মূল: জন পিলজার, ভাষান্তর: ইলোরা সুলতানা
অনুবাদকের নোট: প্রখ্যাত অস্ট্রেলিয় যুদ্ধ সাংবাদিক জন পিলজার ১৯৭০ দশকের গোড়া থেকেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লন্ডনের দি ডেইলি মিররের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের অভ্যূদয় এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ঘটনাক্রমের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্লেষক হিসেবে পিলজারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারটি রচনা সংকলিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তার ‘হিরোজ’ গ্রন্থের ’জয়বাংলা’ খন্ডে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পিলজার নিয়মিত এসেছেন বাংলাদেশে, প্রত্যক্ষ করেছেন ডিসেম্বরের বিজয়ও। সত্তুরের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ বহু কারনেই গভীর মনোযোগের দাবিদার যার অন্যতম একটি হচ্ছে এই সমস্ত স্থানীয় ঘটনাবলিকে তিনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে দেখবার সুযোগ করে দেন যেখানে পাঠক হিসেবে আমরা আমাদের নিজ ইতিহাসের সম্পূর্ন ভিন্ন এক প্রেক্ষিত ও নির্ধারকদের মুখোমুখি হই।
হাতিয়া, পূর্ব পাকিস্তান: নভেম্বর ১৯৭০
১৫ই নভেম্বর রোববার সকালের দিকে লন্ডনে ডেইলি মিররের বার্তা কক্ষে গোলমেলে একটা টেলিগ্রাম আসল। এতে বলা হচ্ছিল “ফাইভ লাখস গন, ডেফিনিট। পসিবল ওয়ান ক্রোন। নো সোল সাইটেড পটুয়াখালি, ওয়েভ থার্টি ফিট। মিনিমাম ওয়ান ক্রোন ক্যাটল ডান ফর নোয়াখালি। টেরিবল স্টেট অ্যাফেয়ার্স। রেসপেক্টফুলি রিকোয়েস্ট মোস্ট আর্জেনটেস্ট ইমেডিয়েট এটেনশনস গভার্নমেন্ট এন্ড নিউজ পেপার। টপ মোস্ট প্রায়োরিটি। কাম কুইক। আই অ্যাম হিয়ার- সরোজ, ফখরুদ্দিন”।
আব্দুল উমরাহ ম. ফখরুদ্দিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে দৈনিক মিরর পত্রিকার ‘স্ট্রিংগার’ (স্থানীয় প্রতিনিধি)। তার ‘lack’ ও ‘crone’ অনূদিত হয়েছিল লাখ ও কোটি হিসেবে যা উপমহাদেশে ১,০০,০০০ এবং এক মিলিয়ন হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি বলছিলেন যে, গত শুক্রবার মধ্যরাতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের আঘাতে আধা থেকে এক মিলিয়নের মত মানুষ মারা গেছে- যার মানে এ এমন এক প্রাকৃতিক দূর্যোগ যার তুলনা ইতিহাসে কমই আছে।
আমি এ ইউ এম ফখরুদ্দিন এর কথা মত রাজধানি ঢাকায় উড়ে গেলাম, তারপর চট্টগ্রাম। সঙ্গে জুটলেন কামাল নামের একজন এবং একজন স্থানীয় হেডমাস্টার যারা আগেই ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছিলেন। আমি কামালের জরাজীর্ণ দেশি নৌকাটি, যেটাতে সে সম্প্রতি একটি পুরনো মরিস অক্সফোর্ড ইঞ্জিন লাগিয়েছে, দেখে নিজের চিৎকার সংবরণ করতে পারলাম না । আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পারা যায় রিলিফ নিয়ে নিলাম। এরমধ্যে ছিল ছয়টি কেরোসিনের গ্যালনে ভরা খাবার পানি, এক বান্ডিল শুটকি মাছ, কিছু ব্যান্ডেজ, এক বাক্স চুন, একটি পুরোনো জীবাণুনাশক ক্রিম এবং অনিশ্চিত মনে কিছু ভ্যাক্সিন যার জন্য কোন সিরিঞ্জ আমাদের কাছে নেই।
চারদিকের সাগর ছিল একদম নিথর- কোন বাতাস নেই, তীক্ষ্ন সূর্যের আলোয় চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায়, জলোচ্ছাসের পানি পলিমাটিতে তখনো ঘোলা, স্রোত এত এলোমেলো যে কামালকে নৌকা সামলে রাখার জন্য রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছিল। হেডমাস্টার বললেন, জলোচ্ছাসের প্রবল ঢেউ নেমে গেলেও মোহনা এখনো এর প্রভাবে অশান্ত। পূবের সবচেয়ে শক্তিশালি দুটি নদী গঙ্গা ও ব্রক্ষপূত্র এখানে মিলেছে। আকাশ থেকে দেখলে ঢাকার দক্ষিণের এই অঞ্চলটিকে মনে হয় শান্ত হ্রদের উপর একটা ছবি আলতো করে বসিয়ে তারপর ঝাঁকিয়ে জটিল ধাঁধাঁ বানানো হয়েছে। ব-দ্বীপের সর্বদক্ষিণে ছোট ছোট দ্বীপগুলো ঝালরের মত নেমেছে বঙ্গোপসাগরে যেগুলোতে ভূমি অস্বাভাবিক রকমের নীচু। যেসব মানুষ এখানে নিরন্তর বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত তাদের কাছে পানির মাত্র কয়েক ফুট উপরের জমি মানেই উচুঁ জমি। সারা বছর এখানে ফসলের আবাদ হয়, গবাদি পশু চড়ে বেড়ায়, যদিও বাস্তবতা এই যে, বছরে অন্তত দুইবার এখানে জলোচ্ছাস হয় এবং ছোট ছোট দ্বীপগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়, পৃথিবীর যে কোন জায়গার চেয়ে এখানে ঘূর্ণিঝড়ের আশংকা অনেক বেশি।
কিন্তু নভেম্বরের এই সময়টা ফসল কাটার মৌসুম। সাত কোটি মানুষের এই দেশে-যেখানে মানুষের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় সর্বসাকুল্যে ২০ পাউন্ড, সেখানে খাবার হচ্ছে এমন এক প্রয়োজন যে এর জন্য মানুষকে এমন সব জায়গায় বাস করতে হয় যেখানে বসবাসই উচিত নয়। মানুষকে এখানে থাকতে হয় দ্বীপগুলোর মাঝ বরাবর একচিলতে উঁচু মাটির উপর দাঁড়ানো গাছপালার আড়ালে আশ্রয় নিয়ে যা ঝড় বৃষ্টি ঠেকানোর চেষ্টা হিসেবে কেবল করুণারই উদ্রেক করে। এ এক ভয়াবহ জায়গা- একটা ভৌগলিক কফিন।
ঝড়গুলো সাধারণত বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচন্ড বেগে পাক খেয়ে উঠে এসে এই সর্বশেষ প্রান্তে- যেখানে উপমহাদেশের উপকূলে উলম্বিক কোনের চেয়েও বেশি সংকুচিত হয়ে ঢুকে গিয়ে বার্মার উপকূল হয়েছে- সেখানে আঘাত হানে। এই অঞ্চলে যেসব জলোচ্ছাস হয় তার সবই আছড়ে এসে পড়ে এই নীচু সমতলে যার একমাত্র পূর্বাভাস মেলে ঢেউয়ের গর্জন আর তার চূড়ায় দেশি নৌকার আলোর নাচানাচি দেখে।
এরকমই ঘটেছিল ১৯৭০ সালের ১৫ই নভেম্বর শুক্রবার মধ্যরাতে। ঢাকায় আসা এক প্রত্যক্ষদর্শী, মনপুরা জেলা পরিষদের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য, ঝড়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ’প্রচন্ড ঝড়ের গর্জন আর সাথে তীব্র ঠান্ডা, হুল ফোটানোর মত প্রখর আলো… আলোর ঝলসানিতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল’। ঢেউয়ের উচ্চতা ছিল প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুটের কাছাকাছি কিংবা তার চেয়েও বেশী যা দূর্বল ঘরবাড়ীগুলোকে প্রথম আঘাতেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট এবং যেসব গাছ তারপরও দাঁড়িয়ে ছিল তার ডালে আশ্রয় নেয় প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা। প্রায় দুই ঘন্টাব্যপী পানির এই উচ্চতা টিকে ছিল। এরপর শুরু হল বাতাস ঘন্টায় প্রায় ১০০ মাইল বেগে, সবচেয়ে শক্তিশালী কয়েকজন ছাড়া বাকিদের হাত ছুটিয়ে উড়িয়ে নেয় এই বাতাস। যখন বাতাসের উন্মত্ততা থিতু হয়ে আসল তখন পানির তোড় অতর্কিতে নেমে যাওয়ার সময় মৃতদের বেশিরভাগকেই সাথে করে নিয়ে গেল।
আমরা প্রথম যে দ্বীপটির দিকে গেলাম সেটি হল হাতিয়া। আনুমানিক ২০০০ মানুষের আবাস ছিল এটা, আর এখন দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি চকচকে মুদ্রার পিঠ, একটা মাত্র ঝুঁকে পড়া ঘর দেখা যাচ্ছে যার দক্ষিণ কোণে ধূসর আবছায়ার মত কিছু একটা। আমরা কাছে যেতেই কামাল এক লাফে নেমে গেল।
‘মানুষ!’ সে চিৎকার করে উঠলো, ‘সব মানুষ’।
ছায়াটা ছিল মৃত মানুষের স্তুপ। তাদের কেউ কেউ এখনও সোজা হয়ে বসে আছে, কেউ কেউ একজন আরেক জনকে আঁকড়ে ধরে আছে।
কামাল বলল ‘ঠিক এখানে একটি প্রাইমারি স্কুল ছিল, কোথায় গেল?’
এখানে দোকান-পাটে যাবার একটা ভাল রাস্তা ছিল, একটি পুলিশ ফাঁড়ি এবং জেটির সাথে একটি পেট্রল পাম্পও ছিল। এখন সেখানে কিছূই নেই শুধুমাত্র ঝুঁকে পড়া এই ঘরটা আর এর পিছনে ইউ আকৃতিতে বেঁকে থাকা একটা গাছ ছাড়া। কয়েক শত লাশের স্তুপে বাধা পেয়ে ঢেউ যেখানে ভেঙে পড়ছিল তার পাশেই কামাল নোঙ্গর ফেলল। হেডমাস্টার সাথে আনা রিলিফে চোখ বুলিয়ে সেখান থেকে চুন বের করে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে কাদা ভেঙে রওনা হলেন। আমরাও তার পিছু নিলাম, মসৃণ কাদা মাটি আর বালিতে আমাদের গোড়ালি পর্যন্ত দেবে যাচ্ছিল যা দেখে মনে হচ্ছে কোন দানবাকৃতির মই দিয়ে সব সমতল করে দেয়া হয়েছে। আমরা শিশুদের লাশের একটা অর্ধগোলাকৃতির স্তুপ দেখে থমকে দাঁড়ালাম। হেডমাস্টার তাদের উপর চুন ছুঁড়ে দিতে লাগলেন, শেষ হলে বাক্সটা ছুড়ে মারলেন একপাশে আর বিড় বিড় করে কাকে যেন অভিশাপ দিতে থাকলেন। দেখে মনে হচ্ছিল এটা এক নির্দয় আর অমানবিক কাজ কিন্তু আসলে তা নয়, তার চোখ দিয়ে অশ্রু নামছিল অঝোরে।
ঘরটাকে মনে হচ্ছিল অদ্ভূত এক নিঃসঙ্গ স্মৃতিস্তম্ভ, অন্য সবকিছুর সাথে এই ঘরটিও কেন ভেসে চলে যায়নি তার কারণটা দ্রুতই জানা গেল। ঘরের ভিতর পঞ্চাশ বা সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারবেন কত, মৃতদেহ। সবচেয়ে নিরাপদ ঘরের ভিতরে যে মানুষগুলো গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছিল নিশ্চয়ই তারা এই তান্ডবের গর্জন শুনতে পেয়েছিল এবং কোনভাবে তাদের সম্মিলিত ওজনে ঘরটি এখনো সোজা অবস্থায় আছে। পিছনে গাছের ডালে ঝুলে ছিল একটা শিশুর মৃতদেহ।
আমরা আরো দুটি দ্বীপে নামলাম। একটাতো একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার শুধু কয়েকটা মৃত গবাদিপশু ছাড়া। অপরটি অলৌকিকভাবে শুধুমাত্র দুটি পরিবার হারিয়েছে। যদিও অর্ধেকের বেশী ঘরবারি তছনছ হয়ে বা ভেসে গেছে। যারা বেঁচে আছে তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তারা কোন বিমান দূর্ঘটনার শিকার হয়েও এই মাত্র বেঁচে ফিরেছে। আমাদের সাথে আনা যেসব রিলিফ ছিল হেডমাস্টার সবার মাঝে বিলি করে দিলেন, নিমেষের মধ্যেই খাবার পানি শেষ হয়ে গেল। তারপর তিনি একটি খালি হওয়া কেরোসিনের টিনের উপর বসে হিসাব শুরু করলেন, বাঙালি আমলাতন্ত্র শুরু হল- তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিরলস হাতে তিনটি স্কুল-খাতায় সবার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব লিখে চললেন: শাড়ি, শার্ট, লুঙ্গি, পাজামা, জুতা, হাড়ি-পাতিল, মুরগি, মানুষ- সবকিছু।
হেডমাস্টার যখন এই হিসাবে ব্যস্ত, তখন এক লোক- পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী পিপলস্ লীগের একজন সংগঠক, রাগত স্বরে আমাকে বললেন, একটা জরুরী দূর্যোগ অপসারণ পরিকল্পনা আছে সেটা কখনই বাস্তবায়ন হয়নি, রেডিওতে একটা সাধারণ মানের সতর্কবাণী প্রচার করা হয়ে ছিল যে দমকা হাওয়ার আশংকা রয়েছে, প্রয়োজনে উপকূলবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হবে যে কেন্দ্র ইসলামাবাদ সরকার নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিয়েও করেনি। “আমরা তো জন্তু নই”- তিনি বললেন, “তবে কেন আমরা বছরের পর বছর আল্লার গজবের শিকার হব?”
তিনি আমাকে নুরুন্নেসা নামের এক নারীর কাছে নিয়ে গেলেন, যার উম্মাদনা তার এই কথার সত্যতা আরও মেলে ধরছিল। গত পাঁচ বছরে, পাঁচটি প্রাকৃতিক দূর্যোগে নুরুন্নেসা নিজের ছয় সদস্যের পরিবারটিকে এক সদস্যে পরিণত হতে দেখেছেন, শুধু নুরুন্নেছা নিজে। তার বড় ছেলে অলি ১৯৬৫ সালের মে মাসে বন্যায় ডুবে মারা যায়। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি সাইক্লোনে ১০,০০০ হাজার মানুষ মারা যায় এবং এরমধ্যে তার ছোট ছেলে খানও মারা যায়। পরবর্তী বছরের অক্টোবর মাসের এক সাইক্লোনে তার ঘর পড়ে যায় এবং তার শাশুড়ি এতে আহত হয়ে পরে মারা যায় এবং মাত্র ১২ মাস আগে তার ছোট মেয়ে মলি বন্যায় ভেসে গেছে। সর্বশেষ, ফসল কাটার মৌসুম বলে, আর সব বছরের মতই ১৫ই নভেম্বর শুক্রবারের কালরাতেও তার স্বামী সিরাজ মাঠেই ছিলেন এবং এখনো পর্যন্ত তিনি নিখোঁজ।
আমি এসব দূর্যোগের ব্যাপারে কখনই কোথাও কিছু পড়িনি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে ‘লন্ডন ব্লিৎজ’বছরে দুইবার করে ঘটছে এবং গোটা মানব জাতির অবশিষ্টাংশ এই ব্যাপারে কিছু জানে না বা তাদের জানানো হয়নি। পরবর্তীতে আমি করাচিতে ১৯৬৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার দৈনিকগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখেছিলাম যে যেখানে প্রায় ১০,০০০ হাজার বাঙালি ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছে সেই সময় দৈনিকগুলো প্রথম পাতায় বেশি গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে একটা পাকিস্তানি বোয়িং মিশরের পথে উদ্বোধনী যাত্রাতেই বিধ্বস্ত হওয়ার খবর যাতে নিহত হয়েছেন ১২২ জন মধ্যবিত্ত পাঞ্জাবি যাত্রী, বেশির ভাগই সাংবাদিক। আর ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে একটি সংবাদ ছাপা হয় যার শিরোনাম ছিল এই রকম, ’পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণে ঝড়, এক হাজারের মত নিখোঁজ। ’
এই উদাসীনতা অংশত ছিল একটা সাম্রাজ্যিক পরম্পরার ফল। ১৯৪৭ এর স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে এক উত্তপ্ত সপ্তাহান্তে খুব তাড়াহুড়ায় কয়েকজন বৃটিশ আমলা ও একজন সাংবিধানিক আইনজ্ঞ পাকিস্তানের একটি অযৌক্তিক সীমারেখা টানেন। পাকিস্তানি শাসক শ্রেণী, ব্রিটিশ রাজের সেনাবাহিনী যারা চালাতেন, সেই পাঞ্জাবিদের কাছে এক হাজার মাইল পূর্বের নতুন এই মুসলমান বাঙালি জাতি ছিল একটা শ্রমের উৎস যার একটা বর্ণবাদী চেহারাও ছিল। বাঙালী জাতির উপর শাসক গোষ্ঠির এই উদাসীনতা আসলে আরো অনেক আগের। ১৮৭৬ সালের ১২ই ডিসেম্বর টাইমস্ পত্রিকায় বাংলার একটা ঘূর্ণিঝড়ের খবর, যেখানে প্রায় ২৫ হাজারের মত মানুষ মারা যায়, এভাবে প্রকাশিত হয়:
দূর্যোগটি নিয়ে জনগনের খুব বেশি বাস্তব দূর্ভোগ হওয়ার আশংকা নেই। সরকারি ত্রান কেন্দ্রগুলো ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে এবং যাদের আসলেই সাহায্যের প্রয়োজন তাদের সহযোগিতা করা হবে। তবে কোন বড় অংকের টাকা ব্যয় করা হবে না এবং সবকিছু যতটুকু সম্ভব ব্যক্তি উদ্যোগের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে।
এবং এটা ছিল বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাকৃতিক দূর্যোগের মতোই একটি দূর্যোগ। ১৯৪৩ সালে অগ্রসরমান জাপানি সৈন্যরা যাতে খাবার সংগ্রহ করতে না পেরে কোনঠাসা হয়ে পরে, সেই জন্য বৃটিশ সরকার দেশের পর পর দুই মৌসুমের ফসল মজুদ, স্থানান্তরিত অথবা ধ্বংস করার কারণে তখন প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষ না খেয়ে মারা যায়। পশ্চিমা যুদ্ধ সাংবাদিকেরা এইটা জানতেন, কিন্ত হয় তারা এই সংবাদ দিতে অনাগ্রহী ছিলেন অথবা পত্রিকাগুলো তাদের পাঠানো সংবাদ প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কিন্তু ১৯৭০ এ পূর্ব পাকিস্তানের এই প্রাকৃতিক দূর্যোগটি একটু আলাদা হয়ে গেল যখন ঘটনার প্রায় সাথে সাথেই এর প্রকৃত চেহারা জানিয়ে সর্বপ্রথম নিউজ করলেন ডেইলি এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ইয়ান ব্রডি, তিনি সর্বপ্রথম বিদেশী সাংবাদিক যিনি তার হংকং বেজ থেকে ঢাকা এসে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নিউজ করেন এবং এই সংবাদটি একটা আন্তর্জাতিক ’ঘটনা’য় পরিণত হয়। ব্রডির নিউজের পরপরই যখন মিরর পত্রিকায় আমার নিউজ প্রকাশিত হল তখন টেলিভিশনের দল চলে আসল এবং এই ‘স্টোরি’ একটা গতি অর্জন করল। ঘটনাটা খ্বু স্বাভাবিকভাবেই অন্যদিকে সরে যেতে পারত যেখানে আন্তর্জাতিক তথা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম স্বভাবতই একটু খেয়ালি, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সাথে তাদের গোলমেলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কিংবা আরো গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদের নিচে এই সংবাদটি চাপা পড়তে পারত, অথবা ব্রডির চেয়ে আরো কম অভিজ্ঞ কোন সাংবাদিক বিষয়টা নিয়ে নিউজ করতে পারতেন যা টেলিভিশন, প্রভাব বিচারে যে মাধ্যমের গুরুত্ব অনেক বেশি, তাকে বাংলা থেকে দুরে রাখতো এবং এসবের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলার দূর্দশা আরও একবার সকলের অগোচর থেকে যেত। এসব শিরোনাম এবং টেলিভিশনের ছবি পূর্ব পাকিস্তানের বাইরে প্রচারিত হওয়া সত্তে¡ও দেখা গেল উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর কাল্পনিক আশু ত্রাণ তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থার আমলাতান্ত্রিক মিষ্টি কথাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচারে গণমাধ্যমের যে দক্ষতা, তার সামনে এগুলো খুবই সামান্য।
এসবের পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে ‘সাহায্য’ হিসেবে প্রচলিত কর্মকান্ডের সুনির্দিষ্ট এবং নির্জলা রাজনৈতিক প্রয়োগ। ১৯৭০ এর সাইক্লোন এবং তার পরবর্তী হিসেব নিকেশ আমাদের পশ্চিমা সাহায্যের আসল প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক কিছুই জানায় যার অন্যতম একটি হচ্ছে এমন সব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিন্যাসকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা যা প্রকৃত সাহায্য যাদের দরকার তাদের প্রয়োজনের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানি সরকার ও তার পুষ্ট সেনাবাহিনীকে মাথায় তুলেছিল ‘পাকিস্তান এইড কনসরটিয়াম’ তথা এর আওতাভূক্ত দেশগুলো যার মধ্যে আছে বৃটেন, কানাডা, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, এবং ইটালি। অন্যদিকে একক কিন্তু আরো কার্যকরী অর্থে একই ভূমিকা নেয় যুক্তরাষ্ট্রও। এসব দেশের সরকার ইসলামাবাদের অগণতান্ত্রিক, পক্ষপাতদুষ্ট ও পাশবিক সরকারকে সময়ের বিচারে একটি জরুরী ‘বোড়ে’ হিসেবে বিবেচনা করত। পাকিস্তান ছিল চীন, যাকে তখন ‘লাল’ চীন বলা হতো এবং প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই অশুভ শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার করা হতো, তার বিপরীতে একটা বোড়ে- ‘বুলওয়ার্ক’। তার পরবর্তী ঘটনাক্রম বিচারে এই পরিহাস নিজেই নিজের প্রমান।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান এইড কনসর্টিয়ামকে বৃটেন ৯ মিলিয়ন পাউন্ড দেয়। ঘূর্ণিঝড় যখন আঘাত হানে, এডওয়ার্ড হিথের সরকারসহ পশ্চিমের অন্যান্য সরকারগুলো পরিস্কার অর্থে বাঙালিদের, যারা এমনিতেই স্থানীয় নির্বাচন ও বিভিন্ন সমস্যায় ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি নিজেদের ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাদের প্রতি সাহায্য পাঠিয়ে পাকিস্তানি জেনারেলদের মনক্ষুণœ করতে চায়নি। এরকম ঘটনার আরো নজির রয়েছে। এক বছর আগে, ১৯৬৯ সালে লেবার পার্টির হ্যারল্ড উইলসন অবরুদ্ধ বায়াফ্রানদের জরুরী ত্রান সরবরাহ করে নাইজেরিয়ান সরকারের মনক্ষূন্ন করতে চায়নি। বৃটিশদের সবচেয়ে বড় তেল সরবরাহক নাইজেরিয়াও ছিল একটা ‘বুলওয়ার্ক’। কাজেই বায়াফ্রানরাও অনাহারে মরেছে।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নভেম্বরের এই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার এক সপ্তাহ পরও সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতেও কোন সাহায্য এসে পৌছায় নাই। বরং এই পুরা সপ্তাহ জুড়ে পাকিস্তানি জান্তা তাদের হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমানগুলোকে পশ্চিমাঞ্চলে অলস বসিয়ে রেখেছে। আওয়ামী লিগের মনে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলনা যে, এই উদাসীনতার পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে অরাজক বিশৃঙ্খল অবস্থা ধরে রেখে পাকিস্তান ধারণার প্রতি বাঙালিদের ক্রমবর্ধমান অনাস্থাকে ছত্রখান করা। এই কঠিন সময়ে এইড কনসরটিয়ামের সদস্যদের কাছ থেকে বা আমেরিকা থেকে কোন ধরণের সাহায্য এসে পৌছায়নি, এক সপ্তাহের মধ্যে পানিশূন্যতা, কলেরা ও আঘাতজনিত কারণে ১৫০,০০০ মানুষ মারা যায়, যাদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধই বেশী। পঞ্চম দিনে আমেরিকান সরকার ঘোষণা করে যে, তারা ছয়টি হেলিকপ্টার সাহায্যের জন্য পাঠাবে, যাদের দুটো নেপাল থেকে এবং বাকি চারটি উত্তর ক্যারোলিনার ব্র্যাগ ফোর্ট থেকে যার মধ্যে দুটোই হচ্ছে উড়ন্ত বুদবুদের মত যেখানে শুধু পাইলটেরই কোনরকমে জায়গা হয়। নেপালের দুটো ইঞ্জিন সমস্যাজনিত কারণে নেপালেই থেকে গেল, উত্তর ক্যারোলিনারগুলো আরো চারদিন সময় নষ্ট করল রক্ষণাবেক্ষণের কাজে। অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টা দুরে ভিয়েতনামে আমেরিকার পাঁচ হাজারেরও বেশী হেলিকপ্টার ছিল, যাদের বেশীর ভাগই অলস বসে আছে প্রশিক্ষিত ক্রু নিয়ে, যারা প্যারাশুটের সাহায্যে সরবরাহ নামাতে সক্ষম।
বলা হচ্ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে সাহায্যসহ জাহাজ পাঠিয়েছে কিন্তু এ ব্যাপারে দেখা গেল কেউই নিশ্চিত নয় এবং সবাই আরো বেশি অনিশ্চিত এই সাহায্য কবে বা কখন এসে পৌছাবে এই বিষয়ে। সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, এবং অন্যান্য ই ই সি ভুক্ত দেশগুলো অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্র“তি দিলো যার কোন তাৎক্ষনিক উপযোগ নেই। কিছু সাহায্যের নিদর্শন এসে পৌছাল যার মধ্যে ছিল কম্বল, শিশুদের খাবার, অস্থায়ী ইলেকট্রিক ফ্লাশযুক্ত টয়লেট ইত্যাদি যার বেশীরভাগই ঢাকা বিমানবন্দরে পড়ে থাকল হেলিকপ্টার ও লরির অভাবে।
ঘূর্ণিঝড়ের আট দিন পর ত্রাণ সাহায্যসহ বৃটেনের একটি প্লেন এসে পৌছায়। তার কিছুদিন পরেই ইঞ্জিন চালিত তেরোটি নৌযান এসে পৌছায় যেগুলোর কোন কর্মী নেই। যাইহোক, এক সপ্তাহব্যাপী পত্রিকার হেডলাইনের কিছু ফল দেখা যাচ্ছিল যদিও দূর্ভাগ্যবশত এগুলো ছিল অদরকারি ফল। ঘূর্ণিঝড়ের এগারদিন পরে দুটো রয়েল নেভি শিপের একটা ‘টাস্কফোর্স’ সিঙ্গাপুর থেকে এসে বঙ্গোপসাগরে ঢুকল। টাস্কফোর্সের সুভাষী অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার রয় ওভেন্স ঢাকায় ভোজ সহযোগে প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলেন এবং লন্ডনের হেডলাইনগুলো তাদের সুর পাল্টে ফেলল। মিরর পত্রিকা প্রথম পাতার একটি প্রধান নিবন্ধ ঘোষণা করল ‘আজ আপনারা বৃটিশ হওয়ার জন্য গর্বিত বোধ করতে পারেন’, এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুরনো জনসংযোগ কৌশল যাতে বৃটিশ মিলিটারি অন্য অনেক কিছুর চেয়ে বেশি দক্ষ। মিরর এর নিবন্ধ আরো লিখল:
“আজ হচ্ছে সেই মুহূর্ত যখন বৃটিশ হিসেবে নিজেদের গর্বকে আমরা গ্লানি ও ভারমুক্ত করতে পারি। এই হচ্ছে সেই খবর যা সকলের হৃদয়কে একটু হলেও সিক্ত করবে- পূর্ব পাকিস্তানের ঘূর্ণিদূর্গত এলাকায় কার্যকরী বৃটিশ সাহায্য পৌছানো শুরু করেছে।”
নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে এই আত্মতৃপ্তি একটু ম্রিয়মান হয় এবং সত্য খানিকটা উঁকি দেয়:
“রেডক্রসের হিসাবে এখনো দিনে গড়ে ত্রাণ সাহায্যের অপেক্ষায় থাকা এক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বৃটিশ সাহায্য কি আরেকটু আকারে বড় বা দ্রুত হতে পারে?” (দি ডেইলি মিরর, নভেম্বর ২৩, ১৯৭০)
বাস্তবতা আর তা নিয়ে সমস্ত সংশয় এখন ঘটনার আওতার বাইরে চলে যাচ্ছিল। ব্রিগেডিয়ার ওভেন্স বৃটিশ সাংবাদিকদের একত্র করলেন, তারপর আমাদের হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে এইচ এম এস ইন্ট্রেপিডে (রয়েল নেভি শিপ) নিয়ে গেলেন এবং আমাদের আরো একটি ব্রিফিং দিলেন। তিনি বললেন প্রথম ‘মার্সি মিশনে’ আমাদের মত সাংবাদিকদের যাওয়া উচিৎ যাতে করে আমরা সময় মত ইন্ট্রেপিডে ফিরে আসতে পারি এবং রয়েল নেভির নতুন স্কাইনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত খবর পাঠাতে পারি যা সরাসরি ছাপানো ও শব্দ সংকেত আকারে বৃটিশ কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয় এবং প্রতিরক্ষা অধিদপ্তর তা মুহূর্তেই পেয়ে যায়। ঢাকার টেলিগ্রাফ অফিসে গলদঘর্ম হয়ে অনেকবার আসা যাওয়ার পরে স্কাইনেট মনে হল এক বিশাল বাঁচোয়া। ইন্ট্রেপিডে একটি ‘প্রেস অনলি’ কক্ষ বরাদ্দ হল যেখানে টাইপরাইটারগুলো গাদা গাদা গোলাপি কাগজ নিয়ে অপেক্ষায় থাকল, নাবিকেরা একছুটে আমাদের দেয়া খবর স্কাইনেটে দেয়ার জন্য সদা দন্ডায়মান এবং অফিসার্স মেসের একটি পানশালা আমাদের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হল।
কাজেই আমরা যথারীতি ‘মার্সি মিশন’গুলোতে সাথী হয়ে উড়ে গেলাম কিন্তু যেমনটা আমাদের বলা হয়েছিল কোথাও সে রকম কিছু দেখতে পেলাম না- কোন নাবিককে মৃতদেহ সৎকার অথবা কোন প্রকৌশলীকে বাঁধের ব্যবস্থা করতে দেখলাম না। আমার হেলিকপ্টার ছয় বস্তা চাল, কিছু চা পাতা এবং চিনি নিয়ে গেল যার মধ্যে দুটো বস্তাই মাটিতে পরার আগেই খুলে যায়। তারপরও এই যৎসামান্য সাহায্য পেয়েই গ্রামবাসীরা কৃতজ্ঞ হল এবং আমরা উড়ে চলে যাবার সময় উল্লাস প্রকাশ করল।
ডেইলি টেলিগ্রাফে ডেভিড লোশাক লিখলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ তৎপরতায় বৃটিশদের অবদান… প্রতিরক্ষা মহলে পূর্ব সুয়েজে তাদের উপস্থিতি ও ভূমিকার মাহত্ম ও যথার্থতাকেই তুলে ধরছে’ (ডেইলি টেলিগ্রাফ, নভেম্বর ২৫, ১৯৭০)। লোসাক ঠিক জায়গাটিতেই আঙ্গুল রেখেছিলেন। রয়েল নেভি তখন সুয়েজ খালের পূর্বে তাদের পুরোনো উপস্থিতি জায়েজ করবার চেষ্টা করছিল এবং এই হৃদয়গ্রাহ্য উষ্ণ শিরোনামগুলো এর চেয়ে বেশি সময়োচিত আর হতে পারত না। মিররকে পাঠানো আমার খবরে ‘উদ্ধার কাজে’র দূর্বল প্রকৃতি আমি তুলে ধরেছি এবং এক্ষেত্রে রয়েল নেভির অদক্ষতার সাথে জনসংযোগের ক্ষেত্রে তাদের চমকদার দক্ষতার তুলনামূলক বিচার করেছি। কোন এক কারণে সেদিনের আটটি রিপোর্টের মধ্যে আমার রিপোর্টটিই ছিল একমাত্র যা চমকপ্রদ স্কাইনেট বিকেলের সংখ্যা ধরানোর জন্য লন্ডন পাঠাতে সক্ষম হলো না। এটা শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরের একজন বয়স্ক বার্তাবাহক সাইকেলে করে পৌছে দেন হলবর্ন সার্কাসের মিরর অফিসে- পাঠানোর দুই দিন পরে।
এবং তার পরপরই আমাকে অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে লন্ডন ফিরে যেতে ডাকা হয় কারণ ততক্ষণে ‘স্টোরি’ হিসেবে এই সাইক্লোন এখন ‘মৃত’। আমাদের চলে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই রয়েল নেভি টাস্ক ফোর্স তার স্কাইনেট, টাইপরাইটার এবং গোলাপি কাগজের বান্ডিলসহ বঙ্গোপসাগর থেকে আলগোছে বেরিয়ে গেল। আরো দশ দিন পর মিরর এর বার্তা কক্ষে এ ইউ এম ফখরুদ্দিন আবার টেলিগ্রাম করলেন- এখনো পটুয়াখালীর দ্বীপগুলোতে শত শত ছোট আগুনের সংকেত জ্বলছে ‘সাহায্যের জন্য আকুল আবেদন’ জানিয়ে।