- লেখক: সারোয়ার তুষার
চিলিতে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। শাসকের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, অর্থনৈতিক সংস্কার সহ অনেকগুলো দাবিতে ৩০ লক্ষ অধিবাসির শহরে ১০ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়েছে। গণদাবির মুখে মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়েছে সেই দেশের সরকার। সেখানে জনতা কী কী দাবি তুলছে , সেগুলো খেয়াল রাখার চেষ্টা করছিলাম। চিলির জনগণ বলছে, নিওলিবারালিজম অর্থনীতির রক্তাক্ত পরীক্ষাগার বানানো হয়েছিল চিলিকে।
পপুলার ম্যান্ডেটের আলেন্দে সরকারকে সিআইএ সমর্থিত ক্যু এর মাধ্যমে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সত্তরের দশকের নিকৃষ্টতম সামরিক স্বৈরাচার পিনোশে ; এখন এই নিওলিবারালিজমের কবরও হবে চিলিতে।
তারা একটা ‘নতুন চিলি’র কথা বলছে। কী সেই ‘নতুন চিলি’? আন্দোলনকারী বলছেন, চিলির গণঅসন্তোষ এই ইস্যু কিংবা সেই ইস্যুকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে বলে আপাতভাবে মনে হলেও, আসলে তারা চিলির রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের গোড়া ধরে টান দিতে চান।
তারা মনে করেন চিলির রাষ্ট্রনৈতিক সংকটের উৎস চিলির সংবিধান। আন্দোলনকারীরা নতুন সংবিধান সভা গঠনের মাধ্যমে একটা বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক চিলির জন্য নতুন একটা সংবিধান প্রণয়ন করতে চান।
সমাজ-রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক সমস্ত পক্ষের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই এই ধরনের সংবিধান প্রণয়ন করা হবে।
যে সংবিধান রাজনৈতিক পরিসরে সামাজিক কমিটমেন্ট, ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীনতা এবং জনগণকে সার্বভৌম করবে।
“It’s clear that this movement is not just addressing this or that issue. It is raising questions which go right to the roots. […] Our constitution today is the heritage of neoliberalism in Chile, dating back to Pinochet and the Chicago Boys. To change things fundamentally we need to cut those roots. We need to create new rules of the game. We need a completely new constitution, created by a constituent assembly, with all kinds of social representatives involved. That would give real power to the people and encourage a much-needed new culture of participation, involvement, and social commitment to the political space.”
We Will Make a New Chile, Jacobin, 28/10/2019
আসলে এটাকেই বলে ‘সময়ের প্রয়োজনে’, সময়ের বাস্তবতা বুঝে অলীক কথাবার্তা না বলে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পরিসরকে বাড়ানো।
এবং সেটা কেবলমাত্র সম্ভব যদি বিদ্যমান একচেটিয়া-নিরঙ্কুশ একব্যক্তিকেন্দ্রীক ক্ষমতাকাঠামোকে একটা জবাবদিহিতামূলক, গণক্ষমতাতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা রিপ্লেস করা যায়।
যেখানে রাষ্ট্রের সাপেক্ষে মানুষ ও সমাজ নয়, রাষ্ট্রের আইনের শর্তাধীন মৌলিক অধিকার নয় ; বরং মানুষ ও সমাজের স্বাধীনতার সাপেক্ষে রাষ্ট্র, মৌলিক অধিকারকে মানুষের অবিচ্ছেদ্য, নিঃশর্ত মানবীয়তা ধরে নিয়ে তাকে ধারণ করতে পারার মত আইন প্রণয়ন করার মত রাষ্ট্রপ্রকল্প হাজির করা।
রাষ্ট্রচিন্তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক সংকটকে এভাবেই উন্মোচন করতে চায়। সমাজ-রাষ্ট্রে ক্রিয়াশীল সমস্ত প্রগতিশীল-গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে নিয়ে নূন্যতম ঐক্য ও কর্মসূচির ভিত্তিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক সংকট সমাধানে সম্ভাব্য রূপকল্প হাজির করতে চায়।
রাষ্ট্রচিন্তা প্রণীত রাষ্ট্র সংস্কারের সাতদফা খসড়া কর্মসূচি ও প্রস্তাবনা বাংলাদেশের মানুষকে মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে এমন এক রাষ্ট্রপ্রকল্পের দিকে নিয়ে যেতে চায়।
নতুন সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধানের অগণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী, নিপীড়নমূলক, ঔপনিবেশিক ও স্বৈরাচারী আইন-কানুনকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সাপেক্ষে গণতান্ত্রিক এবং জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার অধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে চায়।
এই কাজে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ও সক্রিয় সমস্ত পক্ষের সাথে যুক্ত হতে চায়। গণোরিয়াকে বদলে সিফিলিস আর নয় ;
সমাজ-রাষ্ট্রে রাষ্ট্রনৈতিক বিমার ছড়ানো অসুস্থ, দুরারোগ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি নিরাপদ, সুস্থ ও মানুষের মর্যাদার প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল গণমুখী রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার মধ্যেই বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যতের শর্ত নিহিত।
তারাপদ রায়ের কবিতার মত করে যেন আমাদের কপাল চাপড়াতে না হয় :
“আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে…”