- লেখক: বাকী বিল্লাহ
হার্ড ইমিউনিটি তত্ত্বের সাথে মতপ্রকাশের উপর সরকারের নতুন করে খড়গহস্ত হয়ে ওঠা বা হার্ডলাইনের নিবিড় সম্পর্ক আছে। মাঝখানে করোনাকালীন একটা সাময়িক বিরতি দিয়ে আবারো চালু হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্টিম-রোলার। সরকারবিরোধী লেখালেখির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১ জনের নামে মামলা করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভুুঁইয়াকে র্যাব পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে কার্টুনিস্ট আহম্মেদ কবির কিশোর এবং মোস্তাক আহম্মেদকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়। দিদারকে গ্রেপ্তার দেখানো বা থানায় হস্তান্তর করা হয়নি। এরা তিনজনই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রমনা থানায় দায়ের হওয়া ওই মামলার আসামী।
কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন—‘সম্ভবত হ্যার্ড ইমিউনিটির জন্য সবচে সম্ভবনাময় গভার্নমেন্টালিটি মডেলের এক্সপেরিমেন্ট হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’ তিনটি ধাপে তিনি মডেলটির ধরণ ব্যাখ্যা করেন। ধাপগুলো নীচে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
“প্রথম ধাপ: টেস্টের পরিমাণ ও পরিসর ডেলিবারেটলি কম রাখা। বাদবাকি পাবলিক পরিসংখ্যান আর সব দেশের সাথে মিলিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার করা। সে প্রস্তুতি অভারঅল আগে থেকেই ভাল ছিল।
দ্বিতীয় ধাপ: এক্সপেন্ডেবল ‘বেয়ার লাইফ’গুলানকে ইনফেকশনে এক্সপোজার দিয়ে বসে বসে দেখতে থাকা কী হয়। অন্যদিকে প্রিভিলেজড পপুলেশনের জন্য প্রটেকশনের আয়োজন পুরা পার্টি-পাওয়ার-বিজনেস র্যাকেটের হাতে রেখে প্রফিট এবং লুটপাট যতদুর সম্ভব চালু রাখা।
তৃতীয় ধাপ: বাই চান্স এই ফর্মূলায় পরিস্থিতি সামলানো গেলে করোনার কারণে বিরাট স্কেইলড-আপ হওয়া সার্ভেইল্যান্স, ডিজইনফরমেশন আর পপুলেশন কন্ট্রোল মেকানিজমকে ক্ষমতা আরো পোক্ত করে আরো র্যাম্পেন্ট মানি মেইকিংয় কাজে লাগানো।”
এই পোস্টে আমি মতপ্রকাশের উপর হঠাৎই নেমে আসা আক্রমণ এবং বখতিয়ার আহমেদের উল্লেখিত তৃতীয় ধাপের ভেতরকার সম্পর্ক দেখার চেষ্টা করছি। প্রথমে দেখা দরকার, সরকারবিরোধী বা গুজব সৃষ্টিকারী হিসেবে সনাক্ত করা উপাদান বা টেক্সট কোনগুলোকে বলা হচ্ছে? এইটা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ঠিক করা হয়, এর মূল কার্যকারিতার দিকটি হলো মূলত পাবলিককে ভয় দেখানো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বানানো হয়েছে সেভাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কখন মানুষকে ভয় দেখানোর দরকার পড়ে? যখন সরকার পাবলিক ইন্টারেস্টের জায়গাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। যখন সরকারেরই উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা বা সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা করোনার ভয়াবহতা ইগনোর করছিলেন, বাংলাদেশে করোনা আসবে না বলে ভবিষ্যতবাণী দিচ্ছিলেন— সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই ভুল করেনি। আমরা অন্যান্য দেশের চেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় ছিলাম, সকলের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে ছিল। সরকার এবং তার মন্ত্রণালয়গুলো যদি কাণ্ডজ্ঞান কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো— ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, কেরালা বা পশ্চিমবংগের মত আমরাও এটা মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়াকে ঠেকাতে পারতাম। আবার একইভাবে সোশাল মিডিয়ায় পাবলিক যদি সিরিয়াস ওয়াচডগের ভূমিকা না নিতো, তাহলে আমাদের পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হতো; তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ডাক্তারদের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিত করা বা অঘোষিত লক-ডাউনের কবলে পড়া ক্ষুধার্ত মানুষকে বাঁচানো বা জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি ইস্যুতে, সাধারণ মানুষ ভলান্টিয়ারি করে এবং সোশাল মিডিয়ায় জনমত সৃষ্টি করে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে দুর্যোগের কালে নায়কের ভূমিকায় আবির্ভুত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং নিপীড়নের শিকার হওয়া দিদার, কিশোর বা মোস্তাক আহম্মেদরা পাবলিকেরই সেই অগ্রণী অংশ। যারা মানুষের পাশে খাবার নিয়ে শুধু দাঁড়িয়েছে তা নয়, প্রতিটি মুহূর্তে সরকারের অথর্ব সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে সজাগ সমালোচনা করেছে, স্যাটায়ার করেছে। এইখানে সরকারের সমালোচনা বা স্যাটায়ার মুখ্য উদ্দেশ্য না, মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে— এগুলোর মধ্য দিয়ে পাবলিক ইন্টারেস্টকে রক্ষা করা। একটা গণতান্ত্রিক দেশের আলটিমেট লক্ষ এবং মোক্ষ এটাই।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে মাঝখানে কিছুদিন সরকারের পোষা বুদ্ধিজীবী বা অ্যাডভোকেটদেরও দেখেছি যে তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর সুপ্রিমেসিকে অক্ষুন্ন রেখে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর হচ্ছে। তালা বলছিলেন, অযোগ্য অথর্ব সব মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর সব অর্জন খেয়ে দিচ্ছে। এখন আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এমন যে চাইলে এই কথাগুলোর কারণেও লোকেদের মামলা দিয়ে জেলে পুরে দেয়া যায়। কিন্তু এই মামলাগুলো যেহেতু ভয় দেখানোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হয়, আর এই ভয় দেখানোটার নেসেসিটি তৈরি হয় এন্টি পিপল জায়গা থেকে— পাবলিক ইন্টারেস্টের পক্ষে কাজ করছেন, এমন মানুষদেরই টার্গেট করা হবে। তিনি কী লিখেছেন সেটা মুখ্য নয়।
করোনা পরবর্তী পৃথিবী বা বাংলাদেশ কেমন হবে, লক ডাউনের দিনগুলোতে সেটা একটা জনপ্রিয় আলোচনার বিষয়। সাধারণভাবে অধিকাংশরা মনে করেছেন করোনা পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য বা শিক্ষার মত মৌলিক বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে, অস্ত্র কেনাবেঁচা বা তথাকথিত উন্নয়নের মাথাভারী মেগা প্রজেক্টের চেয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি বরাদ্দে আমরা পৃথিবীতে একেবারেই নীচের দিকে। এমনকি দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জিডিপি বরাদ্দ আমাদের চেয়ে বেশি। জনমনে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতি চোখে আংগুল দিয়ে যে সত্য দেখিয়ে দিল, তাতে ভবিষ্যতে আমরা বিকৃত উন্নয়নের ডামাডোল থেকে বেরিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত মৌলিক খাতকে অগ্রাধিকার দিতে শিখবো। কিন্তু বখতিয়ার আহমেদের হার্ড ইমিউনিটির জন্য সম্ভাবনাময় গভার্নমেন্টালিটির যে তৃতীয় ধাপের কথা লিখেছিলেন সেখানে ভিন্ন ইংগিত ছিল। এমনকি মেটাফোর হিসেবে দেখলে, করোনা পরিস্থিতি পার করে হার্ড ইমিউনিটির ভিন্ন আরেক প্রাসংগিকতা সামনে আসতে পারে। কত লোক এর মধ্যে মারা যাবে সেটা যেমন একটা বিষয়, তেমনি ভবিষ্যত দিনগুলোতে মানুষের সম্পদ ও জীবনী শক্তি শুষে নিয়ে মুনাফা বানানো গোষ্ঠীটি মানুষের বেঁচে থাকা আরো হার্ড বানিয়ে দিতে চাইবে। তা রুখতে হলে নিজেদের ইন্টারেস্ট নিয়ে সজাগ থাকতে হবে, প্রতিটি গণবিরোধী সিদ্ধান্তের চূলচেরা সমালোচনা করতে হবে। যত বেশি নিপীড়ন তত বেশি সক্রিয়তা লাগবে। বেশি বেশি পরিমাণে.. যেন ওদের মাথা খারাপ হয়ে যায় এই ভেবে যে এত মানুষকে রাখার জেলখানা কোথায় পাবে?
লেখক: বাকী বিল্লাহ, লেখক ও এক্টিভিস্ট