- লেখক: হেলাল মহিউদ্দীন
এই লেখাটি কেন লেখা প্রয়োজন? প্রয়োজন এ জন্য যে ভাবনা ঠিক বা শুদ্ধ যাই হোক, আলোচিত ও বিশ্লেষিত হওয়া দরকার। এই লেখাটির ভাবনা-বিনিময়ে নামার কাজেও ইতোমধ্যে দেরি হয়ে গেছে। আরো পাঁচ-সাত বছর আগেই এই কথাগুলো আলোচনায় আসা দরকার ছিল মনে করি। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছিল কেউ না কেউ তো বলবেনই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সংশ্লিষ্টগণ হয়ত কোথাও না কোথাও বলেই রেখেছেন। হয়ত আমারই নজর এড়িয়ে গেছে। সেই ধারণা হতেই এই ভাবনার বা কাছাকাছি ধরণের ভাবনার সন্ধানে নেমেছি। এখনো তেমন কিছু পাইনি। পাঠকগণ সন্ধান পেলে জানাবেন।
এই লেখাটিকে তত্ত্বকথা হতে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকব। সুগভীর অথবা অগভীর রাজনৈতিক দর্শনও রাখব না। পরের কিস্তির লেখাগুলোতে তত্ত্বের সহজ ব্যাখ্যা আনতে চেষ্টা করব। উদ্দেশ্য একটিই। সকলেই যেন কথাগুলো সহজে বুঝতে পারেন। তবে “মৌল-কাঠামো” বা “অর্থনীতি” এবং “উপরিকাঠামো” বা ‘অ-অর্থনীতি’কে (অর্থনীতির বাইরে সকল অবস্তুগত সামাজিক-মানবিক চাহিদা) ধরেই আলোচনাটির সহজ সরল বিস্তার-বিস্তৃতি প্রয়োজন হবে।
প্রথমেই নিচের চিত্রটি বুঝতে চেষ্টা করা যাক। মডেলটির সঙ্গে অনেকেরই পরিচিতি আছে নিশ্চিত। মোটা দাগে সারা দুনিয়াকেই বোঝা যাবে দুই ধরণের সমাজকাঠামোর মাধ্যমে। একটি রম্বস আকৃতির সমাজকাঠামো। অন্যটি পিরামিড আকৃতির সমাজকাঠামো।
সবগুলো ধনী দেশ, শিল্পোন্নত দেশ, উন্নত দেশ, এমন কি কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোরও আকৃতি ডান পাশের চিত্রটির মত। অর্থাৎ রম্বসের মত। কারণ, এসব দেশে “মধ্যবিত্ত” বেশি। বেশির ভাগ মানুষই কমবেশি মধ্যবিত্ত। সেখানে দরিদ্র কম। ধনীও কম।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশ, দরিদ্র দেশ, অনুন্নত দেশ যা-ই বলি না কেন এই সব দেশে দরিদ্ররাই বড় অংশ। ধনীদের সংখ্যা কম। মধ্যবিত্তের সংখ্যাও কম।
এবার দেখা যাক, মহাসমুদ্র আকারের ভয়ংকর গলদ দুইটি কোথায় কোথায়, এবং কীভাবে হয়?
এক নম্বর মহাগলদ: রাষ্ট্র–পরিকল্পনার মহাগলদ
দুই আকৃতির সমাজ-কাঠামো বিচারে রাষ্ট্র–পরিকল্পনার ধরণ তা হলে কী রকম হবে?
একেবারে প্রথম ও মৌলিক কর্তব্য—সংখ্যাধিক্যকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ–
রম্বস আকৃতির ধনী দেশগুলোর সব পরিকল্পনাই হবে “মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক”।
পিরামিড আকৃতির উন্নয়নশীল দেশগুলোর সকল রাষ্ট্রপরিকল্পনাই হতে হবে “দরিদ্রকেন্দ্রিক”।
দরিদ্র, অনুন্নত, উন্নয়নশীল যা-ই বলা হোক না কেন, দরিদ্রের সংখ্যাধিক্যের কারণে পিরামিড আকৃতির দেশে রাষ্ট্র–পরিকল্পনাকে অবশ্যই হতে হবে দরিদ্রকেন্দ্রিক ও দরিদ্রবান্ধব— এই মূলনীতির আলোকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র–পরিকল্পনাকে কি আদৌ দরিদ্রকেন্দ্রিক ও দরিদ্রবান্ধব বলা চলে?
মোটেই নয়। কাঁচা অর্থনীতি, হাতে হঠাত কাঁচা-টাকা, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, জিডিপি-জিএনপির উল্লম্ফন ইত্যাদির লোভে রাষ্ট্র–পরিকল্পনা ধণিক–শ্রেণিকেন্দ্রিক এবং দূর্বৃত্ত–শ্রেণিকেন্দ্রিক।
এখানে রাষ্ট্র–পরিকল্পনার ধরণ পিরামিডের ১৮০ ডিগ্রী উল্টো। পিরামিডের উল্টো দিক বা সংখ্যালঘু ধনীক শ্রেণিই শুধু অর্থনীতির হাল ধরতে জানে, টাকা-পয়সার পাহাড় গড়তে জানে— এ রকম বদ্ধমূল চিন্তাকে পরিকল্পনার কেন্দ্রে রেখে বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল-পদ্ধতি ঠিকঠাক করা হয়।
মধ্যবিত্তপ্রধান হবার কারণে আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন, জাপান, কোরিয়া যে রাষ্ট্রই বিবেচনায় নিন না কেন, তাদের রাষ্ট্র-পরিকল্পনা কিন্তু রম্বসের নিয়ম মেনেই মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক ও মধ্যবিত্তবান্ধব। ইউটিউবে এই সব দেশের নির্বাচনী প্রচারণাগুলো দেখুন। দেখবেন সকল প্রার্থীই বলছেন মধ্যবিত্তের পকেটের টাকা যেন খোয়া না যায়, অপচয় না হয়, চিকিৎসা-শিক্ষা-বাসস্থান সেবার মান যাতে অনুন্নত না হয়ে আরো উন্নত হয় তার জন্য এই করব সেই করব ইত্যাদি। “মধ্যবিত্ত” শব্দটি কতবার উচ্চারিত হয় গুনে রাখুন। পরের কিস্তির লেখায় আলোচনা করব কীভাবে সেটি সংখ্যালঘু ধনী ও দরিদ্রের জন্য ন্যায্য সুবিধা বয়ে আনে।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যে মৌল কাঠামো, তথা “অর্থনীতি”, তার বিকৃতির শুরু রাষ্ট্রপরিকল্পনার এই গলদ হতেই। সংবিধানে “জনবান্ধব রাষ্ট্রপরিকল্পনা”র উল্লেখ থাকলে দরিদ্র বেশি থাকলে “দরিদ্রকেন্দ্রিক” রাষ্ট্রপরিকল্পনা হবে। মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে গেলেই মধ্যবিত্তের দেশ হয়না। তবু মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়লে, দেশ রম্বস আকৃতির হয়ে গেলে “মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক” পরিকল্পনাও করা যাবে। সংবিধান কোনো ঐশিবাণী নয়, প্রয়োজনে “জনবান্ধব রাষ্ট্রপরিকল্পনাও” অন্তর্ভূক্ত করা যাবে।
গার্মেন্টস শিল্পের কথাই ধরুন। বিশ্ব-পরিসরের মানবিক রাষ্ট্রগুলোর পরিকল্পনা-পদ্ধতি আমলে নিলে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অবশ্যই হতে হবে গার্মেন্টস- শ্রমিককেন্দ্রিক। কৃষিই যেহেতু অর্থনীতির সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ও টেকসই খাত, রাষ্ট্র-পরিকল্পনাকে কৃষককেন্দ্রিকও হতে হবে। পর্যায়ক্রমে দরিদ্রদের ও গরিবানার অন্যান্য স্তরগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। অবশ্যই পরিপার্শ্ব-চিন্তা এবং প্রান্ত-চিন্তাও আসবেই। পর্যায়ক্রমে।
গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থা আজ আছে তো কাল নেই—একেবারেই অনির্ভরশীল একটি বেলুন খাত— তবু দেখুন রাষ্ট্রের রক্ত-মাংস-চর্বি-মগজ সবকিছু এখানে জড়ো করা হয়েছে। কিন্তু তা করা হয়েছে মালিক শ্রেণির রক্ষাকবচ হিসেবে, শ্রমিকের জীবন-জীবিকার ও বেঁচে থাকার নিরাপত্তা-বর্ম হিসেবে নয়। মূল কারণ, সংবিধানে উল্লেখ না থাকায় রাষ্ট্রপক্ষকে এ ব্যাপারে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। দায়বদ্ধতা (একাউণ্ট্যাবিলিটি) এবং স্বচ্ছতা (ট্রান্সপারেন্সি) নিয়ে প্রশ্ন করার পথও তাই রুদ্ধ।
বাংলাদেশের মত অবস্থাতেই ছিল, কিন্তু দরিদ্রবান্ধব রাষ্ট্রপরিকল্পনা দিয়ে মৌল কাঠামো তথা “অর্থনীতি”কে টেকসই করে তুলতে পেরেছে চীন, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বহু রাষ্ট্র। এসব দেশে তাই জিডিপির অস্বাভাবিক উল্লম্ফনও নাই, অস্বাভাবিক পতনও নাই।
পিরামিড আকৃতিকে বিবেচনায় না নিলে, সমাজকাঠামোকে এখনো বাস্তবের চোখে পাঠ না করলে, রাষ্ট্র–পরিকল্পনা দরিদ্রকেন্দ্রিক ও দরিদ্রবান্ধব না করার মত মহাগলদটি রয়েই যাবে। তার সুরাহা করা না গেলে বাংলাদেশে রাষ্ট্র–কাঠামোয় বা রাষ্ট্র–চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
দুই নম্বর মহাগলদ: রাষ্ট্রনৈতিকতার গলদ—কলকব্জার ফাঁদের গলদ
রাষ্ট্রচিন্তায় দুটি প্রপঞ্চের ব্যবহারকে গুলিয়ে ফেললে কী যে মহাবিপদ হয়, তার উৎকৃষ্ট এবং প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ। এই দুইটি প্রপঞ্চ হচ্ছে—
বাংলাদেশে কয়েক দশক যাবত বুঝে না বুঝে, কিংবা জেনে বা না জেনে বাংলাদেশের ডান-বাম চিন্তার মানুষেরা আইডিয়লজি বা তত্ত্বাদর্শ কচকচানিকে অবলম্বন করে ঝগড়াঝাটি এবং নিজেদের মধ্যে দল-উপদল ও বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছেন, যেগুলোর বেশির ভাগই অনর্থক ও অহেতুক। পৃথিবীর সকল অগণতান্ত্রিক সরকারই এরকম ‘কাইজা’সর্বস্ব রাজনীতি চায়, এবং ‘কাইজা’র আগুনে সম্ভাব্য সব উপায়ে ঘি কেরোসিন ঢালতে থাকে। যত বেশি বিভেদ, তত অনৈক্য, তত বেশি দমন-পীড়ন ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের সুযোগ তৈরি হয় তাদের জন্য।
বাংলাদেশে অন্তত গত দুই দশকের জাতীয়তাবাদ বিতর্ক, ডান-বাম বিতর্ক ইত্যাদির ভল্যুম ভল্যুম বাহাসের স্তুপ নিয়ে বসলে বোঝা যায়, যে বিষয়টির আলাপ সবচাইতে বেশি প্রয়োজন ছিল, “প্রিন্সিপলস” বা নীতিমালা, তার প্রায় কিছুই হয়নি। আইডিয়লজি— যা তত্ত্ব-নির্মাণে ও জ্ঞান-নির্মাণে প্রয়োজনীয় হলেও রাষ্ট্রচিন্তায় সামান্যই দরকার ছিল, তার অহেতুক চর্চ্চার সীমা-পরিসীমা ছিল না। এখনো নেই।
