দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটি প্রণীত সরকারী ত্রাণ মনিটরিং ২য় রিপোর্ট

প্রকাশের তারিখ: ২৩শে মে ২০২০
(প্রথম রিপোর্ট উপস্থাপনের তারিখ: ৩০শে এপ্রিল ২০২০)
টিম মেম্বার:
চারু হক, রাখাল রাহা, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, গাওহর নঈম ওয়ারা, হাসিবউদ্দিন হোসাইন
সম্পাদনা: রাখাল রাহা, সদস্য সচিব্, দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটি

রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু কথা

১. সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত ৩০শে মার্চ থেকে দেশের ৬৪টি জেলার জন্য “করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিকভাবে মানবিক সহায়তা হিসাবে বিতরণের নিমিত্ত” চাল ও নগদ অর্থ এবং ৬ই এপ্রিল থেকে শিশুখাদ্য ক্রয় বাবদ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া সেই তথ্যগুলোই মূলত এই রিপোর্টের প্রধান সূত্র।

২. দ্বিতীয় হচ্ছে ২০১৬ সালে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপে জেলাওয়ারী দরিদ্র হার নির্ণয় করা হয়েছিল। এই রিপোর্টে জেলাওয়ারী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নির্ণয়ে সেটার উচ্চসীমাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

৩. তৃতীয় হচ্ছে ২০১১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৬ শো ৯৭। একে ভিত্তি ধরে ২০১৭ সালে সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২০ সালের জন্য প্রত্যাশিত জনসংখ্যার যে হিসাব প্রকাশ করেছিল (১৬ কোটি ৯৫ লক্ষ ৪০ হাজার, পৃষ্ঠা ১০৫) সেই হিসাব অনুযায়ী জেলাওয়ারী জনসংখ্যা বণ্টন করা হয়েছে, এবং সেই জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাওয়ারী দরিদ্র জনসংখ্যা বের করা হয়েছে।

৪. যদিও মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি বরাদ্দ আদেশে মহানগরীযুক্ত জেলাগুলোর ক্ষেত্রে বরাদ্দটা ২ ভাগে ভাগ করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু এ যাবত দেওয়া মোট বরাদ্দ দেখাতে জেলা ও মহানগরী একত্র করেই জেলার বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। তাছাড়া খানা জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দরিদ্রহারগুলো যেহেতু পুরো জেলার ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে, সেকারণে মহানগরীর বিশ্লেষণ এই প্রতিবেদনে পৃথকভাবে ততোটা করা হয়নি। পরবর্তী প্রতিবেদনে আমরা মহানগরীর চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা করবো।

৫. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বাইরে থেকে যেটুকু সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা এই রিপোর্টে বিবেচনায় আনা হয়নি। তবে এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মূল বরাদ্দটা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই দেওয়া হচ্ছে। 

৬. এই রিপোর্টে শুধু বরাদ্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বরাদ্দ কিভাবে বণ্টন হচ্ছে, প্রকৃত ভুক্তভোগীদের হাতে যাচ্ছে কিনা, বা যতোটুকু যাওয়ার কথা তা যাচ্ছে কিনা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা এতে নেই। এগুলো নিয়ে দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে ভিন্ন আরেকটি রিপোর্ট তৈরীর কাজ চলছে।

তথ্য পর্যালোচনা:

