- কাজী রবিউল আলম
একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যপথ
মারসেল মস্(Marcel Mauss) তাঁর উপহার(The Gift) বইটিতে বিভিন্ন সমাজে বিদ্যমান উপহার-প্রদানের ধরণ, অর্থ এবং কাঠামো সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। মস্ অন্য অনেকের মতো লক্ষ্য করেন যে একটি ব্যাপক সংখ্যক সমাজে — বিশেষত আর্থিক বিনিময় এবং আইনী কাঠামো বিহীন সমাজে—উপহার আদান-প্রদান পরিচালিত হতো কঠোর প্রথা ও অলিখিত আইন অনুযায়ী। মস্ তাঁর উপহার বইটিতে কিভাবে কখন উপহার প্রদান, গ্রহণ ও বিনিময় দেওয়া হবে সেই কাঠামোটিকে বিশ্লেষণ করেছেন এই কাঠামো পরিচালনার অন্তর্নিহিত ও অব্যক্ত কারণ সম্পর্কে বুঝবার জন্য। তিনি আরো দেখতে চেয়েছেন আধুনিক, পশ্চিমা সমাজে তাঁর এই বিশ্লেষণের প্রভাব কি থাকতে পারে। মস্-এর অনুসন্ধানে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে অনেক সংস্কৃতিতে উপহার-প্রদান একটি গুরত্বপূর্ণ কাঠামোগত শক্তি যা উপহারের আইনের মধ্য দিয়ে মানুষকে একটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার জালে আবদ্ধ করে (Macat 2017:5)।
লেখক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মারসেল মস্ ১৮৭২ সালে ফ্রান্সের ভস (Vosges) শহরের একটি “রক্ষণশীল” ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মামা, এমেইল ডুর্খেইমকে আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডুর্খেইমকে ঘিরে তরুণ মেধাবিদের একটি দল গড়ে উঠেছিল, তাঁর মধ্যে মস্ নিয়োজিত হয়েছিলেন ধর্ম অধ্যয়ন করতে। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের ধাক্কায় দলটি ভেঙ্গে যায়; ডুর্খেইমের সন্তানসহ অনেকে মারা যান, এবং এরই শোকে কিছুদিনের মধ্যে ডুর্খেইমও মারা যান। ফলে উল্লেখযোগ্য বলতে শুধু মস্ই বেঁচে থাকলেন দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নেবার জন্য।
কোন বিবেচনাতেই মস্ কখনই তাঁর এই দৃশ্যমান অর্পিত দায়িত্ব গুরত্বের সঙ্গে নেননি। অসামান্য পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও (সংস্কৃত, মাওরি এবং ক্ল্যাসিকাল আরবী ভাষা সহ তিনি কমপক্ষে এক ডজনের উপর ভাষা জানতেন), তাঁর মধ্যে একজন মহিয়ান প্রফেসরের ভারত্বের অভাব ছিল। একজন প্রাক্তন সৌখিন মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সামান্য বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টাপূর্ণ বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। কোন বড় ধরনের দার্শিনিক তত্ত্ব নির্মাণের চেয়ে তিনি নানা ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত ধারণা নিয়ে ‘ভেলকি’ দেখানো পছন্দ করতেন (Graeber 2013:2)। তিনি তাঁর জীবনে অন্তত পাঁচটি ভিন্ন ধরণের বই লেখার কাজ হাতে নিয়ে ছিলেন (যেমন প্রার্থনা, জাতীয়তাবাদ, অর্থের উৎপত্তি প্রভৃতি), কিন্তু কোনটির কাজ তিনি শেষ করেন নি। তা সত্ত্বেও একদল নতুন প্রজন্মের সমাজবিজ্ঞানীদের সফলভাবে দীক্ষা দিতে সমর্থ হন এবং বলা যায় একার হাতেই ফ্রান্সে নৃবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি তিনি অনেক অসাধারণ উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন যাদের প্রত্যেকটিকে একটি নতুন ধরণের সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায়(Graeber 2013:3)।
