- কামরুল হাসান মামুন
অনেকেই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন অন লাইন ক্লাস নিচ্ছে না প্রশ্ন করছেন। কেউ আবার অন লাইন ক্লাস না নেওয়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকেও দায়ী করছেন। অন লাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য প্রথমত কি জরুরি? ১. ল্যাপটপ/ট্যাব/ডেস্কটপ, ২. শক্তিশালী ইন্টারনেট কানেকশন ৩. সফ্টওয়্যার যেমন zoom! প্রথম দুটি থাকলেই তৃতীয়টি পাওয়া কোন ব্যাপার না। এখন কথা হলো বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্রের কি প্রথম দুটি আছে? দুটির একটি থাকলে কিন্তু হবে না। Zoom-এ ক্লাস করার জন্য শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে? আর থাকলেও আমাদের সব আমাদের সব ছাত্রছাত্রী কি এর ব্যয়ভার বহন করতে পারবে? তাছাড়া যদি ধরে নেই উপরের সব কিছুই আছে তারপরও কোন কোন শিক্ষকের এই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় কি সেই সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে পেরেছে? সব কিছু শুরু করার আগে প্রস্তুতিমূলক একটা হোমওয়ার্ক লাগে আমরা কি সেটাও করেছি?
কর্তৃপক্ষের জানা উচিত যে আমাদের অনেক ছাত্রই আসে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে। অনেকেই এত দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে যে তাদের বাবা-মায়ের এমন আর্থিক সঙ্গতি নেই যে তারা তাদের সন্তানদের পড়াশুনার খরচ জোগাতে পারে। উল্টো তারাই সন্তানের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য কামনা করে এবং এইজন্য সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ে অল্প বয়সেই কোন চাকুরী করে পরিবারের হাল ধরুক চেয়েছে। দেখা গিয়েছে এদের একটি ক্ষুদ্র অংশের পড়াশুনা করার বাসনা এত বেশি যে ভেবেছে পরিবার থেকে আর্থিক সাহায্য না নিয়ে কষ্ট করে হলেও পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। এমনকি প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েও পরিবারকে সহায়তা করে। এমনটা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। আমরা কি এমন ছাত্রের গল্প জানিনা যে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোতে বা প্রতিবেশীর ঘরের বারান্দার আলোতে পড়াশুনা করেছে? আপনারা কি চন্দ্র নাথের গল্প শুনেননি? Covid-১৯ আসার পর তাকে নিয়ে দেশের দৈনিক ও সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচিত হয়েছে। কেন? শৈশব থেকেই দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালে তাঁর শিক্ষক বাবা প্রাইমারি স্কুল থেকে অবসরে যান। তখন তার মা কাজ শুরু করেন মাঠকর্মী হিসেবে একটা এনজিওতে। কোনো কোনো বেলা ভরপেট খাবারও কপালে জুটত না তার। প্রাইমারি স্কুল থেকেই চাষাবাদ থেকে শুরু করে তাকে করতে হয়েছে গৃহস্থালির সব ধরনের কাজ। সেই ছেলেটি আমেরিকায় পিএইচডি অর্জন করে আজ সে ড. চন্দ্র নাথ হয়েছে। এখন পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসাবে কাজ করছেন। অভাব ও কষ্টকে পারি দিয়ে তার মত এতদূর আসতে পারা মানুষের সংখ্যা কম হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা ও দেশে ভালো চাকুরী পাওয়াদের সংখ্যা নেহাতই কম না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আতিয়ার রহমান এমনি একজন মানুষ।
আমেরিকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টিউশন ফী এত বেশি যে আমেরিকার অনেক বাবা-মায়েদের পক্ষেই সম্ভব হয় না ওসব প্রতিষ্ঠানে পড়ানো। তারা পড়ে হয় স্কলারশিপ পেয়ে নতুবা ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে পড়ে যা পরবর্তীতে চাকুরী পেয়ে ধীরে ধীরে শোধ করতে হয়। অনেকে সেমিস্টার break-এ চাকুরীও করে। কিন্তু নিজের পড়ার খরচ চালিয়ে মা-বাবা ও পরিবারকে চালানো বা সাহায্য করার জন্য উপরি আয় করতে হয় না। বাংলাদেশের ছাত্রদের মত ছাত্রাবস্থায় নিজের পড়ার খরচের বাহিরে পরিবারের হাল ধরার উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। করোনা আসার পর সেইরকম পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাড়ি চলে যায়। ফলে প্রাইভেট পড়িয়ে আয় বন্ধ হয়ে যায়। এরা পরেছে চরম বিপাকে। আমি নিজে অনেককে সাহায্য করেছি। আমার বিভাগ আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে সাহায্য করছে। আমার কয়েকজন অত্যন্ত মানবিক সহকর্মী আছে তারাও অনেককে সাহায্য করেছে এবং করছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরো বেশি হারে সাহায্য করছে। তারপরও যথেষ্ট না। এই ছাত্রদের অনেকের ল্যাপটপ বা ট্যাব নাই। আর এখন যখন খাবার কেনার টাকাই নাই তাদের কিভাবে বলা যায় ইন্টারনেট প্যাকেজ কিন? আর পড়াশুনা ও ক্লাস করার একটা পরিবেশ যেমন লাগে তেমনি লাগে একটি ভালো মানসিক পরিবেশও। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কতজন এখন এই পরিবেশে আছে? পড়াশুনার জন্য মানসিক পরিবেশতো এমন না যে সুইচ টিপ্ দিলাম অন হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার মত একটি অফিস লাগবে যেখানে এক্সপার্ট লোকজন থাকবে। শিক্ষকদেরও অনেকের আর্থিক সহযোগিতা লাগতে পারে। ক্লাস তৈরির জন্য লাইব্রেরির access লাগে। অর্থাৎ একজন ছাত্র যেকোন জায়গা থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির access পেতে পারে এমন ব্যবস্থা থাকতে হবে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের লাইব্রেরি ডিজিটালাইজড। অর্থাৎ একজন ছাত্র যেকোন জায়গা থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির access পেতে পারে। শ্রেণীকক্ষের lecture-এর পাশাপাশি লাইব্রেরীর বই পড়তে পারার সুযোগ পড়াশুনার একটি অত্যাবশ্যক কম্পোনেন্ট। অনেকেই বলে প্যান্ডেমিক চলে গেলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আর আগের মত থাকবে না অর্থাৎ পড়াশুনা ধীরে ধীরে অন লাইন based হয়ে যাবে। যদি তাই হয় সেটা কি ধনাত্বক পরিবর্তন হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা ক্যাম্পাস নির্ভর। একজন ছাত্র শ্রেণীকক্ষে যা শিখে তার চেয়ে অনেক বেশি শিখে শ্রেণী কক্ষের বাহিরে। এছাড়া socialization ও পড়াশুনার একটি বড় কম্পোনেন্ট। এগুলোতো আর অন লাইনে সম্ভব না।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন লাইন ক্লাসের কি অবস্থা তা জানার জন্য আমার বিদেশী বন্ধুদের মাধ্যমে জানার একটু চেষ্টা করেছি। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল দুইয়েকটি আর্টস ডিপার্টমেন্ট অনলাইন শুরু করছিল, কিন্তু তাদের VC সোজা জানিয়ে দেয় যে, “আমাদের যাদবপুরে ছাত্ররা বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্তর থেকে, গ্ৰাম থেকে পড়তে আসে যাদের কাছে ইন্টারনেট ও নিজস্ব ল্যাপটপ নাও থাকতে পারে”। তাই অনলাইন ক্লাস নিতে আপত্তি করেন। মনে রাখতে হবে এশিয়ার রেঙ্কিং-এ যাধবপুর ইউনিভার্সিটির অবস্থান ১৯৬ যেখানে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪০১! আর অর্থনৈতিক অবস্থার দিক দিয়ে আমরা যে কলকাতা থেকে এগিয়ে সেটা আমি দাবি করতে পারব না। ওদিকে জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ৭০% শিক্ষক অন লাইন ক্লাসের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে এটি এশিয়া রেঙ্কিং-এ ১৮৭তম অবস্থানে এবং ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অবস্থিত। তবে যতদূর জেনেছি ওখানকার উচ্চ শিক্ষার প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অন লাইন ক্লাস চালু রেখেছে। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের বিষয়টা একটু ভিন্ন। সেইসব প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ক্লাস চালু না রাখে তাহলে ছাত্ররা টিউশন ফী ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক ফী দিবে না এবং তাতে তাদের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দিতে সমস্যা হবে। তাদের কাছে চালিয়ে নেওয়াই বড় কথা নাহলে তারা বড় সমস্যায় পরবে। আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোতেও অন লাইন ক্লাস চলছে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক প্রতিষ্ঠানেও চলছে। যেইগুলোতে চলছে সেগুলোর বেশির ভাগই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। আর পাবলিক বা স্টেট প্রতিষ্ঠানগুলোর যেইগুলোতে চলছে সেগুলোতে আগে থেকেই কিছু অন লাইন শিক্ষা চালু ছিল। তাই তাদের সাপোর্টিং সিস্টেম বেশ শক্ত। তাছাড়া সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতেই তারা কিছু অন লাইন কোর্স চালু ছিল। তাই তাদের সক্ষমতার সাথে আমাদের তুলনা চলে না। তাদের ছাত্রদের আর্থিক অবস্থা ও টেকনোলোজিক্যাল সাপোর্ট সিস্টেম আমাদের ছাত্রদের তুলনায় যোজন যোজন ভালো।
হঠাৎ করে অন লাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য সরকার, ইউজিসিসহ বিভিন্ন মহল থেকে এক ধরণের চাপ দেখছি। সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে উনারা বেশি ব্যথিত। হঠাৎ করে ছাত্রদের প্রতি উনাদের এত দরদ কেন উথলে উঠেছে? দেখে মনে হচ্ছে দরদ যেন চুইয়া চুইয়া বাইয়া বাইয়া পরতেছে! এইসব দেখে আমারতো মাছের মায়ের পুত্রশোকের কথা মনে পরছে। ১০০ বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী মুক্তিযোদ্ধা বিশ্ববিদ্যালয়! সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এখনো এই যুগে একটি ইমেইল আইডি দিতে পেরেছি? অথচ বিদেশ কেউ এক সেমিস্টারের জন্য কোন সাধারণ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ভর্তির দিনই থেকেই তাকে নাম@বিশ্ববিদ্যালয়.academic.bd এইরকম একটি ইমেইল আইডি দিয়ে দেওয়া হয়। অন্তত মাস্টার্সের ছাত্রদেরকেতো দেওয়া ফরজে আইন। কারণ আমাদের ছাত্ররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য দরখাস্ত করে। একটি একাডেমিক ইমেইল থাকলে অনেক সুবিধা। আর এটাতো তাদের রাইট, এটা একটা পরিচয়। শুধুই কি ইমেইল আইডি? আমাদের ছাত্রছাত্রীরা কেমন করে হলে থাকে, কি খায় সেই সম্মন্ধে কি সরকার জানে না?
হঠাৎ করে অন লাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য সরকার, ইউজিসিসহ বিভিন্ন মহল থেকে এক ধরণের চাপ দেখে আমারতো মাছের মায়ের পুত্রশোকের কথা মনে পরছে। যেন অনলাইনে ক্লাস নেওয়া ব্যতীত আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আর কোন সমস্যা নেই। কেন গো আমাদের ছাত্ররা গণরুমে চারজনের স্থলে ৩০-৪০ জন ছাত্র থেকে শিফটে যখন ঘুমায় তখন আপনাদের এত দরদ কোথায় থাকে? মিটিং মিছিলে যখন জোর করে যোগ দিতে বাধ্য করে আর না গেলে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয় তখন আপনাদের এত দরদ কোথায় থাকে? অসংখ্য গরিব মেধাবী ছাত্র আছে যারা নিজের পড়ার খরচ জোগাড়ের পাশাপাশি পরিবারকে চালাতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে ফেলে তখন আপনাদের এত দরদ কোথায় থাকে? ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রদেরকে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহার করে তাদের মূল্যবান জীবন নষ্ট করেন তখন আপনাদের এত দরদ কোথায় থাকে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ডাইনিং ও ক্যান্টিনে অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে রোগাক্রান্ত হয় তখন আপনাদের এত দরদ কোথায় থাকে? এইসবের ফলে আমাদের ছাত্ররা যে ভালো মানের উচ্চ শিক্ষা থেকে বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হচ্ছে কই সেইসব নিয়েতো কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়না। অন লাইন ক্লাস না নিলে যত ক্ষতি হচ্ছে তার চেয়ে শতগুন বেশি ক্ষতি আমাদের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে ছাত্ররা প্রায় ৩ ষ্টার হোটেলের মত হলে থেকে পড়াশুনা করে আর আমাদের ছাত্ররা?
অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের উৎসাহের একটি কারণ এতে বিনা পুঁজিতে কিছু বাহবা পাওয়া যাবে। বিনা পুঁজিতে বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে আছি ভাবা যাবে। মুখে বললেই কি অনলাইনে ক্লাস শুরু করা যায়? আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অবস্থা বুঝতে হবে না? কত ছাত্র আছে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি পরিবারকেও সাহায্য করে। পাবেন এমনটা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে? ইউরোপ আমেরিকায় কিছু ছাত্র আছে যারা পড়াশুনার পাশাপাশি সেমিস্টার ব্র্যাকে পার্ট-টাইম চাকরি করে কিছু আয় রোজগার করে। এছাড়া অনেকেই স্কলারশিপ অথবা ব্যাংক লোন নিয়ে পড়াশুনা করে। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় পরিবারকে সাহায্য করে এমনটা পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না। আমাদের অনেক ছাত্র আছে যাদের বাবা দিনমজুর, শ্রমিক বা স্বল্প বেতনের চাকুরে। তাদেরতো এখন আজ রাতেরবেলা কি খাবে সেই চিন্তায় অস্থির। কত ছাত্রছাত্রী বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছে ধারণা আছে? কতজনের ল্যাপটপ আছে এই সম্মন্ধে ধারণা আছে? আর ল্যাপটপ থাকলেই কি অনলাইনে ক্লাস করা যায়? ভালো ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে হবে। আবার সব জায়গায় ভালো ইন্টারনেট কানেকশনও নেই। যাদের নেই তাদের অনলাইনে ক্লাস থেকে deprive করার অধিকার কি আমাদের আছে?
৩৫ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ মাত্র ৬০০ কোটি টাকার মত। আগামী অর্থবছরে দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য মোট বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৪৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় বরাদ্দ কমেছে। আসুন একটু বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দের দিকে একটু চোখ বুলাই। ২০১৮-১৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আমাদের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেই বাজেট তার প্রায় তিন গুন্ বাজেট কেবল অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা হলো প্রায় ২৫ হাজার আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা হলো প্রায় ২৩ হাজার। উভয় ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কিভাবে কোন যুক্তিতে আন্তর্জাতিক মানের হবে বলে আশা করি। এত কম টাকা দিয়ে যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে আছে, ছাত্রছাত্রীরা সার্টিফিকেট পাচ্ছে এ এক আশ্চর্যের বিষয়। অথচ কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক দল, প্রশাসন বা ছাত্ররা কোন প্রকার প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। এত obedient ছাত্র শিক্ষক প্রশাসন পৃথিবীর আর কোথাও পাবেন না। পৃথিবীর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যার একটি বিভাগের গবেষণা বাজেটও এর চেয়ে বেশি। এত স্বল্প বাজেট বরাদ্দ দিয়ে প্রতি বছর এত ছাত্রছাত্রীকে ডিগ্রী দেওয়া সম্ভবত একটি বিশ্ব রেকর্ড। এত স্বল্প বাজেট বরাদ্দ সত্বেও আমাদের অনেক ছাত্র এখান থেকে পাশ করে বিদেশে সুনামের সাথে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাই অন লাইন শিক্ষাই একমাত্র সমস্যা না যে এইটা করলেই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। অনলাইন ক্লাস চললে এইটার একটা প্রচার মূল্য আছে। হয়ত একমাত্র সেকারণেই আপনাদের এই মায়াকান্না।
- লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (khassan@du.ac.bd)