বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় ‘নব্য-উদারনীতিবাদ’: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ‘কৌশলপত্র’ কেন গ্রহণযোগ্য নয়?

  • মোহাম্মদ আজম

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০০৫ সালে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা পেশ করেছে (ইউজিসি ২০০৫)। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজও চলছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে এ বাবদ বিশেষ সচেতনতা বা আলোচনা-পর্যালোচনা দেখা যায়নি। বামপন্থি দলগুলো আলাদাভাবে বা সামষ্টিকভাবে কিছু সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেছে; দু-চারবার অন্য প্রতিবাদী কর্মসূচিও দিয়েছে। কিন্তু তাতে বিপুল গরিষ্ঠ শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ এ ব্যাপারে সচেতন হয়েছে বলে মনে হয় না। পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব অর্থায়নের খাত তৈরি করা। স্বভাবতই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত কয়েক বছর অব্যাহতভাবে শিক্ষাব্যয় বাড়িয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে। তাতে কয়েক বছর ধরে ‘বেতনভাতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে অচলাবস্থা’ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রকল্পের অংশ হিসাবে শিক্ষকদের একাংশ গবেষণা-বৃত্তি ও প্রকল্প-সহায়তা বাবদ অর্থ-বরাদ্দ পেয়েছেন। তাঁরা কেউ কেউ কাজও করেছেন। শিক্ষকদের কারো কারো সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, তাঁরা ব্যাপারটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে, তাতে আসলেই ইতিবাচক নানা দিক আছে। উচ্চশিক্ষার প্রসার এবং মান-উন্নয়নের ব্যাপারে এতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষাদানপদ্ধতির পরিবর্তন আর নতুন যুগের চাহিদা অনুযায়ী পড়ানোর বিষয় ও ভঙ্গির বদলের কথা সবিস্তার বলা হয়েছে। আছে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো আর শিক্ষকদের মান-উন্নয়নের কথা। যাঁরা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার হালহকিকত সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখেন, তাঁরাই বুঝবেন, এর সব কটিই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে নিত্য আলোচিত চাওয়া। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এসব চাওয়ার একাংশও যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা গ্রহণ আর বাস্তবায়ন তো আলাদা ব্যাপার। ওই কৌশলপত্রে বাস্তবায়নের জন্য যেসব উদ্যোগ-আয়োজনের কথা বলা আছে, যে পদ্ধতির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতেই সন্দেহ হয়, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। অথচ এর অধীনে কাজ তো চলছেই। ইতিমধ্যেই বেশ কটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, যেগুলো এই পরিকল্পনা মোতাবেক পরিচালনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আধ-খেচড়াভাবে কিছু কিছু নতুন জিনিস ঢুকে পড়ছে। উদাহরণ দেয়া যাক।

বেশ কবছর আগে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিন বছরের অনার্স কোর্সকে চার বছর মেয়াদি করা হয়েছে। পরে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয়। কোনো পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বা কোনো গবেষণার বরাতে এসব ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, চাকরির বাজার ইত্যাদি বিবেচনায় চার বছরের প্রফেশনাল স্নাতক ডিগ্রির কোনো তাৎপর্য নেই। তবুও চার বছরের অনার্স চালু করলে আশা করা যায়, মাস্টার্সে থিসিস বা গবেষণাভিত্তিক পাঠক্রম গৃহীত হবে। তা হয়নি। ফলে ছাত্রছাত্রীরা প্রলম্বিত অনার্সের পর আরো এক বছর একই কায়দার পড়াশোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটায় মাত্র। এ অবস্থায় পরে আচানক সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হয়। অবকাঠামোগত সুবিধা, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, উপযোগিতা ইত্যাদি সম্পর্কে সামান্যতম জরিপ ছাড়াই নামকাওয়াস্তে এ পদ্ধতি আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ থেকে জানি, খুব কম শিক্ষকই এ পদ্ধতি পছন্দ করছেন। কিন্তু সামষ্টিকভাবে নিজেদের ভিন্নমত জানোনোর কোনো উদ্যোগও কেউ নেননি। 

চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স বা সেমিস্টার পদ্ধতি ইউজিসির কৌশলপত্র অনুযায়ী হয়নি। তবে মর্মের দিক থেকে এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতির দিক থেকে কৌশলপত্রের সঙ্গে এর যথেষ্ট মিল আছে। এ ধরনের উদ্যোগ কোনো সুফল আনতে পারে না। বরং বিদ্যমান পদ্ধতির তাৎপর্যও নষ্ট করে। এ কারণেই ইউজিসি-প্রণীত কৌশলপত্র সম্পর্কে সতর্কতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা দরকার।

মোহাম্মদ আজম

আমাদের আসলেই পরিকল্পনা দরকার। কিন্তু প্রথমেই যে প্রশ্ন মনে আসে তা এই, এ পরিকল্পনার জোগানদার বিশ্বব্যাংক কেন? ইউজিসির দাবি, বিশ্বব্যাংকের কাছে পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে এত নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত গবেষণা-প্রতিষ্ঠান থাকতে কোন যোগ্যতার কারণে বিশ্বব্যাংকের কাছে একটি দেশের শিক্ষা-পরিকল্পনা চাওয়া হল, তার কোনো ব্যাখ্যা এই কৌশলপত্রে দেয়া হয়নি। এই অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের নামে প্রচারিত নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব আর পক্ষপাতের কথা উল্লেখ না করেও বলা যায়, গোটা পরিকল্পনাটি সম্ভাব্য মুনাফার লোভ জাগানোর জন্য যতটা লিপ্ত থেকেছে, ‘শিক্ষা’র ব্যাপারে তার পাইর পাই আগ্রহও দেখায়নি। পুরো পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে বাজারকে কেন্দ্রে রেখে। তাতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু দেশীয় বাজার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা নিতান্তই কুয়াশাচ্ছন্ন। কোনো সুদূর ভবিষ্যতে দেশীয় বাজারে চাহিদা তৈরি হবে – এমন একটা আভাস মাত্র পাওয়া যায়। বারবার বলা হয়েছে প্রতিযোগিতার কথা। কিন্তু বাজার সম্পর্কে যথাসম্ভব সুনির্দিষ্ট ধারণা না থাকায় কৌশলপত্রে ব্যবহৃত ‘প্রতিযোগিতা’ শব্দটিও সুস্পষ্ট ব্যঞ্জনা তৈরি করেনি। আর বলা হয়েছে বিনিয়োগ-অনুপাতে মুনাফার কথা। মানে, শিক্ষাখাতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করা হবে, সে অনুপাতে মুনাফা অর্জিত হবে। কথাগুলো যেমন সত্য তেমনি খাঁটি। কিন্তু বিনিয়োগের ধরন সব ব্যবসায় এক রকম নয়; মুনাফা লোটার হার আর ধরনও ব্যবসাভেদে ভিন্ন হয়। আলোচ্য কৌশলপত্রে শিক্ষা কথাটা সর্বত্র ‘স্কিল’ অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। বাণিজ্যশিক্ষা আর প্রযুক্তিশিক্ষার বড় অংশের সঙ্গে এই সংজ্ঞা সামঞ্জস্যপূর্ণ বটে, কিন্তু খাঁটি বিজ্ঞান, কলা আর সমাজবিজ্ঞানের পড়াশোনাকে ‘স্কিল’ শব্দের আওতায় সামান্যই আঁটানো যায়। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো জাতীয় শিক্ষানীতি এ ভাষা বা পরিভাষায় রচিত হতে পারে না; বড়জোর কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো বিশেষ ‘ডিসিপ্লিন’ এ ধরনের পরিকল্পনা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জন্য বিশ্বব্যাংক-প্রণীত এ পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য – বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা বা সামষ্টিক উন্নয়নের ব্যাপারগুলোকে পাশ কাটিয়ে কেবল বাজারকে বিবেচনায় রেখে এ নীতিমালা তৈরি হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সে বাজার চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের বিভাজনরেখা মোটেই স্পষ্ট হয়নি।

