- ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ
বাংলাদেশের ধনীরা আয়কর ফাঁকি দেয়, এটা আংশিক সত্য মাত্র, পুরা না। তবে এটা খুবই স্বাভাবিকও। ট্যাক্স তোলার অবকাঠামো তৈরির নামে শত কোটি লোপাট হচ্ছে, কিন্তু উৎসে ট্যাক্স তোলার অবকাঠামো ঠিক হয়নি। এর পিছনে আমলাতন্ত্রের ঘুষ ও আর্থিক স্বার্থ জড়িত, এর সাথে দুর্নীতি জড়িত। রাউটার ও সুইচের পার্থক্য জানে না, ফাইবার-আরজে৪৫ ক্যাবল চিনে না এমন অখ্যাত ও কুখ্যাত (ব্ল্যাক লিস্টেড) বিদেশী কোম্পানিকে ডিজিটাল কানেকটিভিটির কাজ ধরিয়ে দিয়ে ট্যাক্স অবকাঠামো তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা হাতানো হয়েছে, খুব দূরে যাওয়া লাগবে না, দুর্নীতির এই শ্বেতপত্র বাংলাদেশের ব্যাংকের কর্তাদেরও জানা আছে, সময় হলেই এগুলা সব বেরুবে। উৎসে সরাসরি ট্যাক্স না তুলে, ট্যাক্স তোলার টেকসই ও সেন্সিবল অবকাঠামো না করে আপনি মানুষকে গালি দিবেন তারা ট্যাক্স দেয় না, খুব ভালো শুনায় তাই না? অবকাঠামো ঠিক না থাকলে দুনিয়ার সব দেশের লোকেই ট্যাক্স ফাঁকি দিবে। কথা হচ্ছে দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই পেমেন্ট সিস্টেম ও ফাইনান্সিয়াল ইনফাস্ট্রাকচার কানেক্টিভিটি এমন করে ফেলেছেন যেখানে ট্যাক্স ফাঁকির সুযোগ নেই, বরং রিটার্ন জমা দিলে কিছু ফেরত পাওয়া যায়, অর্থাৎ সরকার সঠিক ভাবে ডিরেক্ট পেমেন্ট সিস্টেম ইন্টারফেইসের মাধ্যমে সোর্স থেকে ১০০% কাটে। আপনি কর অবকাশ সুবিধার সুযোগ নিয়ে কিছু ফেরত পেতে পারেন মাত্র।
২য় পয়েন্ট হচ্ছে, চাকুরীজীবীরা ট্যাক্স দেয়না এটা শতভাগ মিথ্যা। চাকুরীজীবীরাই সবচেয়ে নিয়মিত রিটার্ন দেন। আগে সোর্সে কাটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন নিয়োগদাতার কাছে রিটার্ন এর একনলেজমেন্ট স্লিপের কপি জমা দিয়ে প্রমাণ করতে হয় রিটার্ন দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারাও এখন বাধ্যতামূলক রিটার্ন দেয়। তাইলে প্রশ্ন হচ্ছে, রিটার্ন বাড়ছে না কেন? উত্তর হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকরিই বাড়ছে না, তাই রিটার্ন বাড়ছে না।উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের সরকার মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৩% কে নিয়োগ দেয় যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে, যারা কর সীমার নীচে আয় করেন তারা ট্যাক্স দিবে না। এখানে রাষ্ট্রকে আরেকটা প্রশ্ন, রাষ্ট্র কি মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান তৈরি করছে? যাতে সব চাকরি ডিরেক্ট ট্যাক্স তৈরি করে, সব চাকরি রিটার্ন লিস্টে আসতে পারে।
দেশের মোট কর্মসংস্থানের বা মোট শ্রমবাজারের ৮৫.১% যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সেখানে আপনি উচ্চ হারে ট্যাক্স রিটার্ন জমাদানের আশা করেন কিভাবে? বেশি ট্যাক্স রিটার্ন চাইলে ফর্মাল নিয়োগ বাড়ান, মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান তৈরির সেন্স গ্রো করেন, গুরুত্ব বুঝেন । অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কয়জন কর সীমার উপরে আয় করে? নিম্ন আয়ের লোকের কাছে ট্যাক্স ও ট্যাক্স রিটার্ন আশা করাই তো শোষণ, তাদের কাছ থেকে ভ্যাট সহ যাবতীয় প্যাসিভ ট্যাক্সেই সন্তুষ্ট থাকেন। তবে এই খাতেরও অনেকেই ট্যাক্স দেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক কেউ কেউ যেটা দেয় না সেটা হচ্ছে রিটার্ন। হয়রানির কারণে দেয় না, কর অবকাশ সুবিধা পায়না বলে দিতে চান না। সোর্সে ট্যাক্স দেয়ার পরে কেউ ট্যাক্স রিটার্ন না দিলে সরকারের আয় কমে না। ট্যাক্স না দেয়া আর ট্যাক্স রিটার্ন না দেয়ার পার্থক্য আবাল সেলেব্রিটি করতে পারবে না এটাও স্বাভাবিক।তবে পেমেন্ট সিস্টেমের সেন্সিবল না করলে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ট্যাক্স সঠিক হিসাবে আসবে না। আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ধনী ব্যবসায়ীরাই আয়কর কর্মকর্তাদের ঘুষের একটা বড় উৎস। এই দুই পক্ষের মাঝে সবসময়ই একটা ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলে।
৩ং পয়েন্ট হচ্ছে, মূলত ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স ফাঁকি দেন। এরা কারা? প্রায় সবাই সরকারের বা ক্ষমতার বা প্রশাসনের হেডমে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়। যারা আওয়ামীলীগ করে, তারা ট্যাক্স দিবে কেন? তারা তো মধ্যরাতে ভোট দিয়ে সরকার বসাইসে, ভাইসা আসেনি! তারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করসে। মামা চাচা নাই এমন ব্যবসায়ীর গলা পাড়া দিয়ে ট্যাক্স আদায় করা হয়, এই দেশে। হ্যাঁ পুরাটা সরকারের ঘরে যায় না, বড় অংশ কর্তার পকেটে যায়। আওয়ামীলীগ আমলে আমলাতন্ত্র এমন ডিজিটাল সিস্টেম আবিষ্কার করসে, এখানে ব্যক্তি আমলার ঘুষ খাওয়া লাগে না, সিস্টেম্যাটিক। নেগোসিয়েশানের পরে তারা ক্যালকুলেটরে হিসেব করে একটা এমাউন্টে জমা দিতে বলে, কেউ টাকা জমা দিলেই নির্দিষ্ট % একাউন্টে চলে আসে অটো। এটা ট্রেনের টিকেট, বিয়ারটিএ জমা থেকে করে এনবিআর সবখানেই। কারো আলাদা ঘুষ চাওয়া লাগে না, ডিজিটালি সব ভাগাভাগি হয়ে যায়। অথচ, এই সিস্টেমটাই বেতন দেয়া বা কেনাকাটার ট্রানজেকশন থেকেই ট্যাক্স-ভ্যাট সেপারেশান কিংবা সংগ্রহের জন্য করতে পারলো না।
এর দায় জনগণের নয়। এর দায় সরকারের, প্রশাসনের। আর সোলায়মান শুখনদেরও, যারা বুঝেও এই লুটেরা এলিট সেটেলমেন্ট জারি রেখেছেন, নিজেদের স্বার্থ হাতানো এখানে মুখ্য। এই উচ্ছিষ্ট ভোগীরা জনগণকে গালি দিয়ে অনলাইনে আয়ও করেন, তদবিরেও কামাই করেন। এই ভদ্রলোক কখনই বলবে না, সরকার তোমার লুট থামাও! শত শত অর্থ লোপাটের কেলেঙ্কারি ফাঁস হবে পরেও! যেখানে রিটার্ন জমাদাতা প্রায় ৪০ লাখ প্লাস সেখানে সেটা কমিয়ে অর্ধেক বলে উনি সুশীলিয় বহবা কামাচ্ছেন!
৪নং, বাংলাদেশ সরকার এমন কি সেবা দেয় যে, লোকে লাইন দিয়ে, আয়কর কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে আয়কর রিটার্ন দিতে যাবে? যে লোক একটা করোনা টেস্টের জন্য বহু ফোন দিয়ে, বহু ব্যয় করে পরে নির্দিষ্ট দিনে স্লট পাবার পরেও টেস্টের আগে ৭-৮ ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করছে উনি ট্যাক্স দিবে কোন দুঃখে? এই দেশে সিটি কর্পোরেশন অফিস, থানা, বিদ্যুৎ ওয়াসা তিতাস কিংবা সচিবালয়ে কিংবা হাসপাতালে গিয়ে কেউ ঘুষ ছাড়া সেবা পায়? সে কেন নাচতে নাচতে ট্যাক্স দিবে?
