- আ-আল মামুন
সম্পাদকীয় মন্তব্য: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আ-আল মামুন রচিত মক্কেল রাষ্ট্রের একটি সংবাদপত্রে মার্কিন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে;মানুষ, সন্ত্রাস-মিডিয়া-যুদ্ধ সংখ্যায়। প্রকাশের তারিখ থেকে বোঝা যাচ্ছে তখন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামক যুদ্ধোন্মাদে আক্রান্ত পুরো পৃথিবী; ১/১১ এর পরপরই আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিনি আগ্রাসন শুরু হয়েছে: শ্লোগান কখনো ওয়ার অন টেরর, কখনো ইরাককে ‘স্বৈরাচারে’র হাত থেকে মুক্তকরণ। এর ঢেউ বিভিন্নভাবে এসে পড়েছে বাংলাদেশে, নানামুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। মার্কিনি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কীভাবে বাংলাদেশের পত্রিকায় উপস্থাপিত হয়েছে, কোন ধরনের ন্যারেটিভ কোন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, কোন ধরনের মনোভাব এতে প্রকাশিত হয়েছে তা-ই এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। সম্প্রতি আবারো আফগানিস্তান, তালেবান, মার্কিনি সেনা প্রত্যাহার, সবকিছু নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হয়েছে। সেই সাথে সংবাদ পরিবেশনার রাজনীতি নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়াতে বাৎচিত চালু আছে, বা শুরু হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আ-আল মামুনের প্রায় ২০ বছর পূর্বের প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে পুনরায় প্রকাশিত হলো। প্রকাশের অনুমতি দেয়ার জন্য আমরা আ-আল মামুনের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। [বি: দ্র: লেখকের ‘প্রথম আলোয় ইরাকে মার্কিনি হামলা: আগ্রাসন যখন মুনাফার মওকা’ লেখাটিও ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হবে।]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার স্নায়ুকেন্দ্র পেন্টাগন এবং কর্পোরেট-স্বার্থসংরক্ষণমূলক বিশ্বায়নের চাকা বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রে ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ তারিখে পরিচালিত হামলা নিঃসন্দেহে পশ্চিমা অহংকারে আঘাত হানার মতো কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো ঘটনা। সাড়া জাগানো ঘটনা বলছি একারণে যে, নোম চমস্কির ভাষায় বলতে হয়, “এই প্রথমবার বন্দুকের নল উল্টোদিকে ঘুরেছে। এটা নাটকীয় এক পরিবর্তন” (www.z net.org.-এ সংকলিত নোম চমস্কির কম্পেজিট সাক্ষাৎকার-১)। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যেমন তাদের পদানত ‘নেটিভদের’ দ্বারা কয়েকটি দুর্লভ ব্যতিক্রম ছাড়া কখনো আক্রান্ত হয় নি তেমনি বর্তমান বিশ্বে পাগলা ষাঁড়ের মতো ঢুঁষিয়ে বেড়ানো মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এর আগে নিজ ভূখণ্ডে অন্য কারো দ্বারা আক্রান্ত হয় নি; যদিও গত অর্ধ শতকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন আক্রমণ-আধিপত্যের বলির সংখ্যা অপরিমেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার কারণ অনুসন্ধান করে তার প্রতিকার করার চেষ্টা করে নি, চেষ্টা করে নি আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিয়ে অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচারের। সন্ত্রাস মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নেয়ার দৃষ্টান্ত কিন্তু আমাদের সামনে আছে। নিকারাগুয়ার বিরুদ্ধে রিগ্যান-মার্কিনি যুদ্ধ দেশটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল। নিকারাগুয়া এর জবাব দিয়েছিল। তারা ওয়াশিংটনে বোমা ফেলার মাধ্যমে জবাব দেয় নি বরং জবাব দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে। আন্তর্জাতিক বিচারালয়, বিশ্ব আদালত ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছিল। বিশ্ব আদালত নিকারাগুয়ার পক্ষে রায় দিয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বেআইনীভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগের’ – যার অর্থ সন্ত্রাসবাদ- জন্য তিরস্কার করেছিল এবং ব্যাপক ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রায় অবজ্ঞার সাথে খারিজ করে দেয়। “এযাবৎকালের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যে-দেশ একই সাথে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের জন্য বিশ্ব আদালত কর্তৃক নিন্দিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করেছে (“সন্ত্রাস কাজে আসে”, নোম চমস্কি, www.z net.org.)।
অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্মম প্রতিশোধ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। নিউ ইয়র্ক পোস্ট দাবী করেছিল, ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে আমরা চাই প্রতিশোধ’। (প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১)। এক মুহূর্তও দেরি না করে যুক্তরাষ্ট্র ওসামা বিন লাদেনকে অভিযুক্ত করেছে। হেইকেলের ভাষায়, “দেশীয় জনগণের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তৎক্ষণাৎ আঘাত করার মতো একটা শত্রুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ”। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কলিন পাওয়েল বলেছিলেন, লাদেন যদি ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার জন্য দায়ী নাও হয় তাতে কিছু এসে যায় না। ইতোমধ্যে সে অনেক অপরাধ করেছে যে-জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। (“আফগানিস্তানে এক মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের মিসাইল-তুল্য একটিও লক্ষ্যবস্তু নেই”, মোহাম্মাদ হেইকেল, মধ্যপ্রাচ্যের অত্যন্ত সম্মানিত রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং মিশরের কর্নেল নাসেরের মন্ত্রীসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, www.z net.org.) লাদেনকে আশ্রয় দেয়ার জন্য স্বাধীন স্বার্বভৌম আফগানিস্তানের ওপর ৭ অক্টোবর ২০০১ থেকে সামরিক হামলা চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র ও তার মিত্ররা সেখানকার তালেবান সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের পছন্দের সরকার বসিয়েছে। অবশ্য যে-লাদেনকে হস্তগত করার অজুহাতে এতো বড় সামরিক অভিযান চালানো হলো সেই লাদেন এখনো মার্কিনিদের নাগালের বাইরে। অথচ কার্পেট বম্বিং-এ আফগানিস্তান গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। আসলে লাদেনকে পাকড়াও করার কথা ছিল বাহানা মাত্র, মার্কিন স্বার্থ এর চেয়েও বড়। এজন্যই হয়তো মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামস্ফেল্ড বলেছিলেন, “…সমস্যাটা লাদেনের চেয়ে অনেক বড় এটা পরিস্কার” (প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০১)।
বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে হামলা এবং তার প্রতিশোধ হিসেবে একটি দেশকে বোমাবর্ষণের মাধ্যমে ‘প্রস্তরযুগে পাঠিয়ে দেয়ার’ ঘটনা সম্পর্কে আমাদের যে বোধ-ধারণা-দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে তা মিডিয়াবাহিত। মিডিয়া কেমন বোধ-ধারণা-দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে , কীভাবে গড়ে তুলেছে এবং কার স্বার্থে মিডিয়া প্রকাশ্যে-গোপনে এমন কাজ করে যায় সেটাই বিচার্য বিষয়। অভিমত নিজ পক্ষে রাখার জন্য মিডিয়ার মাধ্যমে একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার এক ভয়ানক খবর আমরা পাই উপসাগরীয় যুদ্ধের পর। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-স্যান দিয়াগোর অধ্যাপক হার্বাট শিলার তার ম্যাস কমিউনিকেশন্স এন্ড এ্যমেরিকান এম্পায়ার (ওয়েস্টভিউ প্রেস, পৃ.১, ১৯৯২) গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে মার্কিন মুলুকে এবং সারা বিশ্বে উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্য ও ভাষ্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে একটা মাত্র টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। আর সে নেটওয়ার্ক হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন)। সিএনএন কেবল দুটি উৎস থেকে – পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউস – তার তথ্য-ভাষ্যের উপকরণ সংগ্রহ করেছিল। অর্থাৎ, উপসাগরীয় অঞ্চলে কী ঘটছিল এবং তার তাৎপর্য কী প্রায় পুরো বিশ্বব্যপী সে-সম্পর্কিত ধারণা গড়ে উঠেছিল একটি মাত্র মার্কিন সূত্রের মাধ্যমে এবং এভাবেই মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন দেশের সংবাদ-মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সুকৌশলে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে উপসাগরীয় যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবং এই নিবন্ধের আলোচ্য ঘটনাপ্রবাহও ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন। মার্কিন আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া ‘পোষা কুকুরের মতো’ মার্কিন সরকারকে সদাসর্বদা অনুসরণ করে। এই উপমা চমস্কি ও হারম্যানের (দেখুন তাদের লেখা ম্যানুফ্যাক্চারিং কনসেন্ট গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়; ভিন্টেজ, ১৯৯৪)।
হার্বাট শিলার তার গ্রন্থে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আরও জানাচ্ছেন যে মার্কিন সাংস্কৃতিক পণ্যের দাপটের কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছে অন্য সকল দেশের সাংস্কৃতিক পণ্য। যেকারণে মার্কিন সাংস্কৃতিক পণ্যে যে মূল্যবোধ-বিশ্বাস-জীবনাচরণ-ঢঙ তুলে ধরা হয় সেই একই ঢঙ অনুকরণ করা হয় অন্য সকল দেশের সাংস্কৃতিক পণ্যের বেলায় (দেখুন, পৃ ১২-১৩)। সংবাদ-মিডিয়ার ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য? আমাদের দেশের সংবাদ-মিডিয়াও কি জ্ঞাতসারে-অজ্ঞাতসারে পশ্চিমা ‘প্রচারণা-মাধ্যম’ (প্রচারণা-মাধ্যম কেন বলছি সে-ব্যাখ্যা পরে দেব) অনুকরণ করে তাদেরই মূল্যবোধ-বিশ্বাস-দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে? আমাদের সংবাদ-মিডিয়া কি পশ্চিমা এবং দেশীয় কর্পোরেট-স্বার্থকেই বড়ো করে দেখে?
বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্র প্রথম আলোর এক মাসের বিষয়বস্তু বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই নিবন্ধ তৈরী করা হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর ২০০১ থেকে ১১ অক্টোবর ২০০১ সময়কালের প্রথম আলোর প্রতিটি সংখ্যার খবর-মন্ত্যব্য
প্রতিবেদন-সম্পাদকীয়-কলাম এই প্রবন্ধের মসলা হিসেবে কাজ করেছে। প্রথম আলোকে বিচার-বিশ্লেষণের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে কারণ হচ্ছে পত্রিকাটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে; বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর সাথে ‘তারকা জরিপ’ ও অন্যান্য আয়েজনের মাধ্যমে প্রথম আলো বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর বক্ত্যব্যও সাফল্যের সাথে প্রচার করছে; এবং বিভিন্ন আলোচনা-সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে পলিসি পর্যায়েও ভূমিকা রাখছে। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের প্রতিদিনের ঘোষণা অনুযায়ী এই পত্রিকাটি ‘সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক’, যদিও বাংলাদেশের অন্য দৈনিক সংবাপত্রও একই দাবী করে। শুধু তাই নয় তাদের একটি প্রমোশনাল বিজ্ঞাপনে হরহামেশাই প্রচার করা হচ্ছে: ‘চোখ খুললেই প্রথম আলো, চোখ খুলে দেয় প্রথম আলো’। আসুন বিচার করে দেখা যাক প্রথম আলো পত্রিকাটি আমাদের জগত দেখার চোখ খুলে দেয় না কি আমাদের চোখ তুলে নেয়।
প্রসঙ্গত বলে নেয়া দরকার এই লেখার শিরোনামে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মক্কেল রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করারও একটা মাজেজা আছে। আমাদের দেশের এমন অবস্থা হয়েছে যে মার্কিন মোড়লের হুকোয় তামাক সেজে দেয়ার জন্য সে বিনয়ানুগত্যে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। সেকারণেই বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো রকম গণমতের তোয়াক্কা না করে আফগানিস্তানে হামলার প্রয়োজনে আকাশসীমা ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের মার্কিন প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বসে। আধিপত্যশীল রাজনৈতিক দলগুলোও সেইসাথে সুর মেলায়। “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ তার আকাশসীমা ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে দিতে সম্মত হয়েছে। … প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্পষ্ট করেই বলেছে, এব্যপারে বাংলাদেশের ইতিবাচক সাড়া দেয়া উচিত” (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১)। বাংলাদেশের পক্ষে হয়তো বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এমন নতজানু অবস্থান নেয়ার কোনো বিকল্পও নেই। অবশ্য ইসরাইল, পাকিস্তান, সৌদি আরব কিংবা ফিলিপাইন যেমন সাচ্চা মক্কেল রাষ্ট্র বাংলাদেশ অতোটা ঈমানদার মক্কেল এখনও হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যই সজাগ জনগণ এক্ষেত্রে বাধা তৈরী করে। তবে আর বাকিও নেই। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস উত্তোলন ও রপ্তানি বিষয়ে মার্কিনি খবরদারি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
“অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী আক্রমণ মোকাবিলায় অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে”। প্রথম আলোর ১৩ তারিখের সংখ্যাটি হাতে নিন; দেখবেন প্রথম পাতায় আট কলামব্যাপী এক শিরোনাম “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ”। এই শিরোনামের খবরটির শুরু হয়েছে আমি যেভাবে এই অনুচ্ছেদটি শুরু করলাম ঠিক সেভাবে। কিন্তু কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধে” জড়িয়ে পড়েছে? কারণ, তাদের ২ * ১১০ তলার অহংকার এবং পঞ্চভূজ সান্ত্রীভবনে হামলা চালানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের আশ্রয় নিয়ে হামলাকারীদের শনাক্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করলেই তো হয়। সেটাই তো সভ্য সমাজের রীতি যে আক্রান্ত হলে সেই রাষ্ট্র আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের আশ্রয় নেবে। কিন্তু না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমন সাদামাটা স্বাভাবিক পথে এগোয় না। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার একদিন না যেতেই তারা “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধে” জড়িয়ে পড়ে।
মার্কিন প্রশাসন কেবল একা এই “অবিশ্বাস্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে” তা কিন্তু নয়। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে অর্জুনের সারথি ছিলেন যেমন কৃষ্ণ তেমনি মার্কিন সরকারের এই “অবিশ্বাস্য যুদ্ধে” সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে মতাদর্শিক যুদ্ধ চালানোর দায়িত্ব নেয় মিডিয়া (সচরাচর এমনটাই দেখা যায়)। সেকারণেই হামলার পর একদিন পার না হতেই পশ্চিমা আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়ার মতো আমাদের প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আট কলামব্যাপী শিরোনামে এবং বিষয়বস্তুতে “অবিশ্বাস্য যুদ্ধ” শুরু হয়ে যায়- একটা এজেন্ডা নির্ধারিত হয়ে যায়।
তারপর চলে মিডিয়ার পাতায় যুদ্ধের মাঠ প্রস্তুতের কাজ। এবং তারই অংশ হিসেবে এই একই রিপোর্টে বলা হয় “বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে আঘাত করা একটি বিমানের পাঁচজন আরব যাত্রীকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে”। আরও বলা হয় “যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একাধিক হামলার মূল হোতা বলে কথিত ওসামা বিন লাদেন এই ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করলেও মার্কিন কর্মকর্তাদের বড় সন্দেহ তার ওপরই”। লক্ষণীয় যে আফগানিস্তান ছাড়া অন্য কোনো দেশের, অন্য কোনা জাতিসত্তার কারো বিরুদ্ধে সন্দেহের আঙ্গুল তোলা হলো না। আমরা দেখবো এই সন্দেহই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, মার্কিনি হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের যুক্তিভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য এই রিপোর্টেই লক্ষ্যবস্তু নির্দিষ্ট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বলা হয়, “ম্যাসাচুসেট্স কর্তৃপক্ষ পাঁচজন আরবকে সন্দেহভাজন বিমান ছিনতাইকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।… দুটো লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ব্যাপারে ওসামা বিন লাদেনের সমর্থকদের মধ্যে টেলিযোগাযোগের এবং অন্তত একজন পাইলট এ্যাটেন্ডেন্ট ও দুই বিমানযাত্রীর মধ্যকার সেলফোন কল ইন্টারসেপ্ট করার পর তদন্তকারীরা ঘটনার সঙ্গে লাদেনের সম্ভাব্য একটি যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন”। প্রথম আলোর পাতায় পরবর্তী একমাসে হামলার সাথে আর অন্য কারো যোগসূত্র খুঁজে দেখা হয় না এবং এভাবেই প্রথম আলো কোনোরকম প্রশ্ন না তুলে আনুগত্যের সাথে মার্কিন সরকারের একটা এজেন্ডাকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়ার কাজে নিজেকে লিপ্ত করে। প্রথম আলোর এই মিশন সফল করতে ১৩ তারিখের পত্রিকাতেই প্রথম পাতায় ছাপা হয় “বিন লাদেনের প্রতি সন্দেহ বাড়ছে” শিরোনামের তিন কলামের খবর। হামলার একদিন পরই ওসামাকে অভিযুক্ত করে বড়ো আকারের একটি সংবাদ-কাহিনী নির্মাণ এবং ছবি প্রকাশ করা, বিভিন্ন উদ্ধৃতি ব্যবহারের মাধ্যমে ওসামার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করার চেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম আলো শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয় না। একজন আরবের মুখ দিয়ে লাদেনের সংশ্লিষ্টতার কথা বলানো গেলে সন্দেহকে আরো পোক্ত করা যায়। তাই লন্ডনভিত্তিক আল্-কুদস আল আরাবী পত্রিকার সম্পাদক আবদেল বারী আতওয়ানকে উদ্ধৃত করে এই সংবাদ-কাহিনীতে বলা হয়, “তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এই হামলার সাথে লাদেন জড়িত। উল্লেখ্য, আল-কায়েদা দলের সাথে আতওয়ানের যোগাযোগ আছে”। না হয় বোঝা গেল যে আল-কায়েদার সাথে আতওয়ানের যোগাযোগ থাকার কারণে তিনি এসম্পর্কে কথা বলার অধিকারী। কিন্তু কোন প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি এমন রায় দিলেন? আর আল-কায়দার সাথে আতওয়ানের সম্পর্ক শত্রুতাপূর্ণ না কি মিত্রতাপূর্ণ এই তথ্যগুলোও স্বাধীন বিচারের জন্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয় না। বরং এই উদ্ধৃতির পরই সংবাদ-কাহিনীতে বলা হয়, “গত তিন মাস আগেও তিনি হুমকি দিয়েছিলেন, অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের হামলা চালানো হবে”। পাঠক দেখুন, কী চমৎকারভাবে প্রথম আলো হামলার মাঠ নির্মাণ করে দিচ্ছে।
লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত হয়েছে। এবার এই লক্ষ্যবস্তুতে হামলার সমর্থনে জনমত গড়ে তুলতে হবে। প্রথম আলো এগিয়ে আসে। মার্কিন যুক্তরষ্ট্রে হামলা সম্পর্কে মানবিক আবেদন সৃষ্টি করে, লাদেন ও আফগানিস্তান সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রচার করে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক মার্কিন সরকারকে সমর্থন করাকে প্রথম আলো জনমত গড়ে তুলতে কাজে লাগায়। ১৩ তারিখের পত্রিকার ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় সাত কলামব্যাপী লাল কালির “যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়” শিরোনামের খবরটি লক্ষ করুন। এমন হামলার ঘটনায় নিন্দা-প্রতিবাদ জানানো খুব স্বাভাবিক, সেটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছি না। মৃত্যু মৃত্যুই। বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে হামলার ফলে যে-মৃত্যু ঘটেছে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবু ইঙ্গ-মার্কিন হামলা এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকে ১৫০০০০০ মানুষ মারা গেলেও আমাদের পত্রিকায় কোনো ঝড় ওঠে না; ইরাকের পক্ষ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলার জন্য জনমত গড়ে তোলা হয় না। ইরাকের জন্য কোনো সাত কলামের লাল কালির শিরোনাম থাকে না। কিন্তু মার্কিন দেশে ৬০০০ মানুষ নিহত হলে মিডিয়াতে এমন “নিন্দা-প্রতিবাদের” ঝড় ওঠে এবং এই হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রণদামামা বাজানো হয়। এই বৈপরিত্যটাই লক্ষ করতে বলছি। ন্যাটোকে উদ্ধৃত করে এই সংবাদ-প্রতিবেদনে বলা হয়, “ন্যাটোর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মার্কিনিদের লড়াইয়ে জোর সমর্থনদানের অঙ্গীকার করেছে। ন্যাটোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্বের সকল সভ্য দেশকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হবে”। ন্যাটোকে মার্কিন সরকারেরই সম্প্রসারণ বলা যায়। সাম্প্রতিককালে কসোভোতে কিংবা ইরাকে মার্কিন হামলার সময়ই আমরা সেটা লক্ষ করেছি। কিন্তু ন্যাটোর সেই ভূমিকা ব্যাখ্যা করে বলা হয় না। বরং “সভ্য দেশগুলোকে”- পাশ্চাত্যের ন্যাটোভুক্ত যে দেশগুলো শত শত বছর ধরে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন-আমেরিকা এবং পূর্ব-ইউরোপে তলোয়ারের জোরে অসংখ্য দেশকে পদানত করে নির্বিচার হত্যা ও লুণ্ঠন চালিয়েছে এবং এখনও নব্য-সাম্রাজ্যবাদী কালে সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে- আরও একবার এগিয়ে আসার আহবানকে প্রথম আলো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেছে । পাশ্চ্যাত্যের আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া মার্কিন হামলার পক্ষে যেভাবে কাজ করে যায় প্রথম আলোও সেভাবে কাজ করতে চায়। সেকারণে ১৩ তারিখের প্রথম আলোর ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় ছাপা হয় “বিশ্বের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে হামলার ঘটনাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে” শিরোনামের খবর। খবরটিতে ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকীয় নিবন্ধের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়, যেখানে বলা হচ্ছে, “ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা প্রতিহত করতে এবং দেশকে রক্ষা করার জন্য বুশ প্রশাসনকে অবশ্যই আগ্রাসী ভূমিকায় নামতে হবে। আর পুরো জাতিকে শান্তি ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে নতুন শতাব্দীর এই প্রথম যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। …. সন্ত্রাসবাদের সকল উৎসের মূল উৎপাটন না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অঘোষিত যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য আগের চেয়েও শক্তিশালী করে তুলতে হবে”। মার্কিন সরকারের পলিসির সাথে ওয়াশিংটন পোস্টের এই বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে সাযুজ্যপূর্ণ। মূলত মার্কিন সরকারের পলিসিগুলোকে আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়াগুলো এভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তোলে, জনগণকে যুদ্ধের পক্ষে উষ্কে দেয়। পেন্টাগন-গবেষণা প্রকল্পের প্রথম পরিচালক হার্বাট ইয়র্ক তার রোড টু অবলিভিয়ন গ্রন্থে এজন্যই বলেছেন, ১৯৪৫ সালের পর থেকে মার্কিন সমর শক্তি খারাভাবে বাড়তে থেকেছে এবং প্রতিটি সংকটজনক মূহুর্তে মার্কিন প্রশাসন অস্ত্র প্রতিযেগিতায় ইন্ধন জুগিয়েছে। (উদ্ধৃত, “আক্রমণের বাজেট”, এডওয়ার্ড এস হারম্যান, মানুষ-এ অনুদিত)। এমন বক্তব্যকে প্রথম আলোর পাতায় স্থান দেয়ার মাধ্যমে এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন কোনা মিডিয়ার বক্তব্য উদ্ধৃত না করার মাধ্যমে প্রথম আলো মার্কিন সরকারের পক্ষেই কাজ করে যায় এবং “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধের” পক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
জনমত গড়ে তোলায় প্রথম আলোর অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সম্পাদকীয় পাতায় একটি কলাম ছাপা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে। এ লেখাটি আর ডব্লিউ এ্যপল জুনিয়র-এর। লেখাটির শিরোনাম “এ যুদ্ধ এমন শক্তির বিরুদ্ধে যাকে শনাক্ত করা কঠিন”। দেখুন, শিরোনামেই যুদ্ধর প্রস্তাব করা হচ্ছে। লেখাটিতে বিভিন্ন রণকৌশলগত দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে সম্ভাব্য হামলাকারী কারা কারা হতে পারে তা আলোচনা করা হয় নি, কেবল ওসামার নাম উঠে এসেছে এবং প্রতিশোধ হিসেবে আফগানিস্তানে হামলা চালাতে হলে কীভাবে এগোতে হবে সেই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ্যপল জুনিয়র লিখেছিলেন ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে হামলার পরপরই। আর তৎক্ষনাৎই তিনি লাদেনকে হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত করে ফেলেছেন এবং তার আশ্রয়স্থল আফগানিস্তানে হামলার প্রস্তাব করে বসেছেন! অন্য কোনো বিকল্পের কথা তিনি বলেন নি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে মার্কিন সরকারের সাথে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর স্বার্থ এক তারে বাঁধা। নোম চমস্কি এবং হারম্যান তাদের ম্যানুফ্যাক্চারিং কনসেন্ট গ্রন্থে প্রমাণ করে দেখাচ্ছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ্যভাবে নিকারাগুয়ার সান্দিনিস্তা সরকারকে অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিলে যেমন নিউ ইয়র্ক টাইমস মার্কিন সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব নেয় তেমনই গুয়েতেমালা ও এল সালভাদরে মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারের ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞের পক্ষেও মার্কিন সরকারের সাথে সাথে নিউ ইয়র্ক টাইমসও সাফাই গাইতে থাকে (দেখুন, প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়)। এবং সেকারণেই এ্যপল জুনিয়রের অন্য কোনো বিকল্পের কথা না-বলাটাই স্বাভাবিক। সিআইএ’র কাউন্টার টেরোরিস্ট অপারেশনের সাবেক প্রধান ভিনসেন্ট ক্যানিস্ট্রারো’র ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ছাপা মূল লেখা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে প্রথম আলো ছেপেছে ১৫ সেপ্টেম্বরের সম্পাদকীয় পাতায়। লেখাটির শিরোনাম যদিও “প্রতিশোধ সমাধান হতে পারে না”। তবু বিনা প্রমাণেই লেখাটিতে লাদেনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা পুরো লেখা জুড়েই প্রস্তাব করা হচ্ছে ‘সন্ত্রাস’ দমনের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর কথা এবং “তালেবানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লাদেনকে তুলে দিতে। তালেবানরা তা না করলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেনাবাহিনী ব্যবহারসহ একটি সামরিক অভিযান চালানো। তখন সামরিক অভিযান চালিয়ে জঘন্য হামলার পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের সমর্থনকারী সরকার উভয়কে ধ্বংস করা উচিত কাজ হবে”। কিন্তু প্রথম আলো কেন নিউ ইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াশিংটন পোস্ট-এ ছাপানো এসব কলাম পূর্নমূদ্রণ করে? সে কি কেবল মার্কিন সরকারের অবস্থান জানানোর জন্য? না। সে গুড়েবালি। বরং আমরা বলতে পারি নিউ ইয়র্ক টাইমস কিংবা ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সাথেই প্রথম আলো একাত্বতা বোধ করে।
“যুক্তরাষ্ট্রে ৭ হাজার গোয়েন্দা তৎপর” শিরোনামের খবরটি ছাপা হয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথম পাতায়। কত গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছে সেটা কি পাঠককে জানানোর প্রয়োজন ছিল? গোয়েন্দাদের তো তৎপর হওয়ারই কথা। তবে কেন এই গোয়েন্দা সংখ্যাকে খবর বানানো হচ্ছে? এজন্যই খবর বানানো হচ্ছে যে গোয়েন্দা সূত্র যেসব তথ্য দেবে তা যেন পাঠক নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে বসে। খবরের বিষয়বস্তুতে তাই বলা হচ্ছে, “৫০ ব্যাক্তিকে এপর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে যারা গত মঙ্গলবারের ঐ ভয়াবহ হামলার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত”। কোনা সন্দেহ নয় একেবারে নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে। ব্যতিক্রমহীনভাবেই এরা সকলে আবার আরব মুসলমান। এবং “বিধ্বংসী ঐ হামলা চালানোর জন্যই তারা সেখানে বিমান চলানো শিখেছিল বলে মনে করা হচ্ছে”। মানুষ কি শুধুই হামলা চলানোর জন্য বিমান চালানো শেখে? অন্য কোনো কারণ কি থাকতে পারে না? প্রথম আলো এমন অদ্ভুত উপায়ে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার পর একই সংবাদ-কাহিনীতে বলে, “পশ্চিমী উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্ব্যর্থহীন সংহতি প্রকাশ করেছে”। ‘উন্নত’, ‘গণতান্ত্রিক’ ‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দগুলো পাঠক মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করবেন। আরো দেখুন এই রিপোর্টেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার রিপাবলিকান প্রতিনিধির উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বলা হচ্ছে, “লাদেনই একমাত্র ব্যক্তি যার পক্ষে এমন হামলা চালানো সম্ভব”। কোনো রাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো মহলের পক্ষে কি এমন হামলা চালানো সম্ভব নয়? আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে দুটি সরকারি ভবন বোমা হামলার মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হলেও মার্কিন আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে হামলা চালানোর। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই একটি মিলিশিয়া বাহিনী সে হামলা চালিয়েছিল। তবে কেন কেবল লাদেন সম্পর্কে এমন নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে? হেইকেল কী বলছেন শুনুন, “যে সামান্য তথ্য-প্রমাণ তার সংশ্লিষ্টতার পক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে তা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। আল কায়েদা সম্পর্কে বুশ এমনভাবে কথা বলছেন যে শুনে মনে হয় তিনি যেনবা নাজী জার্মানী কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্যম্যুনিস্ট পার্টি সম্পর্কে কথা বলছেন। এসব দেখে আমি হাসি। কারণ আল কায়েদা সম্পর্কে আমি জানি। বেশ কয়েক বছর ধরে লাদেন নজরবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তার প্রতিটি টেলিফোন কল মনিটর করা হয়; আল কায়েদাতে মার্কিনি, পাকিস্তানী , মিশরীয় এবং সৌদি গোয়েন্দা বিভাগ চর ঢুকিয়ে রেখেছে। ফলে তার পক্ষে এমন বিশাল মাপের হামলার জন্য যে সাংগঠনিক তৎপরতা ও সুক্ষতা দরকার গোপনীয়তা রক্ষা করে সেটা করা সম্ভব নয়”। (মোহাম্মদ হেইকেল, প্রাগুক্ত) এমন তথ্য প্রথম আলোর পাতায় খুব একটা উঠে আসে না। ফ্রি প্রেস নেটওয়ার্ক-এর একটি “যুক্তরাষ্ট্রে হামলার জন্য দায়ী লাদেন না কি ইররাইল?” শিরোনামের খবর ইন্টারনেট থেকে ডউনলোড করে ছাপানো হয়েছে ১৯ তারিখের ‘সারা বিশ্ব’ পাতায়। এই একটি মাত্র রিপোর্টে প্রথম আলো সন্দেহের আঙুল লাদেন ভিন্ন অন্য কোনো লক্ষ্যের দিকে তুলেছে। তারপরও ইসরাইলকে সন্দেহ করাটা সঙ্গত হবে না এমন বুঝাতে শিরোনামে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তান ও লাদেনকে লক্ষ্যবস্তু করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে।
এই সূত্র ধরেই ১৪ তারিখে ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় ছাপা হয় “প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় কাবুলে উদ্বেগ উৎকন্ঠা” শিরোনামের খবর। এখবরে বলা হয়, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ শুভ ও অশুভের মাঝে ব্যাপক লড়াইয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন”। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুভ এবং লাদেন, লাদেনকে আশ্রয়দানকারী দেশ আফগানিস্তান অশুভ এমন ধারণাও আমাদের জেনে নিতে হয় প্রথম আলোর কাছ থেকে। বুশের এমন যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিকারী বক্তব্য বার বার উঠে আসে প্রথম আলোর পাতায় এবং সেই উন্মাদনাকে জায়েজ করা হয় অন্যান্য রিপোর্ট ও কলামের মাধ্যমে। লাদেন মুসলমান, আফগানিস্তান মুসলমানদের দেশ, হামলার জন্য দায়ী মুসলমানরা এই ধারণাগুলোকে দৃঢ় করতে এই পাতায় প্রকাশিত হয় “সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম গ্রুপগুলো” শিরোনামের খবর। এখবরের এক জায়গায় বলা হচ্ছে, “এই দুঃখজনক দিনে মুসলমানরা আমেরিকানদের পাশাপাশি গভীর দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেছে”। ভাষা লক্ষ করুন। আমেরিকান মুসলমানদেরকে আর আমেরিকান হিসেবে স্বীকার করা হচ্ছে না। তাদের আলাদা ক্যাটাগরিতে ফেলা হচ্ছে। তার এখন শুধুই মুসলমান। আর, কোনা খৃষ্টান, ইহুদী কিংবা অন্য কোনা ধর্মীয় গ্রুপ নিন্দা করেছে কি না সে তথ্যও দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ, কোনো প্রকার প্রমাণ ব্যতিরেকেই প্রথম আলো এভাবে মুসলমানদের দায়ী করতে শুরু করেছে। এই সুত্র ধরেই ১৭ তারিখের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত ভারতীয় প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদিপ নায়ারের লেখার ভাষা লক্ষ করুন, “নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যক্তি কিংবা কয়েকটি গ্রুপ নয় পুরো সম্প্রদায়কে (মুসলমান) এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, যে-কয়েকজন গোঁড়া লোক তাদের পুরো সম্প্রদায়কে আজ ছিনতাই করতে উদ্যত হয়েছে সেখানে তাদের কোনো প্রশ্রয় নেই”। মুসলমানদের মধ্যে কেন এমন গোঁড়া মৌলবাদীদের প্রাদুর্ভাব হলো সে প্রশ্ন একবারও উত্থাপন না করে তিনি পুরো মুসলমান সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করে বসলেন। শুধু তাই নয়। মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করে কুলদিপ নায়ার তার লেখায় প্রস্তাব করছেন, “দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ওয়াশিংটন। ঘোষণাটি ১০০ ভাগ সমর্থনযোগ্য…। সারা বিশ্বকে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিত উপায়ে এ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই লড়তে হবে”। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাসবাদের প্রধান উৎস তা একবারও বলা হলো না। (আগ্রহী পাঠক মার্কিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ এপ্রসঙ্গে এডওয়ার্ড এস হারম্যানের পাইরেট্স এন্ড ই্ম্পেররস গ্রন্থটি পাঠ করতে পারেন)। যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধ আদৌ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কি না তাও বিচার না করে সমর্থন করা হলো। লাদেনের যে ইমেজ তৈরী করা হয় সেটা ভয়াবহ এবং এই ভয়বহ ইমেজকেই ব্যবহার করা হয় আফগানিস্থানে হামলার বৈধ্যতা প্রতিপন্ন করতে। ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম পাতায় ছাপা লাদেনের দৈতাকৃতির কার্টুনটি দেখুন। মার্কিন সরকার যে দৃষ্টিতে লাদেনকে দেখতে চায় তেমনই প্রতিফলন ঘটে এই কার্টুনে এবং রিপোর্টগুলোতে।
আমরা বলতে পারি, এমন তৎপরতার সুদূর প্রসারী লক্ষ্য আছে এবং সেই লক্ষ্য হলো একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে হামলা চালাবে তার পথ প্রশস্ত করা। এভাবেই প্রথম আলোর পাতায় “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ” এগিয়ে চলে আফগানিস্তানের দিকে। আফগানিস্তানে গত তিন বছর ধরে খরার কারণে যে দূর্ভিক্ষ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, লোকজন শুধু ত্রাণ-সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সে-সংক্রন্ত কোনো খবর উঠে আসে না প্রথম আলোর পাতায়। বরং উঠে আসে “তালেবান রক্ষীরা প্রকাশ্যে ডাকাতি ও লুটতরাজ চালাচ্ছে?” শিরোনামের খবর (প্রথম আলো ২১ সেপ্টেম্বর)। ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম পাতায় প্রকাশিত, “লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দাও, তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তানের চরমপত্র” শিরোনামের প্রধান সংবাদটিতে বলা হয়, “মার্কিন সামরিক হামলা এড়ানোর সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে পাকিস্তান ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তরের জন্য তালেবান প্রশাসনকে চরমপত্র দিতে যাচ্ছে”। এসময়ই প্রথম আলো ১৭ সেপ্টেম্বর ‘চলতি বিশ্ব’ পাতায় দেশ পরিচিতি ছাপে; দেশটি আফগানিস্তান। দেশটির পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে, “দেশটির অধিকাংশ এলাকা বর্তমানে কট্টর মৌলবাদী তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে, যদিও তালেবানদের কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই”। কেন অন্য কোনো দেশের পরিচয় না ছেপে আফগানিস্তানকেই বেছে নেয়া হলো? আর কেনই বা এমন বিশেষণে ভূষিত করা? পাঠক এমন দেশ পরিচিতির মধ্যে কি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন? প্রথম আলোর পাতায় এভাবেই আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে ওঠে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধকে প্রথম আলার পাতায় সবসময় “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন আখ্যা দানের মাধ্যমে আসলে এই সত্য গোপন করা হয়েছে যে, যুদ্ধটা আসলে মার্কিন আগ্রাসনের। রবার্ট ফিস্কের নিবন্ধের শিরোনামে “এটা সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ নয়, এ-যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব শত্রুর বিরুদ্ধে” (www.znet org)। নোম চমস্কি বলছেন, “যেহেতু এই যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদকে লক্ষ্য করছে না তাই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ উপমা ব্যবহার করা একটা বড় ধরনের প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এবিষয়টি গভীরভাবে ভাবা হচ্ছে না। এ-প্রসঙ্গে আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল স্টোহল-এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পারি: ‘আমাদেরকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, প্রথাগতভাবেই পরাশক্তিধর দেশগুলোর সামরিক-বাহিনী ব্যবহারকে এবং সামরিক-শক্তি প্রয়োগের হুমকী প্রদানকে বলপ্রয়োগমূলক কুটনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, সন্ত্রাসবাদ হিসেবে নয়’, যদিও এ-ধরনের কূটনীতিতে ‘হুমকী ও সন্ত্রাসের প্রয়োগ করা হয়; কিন্তু মহাশক্তিধর দেশ বাদে অন্য কোনো দেশ একই ধরনের কৌশল অবলম্বন করলে তাকে সন্ত্রাসবাদী কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়’- এবং প্রত্যয়টির আক্ষরিক অর্থেই”। (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা প্রসঙ্গে নোম চমস্কি, সংস্কৃতি, জানুয়ারী ২০০২) সুতরাং আমরা বলতে পারি পেন্টাগন ও বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রে হামলাকে যদি সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তবে সকল রকম আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আফগানিস্তানে চালানো মার্কিন হামলাকেও সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা উচিত। কিন্তু প্রথম আলো তা করে না। চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ সম্পর্কে প্রচলিত মিথের জারিজুরিও ফাঁস করে দিয়েছেন। ১৮ অক্টোবর ম্যাসাচুসেট্স ইনিসটিটিউটে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, “শীর্ষপর্যায়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বর্ণনা করা হয় বর্বর এবং ‘সভ্যতার বিকৃত বিরুদ্ধতাকারীদের’ ছড়িয়ে দেয়া ক্যান্সার বা প্লেগ এর বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে। বিশ বছর আগে রিগ্যান প্রশাসন ক্ষমতায় এসে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই হবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। ‘সভ্যতার বিকৃত বিরুদ্ধতাকারীদের দ্বারা ছড়ানো প্লেগের’ বিরুদ্ধে রিগ্যান প্রশাসন সাড়া দিয়েছিল একটি নজিরবিহীন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে। আকারের দিক থেকে যা ছিল বিশাল এবং এই নেটওয়ার্ক বিশ্বজুড়ে ব্যাপক নৃশংসতা চালিয়েছিল”। “…সন্ত্রাসকে দুর্বলদের অস্ত্র হিসেবে সচরাচর যেভাবে বলা হয় সেভাবে বললে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে একটি মারাত্নক ভুল থেকে যায়। সহিংসতার অন্যান্য হাতিয়ারগুলোর মতো সন্ত্রাসও প্রধানত ক্ষমতাশীলদেরই অস্ত্র- অভাবনীয়ভাবে। সন্ত্রাসকে দুর্বলের অস্ত্র বলা হয় এ-কারণে যে ক্ষমতাশীলরা মতাদর্শিক ব্যবস্থাটিকেও নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সন্ত্রাসকে কখনোই সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য করা হয় না (“সস্ত্রাস কাজে আসে”, নোম চমস্কি, মানুষ-এ অনুদিত)। তবু প্রথম আলোর পাতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিজস্ব যুদ্ধকে সবসময় ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে মহিমান্বিত করা হয়।
“সারা বিশ্ব” বলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার টার্গেট আফগানিস্তানকে বুঝিবে
প্রথম আলোর ‘সারা বিশ্ব’ নামে একটা পাতা আছে। পাতার নামকরণ দেখেই বুঝা যায় সারা বিশ্বের খবরাখবর এই পাতায় উঠে আসার কথা। কিন্তু পুরো একমাস ধরে এই পাতা দখল করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা, তার ‘ফলো আপ’ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন রণসজ্জার প্রস্তুতি সংক্রান্ত খবরে। এমনকি বাংলাদেশে ১লা অক্টোবর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও প্রথম পাতার ‘আপার ফোল্ড’ (পত্রিকার মাঝখানের ভাঁজের ওপরের অংশ) প্রায় পুরোপুরি এসকল সংবাদেই ঠাসা থাকে। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা এবং ঘটনাটি ব্যাপক কাভারেজ পাওয়ারই উপযোগী। কিন্তু অন্য কোনো দেশে এমন ঘটনা ঘটলে প্রথম আলো যে এরকম ব্যাপক কাভারেজ দিতো না সেটা নিশ্চত করেই বলা যায়। এক্ষেত্রে আমরা জন পিলজারের স্মরণাপন্ন হতে পারি। তিনি বলছেন, “১১ সেপ্টেম্বরের হামলার দুদিন আগেই দক্ষিণ ইরাকের সিভিলিয়ান এলাকায় ইঙ্গ-মার্কিন হামলায় আট জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আমার জানা মতে, বৃটেনের আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়াগুলোতে সেসম্পর্কে একটা কথাও আসেনি (“ইনভিজিবল রিং টু দ্য আনইমাজিনেবল”, www.znet org)। আমরা জানি, আমাদের প্রথম আলোতেও সেসম্পর্কে একটা কথাও লেখা হয় নি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা হলে শব্দ-উপমা-ছবি ইমেজের বন্যা বয়ে যায়। হারম্যানের ভাষায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে সবচেয়ে দক্ষ মিডিয়া-প্রচারণার হাতিয়ার (“আক্রমণের বাজেট”, এডওয়ার্ড এস হারম্যান, মানুষ-এ অনুদিত)। এই হাতিয়ারের সাহায্যে তারা একদিকে সংবাদের সূচি নির্ধারণ করে দেয়, নিজেদের স্বার্থানুকূল খবরগুলোকে সামনে ঠেলে দেয় এবং অন্যদিকে, ভিন্নমত প্রকাশকারী বক্তব্যগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলে। তাছাড়াও এই মিডিয়া প্রচারণায় নিজেদের পক্ষের বক্তব্য বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন ভাষায় এতো বেশি পরিমাণে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরা হয় যে মিডিয়াগুলোও সেই বক্তব্যগুলোকে প্রাধ্যান্য দিতে শুরু করে। প্রথম আলোর ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি লক্ষ করি। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ পক্ষে যতোটা কভারেজ দেয়া হয় তার কণা ভাগও দেয়া হয় না যুদ্ধের বিরুদ্ধতাকারীদের, মার্কিন ভাষ্য যতোটা উঠে আসে তার তুলনায় আফগান সরকারের ভাষ্য নিতান্তই নগন্য। আর আফগান ভাষ্যকেও দেখা হয় পশ্চিমা সংবাদ-নির্মাতাদের চোখে।
“পড়তে পড়তে মন ভেঙে যায় চোখে পানি চলে আসে”
পাঠককে আমি ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানের লেখা “আফগানিস্তানের জন্য দুঃখ” শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ করতে অনুরোধ করবো। প্রথম পাতায় প্রকাশিত এই মন্তব্য প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের মানবিক বিপর্যয়ের কথা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এবং অভিযোগ উঠানোও হয়েছে যে “মহাশক্তিধর আমেরিকার আক্রমণে আফগান জনজীবনের ওপর নেমে আসবে আরও চরম দুর্দশা, ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞ, এটা এখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে”। কিন্তু আফগানিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়া এই অন্যায় যুদ্ধের- যাকে মার্কিনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায় – তিনি বিরুদ্ধতা করলেন না কেন? কেন তিনি আফগানিস্তানে মার্কিন হামলাকে মেনে নিলেন?
কিন্তু আমি এখন তার প্রতিবেদনের, এদিকে নয়, অন্য একটা দিকে আলোকপাত করতে চাই। তিনি প্রতিবেদন শুরু করেছেন এভাবে, “বিগত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে টেলিভিশন যত দেখছি আর খবরের কাগজ যত পড়ছি ততই মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে। নিউ ইয়র্কের বিধ্বস্ত টুইন টাওয়ারের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, সেই সুউচ্চ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে যাওয়া মানুষের ছবি আর নিহতদের আকুল ক্রন্দন ভোলা যায় না। আর সেই সন্ত্রাস কবলিত বিশাল উড়োজাহাজগুলোর যাত্রীদের শেষ সময়ে টেলিফোনে প্রিয়জনদের সঙ্গে সংলাপ, ভালো থেকো, ভালবাসি- পড়তে পড়তে মন ভেঙে যায়, চোখে পানি চলে আসে”।
মতিউর রহমান চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। মিডিয়াতে ঘটনার যেভাবে প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে তাতে করে পাঠকের এমন অনুভূতিই হওয়ার কথা। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠ মতিউর রহমান দেখেন না, তার প্রথম আলো দেখে না। প্রথম আলো বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে হামলার ঘটনাকে সর্বোচ্চ হিউম্যানাইজড কাভারেজ দেয়। ১৩ সেপ্টেম্বর “অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ” শিরোনামের খবরে আবেগঘন বর্ণনা দেয়া হয় এভাবে, “মৃত্যু, ধ্বংস, শোক, আহতের আর্তনাদ, এ্যাস্বুলেন্সের ছোটাছুটি, হাসপাতাল থেকে রক্তের জন্য আবেদন, ধ্বংসস্তুপ অপসারণের চেষ্টা, শক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী- সবমিলিয়ে চাকচিক্যময় মেগাসিটি নিউ ইয়র্কের বিরাট অংশে এখন ভূতুড়ে পরিবেশ”। চাইলে ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রথম পাতায় মূদ্রিত “শোক যখন মানুষকে কাছে আনে” খবরটিও দেখুন। পরবর্তী একমাসে এরকম অসংখ্য ছোট-বড় সংবাদ-কাহিনী, মন্তব্য প্রতিবেদন, উপসম্পাদকীয়তে এমন আবেগময় বর্ণনা দিয়ে পাঠকের মন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে টেনে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ৭ অক্টোবর থেকে আফগানিস্তানে ইঙ্গ-মার্কিন ‘কার্পেট বম্বিং’ শুরু হলে পরে এমন কোনো বর্ণনা আমরা প্রথম আলোতে পাই না। এবং একারণেই আমরা বলতে পারি যে নির্বিচার বোমাবর্ষণের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করা হলেও তার বর্ণনা পড়ে আমাদের ‘মন বিষন্ন হয়ে’ ওঠে না, ‘পড়তে পড়তে মন ভেঙে যায়’ না, ‘চেখে পানি চলে আসে’ না।
১৫ লাখ ইরাকীর তুলনায় ৬ হাজার মার্কিনীর জীবনের দাম অনেক বেশি
প্রথম আলো কেন একই রকম মৃত্যু-ধ্বংসকে দুই মানদণ্ডে বিচার করে? ব্যাপারটা খোলসা করে বুঝতে আমি হারম্যানের “মূল্য হিসেবে এটি ঠিকই আছে” প্রবন্ধ থেকে একটা বড় উদ্ধৃতি দেব। হারম্যান মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ম্যাডিলিন অরব্রাইটের এক টিভি সাক্ষাৎকার দিয়ে শুরু করেছেন: “১৯৯৬ সালের ১২ মে ‘৬০ মিনিট’ অনুষ্ঠানে লেসলি স্টহল-এর সাথে অলব্রাইটের আলাপচারিতার একটা অংশ এরকম:
স্টহল: আমরা শুনেছি পাঁচ লক্ষ শিশু মারা গেছে (ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে)। আমি বলতে চাচ্ছি যে হিরোসিমার চেয়েও এই মৃত শিশুর সংখ্যা বেশি। আপনি কি মনে করেন, মূল্য হিসেবে এটি ঠিকই আছে?
অলব্রাইট: এ প্রশ্নের জবাব দেয়া খুবই কঠিন। মূল্যটা—আমরা মনে করি, লক্ষ্য পূরণের মূল্য হিসেবে এটি ঠিকই আছে।
ইরাকের ক্ষেত্রে যদিও যদিও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ভির্মি খাওয়ার মতো- সেকেলে হয়ে যাওয়া ১৯৯৬ সালের ইরাকী শিশু মৃত্যুর সংখ্যাকে হিসেবে নিলেও বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র / পেন্টাগনে বিমান হামলায় মৃতের সংখ্যার চেয়ে সেই সংখ্যা ৮০ গুণেরও বেশি ছিল- তবু প্রধান্যশীল ধারার গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীরা এরকম গণহত্যাকে মেডিলিন অলব্রাইট কর্তৃক ন্যায়সঙ্গত হিসেবে প্রতিষ্টিত করার বিষয়টিতে আর মনোযোগ দিলেন না। প্রধান্যশীল ধারায় অলব্রাইটের এই শব্দবন্ধ কালেভদ্রে উপস্থাপন করা হয় এবং কখোনোই তাদের মনে বিক্ষোভ জেগে ওঠে না কিংবা এরকম ইঙ্গিত করা হয় না যে কিছু পলিসি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এরকম গণহারে শিশু হত্যা অনৈতিক ও অমার্জনীয়।
১১ সেপ্টেম্বর সকালে বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র / পেন্টাগনে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে সাধারণ নাগরিক হত্যার বিষয়টি সবচে তীব্র, বিস্তারিত এবং মানবিক আবেদনসম্পন্ন কাভারেজ পেয়েছে, যা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে সুস্পষ্ট এবং নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করে জনগণের মনকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে প্ররোচিত করে। কিন্তু উল্টোদিকে, ইরাকের লক্ষ লক্ষ শিশুমৃত্যুর ঘটনা প্রায় অদৃশ্য থেকে যায়, তাদের দুর্ভোগ ও মৃত্যু চোখের আড়ালে পড়ে থাকে।
নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার কারণে ইরাকী শিশুর মৃত্যুর হার বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র / পেন্টাগনের মৃত্যুর চেয়ে ৮০ গুণের চেয়েও বেশি হলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র / পেন্টাগনের ক্ষুদ্র প্রাণহানীর পক্ষে যে পরিমাণ মিডিয়া কাভারেজ দেয়া হচ্ছে তা ইরাকী শিশুদের তুলনায় ৫০০ গুণেরও বেশি”(মানুষ-এ অনুদিত)। মার্কিন পলিসি যেহেতু ইরাকের শিশুহত্যা সমর্থন করে তাই এটা নিয়ে মিডিয়াতে উচ্চবাচ্য করা হয় না। তেমনি আফগানিস্তানে ‘কার্পেট বম্বিং’ নিয়েও আমাদের প্রথম আলো কোনো হিউম্যানাইজড কাভারেজ দেয় না। কিন্তু বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনের বেলায় উল্টো ঘটনা ঘটে।
আক্রান্ত আমেরিকা
প্রথম আলোর ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখের সংখ্যায় প্রধান সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিল “আক্রান্ত আমেরিকা”। যুক্তরাষ্ট্রে এই হামলাকে সভ্যতাবিরোধী, কাপুরুষোতিচ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। “সন্ত্রাসীরা যে অমানবিক, সভ্যতা বিধ্বংসী জঘন্য অপরাধ করেছে আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। ধিক্কার জানাই এই কাপুরুষোচিত হামলার”। আরও বলা হচ্ছে, “ওরা সভ্যতার পথের কাঁটা। ওদের ক্ষমা নেই”। কিন্ত কেন সন্ত্রাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন হামলা চালালো তা বলা হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সভ্যতা, ‘প্রতিষ্টিত গণতন্ত্রের দেশ’, ‘সুস্থ বর্ণবাদী নীতির দেশ’ প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করে ধোয়া তুলসি পাতা করে তোলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে গত এক শতকে অসংখ্য দেশে আক্রমণ চলিয়েছে, নির্মম নিপীড়ন চালিয়েছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে এবং এখনও অবৈধ্য আধিপত্য কায়েম করে রেখেছে বিভিন্ন এলাকায় তা আড়াল করা হয়। দেশে দেশে মার্কিনি হামলার একটি খসড়া তালিকা পেতে দেখুন, জোলটান গ্রসম্যান সংকলিত “এ্যা সেঞ্চুরী অব ইউএস মিলিটারি ইন্টারভেনশন: ফ্রম ওউনডেড নী টু আফগানিস্তান” লেখাটি (www. zmag.org.)। জন পিলজার বলছেন, “মিডিয়া কভারেজে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপরাধ লুকানো হয়” (প্রাগুক্ত)। শুধু লুকানো হয় বললে অর্ধেক সত্য বলা হয়। বরং বলা ভালো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অপরাধ লুকোনোর সাথে সাথে তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ইমেজ গড়ে তুলতেও মিডিয়া তৎপরতা চালায়। “টুইন টাওয়ার ছিল আমেরিকার গর্ব” শিরোনামের খবরটি ছাপা হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর তারিখে। এখবরটির শুরু হয়েছে এভাবে, “স্বপ্নের আমেরিকা বলতে সবার আগে যে ছবিটি…”। যুক্তরাষ্ট্র মানে প্রথম আলোর কাছে যেন শুধুই স্বপ্ন আর ইতিবাচকতা। এ-খবরের একখানে বলা হচ্ছে, “নির্মাণকারীদের ব্যাপক উচ্ছাস ছিল ভবন দু’টিকে ঘিরে। তারা বলতেন ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারটিকে অবশ্যই এমন হতে হবে যেন এটি তার গুরুত্বের জন্য মানুষের মানবতার এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে গড়ে ওঠে। আর এটা প্রয়োজন অন্যান্য ভবনের সাথে স্বাতন্ত্রের জন্য, মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে তার উদারতা খুঁজে পাওয়ার জন্য”। অর্থাৎ, বৃহৎ পুঁজির স্বর্থরক্ষা করা ও অনুন্নত দেশগুলোকে বাজারে পরিণত করে সম্পদ শোষণ ও লুন্ঠনের অবাধ পরিবেশ তৈরি করায় বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রের যে ভূমিকা এমনকি বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে নিয়েছে তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র আমাদের পেতে হলো প্রথম আলোর কাছ থেকে। একই দিনে “পেন্টাগন: বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অফিসভবন” শিরোনামের খবরটি দেখুন। এই সংবাদ-কাহিনীতে পেন্টাগনের বিশালতা, আভিজাত্য ও কর্মতৎপরতা তুলে ধরা হয়েছে। একখানে বলা হয়েছে, “(পেন্টাগনের) সেনা লাইব্রেরী নিজস্ব উদ্যোগে তিন লাখেরও বেশী প্রকাশনা বের করে। আর তা করে এক ভাষায় নয়, বহু ভাষায়”। কেন পেন্টাগন এটা করে? জনকল্যাণের জন্য? প্রথম আলোর বর্ণনা পড়ে আমাদের কি তাই মনে হয় না? আসুন নোম চমস্কি ও এডওয়াড এস হারম্যান তাদের ম্যানুফ্যাক্চারিং কনসেন্ট গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে পেন্টাগনের প্রকাশনা সম্পর্কে কী বলছেন তা শুনি, “পেন্টাগনের একটি জনতথ্য কার্যক্রম রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার লোক কাজ করে, প্রতিবছর লাখ লাখ ডলার ব্যায় করা হয় এবং শুধু ভিন্নমতাবলম্বী কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী নয় বরং এরকম সকল ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠীর সমন্বিত জনতথ্য সম্পদও সে তুলনায় অতি নগণ্য”। তাঁদের মতে, পেন্টাগন মূলত এই প্রকাশনার মাধ্যমে মিডিয়াগুলোর নিয়মিত সংবাদ চাহিদা পূরণ করে। মিডিয়াগুলো আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে পেন্টাগনের মতো সংবাদ-উৎসের ওপর নির্ভর করে। আর এভাবেই পেন্টাগন নিজস্ব ভাষ্য মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরে। এই প্রকাশনাগুলো পেন্টাগনের প্রচারণা মেশিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা এবং তার অজুহাতে আফগানিস্তানের ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় সে সংক্রান্ত যতোগুলো লেখা সম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হয়েছে-সে লেখা মার্কিন সরকারের পক্ষে যাক কি বিপক্ষে যাক- প্রথম আলো সবসময় ‘আক্রান্ত আমেরিকা’ শব্দযুগল ভগ্নোদ্যত বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রর ছবির ওপর সুপার ইমপোজ করে তার প্রতিটি লেখার সাথে লোগো হিসেবে ব্যবহার করেছে।
৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তনে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা চললেও কিন্তু ‘আক্রান্ত আফগানিস্তান’ শব্দযুগলের কোনো ব্যবহার আমরা দেখি নি।
“দুনিয়ার এক নম্বর মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী”
পাঠক, মনে আছে, বুশ “শুভ ও অশুভের মাঝে ব্যাপক লড়াইয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন” এমন তথ্য প্রথম আলো আমাদের জানিয়েছিল? তো সেই অশুভ নির্মাণের কাজও প্রথম আলো বেশ দক্ষতার সাথেই পালন করে। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে যাকিছু ছাপা হয়েছে সবখানেই তাকে “আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী”, “দুনিয়ার একনম্বর মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী” বিশেষণে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে বলে রাখি, মূল নাম ওসামা হলেও পশ্চিমা মিডিয়ার অনুকরণে প্রথম আলো তাকে বিন লাদেন (অর্থাৎ, লাদেন পুত্র) বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কোনো আদালতে কিন্তু ওসামা সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত হন নি। কিন্তু লাদেন সম্পর্কে একটা শয়তানী ইমেজ তৈরী করতেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন বিশেষণ হরহামেশা ব্যাবহার করা হয়। শুধু এমন বিশেষণ ব্যবহার করেই প্রথম আলো ক্ষান্ত হয় না। আগেই যেমনটা বলেছি, ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম পাতায় লাদেনকে নিয়ে দৈতাকৃতির এক কার্টুন ছাপা হয়েছে। ছাপা হয়েছে না বলে আমরা বলতে পারি, ওসামাকে দৈত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই কার্টুনের নিচে দু’কলামের “মহাশক্তিধর আমেরিকার টার্গেট যে-ওসামা” শিরোনামের সংবাদ-কাহিনীতে ওসামার সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার এক কাহিনী নির্মাণ করা হয়েছে। সংবাদ-কাহিনীতে বলা হচ্ছে, “বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শীর্ষ পরিকল্পক ও সংগঠক হিসেবে খুব অল্প সময়েই খ্যাতি বা অপখ্যাতি অর্জন করেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন”। কার্টুন এবং সংবাদ-কাহিনী মিলিয়ে লাদেনের একটি ভয়ানক ইমেজ দাঁড়িয়ে যায় আমাদের সামনে। পরদিন ১৬ অক্টোবর প্রথম পাতায় প্রকাশ করা হয় একটি মানচিত্র “সারাবিশ্বে লাদেন” ক্যাপশন ব্যবহার করে। ওসামা বিন লাদেনের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক’ এই মানচিত্রে চিহ্নিত করা হয়। মিছেমিছি প্রথম আলো লাদেনের এমন ইমেজ তৈরী করে ভাবলে ভুল হবে। এভাবেই লাদেন সম্পর্কে অডিয়েন্সকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাকে ‘টার্গেটে’ পরিণত করা হয়। ওসামার নেতিবাচকতা এখানেই শেষ হয় না। ১৬ অক্টোবর ওসামা সম্পর্কে আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, “লাদেনের অপর্কীর্তিতে তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ”। সংবাদ-কাহিনীর নির্মাণ দেখুন, “আন্তর্জাতিক শীর্ষ সন্ত্রাসী… ওসামা বিন লাদেনের পরিবার গতকাল শনিবার তাদের ছেলের অপর্কীর্তির তীব্র নিন্দা এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিহতদের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছে”। প্রথমে ওসামাকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করা হচ্ছে এবং তারপর তার পরিবারের সমবেদনার কথা বলে প্রচ্ছন্নভাবে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, লাদেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছেমাফিক এক নেতিবাচকতার প্রতীকে রুপান্তর করা হচ্ছে। ২ অক্টোবর “কম্পিউটারে আঁকা লাদেনের নানা রূপ”, ৯ অক্টোবর প্রকাশিত “লাদেনের ধ্বংস চান মুসলিম নেতারা” শিরোনামের খবরও দেখুন। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম পাতার “ওসামা ও ওমর ঘনিষ্ট আত্নীয়” শিরোনামের খবরটি দেখুন, বলা হয়েছে, “১৯৯৮ সালে লাদেন তার বড় মেয়েকে ওমরের সাথে বিয়ে দেন। এরপর লাদেন চতুর্থ বিয়ে করেন। ধারণা হয়, এই চতুর্থ স্ত্রী ওমরের কন্যা”। পশ্চিমী আধুনিকতা আমদের যে মূল্যবোধের মধ্যে বেঁধে রাখে সেই মূল্যবোধের কাছে ওপরে উদ্ধৃত তথ্যগুলো ভয়ানক অভিঘাত তৈরী করে। তাই এই তথ্যগুলো সংবাদমূল্যহীন হলেও প্রথম আলো আমাদেরকে জানিয়ে রাখে। জানিয়ে রাখার কারণ, বুশ “শুভ ও অশুভের মাঝে” যে “ব্যাপক লড়াইয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন’ সেই অশুভকে যেন পাঠক চিনতে পারে।
“গত রোববার ছিল বারনির জন্মদিন”
বারনিকে চিনতে পারছেন না? চিনতে না পারাটা নিশ্চয় আপনার অপরাধ। রোববার বারনির জন্মদিন ছিল আর আপনি সে খবর রাখবেন না? এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা আপনি বেমালুম ভুলে থাকবেন? আফগানিস্তানের খরা-দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কথা, ইরাকে গত দশবছরে ইঙ্গ-মার্কিন অবরোধের কারণে নিহত ১৫ লক্ষ মানুষের কথা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের কথা বিংবা পৃথিবী নানা প্রান্তে কী ঘটছে তা আপনার না জানলেও চলবে। কিন্তু বারনির জন্মদিন আপনাকে পালন করতেই হবে। প্রথম আলো সেই আয়োজন করেছে। ২ অক্টোবর প্রথম আলোর ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় ওপরের দিকে একটা ছবি ছেপে তার নিচে ক্যাপশন লিখেছে, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও তার স্ত্রী ফাস্ট লেডি লরা বুশের সাথে তাদের পোষা কুকুর বারনি। গত রোববার ছিল বারনির জন্মদিন” ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথম আলোর আনুগত্য এত গভীর যে বুশের কুকুরও সংবাদ হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অসংখ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে প্রথম আলোর পাতায় জায়গা করে নেয় বুশের কুকুর।
“মার্কিনিরা মুরগি চিবোচ্ছে আর
আমরা খুঁজছি এক টুকরো রুটি”
গত তিন বছর ধরে আফগানিস্তানে খরা চলছে এবং বৃহত্তর আফগান জনগোষ্ঠী অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘ পরিচালিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসেব অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে ৫৫ লক্ষ লোক সম্পূর্ণভাবে খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মার্কিন হামলার ভয়ে খাদ্য-সাহায্য-সংস্থাগুলো ত্রাণকর্মীদের সরিয়ে নেয় যা অনাহারক্লিষ্ট মানুষের পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তোলে। কিন্তু এসংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট প্রথম আলোতে নেই। বরং আফগান জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এক শয়তানী ইমেজ তৈরী করা হয়েছে মিডিয়াগুলোতে। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত “ওসামা ও ওমর ঘনিষ্ট আত্নীয়” শিরোনামের সংবাদ-কাহিনীতে বলা হচ্ছে, “এখন ওমরের কড়া নির্দেশে আফগানিস্তানের মহিলাদের আপাদমস্তক ঢাকা বোড়কা পড়তে হয়, ছবি তোলা নিষেধ, চোরের হাত কেটে নেয়া হয় এবং হত্যাকারীদের প্রণদণ্ড নিহত ব্যক্তির আত্নীয়দের দ্বারাই কার্যকর করা হয়। আর জেনাকারী মহিলাদের পাথর ছুঁড়ে এবং সমকামীদের ইটের দেয়ালের নিচে গুঁড়িয়ে মারা হয়। গত বছর তিনি বলেছিলেন, আফগানিস্তানের কিছু লোক ইসলামী সরকার ও ইসলামী ব্যবস্থায় সন্তষ্ট নয় বলেই দেশে তীব্র খরা দেখা দিয়েছে”। সৌদি আরব, কুয়েত প্রভৃতি ধর্মীয় মৌলবাদের দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিবিড়। আমরা জানি, আফগানিস্তানের তালেবানদের সাথেও মার্কিন প্রশাসনের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তখন কিন্তু এসব কথা বলা হতো না। এখন যেহেতু টার্গেট আফগানিস্তান তাই এই ইমেজ দাঁড় করানো।
কিন্তু প্রকৃত আফগানিস্তান সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফগানিস্তানকে চিনতে ক্রিস বার্কলির “টু পানিশ ইনোসেন্ট আফগান উড বি ইমমোরাল” লেখা থেকে একটা উদ্ধৃতি দিই। তিনি বলছেন, “আফগানিস্তানের জনগণের ৮৫ শতাংশ কোনোরকম দিনাতিপাত করা কৃষক। অধিকাংশ আফগানের সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা রেডিও সেট নেই। তারা কখনোই বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র বা পেন্টাগনের কথা জানবে না এবং তারা এটাও জানে না যে কোনো এক গোঁড়া গোষ্ঠী পশ্চিমা সভ্যতার এই আইকনগুলোকে আক্রমণ করেছে। আফগানিস্তানে ডাকব্যবস্থাও ঠিকমতো নেই।
বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোতে অসংখ্য পরিবার তাদের শেষ কয়েক মুঠো খাবার নিয়ে প্রতিক্ষায় আছে। খরাক্রান্ত এলাকা অতিক্রম করে কোনো ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রাক ভাড়া দেয়ার মতো অর্থও তাদের কাছে নেই। অনেক পরিবার গ্রামে বসেই মৃত্যুর প্রহর গুনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে হামলার পর থেকে আহত, উদ্ধারপ্রাপ্ত বিংবা যারা নিহত হয়েছে তাদের প্রতি প্রথম আলো ব্যাপক মানবিক আবেদনসম্পন্ন কাভারেজ দেয়। কিন্তু আফগানিস্তানের এই মানবেতর পরিস্তিতি সম্পর্কে টু শব্দটি উচ্চারণ করে না। কেবল আফগানিস্তানে তলেবানরা কী করছে, কোথায় কোথায় কয়টা ক্ষেপণাস্ত্র পড়লো, মাকিন হামলা কতোদূর অগ্রসর হলো সেই খবরগুলো আমাদের জানানো হয়। আফগান জনগণের দুঃখ-যন্ত্রণা-আঘাত পত্রিকার পাতা থেকে উধাও হয়ে যায়। কেবল সম্পাদকীয়তে মিই মিই সুরে বলা হয় “আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা: বেসামরিক প্রাণহানী এড়াতে হবে”। এই সম্পদকীয়তে বলা হয়, “অন্তত এটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বেসামরিক মানুষ যেন প্রাণ না হারায়, বেসামরিক স্থাপনাগুলো যেন আক্রান্ত না হয়”। আর আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে যারা পথে নামে প্রথম আলোতে তাদের ছবি দেখে মনে হয় কেবল ‘কট্টর’, মৌলবাদী’, ‘ইসলামী’ সংগঠনগুলোই মার্কিন হামলার বিরোধিতা করছে। কিন্তু মার্কিন হামলার বৈধতা নিয়ে, অমানবিকতা নিয়ে একবারও প্রশ্ন তোলা হয় না।
তবে, আফগানিস্তান সম্পর্কে মার্কিন ভাষ্য কিন্তু আমরা কিছুটা পাই। প্রথম আলোর ৬ অক্টোবর ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় দেখুন “আফগান উদ্বাস্তদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৩২ কোটি ডলার সাহায্য দেবে” শিরোনামের খবর। আফগানিস্তানের জনগণের কথা, উদ্বাস্তুদের কথা একবারও বলা হলো না কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের খবর দেয়া হলো। সংবাদ কাহিনীটিতে কী বলা হচ্ছে দেখুন, “প্রেসিডেন্ট বুশ পররাষ্ট্র দপ্তরে এক বক্ত্যব্যে আফগানিস্তানের দরিদ্র মানুষের জন্য সাহায্যের অঙ্গীকার করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে যা ঘটেছে তাতে আমরা খুবই ক্রুদ্ধ কিন্তু এই ক্রোধের কারণে ভুলে গেলে চলবে না আমরা সহানুভুতিশীল মানুষ”। আমাদের মনে পড়ে যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার বলেছিলেন,‘ নিজের ঢাক নিজেকেই পিটাইতে হইবে অন্যকে দিলে ফাটাইয়া ফেলিতে পারে’। এমন বক্তব্য প্রচার করে প্রথম আলো বুশের ব্যক্তিগত ঢাক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে না কি? যদি এখনও সংশয় থাকে তবে ১১ অক্টোবর ‘সারা বিশ্ব’ পাতায় প্রকাশিত “বিমান থেকে ফেলা খাদ্য নষ্ট করে ফেলছে আফগানরা” শিরোনামের খবরটি পড়ুন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আফগানদের বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত খাবার নষ্ট করে ফেলাটাই যেন খবর। কিন্তু আরেকটু গভীরে তাকালেই দেখা যাবে যে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র নয় খাদ্য ফেলে মার্কিনিরা একটি মহৎ (?) কাজ করছে এমন দৃষ্টিভঙ্গী তৈরী করাটাই এখবরের আসল উদ্দেশ্য। তাই বলা হচ্ছে, “মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা জানান, আফগানিস্তানে সরবরাহ করার জন্য তাদের কাছে ২০ লাখ প্যাকেট খাবার মজুদ আছে। এসব প্যাকেট খাবারের মধ্যে আছে শিম, চাল, ফল, বাদাম, কিশমিশ,মাখন, স্ট্রবেরী ইত্যাদি”। আগেও বলেছি এসব খবর যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ইমেজ টিকিয়ে রাখার জন্যই। তবু প্রথম আলোর পাতায় ঝলক দিয়ে ওঠে “মার্কিনিরা মুরগি চিবোচ্ছে আর আমরা খুঁজছি এক টুকরো রুটি” শিরোনামের খবর, যদিও কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই এই খবরটিতে (প্রথম আলো ৯ অক্টোবর)।
অন্য হাওয়ার জানালা
প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় একমাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা ও পরে আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের ওপর চারটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। সম্পদকীয়গুলো নতজানু মনোভাবের। কোনো সম্পাদকীয়তেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সেদেশে কেন হামলা করা হলো তার কারণ খুঁজে দেখতে বলা হয় নি। সারা বিশ্বব্যাপী মার্কিনি সন্ত্রাস বিষয়েও কিছু বলা হয় নি। সেইসাথে সংবাদগুলোতে কাছা খুলে মার্কিন সরকারের পক্ষে প্রচারণায় নামা হয়েছে। তবু, একথাও আমাদের স্বীকার করতে হবে যে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় এবং সাময়িকীতে নোম চমস্কি, রবার্ট ফিস্ক, তারিক আলি, অরুন্ধতি রায়, এডওয়ার্ড সাইদের লেখাসহ বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে যে লেখাগুলো আমাদের সামনে পুরো ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে একটা ভিন্ন ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা করে। কিন্তু অন্যান্য লেখার তুলনায় এই ভিন্ন ভাষ্য-নির্মাণকারী-লেখা পরিমাণে এতই কম যে সংবাদ-কাহিনীগুলোতে এবং সংবাদ-কাহিনী সমর্থনকারী অন্যান্য লেখাগুলোর শক্তিশালী ভাষ্যের কাছে সেই ভাষ্যকে আফগানিস্তানের মতোই এক মুমূর্ষু টার্গেট বলে মনে হয়। আমাদেরকে একথাও বলতে হবে যে ভিন্ন ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টাকারী যে লেখাগুলো আমাদের প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে তার অনেকগুলোই মার্কিন আধিপত্যশীল ধারার সংবাদপত্রে প্রকাশের যোগ্যতা অর্জন করতো না। কারণ, কর্পোরেট অধীনস্ত অগ্রসর পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া সবসময় পঁজির মালিক ও ক্ষমতাবনদের ভাষায় কথা বলে এবং ভিন্ন ভাষ্যকে দমিয়ে রাখে। তবু বিকল্প মিডিয়ায় ধারা শক্তিশালী হওয়ায় ভিন্ন ভাষ্যটা সেখানে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ এখনও প্রান্তিক পুঁজিবাদী একটা দেশ বলে এদেশের মিডিয়া সাংস্কৃতিক-শিল্প (কালচার ইন্ডাস্ট্রী) হিসেবে এখনও র্পূণাঙ্গ-বিকশিত হয় নি। তাদের পলিসি এখনও কিছুটা ধুসরতা-আচ্ছন্ন। তাই প্রথম আলোর পাতায় ভিন্ন ভাষ্য উঠে আসে। তাছাড়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবও এদেশে প্রবল। সেই মনোভাবের পাঠককে তুষ্ট করতে প্রথম আলেকে এমন লেখা প্রকাশ করতে হয়। ইন্টরনেট নামক নতুন মিডিয়া-প্রযুক্তির থেকে লেখা ছেপে চমক দেখানোর একটা বাসনার সুযোগেও এই ভিন্নমতের লেখাগুলো উঠে আসে বলে অনুমান করা যায়।
যেকারণেই ছাপা হোক না কেন প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে বিকল্প মিডিয়া বিকশিত হয় নি। তাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাগুলো বুদ্ধিমান পাঠককে পুরো ঘটনাপ্রবাহ স্বাধীনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। এরকম লেখা যতো বেশি প্রকাশিত হবে পাঠকের স্বাধীনতার সীমাও ততোটাই বাড়বে।
সংবাদ উৎসের কামান
আমার আলোচনার প্রথম দিকে প্রশ্ন তুলেছিলাম, আমাদের দেশের সংবাদ-মিডিয়াও কি জ্ঞাতসারে-অজ্ঞাতসারে পশ্চিমা ‘প্রচারণা-মাধ্যম’ অনুকরণ করে তাদেরই মূল্যবোধ-বিশ্বাস-দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরে? আমাদের সংবাদ-মিডিয়া কি পশ্চিমা এবং দেশীয় কর্পোরেট-স্বার্থকেই বড়ো করে দেখে? আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথম আলো তার সংবাদ-উপকরণের জন্য নির্ভর করেছে মূলত সিএনএন, বিবিসি, এপি, এএফপি এবং রয়টার্সের ওপর। অনুন্নত সকল দেশেই এই নির্ভরতা অত্যন্ত প্রকট। বড় বড় সংবাদ-মাধ্যমগুলোর ওপর এই কাঠামোগত নির্ভরতার কারণে চোখ-কান খোলা না রাখলে অনিবার্যভাবেই তাদের প্রচারণা তৎপরতার ফাঁদে পা দিতে হয়। আমাদের প্রথম আলো সেটাই করেছে। সংবাদ-উৎসগুলো কামানের গোলার মতো করে নিজেদের স্বার্থানুকুল অজস্র সংবাদ-কাহিনী নিক্ষেপ করে প্রথম আলোকে কুপোকাত করে ফেলেছে। ইন্টারনেটকেও প্রথম আলো সংবাদ-উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ‘সূত্র এজেন্সি’ বললেই যেমন সঠিকভাবে সূত্র উল্লেখ করা হয় না তেমনি সূত্র ইন্টারনেট বললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ইন্টরনেটের ঠিক কোন্ ওয়েবসাইটকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হলো সেটা বলা দরকার।
নোম চমস্কি এবং এডওয়ার্ড এস হারম্যান তাদের ম্যনুফ্যাক্চারিং কনসেন্ট গ্রন্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারণা তৎপরতা কীভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করতে একটা মডেল খারা করেছেন। তাঁদের মতে, এ-মডেল সেই পথের সন্ধান করে যে-পথে সম্পদ ও ক্ষমতা ছাপা-যোগ্য সংবাদকে ছেঁকে ফেলে দিতে, ভিন্নমতকে কোনঠাসা করে ফেলতে এবং সরকার ও প্রভাবশালী স্বার্থ-গাষ্ঠীগুলোকে তাদের বার্তা নিয়ে জনগণের কছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। তাঁরা এই মডেলে পাঁচটি ফিল্টারের কথা বলেছেন (বিস্তারিত জানার জন্য অনুবাদ অংশ দেখুন)। তাঁদের মতে, সংবাদের কাঁচামালকে অপরিহার্যভাবেই একে একে এই ফিল্টারগুলো অতিক্রম করতে হয়। ফলে ছাপার জন্য কেবল পরিশোধিত অবশিষ্টটুকুই টিকে থাকে। ফিল্টারগুলোর তৎপরতার ফলে মিডিয়ার ওপর এলিটদের আধিপত্য এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের কোনঠাসা হয়ে পড়ার ঘটনা এমন অবলীলায় ঘটে যে মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা- সচরাচর যারা পূর্ণ সততা এবং সুনাম নিয়ে কর্মরত- নিজেদেরকে বলে-বুঝিয়ে তুষ্ট রাখতে পারে যে পেশাগত সংবাদমূল্যের মানদণ্ডের ভিত্তিতেই তারা “বস্তুনিষ্ঠভাবে” সংবাদ নির্বাচন ও ব্যাখ্যার কাজ করে।
ফিল্টারবিশিষ্ট পশ্চিমা সংবাদ-মাধ্যমগুলোর ওপর কাঠামোগত নির্ভরতা, সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে একধরনের মোহাবিষ্টতা এবং নিজেদের অনুসন্ধিৎসার অভাবের কারণে প্রথম আলো পশ্চিমা সংবাদ-মাধ্যমগুলো বাহিত মার্কিন সরকারের পক্ষে প্রচারণায় সামিল হয়।
বেন ব্যাগডিকিয়েনের দ্যা মিডিয়া মনোপলি গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে চমস্কি ও হারম্যান আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিডিয়ার বিপুল সংখ্যাধিক্য থাকলেও সংবাদপত্র প্রকাশনার অর্ধেকের বেশি, এবং ম্যাগাজিন, (টেলিভিশন) সম্প্রচার, বই ও চলচ্চিত্রের অডিয়েন্স ও বিক্রির বেশিরভাগই মাত্র উনত্রিশটি অতিকায় মিডিয়া সংস্থার হাতে। এই অতিকায় সংস্থাগুলো মিলে গড়ে উঠেছে “তথ্য ও সংস্কৃতির নতুন মন্ত্রণালয়” যা জাতীয় এজেন্ডা নির্ধারণের মতো ক্ষমতাধর। চমস্কি-হারম্যান আরও বলেছেন, সর্বেচ্চ স্তরে রয়েছে- সম্পদ, মর্যাদা ও অডিয়েন্সের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা হয়েছে- দশ থেকে চব্বিশটি মিডিয়া সংস্থা। সরকার ও বার্তাসংস্থাগুলোর সহযোগে এই সংস্থাগুলো নির্ধারণ করে দেয় সংবাদের এজেন্ডা (দেখুন, প্রথম অধ্যায়)।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হামলা ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে’ প্রথম আলো যেভাবে তুলে ধরে তা বিচার করে আমরা বলতেই পারি যে ক্ষমতা ও সম্পদের দিক থেকে প্রন্তিক এই দেশের আধিপত্যশীল ধারার একটি মিডিয়া পশ্চিমমুখো নির্ভরতায় কর্পোরেট-অর্থনীতির শীর্ষস্থানীয়দের স্বার্থকেই রক্ষা করে চলে।