মস ছিলেন একজন বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক। ছাত্র জীবন থেকে তিনি সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং জীবনের বেশিরভাগ সময়ে ফরাসী সমবায় আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। প্যারিসে তিনি একটি ভোক্তা সমবায় আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বহু বছর ধরে তা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি প্রায়শই তিনি অন্যান্য দেশের আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ করবার জন্য সেসব দেশে মিশনে যেতেন (যার উদ্দেশ্যে তিনি বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় সময় কাটিয়েছিলেন), যদিও মস্ একজন মার্কিস্ট ছিলেন না। কমিউনিস্ট এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাট উভয়েই ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি মনে করতেন। কারণ উভয়েই বিশ্বাস করতেন সমাজ মূলত সরকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। বরং তাঁর মতে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিৎ ছিল সমাজতন্ত্রের আইনগত ভিত্তি তৈরী করা যা মূলত তলা থেকে বিকল্প প্রতিষ্ঠান তৈরী করার মাধ্যমে সম্ভব(Graeber 2013:3)।
রাশিয়ার বিপ্লব তাঁকে গভীরভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয়। যখন একটি প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে তিনি আনন্দিত হচ্ছিলেন, একই সঙ্গে বলশেভিকদের পদ্ধিতিগত সন্ত্রাস এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর তাদের দমন দেখে তিনি একইমাত্রায় ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন(Graeber 2013:4)। এটাকে মস্ প্রকৃত পক্ষে বাজার নিয়মেরই চেতনা বর্জিত যৌক্তিক হিসেবের শুধুমাত্র একটি সামান্য রূপান্তরিত রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
মস্-এর “উপহার” বইটি, রাশিয়ার এইসব ঘটনা বিশেষত লেনিনের ১৯২১ সালের অর্থনৈতিক নীতির শুধুমাত্র একটা প্রতিক্রিয়াই ছিলনা। লেনিনের অর্থনৈতিক নীতি পূর্বকার বাণিজ্য বিলুপ্ত করবার প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দেয়(Graeber 2013:4)। এই প্রেক্ষিতে মস্ বলেন, রাশিয়ার মতো স্থান যাকে সর্বনিম্ন আর্থিক ইউরোপীয় আর্থিক সমাজ হিসেবে বলা যায়, সেখানে যদি বাজারকে অস্বীকার বা বাতিল করা না যায়, সেখানে বিপ্লবীরা আরও বেশী গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলেন তাহলে “বাজার” আসলে প্রকৃত অর্থে কী ছিল, এটা কোথা থেকে এসেছে, এটার কার্যকর বিকল্প রূপ কী হতে পারে। এই সময়টা ছিল সেসব ঐতিহাসিক ও নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলকে সামনে নিয়ে আসার যা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারে। আর এটাই ছিল মারসেল মস্-এর “উপহার” বইটি লেখার প্রেক্ষাপট যা এই প্রশ্নগুলোর একটি যথার্থ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।
লেখক ও বৌদ্ধিক প্রেক্ষাপট
মস্কে মূলত তাঁর মামা এমেইল ডুর্খেইমের একজন বৌদ্ধিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে মস্-এর কাজকে দেখার একটা সহজ পথ হচ্ছে কিভাবে ডুর্খেইমের মতো একই বৌদ্ধিক সমস্যাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ডুর্খেইমের সমস্যা মূলত উদ্ভব হয় উনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি ও ব্রিটিশ পন্ডিতদের মধ্যে চলমান সামাজিক পরিবর্তনের গতিবিধি নিয়ে বিতর্ককে ঘিরেঃ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার উত্থান, ধর্মীয় সংহতি ও ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের পতন, প্রধান সামাজিক সম্পর্কের ধরণ হিসেবে বাজারের উত্থান (Graeber 2001:152)। আর এরই প্রেক্ষিতে মস্-এর “উপহার” বইটিকে সামাজিক চুক্তির একটি অনুসন্ধান হিসেবে পড়া যেতে পারে।
মার্শাল সাহ্লিনস্ বলেন যে, মস্ যে সমস্যাটিকে মোকাবিলা করছেন তা শেষ পর্যন্ত থমাস হবস্-এর কাছে ফিরে যায়: তুমি কিভাবে মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করবে যেখানে একে অপরকে হত্যা না করবার তাৎক্ষণিক কোন কারণ নেই? (Sahlins 2017: 135)। হবস্ যুক্তি দেন যে, মানুষের অন্তহীনভাবে অধিগ্রহণযোগ্য প্রবণতাটা প্রদত্ত, কাজেই তাঁর প্রকৃতি হচ্ছে “সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধ”; তখনই যথাযথ সমাজ শুরু হতে পারে যখন সকলে মিলে একটি সর্বময় রাজনৈতিক ক্ষমতা সৃষ্টি করতে রাজী হবে। প্রকৃত “সামাজিক চুক্তি” ছিল মানুষের শক্তি প্রয়োগের অধিকার ত্যাগ করতে সম্মত হওয়ার বিষয়, এবং এমন একটা অবস্থা তৈরী করা যেখানে মানুষ নিজের প্রয়োজন মতো যেকোন ধরনের সামাজিক চুক্তি করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে যে যুক্তির ধারা সেইন্ট-সিমন হাত দিয়ে শুরু হয়ে হার্বাট স্পেন্সারে এসে শেষ অংকে পৌঁছে তা প্রস্তাব করে যে রাষ্ট্রের জবরদস্তির ভূমিকা চিরন্তন ছিল না, এবং মানব ইতিহাস দেখছিল সমাজগুলোর ভিত্তি কিভাবে সামরিক থেকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগীতা এবং সেখান থেকে ব্যক্তিদের মধ্যে মুক্ত অর্থনৈতিক চুক্তিতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হচ্ছিল। ডুর্খেইম তাঁর বেশীরভাগ সামাজিক তত্ত্বের কাঠামো দাঁড় করান স্পেনসারের চিন্তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেঃ যেমন, তিনি উল্লেখ করছেন, ব্যক্তিগত চুক্তির বিকাশ রাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে দেয়নি, বরং এটি এমনভাবে নাগরিক জীবনের উপর হস্তক্ষেপ করছিল যা আগে কখনো করেনি(Sahlins 2017: 136)। এরকম একটা বৌদ্ধিক পরিবেশ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কিভাবে “চুক্তির উৎপত্তি” একটা গুরত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘উপহার’ কী ও কেন?
মস্ তাঁর “উপহার” বইটিতে “চুক্তির আদি ধরণ” কি হতে তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। হবস্, অ্যাডাম স্মিথ, বা আধুনিক অর্থনীতিবিদদের অনুমানের বিপরীতে তিনি আরো লক্ষ্য করেন যে প্রথম স্বেচ্ছাক্রিয়, চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক ব্যক্তিদের মধ্যে নয় বরং সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পাদিত হতো: ‘বংশ, ট্রাইব, এবং পরিবার এর মধ্যে’ (Mauss 1990:3)। সেগুলো প্রকৃতিতে না ছিল রাজনৈতিক, না ছিল অর্থনৈতিক; বরং সেগুলো ছিল, মস্-এর ভাষায়, “সামগ্রিক”, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রকে একত্রিত করতো যাকে আমরা ‘ধর্মীয়, আইনী, নৈতিক, এবং অর্থনৈতিক’ হিসেবে আলাদা করতে পারি। উপহার-প্রদান এরই একটি যথাযথ উদাহরণঃ কারণ এটি পুরোপুরি একটা স্বেচ্ছাক্রিয় কাজ যা আবার একধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরী করে। ফলশ্রুতিতে, তাঁর ব্যাখ্যা যে কেন্দ্রীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় তা হলো:
‘আদিম বা ঐতিহ্যবাহী সমাজের কোন নীতির ফলে একটা উপহার গ্রহণ করলে তা শোধ করতে হয়? প্রদত্ত জিনিসে কী শক্তি আছে যা গ্রহীতাকে আবার প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করে?’
কেন মানুষ উপহার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়? তাঁর বিখ্যাত উত্তর: দ্রব্যগুলো বস্তুত দাতার ব্যক্তিত্বের একটা অংশ/শরীক। এটাকে তিনি hau বা উপহারের ‘আত্মা’ বলেছেন— মস্-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, দাতার আত্মা মূলত উপহারের সাথে বিজড়িত থাকে, এবং ফলশ্রুতিতে, তাঁর বাড়ী ফিরে আসার আকাঙ্খাই গ্রহীতাকে বাধ্য করে উপহার প্রত্যাবর্তনে।
কিন্তু বাস্তবে উপহার সবসময় ফেরৎ দিতে হয় না? ফলে মস্-এর মতে প্রশ্নগুলো হওয়া উচিৎ: কখন উপহার ফেরৎ দিতে হয়? কি ধরণের উপহার ফেরৎ দিতে হয়? কোন পরিস্থিতিতে? এবং পরিশোধের যথাযথ হিসেবটা কী হবে? আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে মস্ তাঁর ‘total prestation বা সামগ্রিক বিনিময়’ এর ধারণাটি নিয়ে আসেন। সামগ্রিক বিনিময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্কগুলো স্থায়ী, কারণ সেগুলো উপহার পরিশোধের মাধ্যমে বাতিল করার সুযোগ ছিল না। একপক্ষ আরেকপক্ষের উপর যে দাবী করতো তা ছিল উম্মুক্ত (open ended) কারণ এগুলো ছিল স্থায়ী; এখানে কোন হিসেব রাখার প্রশ্ন নেই কারণ সম্পর্কগুলো কখনো শেষ হয়ে যাবে না(Mauss 1990:3)।
‘উপহারের’ আন্তঃসাংস্কৃতিক ধরণ ও উদাহরণ
পুরো বই জুড়ে, মস্ বার বার বলেন যে পলিনেশিয়া, উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার মানুষেরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে যে উপহার দেয় হয় তা পারস্পরিক বিনিময় করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, সামোয়াদের মধ্যে, বস্তুগত বা আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কিত যেকোন উপহার, ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উপাদানের একটি অংশ। তা রেখে দেওয়া এবং বিনিময় না করা খুবই বিপজ্জনক ও অনৈতিক, কারণ একটি সচল উপহার তার আদি মালিক ও উৎপত্তিতে ফিরে যেতে চায়। আন্দামান আইল্যান্ডে উপহার পরিবারের মধ্যে সংযোগ হিসেবে কাজ করে, যোগাযোগ ও বিনিময়কে সমর্থন করে। ট্রব্রিয়ান্ড আইল্যান্ডে আন্তঃট্রাইব বাণিজ্য চালু আছে যাকে ‘কুলা’ বলে। কুলা বিনিময়ের সময় উপহার অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে খুবই কড়াকড়িভাবে আবর্তিত হয় এবং এই আবর্তন আইনি নীতিগুলোকে শক্ত ভিত্তি দেয় এবং একটি দৃঢ় আধ্যাত্মিক সংযুক্ততা থাকে। এটা শুধু অন্যকে খুশী করবার জন্য উপহার প্রদান নয়; এটা সেবা বিনিময়ের একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা যা ‘যা অন্যান্য বৈচিত্র্যপূর্ণ বিনিময়ের একটি কাঠামো তৈরী করে’(Mauss 1990:27)।
উত্তর-পশ্চিম আমেরিকাতে উপহার বিনিময় ব্যবস্থা হিসেবে পটল্যাচ চালু আছে। এটা মেলেনেশিয়ার বিনিময় ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশী উগ্র, এবং সম্মানের ধারণা এখানে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। পটল্যাচ সমাবেশ চলাকালীন পরিষেবাগুলোকে সম্মানের কাজ হিসেবে দেখা হয়, এবং গোত্রপ্রধান কেবল তাঁর সৌভাগ্য ভাগাভাগি করেই কেবল তাঁ উচ্চ মর্যাদা ধরে রাখতে পারেন। মস্ বলেন যে ‘প্রদান করবার বাধ্যবাধকতাই পটল্যাচের মূল সারমর্ম’ (Mauss 1990:39), একই সঙ্গে বিনিময় করবার বাধ্যবাধকতাও। এখানে প্রতিযোগীতা ও ক্ষমতার খেলা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, এবং এখানে ‘উপহার প্রবহণ এবং ব্যক্তি ও তাঁর অধিকারের প্রবহণের’ (Mauss 1990:46)মধ্যে একটি জোড়ালো সম্পর্ক রয়েছে।
শেষ অধ্যায়ে মস্ মেলেনেশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার উপহারের ধারণার সাথে ইউরোপিয়ান সমাজের উপহারের ধারণার তুলনা করেছেন। পশ্চিমা সমাজে মানুষ সাধারণত উপহার প্রদানকে শর্তহীন প্রদান হিসেবে দেখে থাকেন। এখানে বিনিময় করবার কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্তু, আমরা যদি ইন্দো-ইউরোপিয়ান আইন ব্যবস্থা, ক্ল্যাসিক্যাল হিন্দু আইন, সেল্টিক আইনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে বাধ্যবাধতাপূর্ণ উপহার আদান-প্রদান তাঁদের কাছেও অপরিচিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মান সমাজে gage (একটি অঙ্গীকার) নামে একটা ব্যবস্থা চালু আছে যেখানে দুই পক্ষের যোগাযোগের স্মারক হিসেবে উপহার বিনিময় করা হয়।
পুঁজিবাদ ও বাজারের সার্বজনীন অনুমানের অসারতা
মস্-এর উপসংহার ছিল চমকপ্রদ। প্রথমত, অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে “অর্থনৈতিক বিজ্ঞান” যা বলে আসছিল তা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়। এখনকার মতো তখনকার মুক্তবাজার নিয়ে উৎসাহীদের সার্বজনীন অনুমান ছিল যে যা মানুষকে চালিত করে তা হলো তাঁর আনন্দ, স্বাচ্ছন্দ্য এবং বস্তুগত সম্পদ সর্বাধিক করবার ইচ্ছা (তাদের উপযোগ) এবং মানুষের তাৎপর্যপূর্ণ সব ধরণের মিথস্ক্রিয়াকে বাজারের সূত্র দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে। তাদের মতে শুরুতে এর অফিসিয়াল ধরণ ছিল বার্টার ব্যবস্থা। মানুষ একটা জিনিসের সঙ্গে আরেকটা জিনিসের বিনিময় করার মাধ্যমে সে যা চাইতো তা পেত। যেহেতু এটা ছিল ঝামেলাপূর্ণ, ফলশ্রুতিতে তাঁরা বিনিময়ের সার্বজনীন মাধ্যম হিসেবে অর্থ আবিষ্কার করলো। আরো উন্নত কৌশলের (ঋণ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ) আবিষ্কার শুধুমাত্র একই ব্যবস্থার যৌক্তিক সম্প্রসারণ মাত্র।
মস্ দ্রুত যে সমস্যাটি লক্ষ্য করেন তা হলো, বার্টার ভিত্তিক একটি সমাজের অস্তিত্বে বিশ্বাস করবার কোন কারণ ছিল না। পরিবর্তে, নৃবিজ্ঞানীরা এমন সব সমাজ এর উদাহরণ সামনে নিয়ে আসছিলেন যাদের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন সূত্রের উপর গ্রোথিত, এবং এখানে বেশিরভাগ দ্রব্য উপহার হিসেবে আবর্তিত হয়। এবং যাকে আমরা “অর্থনৈতিক” আচরণ বলছি তা ছিল খাঁটি উদারতার অছিলা এবং কাকে কি দেওয়া হয়েছে তা পুঙ্খানুপঙ্খভাবে হিসেব করবার অস্বীকার। এই উপহার-অর্থনীতি বিভিন্ন উপলক্ষ্যে অত্যন্ত প্রতিযোগীতামূলক হয়ে উঠলেও তা পশ্চিমা সমাজের চেয়ে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতঃ কে সবচেয়ে বেশী পুঞ্জীভূত করলো সেই টেক্কা দেওয়ার চেয়ে এখানে তারাই ছিল বিজয়ী যারা সবচেয়ে বেশী বিলিয়ে দিতে পারতো।
এগুলো আপাত দৃষ্টিতে খুবই উদ্ভট বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মস্ প্রশ্ন করছেনঃ এগুলো প্রকৃত অর্থে কতটা বেমানান? এমনকি আমদের সমাজে শর্তহীন উপহার-প্রদানের ধারণা কিছুটা অস্বাভাবিক নয়। কেন একজন তাঁর বন্ধুর কাছে থেকে কিছু উপহার পেলে (হতে পারে একটি পানীয়, রাতের খাবারের আমন্ত্রণ, একটি প্রশংসা) তার প্রতিদান দিতে বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন? কেন একজন দাক্ষিণ্য/উদারতা গ্রহণকারী প্রায়শই নিজেকে ছোট মনে করেন যদি সে প্রতিদানে দাক্ষিণ্য/উদারতা দেখাতে না পারে? এগুলো কি সার্বজনীন মানবিক অনুভূতির উদাহরণ নয়, যেগুলো আমাদের সমাজে একরকম অগণ্য বলে বিবেচিত হয়—অন্যদের ক্ষেত্রে যা তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই ভিত্তি নয়? মস্ প্রশ্ন করছেন, এগুলো কি আমাদের মতো পুঁজিবাদী সমাজেও বিদ্যমান সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের আবেগ ও নৈতিক মানদন্ডের অস্ত্বিত্ব নয়, যা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজতান্ত্রিক নীতির আহবানের প্রকৃত ভিত্তি নয়। মস্ অবশ্যই তা মনে করেন।
বিচ্ছিন্নতা, বাজার ও ‘উপহার’
নানা দিক থেকে মস্-এর বিশ্লেষণ একই সময়ে জর্জ লুকাস কর্তৃক মার্ক্সীয় বিচ্ছিন্নতা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। উপহার-প্রদান অর্থনীতিতে, মস্ যুক্তি দেন, বিনিময়ে পুঁজিবাদী বাজারের মতো নৈর্ব্যক্তিক গুণাবলী থাকে নাঃ বস্তুত, এখানে যখন একটি মূল্যবান দ্রব্যও হাত বদল হয় সেখানে যে বিষয়টি মূখ্য ভূমিকা পালন করে তা হলো বিনিময়কারী ব্যক্তিদের মধ্যে সম্পর্ক; এখানে বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব তৈরী হয়, অথবা শত্রুতা বা বাধ্যবাধকতার নিস্পত্তি করা হয়, এবং শুধুমাত্র ঘটনাক্রমে মূল্যবান দ্রব্যের বিনিময় করা হয়। ফলে সবকিছুর মধ্যে একধরনের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, এমনকি সম্পত্তি পর্যন্তঃ উপহার-প্রদান অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ সম্পদ — উত্তরাধিকার সূত্র কণ্ঠহার, অস্ত্র, পালকের পোশাক — প্রত্যেকের একটি নিজস্ব ব্যক্তিত্ব/ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলে।
বাজার অর্থনীতিতে এটি সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ধারণা। লেনদেনগুলো এখানে নিছক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতে পাওয়ার পথ মাত্র; আদর্শগতভাবে ক্রেতা ও বিক্রেতার ব্যক্তিগত গুণাবলী এখানে সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক। ফলশ্রুতিতে সবকিছু, এমনকি মানুষও এখানে নিজেকে একটি পণ্য ভাবতে শুরু করে (যেমন, “পণ্য ও সেবা” এর ধারণা)।
পরবর্তীতে কোথায়?
মস্ কখনোই তাঁর বাস্তব উপসংহার সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিলেন না। রাশিয়ার অভিজ্ঞতা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে আধুনিক সমাজ হতে ক্রয় এবং বিক্রয় সহজে নির্মূল হবে না, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে, কিন্তু বাজারের মূল্যবোধকে নির্মূল করা সম্ভব। কাজ সমবায় ভিত্তিক হতে পারে, কার্যকরী সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে এবং, ক্রমশ একটি নতুন মূল্যবোধ তৈরী করা যেতে পারে যেখানে সম্পদ পুঞ্জীভবনের একমাত্র অজুহাত হতে পারে তাঁর পুরোটাই ছেড়ে দেওয়ার সক্ষমতা। ফলাফল: এমন একটি সমাজ যার সর্বোচ্চ মূল্যবোধ হবে ‘জনসম্মুখে প্রদান করবার আনন্দ, উদার শৈল্পিক ব্যয়ে খুশী, গণ বা ব্যক্তিগত ভোজের আতিথেয়তার সন্তুষ্টি’।
দোহাই
Mauss Marcel, (1990). The Gift: The form and reason for exchange in archaic societies. London:Routledge.
Graeber David, (2001). Toward An Anthropological Theory of Value. New York: PALGRAVE™.
Graeber David, (2013). GIVE IT AWAY. Free Words, https://p2pfoundation.net/knowledge-commons
Macat Team, T. (2017). An Analysis of Marcel Mauss’s The Gift. London: Macat Library, https://doi.org/10.4324/9781912281008
Sahlins Marshall, (2017). Stone Age Economics. New York: Routledge.
- কাজী রবিউল আলম, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[প্রবন্ধটি পূর্বে বোধিচিত্তের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয়েছিল]