- ফরিদুল হক
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এই গণবিরোধী আইন এখন পুরোপুরিই এখানকার মানুষের ‘নিঃশ্বাস বন্ধে’র সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে। এইরকম গণবিরোধী আইন বাংলাদেশে নতুন নয়। তাই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আইন বাতিলের দাবীতে আন্দোলোনও নতুন নয়। কিন্তু এবারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবীর পাশাপাশি বেশ জোরেশোরেই আলাপ উঠেছে যে, আজকে আমাদের সামনে শুধুমাত্র আইন বাতিলের লড়াই নয়। এর সাথে সাথে এইরকম গণবিরোধী আইন বানানোর ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা ও ব্যবস্থাকে বদলানোরও লড়াই।
বৃটিশরা এইখানে দুইশো বছর উপনিবেশ বানিয়ে শাসন করেছে প্রধানত আইন ও শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে। আর সেই শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের শিখিয়েছে আইনের চোখে সবাই সমান ও আইনের শাসন ভালো শাসন টাইপ মুখস্ত বুলি। সেই বৃটিশ পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া উপনিবেশিক আইন, আইনি দর্শন আর শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন দেশেও বহাল, তাই এখনো আইন একেকজনের সাথে একেকরকম আচরণ করলে আমরা মনেকরি আইনের ‘অপপ্রয়োগ’ হচ্ছে আর শাসন আমাদের চোখে ন্যায্য মনে না হলে আমরা মনেকরি ‘আইনের শাসন’ নেই।
কিন্তু আইন কি আসলেই সবার জন্য সমান? আইনের শাসন কিভাবে কাজ করে? আইন কারা বানায়? কিসের উপরে ভিত্তি করে আইন বানানো হয়? আইন কি শুধু দেওয়ানি-ফৌজদারি নাকি এর বাইরেও কিছু আছে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এইসব আইন বানানোর ক্ষমতাকাঠামো আসলে কেমন কিংবা কোথায়? মোটাদাগে আইন সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে সেইরকম আলাপ নেই বললেই চলে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসবের উত্তরও সেভাবে নেই।
রাষ্ট্রের আইন বানানোর প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মূলত আইন বিভাগ যাকে আমরা জাতীয় সংসদ নামে জানি। আর সংসদের কাছে এই আইন বানানোর ক্ষমতা তুলে দিয়েছ বাংলাদেশের সংবিধান। সংসদ যেসব আইন বানায় তাঁর প্রায় সবগুলোই বানায় সংবিধান নির্ধারিত পথে ও সংবিধানের ঠিক করে দেয়া ক্ষমতাবলে। আর এর বাইরেও যেসব বিধি-বিধান বা অধ্যাদেশ তৈরি হয় বা দেয়া হয় সেগুলোও সংসদের আইনের দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই করে বা দেয় নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মানে সেগুলোরও আল্টিমেইট ক্ষমতা থাকে সেই সংসদের হাতেই।
বাংলাদেশের সংবিধানে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রতিটি আইন সংসদে ‘বিল’ আকারে উত্থাপিত হবে এবং সংসদ কর্তৃক পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হবে এবং অর্থবিল ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে তিনি তা পুনর্বিবেচনা কিংবা কোন সংশোধনী বিবেচনার জন্য সংসদের পাঠাতে পারবেন। সংসদ এক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিবেচনাসহ বা ছাড়া বিলটি পুনরায় পাস করে রাষ্ট্রপতির নিকটে প্রেরণ করলে তিনি স্বাক্ষর করুন বা না করুন নির্দিষ্ট সময় পরে বিলটি ‘আইনে’ পরিণত হবে।
তারমানে দাঁড়ায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন বানানোর প্রতিষ্ঠান যে জাতীয় সংসদ, তারা আইন বানানোর ক্ষেত্রে পুরোপুরিই স্বাধীন। সাধারন সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই সংসদ যেকোনো আইনই বানাতে পারে। অবশ্য মানুষের ট্যাক্সের টাকায় মিনিটে কয়েকলক্ষ টাকা খরচ করা সংসদ সেগুলো করে ৭০ অনুচ্ছেদবলে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে ও ইচ্ছায়। আইন বানাতে পারার এইযে একচ্ছত্র ক্ষমতা সেটা এই রাষ্ট্রের শুরু থেকেই একইরকম। বাংলাদেশের সংবিধান শুরু থেকেই আইন বানানোর ক্ষমতা যেমন একব্যক্তির হাতে দিয়ে রেখেছে তেমনি কখনো ওই একব্যক্তির হাতে যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য থাকে তাহলে এমনকি সংবিধানকেও সে তাঁর ইচ্ছামতো বদল করার ক্ষমতাও দিয়ে রেখেছে।