এতে বিস্মিত হওয়ার অবশ্য কোনো কারণ নাই। বহুদিন হল আমরা বাস করছি এক ‘নব্য-উদারনীতিবাদী’ বিশ্বে -‘we live in the age of neoliberalism’ (Saad-Filho and Johnston 2005:1)।  এ দুনিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করার স্বার্থে পুঁজির বিশ্বজয় নিশ্চিত করা। এ অর্থে আজকের দুনিয়া যথার্থই ‘গ্লোবাল’। নব্য-উদারনীতিবাদী এ বিশ্বের মূল বৈশিষ্ট্য: পক্ষপাতদুষ্ট বাজারের স্বরাট কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের মতো জনকল্যাণমূলক ব্যয় কমানো, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতা, উৎপাদনব্যবস্থাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা, সমষ্টি বা জনসাধারণের কল্যাণের ধারণা পরিহার করা (Martinez and Garcia 1996) । বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী দেশগুলোর পক্ষে এসব নীতি বাস্তবায়নের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংক বহু বছর ধরে নব্য-উদারতাবাদী বিশ্বব্যবস্থার অনুকূল ‘উচ্চশিক্ষা’র প্রসারের জন্য কাজ করছে। তৃতীয় দুনিয়ায় ’উচ্চশিক্ষা-সংস্কারে’ নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই সংস্কারের মূল বিষয় ‘privatization, deregulation and marketization’ (Levidow 2002)। বিশ্বব্যাংক এক রিপোর্টে বলছে:

The reform agenda… is oriented to the market rather than to public ownership or to governmental planning and regulation. Underlying the market orientation of tertiary education is the ascendance, almost worldwide, of market capitalism and the principles of neo-liberal economics. (Johnstone et al., 1998)

ফলে বিশ্বব্যাংক যে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার জন্য এহেন ব্যবস্থাপত্র দেবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কারণ নাই। ইউজিসি তাদের কাছে পরামর্শ চেয়েছে – বিরোধ কমানোর জন্য তাদের এ প্রচারণাও বোধগম্য। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সরকার, ইউজিসি বা নাগরিকসমাজ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থেকেই মেনে নিয়েছে – এটা বিস্ময়কর। 

ছবি সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

ছড়ানো-ছিটানো কাজের কথা আর সুন্দর কথার ফাঁকে বারবার প্রাধান্য পেয়েছে দুটি বিষয় – বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতিমুক্ত করা আর ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। এ কথাগুলো এতবার এত বিচিত্র কায়দায় বলা হয়েছে যে, যে কারো মনে হতেই পারে, এই দুই মূলনীতি বাস্তবায়নের জন্যই অন্যসব কথার ডালি সাজানো হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক চর্চার নানা কুফল আমরা হামেশাই টের পাই। এ নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনাও চলে। কিন্তু এর সমাধান নিশ্চয়ই ক্যাম্পাসগুলোকে রাজনীতিমুক্ত করা নয়। আসলে সমস্যার প্রকৃতি কেমন, আর তা থেকে পরিত্রাণের উপায়ই বা কী, তা নিয়ে কোনো কার্যকর আলোচনা-পর্যালোচনা বা গবেষণা আজতক হয়ইনি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় ‘অরাজনৈতিক’ সিভিল সমাজ নানা কায়দায় বহুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরাজনীতিকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। নানা লক্ষণ দেখে মনে হয়, এ দাবি জনপ্রিয়ও বটে। আলোচ্য কৌশলপত্রে এই জনপ্রিয় দাবির সুবিধা নেয়া হয়েছে মাত্র। কোনো নতুন বিশ্লেষণে সমস্যার প্রকৃতি নির্ধারণ করে সমাধানের প্রস্তাব করা হয়নি। আর বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে খুব কম খরচায় পড়াশোনা করে, সে কথাও সত্য। কিন্তু খরচ কতটা বাড়ালে শিক্ষার মোট ব্যয়ের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে, আর বাংলাদেশের বিপুল নিম্ন-নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর তার প্রভাবই বা কী হবে, তা নিয়ে কোনো কার্যকর গবেষণা ছাড়া বিভিন্ন মহল থেকে যে বেতনভাতা বাড়ানোর আবদার করা হয়, তা কেবল অবৈজ্ঞানিকই নয়, হাস্যকরও বটে। উচ্চশিক্ষা কৌশলপত্রের এই দুই আরজি তাই সতর্কতার সাথে বিবেচ্য।  