৫ং পয়েন্ট হচ্ছে, সরকার কৌশলে ট্যাক্স হাতিয়ে নেয়। পরোক্ষভাবে ভ্যাট থেকে, যা প্যাসিভ ট্যাক্স। চাল ডাল সবজির মত কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া সব কিছুতেই ভ্যাট দিতে হয়। উপরন্তু সরকার ব্যাংক থেকে টাকা কাটে আবগারি শুল্ক হিসেবে, অনেকেই টেরও পায় না। বাংলাদেশের ব্যাংকে অনেক প্যাসিভ কষ্ট, এর সব ব্যাংক খায় না, সরকারও খায়। মাত্র এক লাখের বেশি টাকা ব্যাংকে থাকলেই সরকার তা থেকে হাজার টাকা ট্যাক্স কাটে, যেটা বিশ্বে বিরল। ইউরোপে ব্যক্তি একাউন্টে ২৫ লাখ এবং যৌথ একাউন্টে ৫০ লাখের বেশি থাকলে বছর শেষে ব্যাংক স্থিতিতে ১ থেকে ১,২৫% ট্যাক্স কাটা হয়।
৬নং পয়েন্ট হচ্ছে সবাই ভ্যাট দেয়, কিন্তু সরকার ও প্রশাসনের লোকদের সহযোগীতায় ব্যবসায়ীরা, ধনীরা সেই ভ্যাট চুরি করে। অর্থাৎ ভ্যাট কে কত দেয় তা সরকার জানে না, সরকার জানার সিস্টেম ডেভেলপ করে নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষের সেটেলমেন্ট শেষে গড়পড়তা এমাউন্ট সরকারি রাজস্বে জমা পড়ে। যেখানে পেমেন্ট সিস্টেম ঠিক করে লেনদেনের বা ট্রানজেকশনের সোর্স থেকেই আপনি ভ্যাট সংগ্রহ করতে পারেন, সেখানে সরকার দুর্নীতি জিইয়ে রাখতে ইএফডি/ইএফআর মেশিন কেনায় শত কোটি ব্যয় করেছে এবং এটা করার পরেও ভ্যাট বাড়েনি। বাড়ার কথাও না। বিশ্বে যে ধারার চলছে, তার উল্টা ধারায় গিয়ে, ঘুষের সিস্টেম জারি রাখার যে ডিজিটাল সিস্টেমের পথে আওয়ামীলীগ হেঁটেছে তাতে ভ্যাট খুব বাড়বে না। বরং সৎ ব্যবসায়ীদের উপর জোরাজুরির কারণে এমপ্লয়মেন্ট কমছে, তারা ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন।
৭ং পয়েন্ট, এটা নিয়ে লোকে আলোচনা করে না। চাঁদাবাজি হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় প্যাসিভ ট্যাক্স। ব্যবসায়ীরা, দোকানদারেরা, রাস্তার গাড়ি, পণ্যের ট্রাক এমনকি হকার রা সবাই বাধ্য হয়ে যে চাঁদা দেয়,এটা ট্যাক্স। এই ট্যাক্সের বিনিময়ে তারা একটা ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে ব্যবসা করে, অথচ নাগরিকের ব্যবসা করার অধিকার বিনা চাঁদায় থাকার কথা ছিল। ফলে যে লোক চাঁদার পাশাপাশি ট্যাক্স দিবে, সে আসলে দুবার ট্যাক্স দেয়। বাংলাদেশে যে সবকিছুর দাম বেশি পড়ে, আমাদের যে কষ্ট অফ প্রোডাকশন বেশি, তাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন আগায় না বরং সব ইম্পোর্ট করা লাগে- এর পিছনের কারণ কি? জমির দাম বেশি, বাসা অফিস ভাড়া বেশি জানি, কিন্তু কেন জানি না যে, জ্বালানির দাম বেশি, একটিভ কর্পোরেট ট্যাক্স বেশি, প্যাসিভ ট্যাক্স হিসেবে চাঁদা আছে, প্যাসিভ ট্যাক্স হিসেবে ভ্যাট আছে, আছে আবগারি শুল্ক, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি, আছে ট্রাক সহ যাবতীয় ট্রান্সপোর্টেশন চাঁদাবাজি। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে ডুয়েল ট্যাক্সেশান বন্ধ হয়ে রাজস্ব আদায় তর তর করে বাড়তে থাকবে।
এত কিছুর পরেও কেমনে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ট্যাক্স দেয় না? আপনাদের লজ্জা করে না? মানুষ যে টাকা দেয় তার বিপরীতে প্রদত্ত সেবার মান না বাড়লে বাড়তি ট্যাক্স চাওয়া অবৈধ। আর ট্যাক্সের টাকায় কোটি টাকার পর্দা কিনলে, সরকারের খরচ ও ব্যয়ের মডেল অস্বচ্ছ ও লুটেরা হলে লোকে ট্যাক্স দিতে উৎসাহ পাবে না। অন্যদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিত্ব না থাকলে, অর্থাৎ যার ভোটাধিকার নাই, সে ট্যাক্স দিতে বাধ্য না- ডেমোক্র্যাসিতে এমন একটা বিধিবদ্ধ নিয়ম এমনিতেই আছে। “নো ট্যাক্সেশান উইদাউট রিপ্রেজেন্টেশান”।