খানিকটা আলগা করে বুঝার চেষ্টা করা যাক বিষয় দুইটিকে—
১) “প্রিন্সিপলস” (নীতিমালা)
২) “আইডিয়লজি” (তত্ত্বাদর্শ)
আধুনিক রাষ্ট্রে কিছু শ্রেয় নৈতিকতার কথা আমরা রোজই উচ্চারণ করি। তাদের বেশির ভাগই কতকগুলো কন্সেপ্ট বা ধারণা। কতকগুলো বোধ। বোধগুলোতে থাকে প্রত্যাশা। যেমন, মৌলিক অধিকার, মৌলিক মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের অধিকার, ন্যায়বিচার, সুবিচার, সুশাসন, মানবিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন ইত্যাদি। এগুলো সবই সমাজের উপরিকাঠামো।
সময়ের পরিক্রমায় সভ্য রাষ্ট্রগুলোতে যুক্ত হতেই হবে ‘বহুত্ববাদ’(ডাইভার্সিটি), ‘অন্তস্থকরন’/ ‘অন্তর্গতকরণ’ (ইনক্লুশন), ‘সুরক্ষা-বর্ম’ (সেইফটি-নেট) ইত্যাদি ধারণা।
রাষ্ট্র-পরিচালনমণ্ডলের জন্য অত্যাবশ্যক ও অবশ্যমান্য প্রিন্সিপলস যেগুলো যুক্ত হয়েছে ১)আইনানুগ বৈধতা (লেজেটিম্যাসি), ২)স্বচ্ছতা (ট্রান্সপারেন্সি), ৩)দায়বদ্ধতা (একাউন্ট্যাবিলিটি), এবং ৪)সুশাসন (গুড গভার্ন্যান্স)।
এগুলো সবই “প্রিন্সিপলস”, একটিও “আইডিয়লজি” নয়।
আধুনিক, মানবিক, সাম্য ও সমতামূলক রাষ্ট্র চলেই শুধু “প্রিন্সিপলস” বা নিয়ম–নৈতিকতাপূর্ণ নীতিমালার ভিত্তিতে। আধুনিক শোষণহীন মানবিক গণরাষ্ট্র হতে হলে “প্রিন্সিপলস” বা নীতিমালা অত্যাবশ্যক, অর্থাৎ লাগবেই লাগবে। “আইডিয়লজি” মোটেই দরকারি নয়।
তাহলে কে ডান, কে বাম, কে মৌলবাদী, কে নারীবাদী, কে অ-নারীবাদী, কে কোন ধর্মের, মতের বা পথের বা বিশ্বাসের এই সব বিভাজনমূলক খুঁটিনাটি বে-দরকারি বিষয় নিয়ে আমরা এত দলে-উপদলে বিভাজিত হতে থাকি কেন? এই সকল ভাবনার ও ভাবের বৈচিত্র্যে ভরপুর মানুষের উপস্থিতি সকল রম্বস সমাজ-কাঠামোয়ও আছে। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তার বেলায় তাদের মধ্যে কোনো বিভাজন নাই কেন? সবাই এক কেন?
কারণ, যে কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের চোখকে হতে হবে মায়ের চোখের মত—সকলে সমান। ঘরের খাবারে যেমন সকলের সমান ভাগ ও অধিকার। ঘরে মায়ের সন্তানদের মধ্যে চিন্তার ও ভাবনার ভিন্নতা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু মা কোনো একজনের বিভাজনমুখী, সংঘাতমূখী ভাবনার প্রতি পক্ষপাত দেখাবেন না, বা বিভাজন উস্কে দিবেন না। পক্ষ নিয়ে উস্কানী দিলে তিনি মা নন, ডাইনি। আধুনিক মানবিক রাষ্ট্র সংক্ষেপে এই রকমই। এটি কল্পস্বর্গ নয়। পৃথিবীর সভ্য ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সবগুলো এই রকমই। এইজন্যই আমরা কল্যাণ রাষ্ট্রের উদাহরণ বারবার টানি।
আইডিয়লজি বিষয়টি কেমন? রাষ্ট্রচিন্তায় অপ্রয়োজনীয়, আসলে খারাপই জানব কেন?
তাহলে আইডিয়লজি কী কী রকম হতে পারে দেখি। সমাজতন্ত্র, ইসলামি শাসনতন্ত্র, হিন্দুত্ববাদ, নাজিবাদ, জায়নবাদ, আরববাদ, নারীবাদ ইত্যাদি।
জ্ঞান-নির্মাণের বেলায় এগুলোর প্রয়োজন আছে—দ্বিমত নেই। কিন্তু রাষ্ট্রচিন্তায় ও শাসন-ব্যবস্থায় এগুলোর প্রয়োগ কি আমরা এখনো দেখিনি? কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন এগুলোর একটিও মানুষে-মানুষে বিভেদ-বৈষম্য এবং একদল দ্বারা আরেকদলকে নিষ্ঠুর অবদমন ছাড়া অন্য কোনো কাজে লেগেছে? কে বলতে পারবেন যেসব রাষ্ট্রগুলো প্রকৃত মানবিক রাষ্ট্র—যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কানাডা—তাদের কোনো রাজনৈতিক আইডিয়লজি না থাকায় আদৌ কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? না কি আইডিওলজি নিয়ে কামড়াকামড়ি না করে প্রিন্সিপলস-নির্ভর থাকার কারণেই বরং রাষ্ট্রগুলো চূড়ান্ত মানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পেরেছে?
আরেকটি কাজ করুন। পৃথিবীর সবগুলো দেশকেই ভাগ করুন। স্পষ্ট দেখবেন প্রিন্সিপলস-নির্ভর সবগুলো রাষ্ট্রই মানবিক রাষ্ট্র। যেগুলোতেই আদর্শের কচকচানি সেগুলোতেই দাঙ্গা, বর্ণবাদ, সংখ্যালঘূ নিবর্তন, সাংস্কৃতিক অবদমন, যুদ্ধ লেগেই আছে। অনাদি-অনন্তকালের অশান্তি সেগুলোতে।
আবারো বলি আইডিয়লজি কী? আইডিয়লজি চিন্তার কাঠামো বা ধরণ যেগুলোর মাধ্যমে অর্থনীতি বা রাজনীতি-সম্পর্কিত তত্ত্ব বা নতুন নতুন ভাবনা দাঁড় করানো যেতে পারে। রাষ্ট্রচিন্তায় শুদ্ধি আনা যেতে পারে। প্রিন্সিপলসগুলোকে আরো ঘষে-মেজে নেয়া যেতে পারে ইত্যাদি।
কিন্তু আইডিয়লজি দিয়ে একবিংশ শতকের আধুনিক রাষ্ট্র মোটেই চলবে না। এজন্যই কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর কথাই উদাহরণ হিসেবে আবারো আনব। উদাহরণটি টানব এটা বলতে যে যতগুলো প্রিন্সিপলস-এর কথা উল্লেখিত হয়েছে এই লেখায়, সব রাষ্ট্রেই সবগুলো মানার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে।
তাহলে এই ধরণের রাষ্ট্রগুলোর আইডিয়লজি কী বা কোথায় দেখেন? অনেকেই বলেন—“হিউম্যানিজম’ বা মানবতাবাদ! কিন্তু না! মানবতাবাদের প্রয়োগও একটি প্রিন্সিপল, কোনো আইডিয়লজি নয়।
আইডিয়লজির মধ্যে চূড়ান্ত খারাপটির নাম ‘ন্যাশনালিজম’ বা জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ মানেই অন্যকে আমার শ্রেষ্ঠত্বের কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। সে জন্য শত্রু লাগবে। যুদ্ধ লাগবে। বিভাজন লাগবে। প্রতিপক্ষ লাগবেই। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য।
হিটলার মুসোলিনির জাতীয়তাবাদের মডেল কি দেখেন নি? স্ট্যালিনেরটি? সেসব কি টিকেছে? সাদাতের প্যান-অ্যারাবিজম টিকেছে? কামাল পাশার তার্ক-জাতীয়তাবাদ টিকেছে? এরদোয়ানের প্যান-ইসলামিজম টিকবে? বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নাই। বাংলাদেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র কিংবা ইসলামি জাতীয়তাবাদ কোনোদিনও আসবে? বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নাই। এরা কল্পস্বর্গ বা বোকার স্বর্গ যেখানেই বাস করুক বা না করুক, এদের অনর্থক জুজু ভেবে ভয়ে থরহরি কম্পমান বা হিস্টিরিক হবার সুযোগ কি আসলেই আছে? মোটেও নাই। ভয়গুলো অমূলক। বানোয়াট ভয়গুলো মানুষের মাঝে সঞ্চারিত করে দেওয়া হয় সজ্ঞানে। যাতে তারা কোনো যথার্থ কোনো কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র স্টিগমার বশবর্তী হয়ে চিরশত্রু হয়ে থাকতে পারে, এবং এক না হতে পারে।
আমরা যে বাঙালি না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নিয়ে যুগের পর যুগ যুদ্ধ-ঝগড়া করলাম, টনে টনে কাগজ নষ্ট করলাম, অশেষ খিস্তি-খেউর মারামারি করলাম— ঠিক কেন করলাম, আসলে কোথায় কি কাজে লাগবে সেসব? আমাদের স্পষ্ট নৃতাত্ত্বিক পরিচয় থাকার পরও জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের দরকারটি কেন বা কোথায়? কে কে ঠিকমত জানেন বা বুঝাতে পারবেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের—বুঝান দেখি! যদি বলেন—হে দরিদ্র, তুমি খেতে পাবে, সুবিচার পাবে, শান্তিতে ঘুমাতে পাবে স্পষ্ট বুঝবে—না কি দেরিদা ফুকো বুর্দো ডিকন্সট্রাকশন হ্যাবিটাস বুঝান তো ভাল বুঝবে? যার দরকার, সে নিজেই তার প্রয়োজনে তত্ত্বীয় আদর্শ বুঝে নিবে, শিখে নিবে।
ল্যুই আলথুসারের আইডিয়লজি ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন রাষ্ট্র নিপীড়ক হয়ে ওঠার দুইটি কলকব্জা আছে। এক আদর্শিক কলকব্জা (আইডিয়লজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাস), এবং দুই, দমন-পীড়নমূলক কলকব্জা (রিপ্রেসিভ স্টেইট অ্যাপারেটাস)। প্রথমটির একটি নমুনার কথা মাত্রই বলা হল— বাঙালি না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তর্ক নিয়ে বিভক্তি। আরো আছে শাহবাগ-অশাহবাগ এবং তারও ভিতরের খুঁটিনাটি নাড়ি-নক্ষত্র নিয়ে দল-উপদল, ক্ষুদ্র দল, নুড়ি দল, ভাব-ভাবনা-কর্মপদ্ধতির ভিন্নতায় তর্কবাগীস বিভাজন। মহান মুক্তিযুদ্ধের আবেগও ঐক্যের শক্তি না হয়ে বুশ ডক্ট্রিনের মত—‘আমার মতই চুড়ান্ত, এর বাইরে ভিন্নমত হলেই তুমি আদর্শচ্যুত’ আইডিয়লজিতে রূপ নেওয়া, এবং এই বিষয়ক চলমান ঘটমান সংঘাত আরেকটি উদাহরণ। দমন-পীড়নমূলক কলকব্জার কথা বলাই বাহুল্য। পক্ষপাতহীন ও নির্মোহ মানুষদের কারোরই নজর এড়ানোর কথা নয় যে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তিই যেন জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি করে গণঅবদমনে নিয়োজিত। কারণ একটিই—আইডিউলজি আর আইডিয়লজি কলকব্জার সক্রিয় ফাঁদ, এবং প্রিন্সিপলস এবং প্রিন্সিপলস-এর নিদারুণ অনুপস্থিতি।
আমাদের রাষ্ট্রটি এখনো পিরামিড শেইপেই আছে। দরিদ্রের সংখ্যাই এখনো সুবিশাল। এই রাষ্ট্রে দরিদ্রের জন্য দরিদ্রবান্ধব ও ঐক্যমূখী স্টেইট “প্রিন্সিপলস” দরকার, অনৈক্য-প্রসারক “আইডিয়লজি” অদরকারি। প্রিন্সিপলস নিয়ে এখনো কথা বলাই শুরু হয়নি। সেই শুরুতে পা রাখায় আর দেরি না করাই বিশেষ প্রয়োজন।
- হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান; এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়