সেরকমই একটা ‘ইচ্ছামতো বদল’ হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। সেই সংশোধনীতে বাতিল করে দেয়া হয় এখানকার মানুষের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা ভোটের অধিকার প্রয়োগের তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে। অর্থাৎ মানুষের অন্তত পনেরো বছরের লড়াইয়ের ফসল ছিলো যে তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা সেটা আদালতের রায়ের নামে কয়েকজন বিচারকের কলমের খোচায় প্রথমে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হয়। এবং পরবর্তীতে মানুষ লড়াই করে যে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করেছিলো সেইটা মানুষের মতামত না নিয়ে কিংবা উপেক্ষা করেই সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়া হয়।
তারমানে আইন তৈরি হোক বা একই প্রক্রিয়ায় সংবিধানের বদল হোক কোথাও রাষ্ট্রপতির আসলে তেমন কিছু করার নেই। মানুষের ভোটে সংসদের পাঠানো প্রতিনিধিকেও ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে একব্যক্তির ইচ্ছায় আটকে রাখা হয়েছে। আর রাষ্ট্রের অন্যকোন প্রতিষ্ঠানও আইন কিংবা আইন তৈরির ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ার রাখেনা। এমনকি বেশিরভাগ গণবিরোধী আইনকেই দায়মুক্তি দেয়া থাকে হয় সেই আইন সম্পর্কে অথবা এর কার্যকলাপ সম্পর্কে আদালতেও যাওয়া যায়না। আর পুরো সংবিধান ঘেটেও আইন বানানো নিয়ে নাগরিকের সরাসরি প্রশ্ন করা, প্রস্তাব দেয়া কিংবা বাধা দেয়ার কোনো ব্যবস্থাই কোথাও পাওয়া যাবেনা।
আমরা জানি ২০১৮ কিংবা ২০১৪ এর নির্বাচনে ভোট ডাকাতি কিংবা বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ সরকার যতই আইন ও সংবিধানের চোখে ‘বৈধ’ হোক না কেন মানুষ এদেরকে নৈতিকভাবে বৈধতা দেয়না। তাই এদের বানানো কোনো আইনকেও এখানকার মানুষ নৈতিক বৈধতা দেয়না। আর সেই রাতের ভোটের ‘নির্বাচিত’ সংসদ আর ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে ‘নির্বাচিত’ সংসদের নামে গত কয়েক বছরে একের পর এক গণবিরোধী আইন তৈরি হয়েছে। সেইসব আইন একদিকে যেমন লুটপাটের ব্যবস্থা মসৃণ করেছে তেমনি পরিবেশ ধংসের আয়োজন সম্পন্ন করেছে। আর এসবের বিরুদ্ধের যখনই একদমই নিরুপায় হয়ে যারা কথা বলছে তাদের জন্য নিপীড়নের ব্যবস্থা করার আইনও তৈরি করেছে।
আমরা দেখেছি কুইক রেন্টালের নামে আইন করে বসিয়ে বসিয়ে মানুষের ট্যাক্সের টাকা সরকারের পছন্দের লোকদের দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে আইন করেই। সেইসাথে আমরা এও দেখেছি প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে খুশি করতে এইখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও বিরোধীতা সত্বেও রামপাল কয়লা বিদুৎকেন্দ্র ও রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে তাও আইন করেই। আইন করে ব্যংক এর হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অবোলোপন করা হয়েছে। আমরা জানি প্রতিবছর এইদেশ থেকে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা যে পাচার হয় সেটাও নিশ্চয়ই আইনের ব্যবহারের মাধ্যমেই হয়। জনস্বাস্থ্য খাতে গত এক দশকে লক্ষকোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে পর্দা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এইসব নিয়ে যারাই কথা বলেছে বা বলছে তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আর এইসব আইন করার জন্য কোনোরকম সাংবিধানিক বা সিস্টেমেটিক বাধা পাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর থাকেনা।
এইরকম কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামো যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় থাকে আর মানুষের কাছে জবাবদিহি করা নুন্যতম ব্যবস্থা যে সরকার ব্যবস্থায় থাকেনা সেইটা বহাল রেখে অনেক কষ্টেসৃষ্টে হয়তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমরা বাতিল করাতে পারবো, কিন্তু গণবিরোধী আইন বানানোর ব্যবস্থাকে বদলাতে পারবোনা। আজকে আমাদেরকে এই আইন বানানোর ক্ষমতার উৎসে যেতে হবে। নয়তো দেখা যাবে ৫৭ ধারা ঠিকই চলে যাবে কিন্তু এর থেকেও ভয়ংকর ৩২ ধারা চলে আসবে। আর কে না জানে কেন্দ্রীভূত জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতাকাঠামোই ফ্যাসিবাদের অন্যতম পূর্বশর্ত! তাই আর যাইহোক কেন্দ্রীভূত জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতাকাঠামো বহাল রেখে এদেশের মানুষের আর কোনো মুক্তি নেই। তাই আমাদের আজকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াই যেমন গণবিরোধী আইন বাতিলের লড়াই তেমনি কেন্দ্রীভূত জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতাকাঠামো সংস্কারেরও লড়াই।