- আলতাফ পারভেজ
বিশ্ব বরাবরই নিপীড়িতের রাজনৈতিক সংগ্রামের অনেক কৌশল দেখে। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। অতিসম্প্রতি ‘বয়কট-আন্দোলন’ নিয়ে কথা উঠেছে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই সূত্রেই মনে পড়লো বাংলার ১৮৭৩-এর বয়কট-আন্দোলনের কথা। যোগেন মন্ডলকে নিয়ে লেখা বইতে (প্রথমা ২০১৯) তার কিছু বিবরণ রয়েছে। এখানে আবারও তার চুম্বক কথাটি তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না।
বাংলার নিম্নবর্গ কীভাবে মর্যাদা ও আত্মসম্মানের জন্য শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়েছে তার অনন্য এক নজির ঐতিহাসিক ঐ বয়কট আন্দোলন।
শুরুতে ঐ বয়কট আন্দোলনের পটভূমিটা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলি। ১৮৭২ সালের শুমারি অনুযায়ী বাংলায় মুসলমান ছিল এক কোটি ৭৬ লাখ। আর সনাতন বা হিন্দু ধর্মের মানুষ ছিলেন এক কোটি ৭৫ লাখ।
মুসলমানদের মধ্যে উচ্চবর্গীয় দাবিদার মোগল-পাঠান-শেখ-সৈয়দরা ছিল মাত্র তিন লাখ মতো। হিন্দুদের মাঝে উচ্চবর্ণীয় দাবিদাররা ছিল ২৩ লাখ মতো। অর্থাৎ বাংলার তখনকার তিন কোটি ৬৮ লাখ জনসংখ্যার মূল অংশই ছিল সাধারণ মুসলমান ও অস্পৃশ্য বা প্রায় অস্পৃশ্য সনাতন বাঙ্গালি।
বাংলায় তখন কার্যত দুটি `সমাজ’। ব্রাক্ষণ-সৈয়দদের সমাজ এবং অচ্ছ্যুতদের সমাজ। দরিদ্র মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ছিল একই অর্থনৈতিক ও মর্যাদাহীন সামাজিক পাটাতনের মানুষ।
এর মাঝে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উচ্চবর্গীয়রা ‘চন্ডাল’ বলতো। বাস্তবে এরাই তখন বাংলার প্রধান হিন্দু জনগোষ্ঠী। প্রবলভাবে বর্ণপ্রথায় নিগ্রহের শিকার ছিল তারা।
১৮৭৩-এর ঐ বয়কট আন্দোলন শুরু এই ‘চন্ডাল’ সমাজতত্ত্বের বিরুদ্ধে। যদিও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভিন্ন উপলক্ষ্যে। তখনকার বাকেরগঞ্জ জেলার মাদারিপুর থানার (ফরিদপুর জেলা হয় ১৮৭৪-এ) আমগ্রামে চরণ ট্যাপা নামের একজন গ্রামপ্রধান ‘চন্ডাল’-এর মায়ের শ্রাদ্ধে ব্রাক্ষণ ও কায়স্থরা নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে নিম্নবর্ণের সকলে উচ্চবর্ণীয়দের বয়কটের ডাক দেয়।
তারা তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ সমাজের জন্য কোন কাজ করতে অস্বীকার করে। জমিতে কাজ বন্ধ করে দেয়। বাড়িঘর নির্মাণে অংশ নিতে অস্বীকার করে।
দ্রুত এই আন্দোলন যশোর, সিলেটসহ আশেপাশের অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ছয় মাস স্থায়ী হয় এই আন্দোলন। এটা কারাগার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এর আগে নিম্নবর্ণের কয়েদি পেলেই তাকে দিয়ে ময়লা পরিষ্কারের কাজ করানো হতো।
এই আন্দোলনেরই ফল ছিল ১৯১১-এর শুমারিতে ‘চন্ডাল’ পরিচয়ের স্থলে লাখ লাখ মানুষকে ‘নমশূদ্র’ (সম্মানিত শূদ্র) হিসেবে উল্লেখ। আরও পরে (১৯৩৫ নাগাদ) এরাই ‘তফসিলী জাতি’র প্রশাসনিক পরিচয় পান।
১৮৭৩-এর এই বয়কট আন্দোলনের একটা বড় দিক ছিল নমশূদ্ররা যখন বয়কট কায়েম করতে আর্থিকভাবে কাবু হয়ে যাচ্ছিলো তখন বাংলার দরিদ্র মুসলমান চাষীদের একাংশ তাদের পাশে দাঁড়ায়। তারা উচ্চবর্ণকে বয়কটের প্রবল সমর্থক ছিল। এই সমর্থনের কারণে তারাও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নেয়; কিন্তু দ্বিধান্বিত ছিল না।
শুমারি দলিলের সংস্কার ছাড়াও এই আন্দোলনের অনেক ফলাফলের একটা ছিল গভর্ণর জর্জ ক্যাম্পবেলের সেই ঘোষণা যাতে জেলখানায় বিশেষ বর্ণের বন্দি পেলেই তাকে ময়লা পরিষ্কারে আর আগের মতো বাধ্য করা যাবে না। (যদিও এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়েছে আরও অনেক পরে)।
এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও চেতনার উপর দাঁড়িয়েই পরে নমশূদ্র সমাজে শিক্ষা আন্দোলনের বিস্তার ঘটেছিল। ১৮৮১-এ খুলনায় হয় নমশূদ্র সম্মেলন।
এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাংলায় দরিদ্র মুসলমান ও নমশূদ্ররা এতদিনকার সমধর্মী অর্থনৈতিক পাটাতনের পাশাপাশি ঐক্যের একটা নতুন রাজনৈতিক পাটাতনও নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিল। ৪-৫টি জেলায় প্রায় আট লাখ দরিদ্র নমশূদ্র এবং মুসলমান চাষিদের ঐ ঐক্য চেতনার মৌলিক ভিত্তি ছিল কাস্ট সিস্টেমের বিরোধিতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবল আর্তি।
কেন যেন মনে হচ্ছে আজো বাংলার মানুষ নানানরূপে কাস্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধেই লড়ছে। যদিও তার রূপ ও ধরন হয়তো আলাদা। কিন্তু এই ধরনের বয়কট আন্দোলন যে ব্যাপকভিত্তিক ঐক্যের পাটাতন দাবি করে ১৮৭৩-এর মতো বাংলার শোষিত নিম্নবর্গ আবার কি সেটা আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে?
ইতিহাস সেই দিকেই তাকিয়ে আছে হয়তো!
১৬ অক্টোবর ২০২০
পুনশ্চ: অনেকেই বয়কট আন্দোলনকে গান্ধীর সঙ্গে মিলিয়ে ভাবতে শিখেছেন। অথচ বাংলার নিম্নবর্গ যখন এই বয়কট আন্দোলন করে তখন গান্ধী চার বছরের শিশু মাত্র।
পুনশ্চ: তাৎক্ষণিক লেখা বলে সাল ও তথ্য-উপাত্তে কিছু ভুল হতে পারে।