বাজার, বিনিয়োগ, মুনাফা, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি ধারণাকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিয়ে যে নীতিমালা তৈরি করেছে বিশ্বব্যাংক, তাতে জীবন-জগত সম্পর্কে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির চরম প্রকাশ ঘটেছে। এ বিশ্বদৃষ্টি আমাদের অচেনা নয়। বিশ্বপুঁজির বর্তমান হাল এবং তার অধীনে সারা বিশ্বকে ঢেলে সাজানোর নানা কায়কসরতও আমরা নিত্য দেখতে পাই। মুশকিল হল, কেবল অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় এ বিশ্বব্যবস্থা চলতে পারে না। কোনো ব্যবস্থাই আসলে চলে না। দরকার হয় ইডিওলজির প্রসার। ভোক্তাকে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে অভ্যস্ত করে তোলা দরকার, যাতে গৃহীত পদক্ষেপ ও জীবনযাপন সম্পর্কে প্রচারিত আদর্শ তার কাছে স্বাভাবিক ও কাঙ্ক্ষিত মনে হতে থাকে। পুঁজিবাজারের গতিবিধি সচল রাখার জন্য প্রান্তের ক্রেতা যেমন দরকার তেমনি দরকার কাঁচামাল। দক্ষ জনশক্তিও এই কাঁচামালেরই অংশ। বিশ্ববাজারে দক্ষ জনশক্তির জোগান অব্যাহত রাখার জন্য গরিব দেশগুলোর দিকে তাকাতেই হয়। এর নানান জটিল হিসাব-নিকাশ আছে। একটা সরল হিসাব এই যে, গরীব দেশে কাজটা করা যায় অনেক কম খরচায়। সারা দুনিয়া থেকে মেধাবী ও দক্ষ লোক বাছাই করে পুঁজির কেন্দ্রীয় কর্মপ্রবাহে যুক্ত করার জরুরত তো আছেই। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রণীত নীতিমালায় যেভাবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়েছে, আর বাজার-বিনিয়োগ-মুনাফার ছকে কথামালা সাজিয়েছে, তাতে হিসাবটা সাদা চোখেই ধরা পড়ে।

কিন্তু এই হিসাবের বড় মুসিবতটা এই যে, বিরাট জনগোষ্ঠী সবসময়েই এই ছকের বাইরে থেকে যাবে। যারা ইতিমধ্যে আর্থিক সক্ষমতা হাসিল করতে পেরেছে, তারাই ওই বড় বাজারের এলাকায় ঢুকতে পারবে। একটা রাষ্ট্র কখনো তার শিক্ষানীতি এভাবে তৈরি করতে পারে না। তারপরেও মেনে নেয়া যাক, এটাও উন্নয়নের একটা মডেল। তাহলেও কাজটা আসলে সরকারকেই করতে হবে। অর্থাৎ, যদি জনগোষ্ঠীর বড় অংশটাকে হিসাবের বাইরে রেখে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা ও বন্দোবস্ত করতে হয়, বাংলাদেশের বাস্তবতায়, আরো অনেক কাল পর্যন্ত কেবল সরকারি খরচে আর সরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজটা করা সম্ভব। গড় আয়ের বর্তমান দশায় নিজের বা অভিভাবকের পয়সায় খরচ জোগানোর মতো পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। একটি উদাহরণ দিলেই আলোচ্য নীতিমালার মুখরোচক কথাবার্তার ফাঁকিটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। পুরো পরিকল্পনায় সরকারি বরাদ্দ কমানোর যুক্তি হিসাবে বারবার উন্নত বিশ্বের কথা বলা হয়েছে – পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। পশ্চিমে এ পদ্ধতি যে একাট্টা সুফল দিয়েছে তা নয়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – সব ক্ষেত্রেই কথিত ‘নিওলিবারেল’ মতাদর্শ ও কর্মসূচির বিস্তর সীমাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে খোদ পুঁজিবাদী বিশ্বেই (Saunders 2010)। কিন্তু ওই দেশগুলোতে কোম্পানিগুলো যে এ বাবদ যথেষ্ট পয়সাকড়ি খরচা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা তো অনুদান হিসাবে এ টাকা জোগায় না। তাদের নানান ধান্দা থাকে এবং সেই ধান্দার বাস্তবতা সে সমাজে বিরাজমান। যেমন, প্রযুক্তিখাতে কোম্পানিগুলো বিপুল বরাদ্দ রাখে শিক্ষার্থীদের গবেষণার ফল ব্যবহার করে বড় দাও মারার জন্য। সব ক্ষেত্রে ফল ফলে না। যা ফলে তাতেই সুদে-আসলে টাকা উঠে আসে। অন্য ক্ষেত্রের গবেষণায় এতটা সরাসরি না হলেও ‘প্রাইভেট’ অংশের মুনাফার হিসাবটা অতি স্পষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে উৎপাদনশীলতার জ্ঞানগত দিকটা পুরোপুরি ধার করা, যেখানে প্যাকিং, সেলাই বা মাল বিক্রিই হল প্রধান উৎপাদন-এলাকা, সেখানে নতুন জ্ঞান-উৎপাদনের জন্য প্রাইভেট বিনিয়োগের সুযোগ কোথায়? কোন ভবিষ্যতে সে সুযোগ তৈরি হবে? তাহলে সরকার বরাদ্দ না বাড়ালে বাড়তি টাকাটা কি সম্পূর্ণরূপে শিক্ষার্থীদের পকেট থেকে আসবে? আগেই বলা হয়েছে, তা সম্ভব নয়। এ কারণেই এ পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত হয়নি। তা কাজও করবে না।

