- চারু হক
কাছাকাছি আয় উন্নতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি সম্বলিত রাষ্ট্রগুলো করোনা নামক মহাবিপর্যয় থেকে তাদের মানুষকে রক্ষার লক্ষ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সবই জানা যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত তুলনায় তুলে ধরা পাকিস্তান ও ভারতের মতো প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো কী প্রয়াস পাচ্ছে সেসবও পত্রিকা মারফত উঠে আসছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ব্যর্থরাষ্ট্র বিবেচিত পাকিস্তান তার ১ কোটি ২০ লাখ দরিদ্র ও নিন্মবিত্ত পরিবারকে, সেই সাথে কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলা মধ্যবিত্তদের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় নগদ অর্থসহায়তা দিচ্ছে। ভারতে মোদির মতো বিতর্কিত শাসক তার দেশের ৮০ কোটি নাগরিককে বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের বাস্তবতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কী প্রকাশ পাচ্ছে?
করোনাকালে সরকারের দেয়া দুর্যোগ সহায়তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্রপ্রবণ জেলাগুলোতে মাথাপিছু সবচেয়ে কম খাদ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, এবং যা ঘোষিত হয়েছে তার অর্ধেকও পৌঁছেনি সংশ্লিষ্টদের কাছে। সরকারি কর্মচারি ও সরকার দলের স্থানীয় প্রতিনিধিদের লুটপাট করার অভাবনীয় সে চিত্র আমরা দেশের গণমাধ্যমে দেখেছি। এমনকি ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকাতেও বরাদ্দকৃত ৫ লাখ টন চালের মধ্যে পৌনে ৩ লাখ টনের হদিস নেই টাইপের দুঃসংবাদ প্রকাশ পেতে দেখেছি। দেখেছি ছিটেফোঁটা অর্থ সহায়তাও কীভাবে চোরছ্যাঁচড়রা নিয়ে গেছে; ২০০ জনের নামের পাশে একজন মেম্বার চেয়্যারমানের ফোন নাম্বার বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী লুটপাট, জনগণের আমানত খেয়ানতের খাসলত আমরা এ সময়কার সরকারি কেনাকাটায়ও দেখেছি। ৫০০ টাকাও দাম নেই এমন মেডিকেল চশমা ৫০০০ টাকা দাম ধরে টাকাগুলো লুট করতে দেখেছি। এরপর দেখলাম কী করে ডাক্তারদের খাওয়ানো একেকটা ডিমের দাম ১ হাজার টাকা হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য টাকা আছে বলেই হয়তো এভাবে খরচ দেখানো সম্ভব হচ্ছে। এজন্য এমনকি কোটি কোটি মানুষের অর্ধাহার অনাহারের কালেও এমপিদেরকে মাথাপিছু ২০ কোটি করে টাকা দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, জনসাধারণকে কী দেয়া হয়েছে সেটা তো সবাই জানে। এর বাইরে দেশের কৃষকসহ ছোটবড় ব্যবসায়ীদের প্রনোদনার নামে অপ্রতুল ব্যাংকঋণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলো এ টাকা তাদেরকে দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সকলের মধ্যেই সন্দেহ আছে। নিজের খরচের বেলায় আরব্য শেখদের মতো অস্বাভাবিক উদারহস্ত সরকার জনগণকে তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার সময় একেবারেই কুণ্ঠিত হয়ে পড়ছে। সেই সাথে এই জনগণের কাছ থেকে নেয়ার সময় সরকারকে বাস্তবতা ও বিবেকবোধ বিসর্জন দিতে দেখা যাচ্ছে। করোনাকালে প্রণীত বাজেটে বিশ্বের সমস্ত দেশ সোকল্ড জিডিপি প্রবৃদ্ধি টাইপের মাপকাঠির চাইতে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রেও অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় দিয়েছে।
রিজার্ভ, রেমিটেন্স, আরএমজিসহ অর্থনীতির সমস্ত স্তম্ভ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, অর্থাৎ অর্থনীতির সর্বাধিক বিপর্যয় সত্ত্বেও ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। পুরো পৃথিবী প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশ সেখানে ৮.২ প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছে। এবং আরও অস্বাভাবিক যে বাস্তবতা সেটা হচ্ছে, সরকার এই বাজেটে স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও অনেক বেশি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যদিও করোনার প্রভাবে অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষ তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে ভয়ানক অনিশ্চয়তায় রয়েছে, যাদের সাথে পূর্ববর্তী আরও প্রায় ৫ কোটি প্রকৃত বেকারকে যুক্ত করা হলে, এবং এর প্রতিক্রিয়ায় দারিদ্র বেড়ে যে ৫০% পেরিয়ে যাবে সে বাস্তবতা তারা বিবেচনার বাইরে রেখেছে। যেজন্য বাজেটে দারিদ্র বিমোচনে বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। একইভাবে, কৃষিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ার দাবি করা হলেও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ৫০ কোটি। বিপরীতে, সেনা বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে আরও ৩,৫০০ কোটি। এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকা সত্ত্বেও জনশৃংখলা রক্ষায় বৃদ্ধি করা হয়েছে ২,৫০০ কোটি। একইভাবে,উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজারের বিপরীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট হলেও এই খাতে মোট ৩১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবং এতদিন অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ ফ্ল্যাট ও জমি কেনার মতো কতিপয় খাতে সীমাবদ্ধ রাখা হলেও এই বাজেটে অন্যায় উপার্জন যেকোন খাতে বিনিয়োগের বৈধতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সিন্ডিকেট স্বার্থ সুরক্ষায় যাচ্ছেতাই লুটপাটকে সরকারিভাবে বৈধতা দেয়া হয়েছে।
মোটাদাগে এ বাজেটে আমরা যে চিত্র পরিলক্ষিত করি সেটা হচ্ছে, সরকার ঘোষিত ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির সাথে রাজস্ব আদায়ের অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবানুগ পরিসংখ্যানে রাখলে, সেই সাথে অযৌক্তিক বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রত্যাশা এবং ব্যাংকের সামর্থের তুলনায় তার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ চাওয়ার বিষয়গুলোকে হিসেবে নিলে বাজেটের ঘাটতি অনায়াসেই ৫০% এরও বেশি দেখা যাবে। এই ঘাটতি মোকাবেলায় করোনায় বিপর্যস্ত জনসাধারণের গলায় পা দিয়ে তেল, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের মতো সেবার ক্ষেত্রে দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৩ ভাগের ১ ভাগে নেমে আসলেও দেশের নাগরিকদের পূর্বমূল্যে প্রদানে বাধ্য করা হচ্ছে, কয়েক মাসের বিদ্যুৎবিল একমাসে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, ১২ বছরে ১৩ বার পানির দাম বাড়ানোর পর পুনরায় বাড়ানোর পাঁয়তারা হচ্ছে। এরইমধ্যে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে গণপরিবহনের ভাড়া ৬০% বাড়ানো হয়েছে। এবং বাস্তবতাকে বাস্তব-না মনে করে জনগণের সামর্থ্যের সাথে সাংঘর্ষিক এমত পদক্ষেপ সরকার সম্প্রতি করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশই করোনা পরীক্ষায় সরকারিভাবে ফি দিতে বাধ্য করছে। এর বাইরে
সরকারি স্বাস্থ্য উপকরণের অপর্যাপ্ততার সুযোগে বা কারণে জনসাধারণকে মাত্রাতিরিক্ত মূল্যে সেগুলো কিনতে হচ্ছে। এবং সরকারি এই প্রবনতায় প্রভাবিত হয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও অমানবিক ব্যবসা করছে মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে। বিপরীতে, নিজের নৈতিক মনোবল না থাকায় কিংবা নিজেও অন্যভাবে একইরকম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকায় বিভিন্ন সংস্থার কেনাকাটা, ব্যয় কিংবা ব্যবসায় দৃষ্টিকটু প্রতারণার কোনও প্রবিধান সরকার করতে পারছে না, অপরাধিদেরকে বিচারের আওতায় আনতে পারছে না।
একইভাবে, জনবিরোধি সিন্ডিকেটস্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রচল দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর রাখার অংশ হিসেবেই আমরা দেখছি, করোনার প্রভাবে দেশের কোটি মানুষ অর্ধাহার অনাহারে থাকলেও সরকারি কর্মচারিদের এমনকি শতভাগ বর্ধিত বেতনভাতার সাথে উৎসবভাতাও দেয়া হচ্ছে। এবং দেশের দশা যা-ই হোক, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মতো তার কর্মচারিরাও যাতে তাদের বিলাসী বাস্তবতা বহাল রাখতে পারে সেজন্যে বাজেটে সরকারি বেতনভাতা খাদে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাড়তি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যদিও আমরা দেখছি ধনী নির্ধন নির্বিশেষ বিশ্বের সমস্ত দেশে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সম্ভবপর কৃচ্ছতা সাধন করা হচ্ছে।
জনসাধারণের কর্মসংস্থান ও উপার্জনে প্রযুক্ত নেতিবাচক প্রভাবের সাপেক্ষে সরকারি বেতনভাতা সমন্বয় করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ধনবান নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো ছাড়াও এমনকি ভারতের মতো দেশও এমপি-মন্ত্রীসহ সমস্ত সরকারি কর্মচারিদের অন্যূন ২০-৩০% করে বেতন হ্রাস করছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার প্রশ্নে বাংলাদেশ এসমস্ত দেশের চাইতে অনেক দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও, ৫০% এর বেশি ঘাটতি বাজেট নিয়েও কেন তার সরকারি কর্মচারি বা বেতনভোগীদের একইহারে শতভাগ বর্ধিত বেতনভাতা প্রদান করবে? যেখানে সাংবিধানিকভাবে দেশের মালিক সাধারণ মানুষ করোনার করাল গ্রাসে, অর্থনীতির অচলাবস্থার কারণে অর্ধাহার অনাহারে দুর্ভিক্ষ দশায় ধাবিত হচ্ছে !
- লেখক: গবেষক ও সদস্য, রাষ্ট্রচিন্তা