- ইরফানুর রহমান রাফিন
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছুদিন ছিলেন সেলিম রেজা নিউটন, সেই অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পরস্পরসম্পর্কিত দুটি লেখায়। লেখাগুলোর নামঃ বিড়ালের জেলখানা ও আদর্শ দাসত্ব-মহাগ্রাম। পাওয়া যাবে ‘অচেনা দাগঃ সম্পর্ক স্বাধীনতা সংগঠন’-এ (ঢাকাঃ আগামী, ২০১৫)।
কান পাতলে লেখাগুলোয় কারাবন্দীদের কান্না শোনা যাবে। শারীরিক অত্যাচার আছে, কিন্তু সেটা প্রধান নয়। অনেক বেশি গভীর ও রক্তক্ষয়ী মানসিক অত্যাচার।
আসলে পুরো কারাপরিস্থিতিটাই।
ম্যানুফেকচারিং ডিপার্টমেন্টের কয়েদীরা বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেয়। চল্লিশ বছর জেল খেটে যখন বেরিয়ে আসে জেল থেকে তখন তাদের পকেটে একটা ফুটা পয়সাও থাকে না। এই বন্দীত্ব আসলে দাসত্বই, অত্যন্ত উৎপাদনশীল দাসত্ব।
সন্ধ্যার আগেই কয়েদীদেরকে তাদের খাঁচায় ঢুকতে হয়। তখনো উঠানে হাঁস-মুরগি চড়ে বেড়াচ্ছে, মাঠে গরুছাগল। এই যে হাঁস-মুরগি-গবাদিপশুর স্বাধীনতাকে ঈর্ষা করতে করতে শ্রমক্লান্ত বন্দীরা তাঁদের খাঁচায় ঢোকে সন্ধ্যার আগেই, নিউটন এটাকে বলছেন ‘আত্মার গভীরে বন্দিত্বের অনুবাদ’।
তবে কারাগারেও কয়েদীতে কয়েদীতে সুস্পষ্ট ফারাক আছে। একদিকে আছেন নিউটনের মতো পলিটিকাল প্রিজনার, যাঁদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ, যাঁরা অচিরেই ডিভিশন পান। অন্যদিকে আছেন আলমগীরের মতো দ্বিতীয় শ্রেণির কয়েদী, যাঁরা কারাগারের বাইরের মতো ভেতরেও পান গরিব হওয়ার শাস্তি, কোনো এক দুপুরে কর্তাদের রক্তচক্ষু লুকিয়ে পলিটিকাল প্রিজনারদের কাছে চলে আসেন একটু ভালো খাবার খেতে পাওয়ার আশায়।
পড়তে পড়তে একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো আমার।
“কারাজীবনের সাথে নারীজীবনের কোথাও কী মিল আছে?”
নারীদের অধিকাংশের জীবনই ম্যানুফেকচারিং ডিপার্টমেন্টের কয়েদীর মতো। বাপভাইস্বামীর সংসারে সারাজীবন বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেন। তারপর কবরে ঢুকে যান বা চিতায় ওঠেন।
তাঁদেরকেও এককালে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হতে। মূলত অর্থনৈতিক কারণে বিধিনিষেধটা কিছুটা শিথিল হয়েছে। রাত নটা-দশটা পর্যন্ত বাইরে থাকলে, বিশেষত পুরুষ আত্মীয় বা বহু বান্ধবীর সাহচর্যে, অনেক পরিবারই আজকাল মেনে নেয়।
নারীতে নারীতেও ফারাক আছে এই সংসার কারাগারে। একদিকে আছেন উচ্চ আর মধ্য শ্রেণির নারীরা, ডিভিশনপ্রাপ্ত কয়েদীদের মতো, শ্রেণিগত কারণে কিছু অর্থনৈতিক প্রিভিলিজ যাঁরা পান। অন্যদিকে আছেন লীলার মানুষ মেশিনের সেই সালেহারা, গরিব হওয়ার কারণে যাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নারী, যাঁদের কেউ গার্মেন্টস কারখানার আগুনে পুড়ে কয়লা হন আর কেউ গৃহকর্তাদের দ্বারা ধর্ষিত হন অথবা গৃহকর্ত্রীদের খুন্তির ডলা খান।
আমার প্রশ্নটার উত্তর আমি পেয়ে গেছি সম্ভবত।
“আছে।”
লিখতে লিখতে আরেকটা প্রশ্ন মাথায় আসলো আমার।
“কারাজীবনের সাথে পুরুষজীবনের কোথাও কী মিল আছে?”
কারাগারে কয়েদী ছাড়াও আরো কিছু মানুষ থাকেন।
সুপার। জেলার। সুবাদার। জমাদার। কারারক্ষী। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
এদের সবার ক্ষমতা সমান নয়, কিন্তু এরা সবাই কয়েদীদের ওপর কমবেশি ক্ষমতাচর্চা করেন।
সংসারেও যেমন নারী ছাড়াও কিছু মানুষ থাকেন।
বাপ। ভাই। মামাচাচা। স্বামী। সন্তান। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
এদের সবার ক্ষমতা সমান নয়, কিন্তু এরা সবাই নারীদের ওপর কমবেশি ক্ষমতাচর্চা করেন।
তবে নারীদের ক্ষেত্রে ক্ষমতাচর্চার সুভাষণ ‘রক্ষা করা’।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তরও সম্ভবত পেয়ে গেছি।
“আছে।”
নারীপুরুষরা যেই কারাগারে থাকে তার নাম পিতৃতন্ত্র। নারীরা এই কারাগারের বন্দী আর পুরুষরা রক্ষী। রাষ্ট্রও কারাগারই, একটু বড়ো আকারের, এই যা।
সম্প্রতি ঢাকায় যে শেকল ভাঙার পদযাত্রা হলো, তাতে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান উঠে এসেছিলো। ‘রক্ষা নয় মুক্তি চাই’, ‘প্রাণ খুলে বাঁচতে চাই’: বন্দিত্বের সীমাহীন যন্ত্রণা থেকেই এমন শ্লোগান উঠে আসতে পারে। কারার অই লৌহকপাট ভেঙে ফেলার ইচ্ছা, লোপাট করার ইচ্ছা, প্রলয় বিষাণ বাজানো তরুণদের রক্তে টগবগ করে ফুটছে।
পিতৃতন্ত্র নামের এই কারাগারটা ভেঙে ফেলা দরকার। তাতে নারীরা যেমন মুক্তি পাবে বন্দিত্ব থেকে, পুরুষরাও তেমনি মুক্তি পাবে রক্ষা করার দায় ও ভার থেকে। নারীপুরুষের সম্পর্কটা সত্যিকার অর্থে মানবিক হয়ে উঠবে, যার ভিত্তি হবে বন্ধুত্ব প্রেম পারস্পরিক শ্রদ্ধা, যা হবে স্বাধীন।
- ইরফানুর রহমান রাফিন: লেখক ও গবেষক।