ছবি সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

অথচ বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কিছু অন্যরকম উদ্যোগ নিলে যে উচ্চশিক্ষার অবস্থা ক্রমশ ভালো হওয়ার অবকাশ আছে, তার দিশা এই কৌশলপত্রেই পাওয়া যায়। এখানেই বলা আছে, বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ উন্নত বিশ্ব তো বটেই, আশপাশের দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম। বাজেটে শিক্ষাব্যয় ক্রমশ বাড়িয়ে ভারতের সমান করলেই উচ্চশিক্ষাখাতের সামগ্রিক অর্থব্যবস্থার চিত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার কথা। সরকার গবেষণাখাতে পরিকল্পিতভাবে কিছু অর্থের জোগান দিলে বাংলাদেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় কত বড় পরিবর্তন আসতে পারে, তার একটি সরল হিসাব একবার অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল (২০১১) পত্রিকান্তরে দাখিল করেছিলেন। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে লাফ দিয়ে উঁচুতে ওঠার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, যা অবাস্তব। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম রোধের জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। বলা হয়েছে, শিক্ষাব্যয় বাড়লে দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেয়া হবে। কিন্তু তার পদ্ধতি ও পরিমাণ কী হবে, তা বিদ্যমান পরিস্থিতিতেই পরীক্ষিত হতে পারত। সেই পরীক্ষার ফলের বরাত দিয়ে দরিদ্র মানুষদের আশ্বস্ত করা যেত যে, শিক্ষাব্যয় বাড়লেও তারা এ ছকের বাইরে পড়ে যাবে না। দরিদ্রদের জন্য ঋণসুবিধা প্রবর্তনের লোভ দেখানো হয়েছে। চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেয়ার আগে এ প্রস্তাবের কার্যকরতা পরীক্ষা করা জরুরি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচন যথাসম্ভব কমানোর কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেত। কিছুই না করে পরিকল্পনা ফাঁদা হয়েছে। তাই সন্দেহ হয়, কার্যকর ফললাভ এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য নয়; বরং পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা নির্দিষ্ট ছকে আঁটিয়ে ফেলা আর সবার মধ্যে শিক্ষা-দর্শনের ছলে বিশেষ জীবনাদর্শের প্রসার ঘটানোই এর প্রধান উদ্দেশ্য। এর ফাঁকে শিক্ষাব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন হলে ভালো, না হলেও ক্ষতি নাই।

উপরে দু একটি উদাহরণ দিলাম পদ্ধতিগত খামতির। নীতির দিক থেকেও এর ফাঁকিঝুঁকি বিস্তর। এ পরিকল্পনায় কেবল উচ্চশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কেবল উচ্চশিক্ষা নিয়ে কোনো শিক্ষানীতি হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, বিদ্যমান সরকারি শিক্ষানীতির প্রতি এই কৌশলপত্রের সমর্থন আছে। কিন্তু কিভাবে মূল শিক্ষানীতির সঙ্গে এই উচ্চশিক্ষানীতির সামঞ্জস্য রক্ষিত হবে, তা কোথাও পষ্ট করা হয়নি। বোঝা যায়, উচ্চশিক্ষা-সম্পর্কিত কোনো ‘জাতীয়’ নীতি প্রণয়ন এই কৌশলপত্রের লক্ষ্য ছিল না। একই কথা খাটে শিক্ষার মাধ্যমের বেলায়ও। কোথাও শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ধরেই নেয়া হয়েছে, শিক্ষার মাধ্যম যে ইংরেজি হবে, তা স্থির হয়ে গেছে। পুরো পরিকল্পনায় যে দেশীয় চাহিদা সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয়নি, কেবল বিশ্ববাজারের দোহাই দেয়া হয়েছে, ভাষা প্রসঙ্গটি বিবেচনায় না আনা তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও এর জনগোষ্ঠী বিবেচনায় আসেনি। সবচেয়ে বড় গোলমাল পাকানো হয়েছে কার্যকারণ-সম্পর্ক নির্ধারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতিতে যুক্ত – এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে শিক্ষার মান-অবনয়নের প্রধান কারণ হিসাবে। কিন্তু রাজনীতিকে কারণ হিসাবে না দেখে ফল হিসাবে দেখার যথেষ্ট যুক্তি আছে। এ কৌশলপত্র ব্যাপারটাকে এভাবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি। খুব সরল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাকেই সর্বরোগহর দাওয়াই মনে করেন, তাঁদের এ মত পছন্দ করার কথা। কিন্তু কেউ কেউ এই মনে করাটাকেই সন্দেহের চোখে দেখেন। তাঁদের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনভাতা বৃদ্ধিসহ অন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে সংগঠিত ছাত্র-আন্দোলন ঠেকানোর জন্যই ছাত্র-রাজনীতি বন্ধের এই তোড়জোড়। রাজনীতি উচ্চশিক্ষার পরিবেশ কিভাবে বিঘ্নিত করছে, আলোচ্য কৌশলপত্রে তার উল্লেখ না থাকায়, এই ধারণা সত্য বলেই মনে হয়। ভালো শিক্ষা পেতে হলে বেশি টাকা খরচা করতে হবে – এই চিন্তাও আপাতদৃষ্টিতে যতটা যৌক্তিক ও সাধু মনে হয়, ততটা যৌক্তিকও নয়, সাধুও নয়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দেয়া হয়। কিন্তু শিল্পোন্নত বিশ্বে নিজে রোজগার করে উচ্চশিক্ষা নেয়ার যে রেওয়াজ ও বাস্তবতা বিদ্যমান, বাংলাদেশে তা কল্পনাতীত। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মকানুনও এর উপযোগী নয়। আগেই বলা হয়েছে, ব্যবসায়ী বা প্রাইভেট কোম্পানি উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করবে – এমন কোনো বাস্তবতা বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্ব-অর্থায়নের প্রস্তাব, যা আদতে ছাত্রবেতন বাড়ানোরই প্রস্তাব, অযৌক্তিক ও জবরদস্তিপূর্ণ।   

কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে সামাজিক সম্মতির দরকার হয়। সামাজিক সম্মতি আসে বাস্তবতা থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির যে কোনো প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই যে আন্দোলন জমে ওঠে, তার কারণ নিশ্চয়ই নৈতিকতা ও সৌজন্যবোধের অভাব নয়। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর জন্য – যত কমই হোক – বাড়তি ব্যয় মেটানো কঠিন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের ওপর একটা দায়সারা গোছের জরিপ হলেই ধরা পড়বে, এখানকার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী আসে গ্রাম থেকে; এবং বেশির ভাগেরই আর্থিক স্তর তলানির দিকে। সমাজবিকাশের দিক থেকে এই বাস্তবতার তাৎপর্য অসীম। দরিদ্র বাবা-মায়ের কোনো সন্তান মেধার জোরে, ধারদেনা করে বা অন্যের সহায়তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মাত্রই পুরো পরিবারটি মধ্যবিত্ত কাতারভুক্ত হয়ে যায়। শিল্পায়নের বেহাল দশার কারণে অন্য কোনো পথেই এই সামাজিক বিকাশের পরিকল্পনা করা যায় না। জনগোষ্ঠীর এই ক্রমবিকাশকে ‘বাজার-বিনিয়োগ-মুনাফা-প্রতিযোগিতা’র ছকে আঁটানো যাবে না। অবশ্য, পুঁজিবাজারে যোগ্য স্নাতক সরবরাহ করাই যদি আমাদের উচ্চশিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হয়, আর তাতে জাতি লাভবান হবে মর্মে যদি সবার সম্মতি তৈরি হয়, তাহলে আলাদা কথা।

এডুকেশন ইজ অ্যা ওয়ে অফ ফ্রিডম, ছবি সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

৫ 

তার মানে এই নয় যে, উচ্চশিক্ষার বিদ্যমান দশায় আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের পরিবর্তন দরকার। আর সেই পরিবর্তনের জন্য পরিকল্পনাও দরকার। তবে পরিকল্পনাটা হবে সামষ্টিক ও সামগ্রিক। উচ্চশিক্ষা হবে সামগ্রিক শিক্ষা-পরিকল্পনার অংশমাত্র। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান করণীয় তিনটি: এক. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, দুই. ইংরেজি-বাংলা-আরবি তিন মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং তিন. মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিমূলক-তত্ত্বীয় ভাগাভাগি কার্যকর করা। যোগ্য নাগরিকদের পরামর্শে সরকারি অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় এ কাজ করতে হবে। বিদ্যমান অবকাঠামো, সিলেবাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অক্ষুণ্ন রেখেই উচ্চশিক্ষার মান-উন্নয়নের জন্য বিস্তর কাজের অবকাশ আছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান যতটা খারাপ, সরকারি এনতেজাম কিন্তু অত খারাপ না। কেবল গবেষণা বলে যে একটা বস্তু উচ্চশিক্ষার অপরিহার্য অংশ, তা সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলগুলো এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। এই বরাদ্দ বাড়িয়ে বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে মান-উন্নয়নের চেষ্টা চালানো দরকার। সরকারের শিক্ষা-বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি ওঠা দরকার। কোনো অযৌক্তিক পরিমাণে নয়, পাশের দেশগুলোর সমান বরাদ্দ নিশ্চিত করা গেলেই অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ-বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। ইউজিসির কৌশলপত্রে ২০২৫ সালের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থী বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তারা কোন জরিপের ভিত্তিতে সংখ্যাটা নির্ধারণ করল তা স্পষ্ট নয়। অথচ এর বরাতে ছাত্রবেতন বৃদ্ধি আর প্রাইভেট-পাবলিক অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। কার্যত, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের বাস্তবতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। সরকারি বরাদ্দের ভিত্তিতেই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। উচ্চশিক্ষার বিস্তারটা হবে সরকারি বরাদ্দের অনুপাতে।

‘উচ্চশিক্ষার মান-উন্নয়ন প্রকল্প’ (হেকেপ)-এর অধীনে ইতিমধ্যেই শিক্ষকদের মধ্যে টাকা বণ্টন করা হয়েছে। নব্য-উদারনীতিবাদী শিক্ষার মূল দর্শনের সাথে এ উদ্যোগ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নয়া শিক্ষাদর্শনে শিক্ষকের ভূমিকা মূলত প্রশিক্ষকের। শিক্ষক দক্ষ হবেন; তাঁর জন্য প্রশিক্ষণ দরকার – গবেষণা বা পাণ্ডিত্য নয়। তিনি ভালো ব্যবস্থাপক হবেন যেন শিক্ষার ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করে বাজারে পাঠাতে পারেন। একজন বিশ্লেষক বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টগুলোর পর্যালোচনাসূত্রে লিখেছেন:

This diagnosis identifies teachers and their traditional protections as the obstacle to market-based efficiencies. In its future scenario, higher education would become less dependent upon teachers’ skills. Students would become customers or clients. As the implicit aim, private investors would have greater opportunities to profit from state expenditure, while influencing the form and content of education. Business and university administrators would become the main partnership, redefining student-teacher relations. (Levidow 2002)

ইউজিসির কৌশলপত্রের পরিকল্পনা ও ভাষাভঙ্গিতে উপরোল্লিখিত নীতির প্রতিফলনই আছে। সে দিক থেকে গবেষণার নামে টাকা বিতরণ সন্দেহজনক। বিশেষত, কাঠামোগত উন্নয়ন না করে ব্যক্তিগত খাতে বরাদ্দ করায় মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, সম্ভাব্য প্রতিরোধ বা বিরোধিতাকারী হিসাবে শিক্ষকসমাজকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যই এ ব্যবস্থা। তবুও ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ ভালো কাজও হয়ত করবেন। কিন্তু গবেষণা কিছুতেই ব্যক্তিগত হতে পারে না। প্রতিষ্ঠান গড়তে হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক প্রতিষ্ঠান মানসম্মতভাবে গবেষণার উপযোগী করে তোলা হয়ত এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় – সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় –  বিদ্যমান অবকাঠামোর মধ্যেই গৃহীত হতে পারে গবেষণার বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে। তাতে কম বিনিয়োগে বেশি সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা।

 নব্য-উদারনীতিবাদী বিশ্বব্যবস্থা পৃথিবীর নানা প্রান্তে বহু ধরনের বিরোধের মুখোমুখি হয়েছে। বিরোধিতার প্রধান দিক বণ্টনের অসাম্য। দার্শনিক দিক থেকে মূল অভিযোগ শত শত বছরের মানবিক অর্জন পরিহার করে মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যক্তিবাদী ধ্যানধারণার বিস্তার। অনেকেই লক্ষ করেছেন, নব্য-উদারনীতিবাদীদের যুক্তিগুলো বেশ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন; এবং অনেক সময়েই পরস্পরবিরোধী। পিয়েরে বুর্দো যেমন বলেছেন, , ‘[Neoliberalism is] A programme for destroying collective structures which may impede the pure market logic.’ (Bourdieu 1998)  বাংলাদেশের মতো প্রান্তীয় দেশে অবশ্য পশ্চিমা বিশ্বের হিসাব খাপে খাপে মিলবে না। তবে উচ্চশিক্ষানীতির মতো খুব কেজো এলাকায় বিশ্বব্যাংকের খবরদারি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার একটা খুব গভীর তাৎপর্য আছে। আজতক যাঁরা পৃথিবীর দেশে দেশে এই বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে নানাভাবে সোচ্চার হয়েছেন, তাঁরা মূলত কাজ করেছেন বিরোধিতার আকারে। বিকল্প কর্মপদ্ধতি প্রস্তাব করতে দ্বিধা দেখিয়েছেন। কারণটি খুবই বোধগম্য। সারা দুনিয়াজুড়ে সক্রিয় এই দানবীয় শক্তিকে রোখার জন্য দানবীয় আয়োজন সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় বিশেষ স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে গৃহীত নীতির পর্যালোচনা আর সক্রিয় বিরোধিতা একদিকে পুঁজির পাগলা ঘোড়ায় খানিকটা লাগাম পরাতে পারে, অন্যদিকে বিশেষ স্থান-কালের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত তত্ত্ব ও প্রণালিপদ্ধতি সার্বিক তত্ত্বায়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

করার আছে অনেক কিছুই। কিন্তু ইউজিসির কৌশলপত্রের মতো রাষ্ট্রবিরোধী, জনবিরোধী আর অবাস্তব নথি কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর সচেতনতা ও সক্রিয়তা দরকার।

তথ্যসূত্র

মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২০১১, ‘মাত্র এক হাজার পিএইচ ডি’, প্রথম আলো, ৬ জুন, ঢাকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৬, রচনাবলি, তৃতীয় মুদ্রণ, ঐতিহ্য, ঢাকা
ইউজিসি ২০০৫, Strategic Plan for Higher Education in Bangladesh: 2005-2025, University Grant Commission, Dhaka
Bourdieu, Pierre 1998, ‘What is neoliberalism? A programme for destroying collective structures which may impede the pure market logic’, Le Monde diplomatique, English Edition, French                                      
Johnstone, D. Bruce, Arora, A. and Experton, W. 1998, The Financing and Management of Higher Education: A Status Report on Worldwide Reforms, Washington, D.C.: World Bank, Departmental Working Paper, http://www-wds.worldbank.org
Levidow, Les 2002, ‘Marketizing Higher Education: Neoliberal Strategies and Counter-Strategies’, Published in K.Robins and F.Webster, eds, The Virtual University? Knowledge, Markets and Management, Oxford, UK, Oxford University Press, pp.227-48
Martinez, Elizabeth and Garcia, Arnoldo 1996, ‘What is Neoliberalism? A Brief Definition for Activists’,  Corp Watch, San Francisco
Saad-Filho, Alfredo and Deborah Johnston 2005, ‘Introduction’, Neoliberalism – A Critical Reader, Pluto Press, London
Saunders, Daniel B. 2010, ‘Neoliberal Ideology and Public Higher Education in the United States’, Journal for Critical Education Policy Studies, vol.8. no.1 
International Journal of Qualitative Studies in Education, Volume 20Issue 3, 2007

  • প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল ‘বাংলার পাঠশালা’ আয়োজিত দক্ষিণ এশীয় সেমিনার ২০১৪-এ। ২২ আগস্ট ২০১৪ তারিখে স্বতন্ত্র পুস্তিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *