মূল: জর্জিও আগামবেন
ভাষান্তর: আ-আল মামুন
(আগামবেনের ব্লগ থেকে লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ডঃ আল্যান ডিন ১১ মে ২০২০ তারিখে)
আমাদের দেশে (আর কেবল আমাদের দেশেই বা বলি কেন, অন্যত্রও) যেসব ব্যতিক্রমী প্রশাসনিক ব্যবস্থা (এপারেটাসেস অব এক্সসেপ্সন) আরোপ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি প্রকাশিত প্রতিক্রিয়াগুলোতে সবচেয়ে বিস্ময়কর যে দিকটি চোখে পড়ে, চলমান সঙ্কট ছাড়িয়েও এইসব ব্যতিক্রমী ব্যবস্থার যে বিশেষ তাৎপর্য থাকতে পারে তা অবলোকনের অক্ষমতা। আর, এই ব্যবস্থাগুলোকে মানুষ ও বস্তুজগৎ শাসনের নতুন আদিকল্পরূপে (প্যারাডাইম) গড়ে তোলার অভিপ্রায়ে বৃহত্তর পরীক্ষানিরীক্ষার লক্ষণ ও চিহ্ন হিসেবে পাঠ করতে উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা তো নিতান্তই নগণ্য। যদিও, যেকোন নিবিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জন্যই সেটা জরুরি।
তবে, এই সময় বুঝতে মনোযোগ দিয়ে পাঠ করার মতো একটা বই ছাপা হয়েছিলো এখন থেকে সাত বছর আগে (টম্পেট মিখবিয়েন [অণুজীবের তাণ্ডব], গালিমার্ড)। সে বইয়ে প্যাট্রিক জিলবারম্যান বর্ণনা করেছেন, এতোকাল রাজনৈতিক হিসেব নিকেশের একেবারে তলানিতে পড়ে থাকা স্বাস্থ্য–নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে ক্রমান্বয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশলের আবশ্যিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর উদ্দেশ্য শাসনের উপায় হিসেবে এক ধরনের ‘স্বাস্থ্য সন্ত্রাস’ কায়েম বৈ আর কিছু নয়, যদিও একে আখ্যায়িত করা হচ্ছে ‘প্রকট সংকটময় পরিস্থিতি’র নিদান হিসেবে। আর এরকম সংকটময় পরিস্থিতির যুক্তিতেই সেই ২০০৫ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছিলো ‘আসন্ন বার্ড ফ্লু’তে ২ থেকে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে। এই ঘোষণা জাতিরাষ্ট্রগুলোর জন্য এমন এক রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নের প্রস্তাব হাজির করেছিল যার জন্য জাতিরাষ্ট্রগুলো তখনও প্রস্তুত ছিল না। জিলবারম্যান দেখিয়েছেন, সঙ্কটকালীন জরুরি ব্যবস্থার প্রস্তাব সাজানো হয়েছিল তিন ধাপে: ১) সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এক কল্প–বাস্তবের নির্মাণ করা হয়েছিলো, যেখানে এমনভাবে উপাত্ত হাজির করা হয় যেন সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে কঠোরতম শাসন পরিচালনার উপযুক্ত আচরণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যায়; ২) প্রকট সঙ্কটকেই রাজনৈতিক রেজিমের যৌক্তিকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়; ৩) নাগরিক দেহের সর্বাত্মক বিন্যাস এমনভাবে পরিগঠন করা যাতে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়; এবং এক প্রকার অতি সুশীল নাগরিক উৎপাদন করা যায়, আরোপিত বাধ্যবাধকতাগুলো তাদের সামনে এমনভাবে হাজির করা হবে যে সেগুলোকে তারা দেখবে স্বতই হিতকরী হিসেবে। স্বাস্থ্য (নিরাপত্তা) তখন আর নাগরিকের অধিকার নয় বরং আইনী বাধ্যবাধকতার (জৈবনিরাপত্তার) বিষয় হয়ে উঠবে।
২০১৩ সালে জিলবারম্যান যে বিবরণ হাজির করেছিলেন আজ তা অক্ষরে অক্ষরে ফলবান হয়ে উঠেছে। এক বিশেষ ভাইরাসের কারণে বর্তমান জরুরি পরিস্থিতি আরোপিত হয়েছে এবং আগামীতে হয়তো এরকম আরেক ভাইরাস একে প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু সেকথা একপাশে সরিয়ে রাখলে, এই জরুরি ব্যবস্থার সুবাদে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠেছে আগামীর জন্য শাসনব্যবস্থার এমন এক প্যারাডাইমের নকশা প্রণয়ন যেন তার দক্ষতা পশ্চিমের পুরো রাজনৈতিক ইতিহাসে চর্চিত আগের যেকোন শাসনব্যবস্থাকে ছাড়িয়ে যায়। মতাদর্শ ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে, ইতোমধ্যেই যদি নিরাপত্তার যুক্তি, ইতঃপূর্বে অনাগ্রহী থাকলেও এখন নাগরিকদেরকে নিজেদের স্বাধীনতার ওপরে আরোপিত বাধ্যবাধকতা মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তাহলে বলা যায় জৈবনিরাপত্তা এখন সর্বোচ্চ নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সর্বপ্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে এবং সকল সামাজিক সম্পর্ক থেকে তাদেরকে বিরত রাখতেও সক্ষম হয়ে উঠেছে। ফলে, অধিকার আদায়ের দাবিতে ও সংবিধান লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ঐতিহ্যগতভাবেই সোচ্চার বামপন্থী দলগুলোর অন্তর্নিহীত বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মন্ত্রণালয় কতৃক আইনি বৈধতাহীন ডিক্রি জারির মাধ্যমে স্বাধীনতার ওপর আরোপিত বাধ্যবাধকতা তারা মেনে নিচ্ছে, যা কিনা ফ্যাসিজমের কালেও অকল্পনীয় ছিলো।
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এবং সরকারগুলোও আমাদেরকে বিরামহীনভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, তথাকথিত ‘সামাজিক দূরত্ব’ আগামী দিনে আমাদের জন্য রাজনৈতিকতার মডেল হয়ে উঠবে। আর এই দূরত্বের সুযোগ নিয়ে শারীরিক নৈকট্যের বিকল্প হিসেবে সর্বত্র ডিজিটাল প্রাযুক্তিক ব্যবস্থা বসিয়ে দেয়া হবে (ইতোমধ্যেই তথাকথিত ‘টাস্ক ফোর্স’ প্রতিনিধিরা এই ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, যদিও তাদের প্রত্যাশিত ভূমিকার সাথে এই ঘোষণা সাংঘর্ষিক)। কেননা, শারীরিক নৈকট্যই সংক্রামক হিসেবে গণ্য হচ্ছে, যদিও শারীরিক নৈকট্যকে রাজনৈতিকভাবেও সংক্রামক হিসেবে আমাদের পাঠ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম, ইতোমধ্যেই এমআইআরইউ প্রস্তাব করেছে, আগামী বছর থেকে অনলাইনেই স্থায়ীভাবে পরিচালিত হবে; তুমি নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকেই চিনতে পারবে না কেননা তা হয়তো মাস্কে ঢাকা থাকবে, কিন্তু ডিজিটাল যন্ত্রপাতি দিয়ে তোমার বায়ো–ডাটা আবশ্যিকভাবেই সংগ্রহ করা হবে; আর যেকোন রকম ‘জনসমাগম’ই, তা রাজনৈতিক কারণেই হোক কিম্বা বন্ধুবান্ধবদের মামুলি আড্ডাই হোক, নিষিদ্ধ করে রাখা হবে ।
মানবসমাজের নিয়তি পুনর্গঠনই মুখ্যত বিবেচ্য বিষয়, বহু দিক থেকেই এটি শেষ বিচারের বা রোজ কেয়ামতের ধারণা ধার করে গড়ে উঠেছে, যে ধর্মের বোধ এখনও তাদের কার্নিশে ঝুলে আছে। অর্থনীতি দিয়ে রাজনীতি প্রতিস্থাপনের পরে, চলমান আদিকল্পে এখন শাসকতা অব্যাহত রাখার সার্থেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে জৈবনিরাপত্তা আদিকল্পের সাথে একে যুক্ত করার। আর এরই জন্য আমাদের অন্যান্য সকল মানবিক চাহিদা বলিদান করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাই যথার্থই প্রশ্ন তোলা যায়, এ ধরনের সমাজকে কি আদৌ আর মানুষের সমাজ বলা যাবে; নাকি স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা নামের সর্ব্যই বানানো গল্পের বিনিময়ে ভব্য সম্পর্কগুলো, মুখায়াবের অনুপস্থিতি, বন্ধুত্ব, আর ভালোবাসা সত্যিই ত্যাগ করা যায়।
জর্জিও আগামবেন
মার্চ ১১, ২০২০।