সরকারের চাল বিতরণের ছবি দেখলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, জেলাগুলোকে দুই স্তরে ভাগ করা হয়েছে। পরিমাণগত দিক দিয়ে বেশী দরিদ্র জেলা, যেখানে অন্তত দশ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে (গাইবান্ধা বাদে), সেখানে চালের মোট বরাদ্দ পরিমাণগত দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে বেশী বলা যায় (প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিক টন)। কিন্তু যখন আমরা জনপ্রতি বরাদ্দের ছবি দেখি তখন বুঝতে পারি যে ত্রাণটা কত অপ্রতুল। আর দরিদ্রতম ৫টা জেলার জন্যে তা বিপরীত্যানুপাতিক। আবার জেলার মোট দরিদ্রসংখ্যা কম হলেই যে বরাদ্দ সবসময় কম দেওয়া হয়েছে সর্বক্ষেত্রে তাও বলার সুযোগ নেই। যেমন ফরিদপুরের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নীলফামারী বা লালমনিরহাট জেলার প্রায় তিন ভাগের একভাগ। কিন্তু ফরিদপুরের বরাদ্দ নীলফামারী বা লালমনিরহাটের চেয়ে প্রায় ৭০০ মেট্রিক টন বেশী। ফেনীর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা নীলফামারী বা লালমনিরহাট জেলার প্রায় চার ভাগের একভাগ। কিন্তু ফেনীর বরাদ্দ নীলফামারী বা লালমনিরহাটের চেয়ে প্রায় ৪০০ মেট্রিক টন বেশী।

অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যে দুই জেলায় সবচাইতে কম (মাদারীপুর এবং মুন্সীগঞ্জ), সে দুই জেলায় মাথাপিছু চাল বরাদ্দ যখন প্রায় পঁয়ত্রিশ কেজি তখন সবচাইতে বেশী দরিদ্র মানুষের যে তিনটি জেলা, সেখানে মাথাপিছু গড়ে দেড় কেজিরও কম চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।   

অর্থবরাদ্দের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। দৃশ্যত মনে হয় বরাদ্দটা দেয়া হয়েছে তিন ধাপে এবং দরিদ্রতম জেলাগুলো অগ্রাধিকার পাওয়া জেলাগুলোর প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপেই আছে। কিন্তু খেয়াল করলে এখানেও বরাদ্দের অপ্রতুলতা এবং দারিদ্রের সংখ্যাধিক্যের সাথে তার চরম বৈপরীত্য চোখে পড়ে। মোট দরিদ্রসংখ্যা কম থাকলেও বরাদ্দে অগ্রাধিকার পেয়েছে বেশ কিছু জেলা, যেমন ফেনী, বাহ্মণবাড়ীয়া, হবিগঞ্জ, ইত্যাদি। এসব জেলার দরিদ্রসংখ্যা জামালপুর, গাইবান্ধা বা নীলফামারীর চেয়ে কয়েক গুণ কম। কিন্তু সেখানে বরাদ্দ জামালপুর, গাইবান্ধা বা নীলফামারীর চেয়ে প্রায় এক পঞ্চমাংশ বেশী। এখানেও মুন্সীগঞ্জ এবং মাদারীপুরে জনপ্রতি বরাদ্দ যথাক্রমে ১৭৫ এবং ১২৬ টাকা, যখন সবচেয়ে দরিদ্র সংখ্যাধিক্যের জেলা দিনাজপুর পাচ্ছে জনপ্রতি মাত্র সাড়ে ৫ টাকা।    

এবার দেখা যাক মহানগর থাকা জেলাগুলোর কি অবস্থা:  

এখানেও লক্ষ্যণীয়, মহানগর থাকা জেলাগুলোর মধ্যে সবচাইতে কম দরিদ্র মানুষ যে দুই জেলায় সেই দুই জেলায় টাকা এবং চাল দুটোতেই ত্রাণ এর পরিমাণ সর্বোচ্চ। এর একটা যুক্তি হতে পারে যে, নারায়ণগঞ্জ যেহেতু করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত জেলা সুতরাং সেখানে বরাদ্দ বেশী হবে। কিন্তু ঢাকা বা চট্টগ্রামও ব্যাপকভাবে করোনা আক্রান্ত মহানগর ও জেলা। এখানকার দরিদ্রপ্রতি বরাদ্দ নারায়ণগঞ্জের চেয়ে কয়েক গুণ কম। সুতরাং বরাদ্দের ক্ষেত্রে করোনার বিস্তৃতি বিবেচিত হয়েছে এটা বলার কোনো উপায় নেই।

অনুসিদ্ধান্ত

১. এখন পর্যন্ত সরকারের বরাদ্দ আদেশ অনুযায়ী (১৪ই মে ২০২০) সারাদেশের ৬৪টি জেলায় মোট ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৮শো ১৭ মেট্রিক টন চাল, ৭২ কোটি ৩৩ লক্ষ ৭২ হাজার ২ শো ৬৪ নগদ টাকা এবং শিশুখাদ্য ক্রয় বাবদ ১৯ কোটি ১৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। 

২. সরকারের চাল ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী ৩৬ টাকা কেজি ধরলে ১৪ই মে পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার জন্য চাল (৫৮৬,১৪,১২,০০০ টাকা), অর্থ ও শিশুখাদ্য বাবদ সর্বমোট ত্রাণ বরাদ্দ ৬৭৭ কোটি ৬১ লক্ষ ৮৪ হাজার ২ শো ৬৪ টাকা। 

৩. ২০১৬ সালের খানা জরিপের দরিদ্র হার এবং বর্তমানে দেশের সম্ভাব্য জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ১৭ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯শো ৪৫। অর্থাৎ মোট দরিদ্র জনসংখ্যার মাথাপিছু এখন পর্যন্ত (১৪ই মে) সর্বমোট বরাদ্দ মাত্র ১৬২.২০ টাকা (চাল, অর্থ ও শিশুখাদ্য মিলিয়ে)। গত ১লা এপ্রিল থেকে ১৪ই মে, অর্থাৎ প্রায় দেড় মাসে, এমন কর্মহীন স্থবির অবস্থায় দরিদ্র মানুষের জন্য মাথাপিছু এই বরাদ্দ উদ্বেগজনক। 

৪. শিশুখাদ্য ক্রয় বাবদ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ৬৪টি জেলার জন্য মোট ২৩ লাখ, ২৪ লাখ ও ৩৬ লাখ—এই ৩টি অঙ্কই ঘুরেফিরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বরাদ্দ জেলাগুলোর শিশুসংখ্যা বা দরিদ্র জনসংখ্যা বা মোট জনসংখ্যা বিবেচনা করে দেওয়া হয়েছে এমনটা বলার সুযোগ নেই। যেমন সাতক্ষীরা জেলার লোকসংখ্যা, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দুটোই কুষ্টিয়া থেকে বেশী। কিন্তু এ পর্যন্ত সাতক্ষীরার শিশুখাদ্য বরাদ্দ ২৪ লক্ষ টাকা এবং কুষ্টিয়ার বরাদ্দ ৩৬ লক্ষ টাকা। মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ শিশু ধরলে সাতক্ষীরায় শিশুসংখ্যা সাড়ে ৪ লক্ষের অধিক। তাহলে শিশুদের মাথাপিছু এ যাবত বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৫ টাকা। কুষ্টিয়ার ক্ষেত্রে সেটা হবে প্রায় সাড়ে ৮ টাকা। বরাদ্দ হিসাবে এটা এতোটাই নগণ্য যে সেটা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয় হচ্ছে এ ধরণের থোক বরাদ্দ কিভাবে ব্যয় হবে এবং তা শিশুর জন্য কতটা কল্যাণ করতে পারবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

৫. দেশের প্রায় সোয়া ৪ কোটি দরিদ্র মানুষকে করোনা দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে সরকার সর্বমোট প্রায় পৌণে ৭ শো কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তা অর্থনীতি অন্যান্য খাতের নানা বিষয়ের সাথে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। সরকার গত বছর একটি কোম্পানীর ট্যাক্স মওকুফ করেছে প্রায় ৩১৭০ কোটি টাকা, যা সর্বমোট ত্রাণ বরাদ্দের প্রায় সাড়ে ৪ গুণ [সূত্র: নিউ নেশন, ২১শে ফেব্রুয়ারী ২০১৯]। গত এক বছরে বেসরকারী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, যা সর্বমোট ত্রাণ বরাদ্দের প্রায় ১৩ গুণেরও বেশী [সূত্র: প্রথম আলো, ১৮ই মে ২০২০]। আর এর চেয়ে ১০০ গুণ বেশী টাকা প্রতিবছর দেশ থেকে নানাভাবে পাচার হতে দেওয়া হয়।

৬. ২৩শে এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত বরাদ্দের ভিত্তিতে মনিটরিং কমিটির প্রথম রিপোর্টে যে অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়েছিল, যে জেলা যতো গরীব সেই জেলায় ততো কম ত্রাণ, প্রায় তিন সপ্তাহ পরেও তার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। জেলাগুলোর ‍দরিদ্রহারের সাথে দরিদ্র-মাথাপিছু ত্রাণ বরাদ্দের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। 

টেবিল ২: সবচেয়ে দরিদ্র ও সবচেয়ে কম দরিদ্র ৫টি জেলার চিত্র।

টেবিল থেকে আমরা দেখতে পাই, ২০১৬ সালের খানা জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র ৫টি জেলা হচ্ছে কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, বান্দরবান, মাগুরা ও কিশোরগঞ্জ। ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত এই জেলাগুলির দরিদ্রদের মাথাপিছু চাল বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৮৭০ গ্রাম, ৬৫০ গ্রাম, ৩ কেজি ৯৯০ গ্রাম, ১ কেজি ৫৩০ গ্রাম এবং ৯২০ গ্রাম! এখন সেটা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১ কেজি ৪৮০ গ্রাম, ১ কেজি ১৪০ গ্রাম, ৬ কেজি ৪১০ গ্রাম, ২ কেজি ৬৭০ গ্রাম এবং ১ কেজি ৫০০ গ্রাম। 

একইভাবে এই জেলাগুলিতে ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত দরিদ্রদের মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৩.৮৫ টাকা, ৩.০০ টাকা, ১৮.১৪ টাকা, ৫.৯৬ টাকা এবং ৩.৭৬ টাকা। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭.১০ টাকা, ৫.৫০ টাকা, ৩২.৭০ টাকা, ১০.৫০ টাকা এবং ৬.৮০ টাকা।

অন্যদিকে খানা জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের দারিদ্র্যহারে সর্বনিম্ন ৫টি জেলা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গাজীপুর ও ফরিদপুর। ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত এই জেলাগুলির দরিদ্রদের মাথাপিছু চাল বরাদ্ধ ছিল যথাক্রমে ২২কেজি ৫৬০ গ্রাম, ২১ কেজি ৫২০ গ্রাম, ২০ কেজি ৯৭০ গ্রাম, ৬ কেজি ৯২০ গ্রাম এবং ৮ কেজি ৪০০ গ্রাম! এখন সেটা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪৬ কেজি ৩৮৫ গ্রাম, ৩৪ কেজি ৭৯০ গ্রাম, ৩৪ কেজি ৭৬০ গ্রাম, ১৩ কেজি ২৫৫ গ্রাম, ১৪ কেজি ৪৬০ গ্রাম।

একইভাবে এই জেলাগুলিতে ২৩শে এপ্রিল পর্যন্ত দরিদ্রদের মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৮৮.১৭ টাকা, ৯৫.৮৩ টাকা, ৭০.৮৯ টাকা, ২৯.৮৮ টাকা এবং ৩৮.৩৮ টাকা। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৬৫.৭৫ টাকা, ১৭৫.৪৫ টাকা, ১২৬.০০ টাকা, ৫৫.২০ টাকা এবং ৭০.৭০ টাকা।

আমাদের প্রস্তাব

যেহেতু ত্রাণ বরাদ্দ এবং দুর্যোগ পরিস্থিতির কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি তাই গত প্রতিবেদনে আমরা কমিটির পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব করেছিলাম, একটু সংযোজন-বিয়োজনসহ সেগুলোকেই এই প্রতিবেদনের প্রস্তাব হিসাবে বিবেচনা করছি।

১. সকল  বরাদ্দ হতে হবে প্রান্তিক জনসংখ্যার ভিত্তিতে। শারীরিক দূরত্ব, দুর্নীতিরোধ, প্রয়োজন ইত্যাদি মাথায় রেখে বিবিএস-এর খানা জরিপের ভিত্তিতে যতদিন দুর্যোগ থাকবে প্রত্যেক মাসে দরিদ্র এবং কর্মহীন প্রতিটি পরিবারকে একবারে ৩০ কেজি চাল এবং নগদ ১০ হাজার টাকা মোবাইলের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে হবে। 

২. প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ভাসমান মানুষ, উপকূলীয় জনগোষ্ঠী, যাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নাই, যাদের তথ্য খানাজরিপেও নাই, তাদের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হবে। দুর্যোগের কারণে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছে। তাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে।

৩. ত্রাণ সহায়তা বিতরণে সকল রকমের অনিয়ম, দুর্নীতি, দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি দূর করতে হবে। এর জন্য মিডিয়া ও সোসাল মিডিয়ার উপর থেকে অন্যায় খবরদারী প্রত্যাহার করতে হবে, যাতে করে যে কোনো ধরণের অনিয়মের চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত পেতে পারেন। 

৪. এ সময় ধান, সবজি ও ফলের মৌসুম। এগুলোর উত্তোলন ও সরবরাহ চ্যানেল সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন ও হয়রানি মুক্ত করতে হবে। দুধ-ডিম-পোলট্রির উৎপাদন ও সরবরাহ চ্যানেল স্বাভাবিক করতে হবে। 

৫. ঘূর্ণিঝড় আমফান কারোনা দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষকে আরো বিপন্ন করেছে। সুতরাং এ সময়ে সকল বরাদ্দ এবং তার বণ্টনব্যবস্থা যথাযথ হওয়া প্রয়োজন। না হলে দেশ আরো সংকটগ্রস্ত হতে পারে, মানবিক সংকট আরো ঘণীভূত হতে পারে।

৬. এ সময়ে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। তার মৌলিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করার জন্য সত্যিকারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।  

পরিশেষে আমরা বলতে চাই, আঞ্চলিক বৈষম্য একটা দেশের মধ্যে কি পরিমাণ অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমরা পাকিস্তান আমলে দেখেছি। এর ভুক্তভোগী আমরা ছিলাম তথন প্রায় ৭ কোটি মানুষ। আজ ১৮ কোটি মানুষের দেশ স্বাধীন বাংলাদেশে এটা কাম্য নয়। রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে যেসব অঞ্চলের মানুষের প্রাধান্য রয়েছে এর সাথে বাংলাদেশের জেলাগুলোর দরিদ্রহার কম-বেশী থাকার একটা সম্পর্ক কম-বেশী দেখা যাবে। ত্রাণ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও এটার ছাপ কম-বেশী রয়েছে, যা দুর্যোগকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে বলে আমরা গত প্রতিবেদনের মতো এবারও আশঙ্কা প্রকাশ করছি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান রাখছি।

তথ্যসূত্র:
দারিদ্র্যহার, ২০১৬ সালের খানা জরিপ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
প্রজেক্টেড/ প্রত্যাশিতজনসংখ্যা (২০০১-২০৫১), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান পকেটবই ২০১৭, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
চাল, অর্থ ও শিশু খাদ্য বরাদ্দ
সংক্রান্ত আদেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় 

অনলাইন সংবাদ সম্মেলন প্রসঙ্গে

দুই দফায় হওয়া আজকের মিটিংএ সঞ্চালনা করেছেন দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব রাখাল রাহা। মিটিং-এ আরও উপস্থিত ছিলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন আহমেদ, শহিদুল আলম, জাকির হোসেন, রাখাল রাহা, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া , মোশাহিদা সুলতানা ঋতু, জাহেদ ইকবাল, গাওহর নঈম ওয়ারা, শামসুল হুদা, আনু মোহাম্মদ, হাসিব উদ্দিন হোসাইন, বাকী বিল্লাহ, হাসনাত কাইয়ূম, দীপক সুমন, চারু হক এবং অন্যান্যরা।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *