করেছে। ছোটভাইবোনদের জন্য, নিজের ভূমিতে নিজের কবরের মাটির জন্য লড়াইকেই সমাধান ভাবে। তারা সহযোগিতা চায়, হাতিয়ার চায় জং করার।
১৯. নানান প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, অধিকার-বোধ, চর্চা ইত্যাদি নিয়ে কিছু জরিপ করেছে। তারই দু একটাতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সাথে তাদের জ্ঞান-দৃষ্টিভঙ্গি -চর্চা ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয়দের চেয়ে তাদের জ্ঞান-গম্মি ভাল বলে জরিপগুলোতে উঠে এসেছে।
২০. টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা পুরো পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্ত। তারা রোহিঙ্গাদের খুব একটা পছন্দ করতে পারছে বলে অন্তত কথাবার্তায় মনে হয় না।
২১. ক্যাম্পে যেসব বাংলাদেশি কাজ করছেন, তারা রোহিঙ্গাদের সম্মান করেন না বলে অনেক বার মনে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনেকের আচরণ দেখে, অনেক বাংলাদেশির কথা শুনে মনে হয়েছে, এই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবির যেন বাংলাদেশিদের কোনো উপনিবেশ, তারা এই নতুন কলোনির মালিক। রোহিঙ্গাদের সাথে বা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনভাবে আমাদের লোকজন কথাবার্তা বলে, মনে হয়, দু শত বছর আগের কোনো ব্রিটিশ মনিব যেন কথা বলছে কোনো নেটিভ ইন্ডিয়ানের সঙ্গে বা নেটিভ ইন্ডিয়ান প্রসঙ্গে।
২২. টেকনাফের স্থানীয়রা পুরো ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধায় আছে। ঠিক কী করা উচিত তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের এই বিপুল আগমন স্থানীয়দের জীবনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে। অনেকে হঠাৎ বিপুল পয়সা করেছে, জায়গা-জমির দাম বেড়ে গেছে অনেক, যার কোনো আয় করার উপায় ছিল না তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করে ভাল আয় করছে, যাদের শিক্ষা আছে ভাল কিন্তু ইগোর কারণে শুরুতে ক্যাম্পের কাজে যোগ দেয়নি, তারা খুবই হতাশ ও বিরক্ত।
২৩. টেকনাফ-কক্সবাজারের বাইরে থেকেও অসংখ্য মানুষ এসেছে এনজিও’র কর্মী হয়ে। স্থানীয়রা এনজিওতে কাজ পেয়েছে কিন্তু বাইরের ইংরেজি বলতে পারা বিপুল লোকও কাজ করছে। এটা স্থানীয়রা ভালভাবে নিতে পারছে না বলে মনে হয়েছে। তারা মনে করছে, এসব চাকুরী তাদের পাওয়া উচিত। এমন কি রোহিঙ্গাদের জন্য যে ব্যয় হচ্ছে তাতে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কিছু ঈর্ষাও সম্ভবত তৈরি হয়েছে। তারা চাইছে, রোহিঙ্গাদের জন্য যা ব্যয় হচ্ছে তার একটা হিস্যা যেন তারাও পায়। একই দাবি চাকুরীর ক্ষেত্রেও তারা করে চলেছে। সরকার কিছু দাবি মেনে নিয়ে এনজিওগুলোকে সেভাবে নির্দেশনাও দিয়েছে। তারপরও নিজেদের প্রাপ্তি ও প্রাপ্যের ফারাক নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ্য করেছি।
২৪. টেকনাফ-কক্সের বহির থেকে আসা দেশি ছেলে-মেয়েদের সংস্কৃতিও স্থানীয় সংস্কৃতিকে ধাক্কা দিচ্ছে। এটাও স্থানীয়দের বিরক্ত করছে বলে আমার মনে হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশি এনজিও কর্মীদের ওপরে স্থানীয়রা খুবই বিরক্ত।
২৫. ক্যাম্পে সরকার অভাবিত রকমের তৎপর। আমার উপলব্ধি, ক্যাম্পের সব কিছু আমাদের সরকারি কর্তাদের নখদর্পণে ও সার্বিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা সম্মিলিতভাবে ওখানে একটা আদর্শ উপনিবেশ তৈরি করে চলেছে যেন। আর রোহিঙ্গা জনগণের মাঝে কায়েম করেছে আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্র। বাংলাদেশের যোগ্যতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তার অভাবিত প্রদর্শনী যেন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প।