বাজেট, বিদ্যুৎ ও ক্রয় আইনে দায়মুক্তির সব দায় সরকার ও রাষ্ট্রের

বাজেট, বিদ্যুৎ ও ক্রয় আইনে দায়মুক্তির সব দায় সরকার ও রাষ্ট্রের

 

আবু সালেক

এক

কোনো মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রে যেখানে সামাজিক নিয়মকানুন, প্রথা আছে, ধর্মীয় বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধ আছে, আইনের শাসন আছে সেখানে একজন সামাজিক ও ধার্মিক মানুষ, একজন স্বাভাবিক ও আইনানুগ ব্যক্তি তার কৃতকর্ম বা পাপ বা কুকর্ম বা অপরাধের জন্য কোনো-না-কোনোভাবে দায়ী হয়। কিন্তু পশু ও প্রাণীর জগতে, জঙ্গল ও প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে মানুষের সমাজ নেই, যেখানে ‘জোর যার, মুল্লুক তার’, যেখানে একে-অপরকে গ্রাস করে জীবনধারণ করে, অন্যকে ক্ষতি করে বেঁচে থাকে, সেখানে কোনো দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন নেই। কেবলমাত্র মানুষের সমাজে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে সামাজিক নিয়মকানুন, প্রথা আছে, যেখানে মানুষের প্রতি মানুষের এবং মানুষের চারপাশের প্রতিবেশ ও পরিবেশের প্রতি তার সকল কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের জন্য প্রতিটি স্বাভাবিক ও আইনানুগ ব্যক্তির কোনো-না-কোনোভাবে এক ধরনের দায়-দায়িত্ব থাকে। মানুষের সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসনে দায় মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।

আইনের শাসনে কেউ দায়ের ঊর্ধে নয়, আইনের ঊর্ধে নয়। যেখানে দায় নেই সেখানে আইনের শাসনও নেই। সেখানে নেই কোনো সভ্যতা, নেই কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র; যেখানে বিরাজ করে এক নৈরাজ্যিক অবস্থা ও জংলি শাসন। দায়হীনতা বা দায়মুক্তি কেবলমাত্র অমানুষের (না-মানুষ) মধ্যে এবং পশু ও প্রাণী জগতে দেখা যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়যুক্ত স্বাভাবিক ও আইনানুগ ব্যক্তির কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের দায় স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর, বিবেক ও সরল বিশ্বাসের ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। তাহলে মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত চলে যাবে অমানুষের (না-মানুষ) দখলে, চলে যাবে পাশবিক ও বর্বরদের দখলে।

বাঁচতে গেলেই বাঁচাতে হয়। এটাই মানুষের স্বাভাবিক কর্ম। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পরিপূরক। মানুষের ধর্ম মানবতা। তাই মানুষ এবং মানবতা একসূত্রে গাঁথা। মানুষ মানেই একটি সম্পর্কের নাম। মানুষ মানেই কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব ও করণীয় কর্তব্যের সমাহার। আর এই কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব ও করণীয় কর্তব্যের সঠিক দিক-নির্দেশনা ও পরিচালনার জন্য আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সর্বজনের প্রয়োজন ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সর্বজনের সম্মতির ভিত্তিতে প্রণীত গণতান্ত্রিক সংবিধান ও আইনের শাসনই হলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের মূল কথা। আইনের শাসন ও আইনের বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা, শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ, বয়স এবং সর্বোপরি দলমত নির্বিশেষে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজে শাসনকার্য পরিচালনা ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা অনুক‚ল ও সহজ হয়। একটি রাষ্ট্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থাকলে, সবকিছু আইন ও বিধি অনুযায়ী চললে সেখানে যে- কেউ কোনোকিছু খেয়ালখুশি মতো করা থেকে বিরত বা বারিত থাকে। আইন সবার জন্য সমান, কেউ আইনের ঊর্ধে নয়, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবেÑএই সর্বজনীন নীতি প্রয়োগ করলে গড়ে উঠবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ। এবং এইরূপ আইনের শাসনের কার্যপরিধির মধ্যে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতা, ঐক্য, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধে একটি সর্বজনের মানবসমাজের দিকে সমগ্র মানবজাতি তার কাক্সিক্ষত লক্ষে অগ্রসর হবে।

দুই: প্রজ্ঞার শাসন নয়, আইনের শাসন

গ্রীক দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো তাঁর যৌবনকালে ‘রিপাবলিক’ নামক সংলাপে কল্পরাজ্য কাল্লিপলিস বা সুন্দর নগরীর যে- কল্পনা করেছেন সেই কল্পরাজ্যের রাজা হবেন দার্শনিক। এই দার্শনিক রাজার প্রজ্ঞার শাসনে নাগরিকগণ সৎগুণে প্রবুদ্ধ ও ন্যায়পর হয়ে সুখী জীবনযাপন করবেন এবং একটি কল্যাণমূলক রাজ্য গড়ে তুলবেন।

পরবর্তীকালে প্লেটো তাঁর উপরিউক্ত সুন্দর নগরী, নাগরিকগণের সুখী জীবনযাপন এবং কল্যাণমূলক রাজ্যের কল্পনা থেকে সরে না এসেও পূর্বোক্ত ওই মত পরিবর্তন করে প্রবীণ বয়সে (৭০ বছর) এসে তিনি ‘ল’ বা আইনকানুন নামক এক দীর্ঘ সংলাপে কল্পরাজ্য ক্রিটের ‘ম্যাগনেশিয়া নগরীর যে-কল্পনা করেছেন সেই কল্পরাজ্যে দার্শনিক রাজার প্রজ্ঞার শাসন নয়, আইনের শাসনই সেই রাজ্যের শাসনের মূলনীতি। বয়সের প্রান্তসীমায় এসে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে প্লেটো তাঁর কল্পরাজ্যে প্রজ্ঞার শাসন নয়, আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি প্রণয়ন করেন শতাধিক (অনুবাদক ট্রেভর জে. স্যন্ডারস- এর এক হিসাব অনুযায়ী ১১৫টি সুনির্দিষ্ট আইন) ফৌজদারি, দেওয়ানি, সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক, আন্তর্জাতিক আইন, বিধান, নিয়মকানুন ও প্রথাপদ্ধতি (তথ্যসূত্র : প্লেটোর ‘আইনকানুন’ : অনুবাদ আমিনুল ইসলাম; বাংলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০১৩)।

তিন: আইনের শাসনে দায়ের বিধি-বিধান

প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি স্বাভাবিক বা আইনানুগ ব্যক্তি তার সকল কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের জন্য দায়ী, অপর ব্যক্তির কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের জন্য দায়ী নয়। এটাই আইনের স্বাভাবিক নিয়ম। তবে এর কিছু ব্যতিক্রম হিসেবে টর্ট (ঞড়ৎঃ) আইনে এক ব্যক্তির কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের জন্য অন্য ব্যক্তিকেও দায়ী করা হয়ে থাকে, যদিও উক্ত অন্য ব্যক্তি ওই কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত নহে। এইভাবে একজনের টর্ট-এর জন্য অন্যজনের দায়কে টর্ট আইনে পরার্থ দায় (Vicarious liabilit) বলা হয়।

পরার্থ দায়ের উদ্ভব তিনভাবে হতে পারে:

১. বিশেষ কোনো সম্পর্কের ফলে;

২. অন্যের কৃত অপরাধটি অনুমোদন করলে;

৩. অন্যের অপরাধ কার্যে সহযোগিতা বা প্ররোচনা দিলে।

১. অপরাধীর সাথে সম্পর্কের দায় :

নিম্নলিখিত সম্পর্কের কারণে এটির উদ্ভব হতে পারে :

(ক) ভৃত্য বা কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধের জন্য মনিব বা মালিকের দায়: মনিব বা মালিকের নিয়োগকৃত ভৃত্য বা কর্মচারী মনিব বা মালিকের নির্দেশে বা নিয়ন্ত্রণে থেকে কর্মরত অবস্থায় কোনো ক্ষতি বা অপরাধ করলে তার জন্য মনিব বা মালিক দায়ী হয়।

(খ) প্রতিনিধি কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়: কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান তার নিয়োগকৃত প্রতিনিধিকে যেসকল কাজ করার জন্য অধিকার প্রদান করেন বা প্রতিনিধির যেসকল কাজকে অনুমোদন করেন সেসকল কাজের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান দায়ী হয়।

(গ) পরিচালক কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য কোম্পানির দায়: এক্ষেত্রে কোম্পানিকে কৃত্রিম ব্যক্তি বা আইনগত সত্তা হিসেবে ধরে কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালককে প্রতিনিধির অনুরূপ বিবেচনা করে পরিচালক কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য কোম্পানিকে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশে প্রযোজ্য ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী এই দায় নিরূপিত হয়।

(ঘ) অংশীদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়: ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও অংশীদারকে প্রতিনিধির অনুরূপ বিবেচনা করে অংশীদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয়। যখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করা হয় তখন অংশীদারগণ প্রত্যেকে এককভাবে ও যৌথভাবে দায়ী থাকবে। বাংলাদেশে প্রযোজ্য ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের অংশীদারী আইনে প্রদত্ত অধিকার বলে কোনো অংশীদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দায়ী থাকবে।

(ঙ) কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য কর্পোরেশনের দায়: প্রতিনিধি বা কর্মচারীর অপরাধের জন্য যেমন প্রতিষ্ঠান প্রধান বা মালিক দায়ী হয় তেমনি কর্পোরেশনের কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য কর্পোরেশন দায়ী থাকবে। এক্ষেত্রে কর্পোরেশনের কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের দায় কর্পোরেশনের ওপর অর্পিত হতে হলে সেটি কর্মচারীর কর্মপরিধির আওতায় এবং কর্পোরেশনের উদ্দেশ্যাবলীর মধ্যে তা হতে হবে।

(চ) স্বাধীন ঠিকাদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য নিয়োগকর্তার দায়: স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগকর্তা কর্তৃক নিযুক্ত স্বাধীন ঠিকাদার ও ঠিকাদারের কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য নিয়োগকর্তা দায়ী নয়। তবে টর্ট আইনে এই নিয়মের তিনটি ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়:

(১) যে-কাজটি সম্পাদন করার জন্য স্বাধীন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয় সে-কাজটি অন্যায় হলে সেক্ষেত্রে স্বাধীন ঠিকাদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য নিয়োগকর্তা দায়ী থাকবে।

(২) যে-কাজটি নিয়োগকর্তা নিজে করলে তার বিপদ হতে পারতো বা যে-কাজটি করার জন্য নিয়োগকর্তার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে সে-কাজটি সম্পাদন করার ক্ষেত্রে স্বাধীন ঠিকাদারের অবহেলা বা অপরাধের জন্য নিয়োগকর্তাই দায়ী থাকবে।

(৩) যে-কাজটি সম্পাদন করার জন্য যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা সতর্কতা অবলম্বন না-করলে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ঠিকাদার ব্যর্থ হলে তার জন্য নিয়োগকর্তাই দায়ী থাকবে।

(৪) যে-কাজটি সম্পাদন করার জন্য সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার নিয়োগকর্তার নিজের হাতে থাকে এবং যেক্ষেত্রে তিনি সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, সেক্ষেত্রে ঠিকাদার কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য নিয়োগকর্তাই দায়ী থাকবে।

(ছ) রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য রাষ্ট্রের দায়: নিম্নলিখিত ক্ষেত্রসমূহে রাষ্ট্রের কর্মচারীর কৃত অপরাধের জন্য রাষ্ট্র দায়ী:

(১) যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারীর কাজের জন্য রাষ্ট্র সুবিধাভোগী বা লাভবান হয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র সুবিধাপ্রাপ্ত বা লাভবান হওয়ায় রাষ্ট্রের কর্মচারীর উক্ত অপরাধের সহায়তাকারী বা দুষ্কর্মের সহচর হিসেবে রাষ্ট্র দায়ী থাকবে।

(২) যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক রাষ্ট্রের অনুক‚লে কোনো দ্রব্য ও সম্পত্তি আটক করা হয়। সেক্ষেত্রে মালিকের পক্ষে কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধের অনুরূপ রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত অপরাধ বা কুকর্মের জন্য রাষ্ট্র দায়ী থাকবে।

(৩) যেক্ষেত্রে বাণিজ্যিক লেন-দেনকালে রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধের ফলে রাষ্ট্র দায়ী হয়। সেক্ষেত্রে মালিকের পক্ষে কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধের অনুরূপ রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধের জন্য রাষ্ট্র দায়ী থাকবে।

(৪) যেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধ রাষ্ট্রের অনুক‚লে বা রাষ্ট্রের স্বার্থে পূর্বে বা পরে অনুমোদন করা হয়। সেক্ষেত্রে দুষ্কর্ম বা অপরাধীর সহচর বা প্ররোচনাকারীর অনুরূপ বিবেচনা থেকে রাষ্ট্রের কর্মচারী কর্তৃক কৃত ক্ষতি বা অপরাধের জন্য রাষ্ট্র দায়ী থাকবে।

(জ) প্রতিপাল্য বা পোষ্য কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য অভিভাবকের দায়: সেক্ষেত্রে প্রতিনিধি কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়ের অনুরূপ কিংবা মালিক-কর্মচারীর সম্পর্কের অনুরূপ বিবেচনা থেকে অভিভাবক বা পিতার নিয়ন্ত্রণে থাকা নাবালক সন্তান কর্তৃক কৃত অপরাধের জন্য অভিভাবক বা পিতা দায়ী থাকবে।

২. কুকর্ম বা অপরাধটি অনুমোদনের ফলে কৃত দায়:

যে-কাজটি করার ফলে কোনো ক্ষতি বা অপরাধের উদ্ভব হয় এবং পরবর্তীকালে ওই কাজটি যার পক্ষে করা হয়েছে তার দ্বারা যদি অনুমোদিত হয় তাহলে উক্ত কৃত ক্ষতি বা অপরাধটির জন্য অনুমোদনকারী অন্যজন দায়ী থাকবে, অপরাধী ব্যক্তিটি নহে।

৩. কুকর্ম বা অপরাধ কার্যে সহযোগিতা করা বা প্ররোচনা দেয়ার দায়:

দুষ্কর্মে সহযোগিতা করা বা প্ররোচনা দেয়ার ফলে সংঘটিত ক্ষতি বা অপরাধের জন্য দুষ্কর্ম বা অপরাধ কার্যে সহযোগিতাকারী বা প্ররোচনা প্রদানকারী দায়ী থাকবে।

পরার্থ দায় বা Vicarious Liability দু-টি ল্যাটিন ম্যাক্সিম বা নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত Respondent Superior অর্থাৎ প্রধানকেই দায়ী করা হোক। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এই নীতিটির মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। মনিব কর্তৃক নিয়োগকৃত ভৃত্যের কাজ যেন মনিব নিজেই করেছে এইরূপ বিবেচনা থেকে এই নীতিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া মনিবের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কিত এই বিধানটি দ্বিতীয় আরেকটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাকে টর্ট আইনে ‘qui facit alium facit per se’ বলা হয়। এর ইংরেজি অর্থ হলো : ‘He who does an act through another it deemed in law to do it himself’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্যের দ্বারা কোনো কাজ করায় আইনত সে নিজেই ওই কাজটি করেছে বলে বিবেচনা করা হয়।

পরার্থ দায় (Vicarious Liability) ছাড়াও টর্ট আইনে পরম দায় (Absolute Liability) নামে আরেকটি বিধি রয়েছে। এই বিধিতে অভিযোগকারী বা বাদীকে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা বিবাদীর বিপক্ষে টর্টের দায়ে মামলার জন্য তার অসতর্কতা, অবহেলা বা অভিপ্রায় প্রমাণের প্রয়োজন নেই। সাধারণত টর্ট আইনে বিবাদীকে দায়ী করতে হলে তার অসতর্কতা, অবহেলা বা অভিপ্রায় প্রমাণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু টর্ট আইনে এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে বিবাদীর অসতর্কতা, অবহেলা বা অভিপ্রায় থাকুক বা না থাকুক, তার দায় সুনিশ্চিত হয়। এই ধরনের দায়কে সুনিশ্চিত বা পরম দায় (Absolute Liability) বলা হয়। বিখ্যাত রাইল্যান্ডস বনাম ফ্লেচার (Rylands Vs Fletcher) মামলায় আদালতের একটি Rule– এর মাধ্যমে টর্ট আইনে সুনিশ্চিত বা পরম দায় ও এর ব্যতিক্রমসমূহ সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই সুনিশ্চিত বা পরম দায়কে ‘রাইল্যান্ডস বনাম ফ্লেচার বিধি’ নামেও অভিহিত করা হয়। উক্ত মামলায় প্রতিষ্ঠিত বিধিতে পরম দায় হিসেবে বলা হয়েছে, “ That the person who, for his own purposes, brings on his land and collects and keeps there anything likely to do mischief if it escapes, must keep it at his peril, and he is prima facie answerable for all the damages which is the natural consequence of its escape. ” অর্থাৎ “যখন কোনো ব্যক্তি নিজ উদ্দেশ্যে তার ভ‚মির ওপর কোনোকিছু এনে জড়ো করে এবং রাখে, যা ছাড়া পেলে বা নিষ্ক্রান্ত হলে অন্যের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা থাকে, তখন সে তা নিজের ঝুঁকিতে রাখে বলে ধরা হবে এবং সেটা ছাড়া পেয়ে বা নিষ্ক্রান্ত হয়ে অন্যের কোনো ক্ষতি সাধন করলে সে এইরূপ ক্ষতির জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হবে, যদিও তাতে তার কোনো অসতর্কতা বা অবহেলা না থাকে।” সুনিশ্চিত বা পরম দায় বিধিটি ভ‚মির অস্বাভাবিক ব্যবহারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ভ‚মিতে ঘরবাড়ি নির্মাণ, ক‚প খনন বা পুকুর কাটা, ইত্যাদি ভ‚মির স্বাভাবিক ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ভ‚মিতে একটি বাঘ এনে বেঁধে রাখা বা বিরাট জলাধার পানির দ্বারা পূর্ণ করে রাখা, ইত্যাদি ভ‚মির অস্বাভাবিক ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। তাই বিবাদী যদি নিজ ভ‚মিতে নিজ উদ্দেশ্যে বাঘ বা পানি ভর্তি বিরাট জলাধার রাখে, সে উহা নিজ দায়িত্বে রাখে এবং তার অসতর্কতা, অবহেলা বা অভিপ্রায় ব্যতীত ওই বাঘ বা জলাধারের পানি নিষ্ক্রান্ত হয়ে অন্যের ক্ষতি করলে, বিবাদী সুনিশ্চিত বা পরম দায় বিধি অনুযায়ী উক্ত ক্ষতির জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হবে। তবে এই বিধিটি কেবল উপরিউক্ত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। যেমন, বিপজ্জনক জীবজন্তু, গ্যাস, বিদ্যুৎ, দাহ্য রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্যসামগ্রী, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অনুরূপ ক্ষতির জন্য সুনিশ্চিত বা পরম দায় বিধিটি সমভাবে প্রযোজ্য।

আইনের শাসনে পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রযোজ্য সাধারণ আইনের পাশাপাশি টর্ট আইনে প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি স্বাভাবিক ব্যক্তি বা কৃত্রিম বা আইনানুগ ব্যক্তি বা আইনগত সত্তা তার বা তাদের দায়-দায়িত্ব ও করণীয় কর্তব্য থেকে কোনোভাবেই রেহাই পায় না। আইনের শাসনে তাই দায়মুক্তি বলে কিছু নেই। প্রতিটি কৃতকর্ম বা কুকর্ম বা অপরাধের দায় নিতে হবে না, অপরাধী রেহাই পেয়ে যাবে; তাহলে তো কোনো বিচার-আচার থাকে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ও আইনে দায়মুক্তি প্রসঙ্গে কিছু লিখতে গিয়ে টর্ট আইনে দায়বিধি, পরার্থ দায় (Vicarious Liability) ও সুনিশ্চিত বা পরম দায় (Absolute Liability) সংশ্লেষে কিছুটা আলোকপাত করতে হচ্ছে।

চার : সংবিধানে দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা

প্রথমে অবলোকন করার চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধানে কোথায়-কোথায় দায়মুক্তি-বিধান রাখা হয়েছে। সংসদ আইন দ্বারা দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন বলে বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে লেখা আছে। সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতাকেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক দায়মুক্তি-বিধান হিসেবে প্রণীত হয়েছে।

উপরিউক্ত ৪৬ অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্তে¡ও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা অন্য কোনো ব্যক্তি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যেকোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা-রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোনো কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোনো দÐাদেশ, দÐ বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্যকোনো কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।’

পাঁচ : বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়নে সংবিধানে দায়মুক্তি-বিধান

এবার আমরা অবলোকন করে দেখব বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংবিধানে দায়মুক্তি-বিধান কীভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সংবিধানের ৮৭(১) অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি (এই ভাগে “বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি” নামে অভিহিত) সংসদে উপস্থাপিত হইবে।’ এই ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ হলো প্রতি করবর্ষে সরকারের রাজস্ব নীতি ও প্রতি অর্থবছরে সরকারের অনুমিত অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দসহ মোট আয়-ব্যয়ের হিসাব-সংবলিত একটি বিবৃতি। এটি প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট হিসেবে অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পরে এই প্রস্তাবিত বাজেটটিকে আইনে পরিণত করার জন্য পৃথক পৃথক “অর্থ বিল” আকারে সংসদ সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করা হয় সেটি পাসের জন্য।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৮২ অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘কোনো অর্থ বিল, অথবা সরকারী অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত রহিয়াছে এমন কোনো বিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত সংসদে উত্থাপন করা যাইবে না; তবে শর্ত থাকে যে, কোনো অর্থ বিলে কোনো কর হ্রাস বা বিলোপের বিধান-সংবলিত কোনো সংশোধনী উত্থাপনের জন্য এই অনুচ্ছেদের অধীন সুপারিশের প্রয়োজন হইবে না।

সংবিধানের ৮৪ (১) অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল রাজস্ব, সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল ঋণ এবং কোনো ঋণ পরিশোধ হইতে সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল অর্থ একটি মাত্র তহবিলের অংশে পরিণত হইবে এবং তাহা “সংযুক্ত তহবিল” নামে অভিহিত হইবে।’

সংযুক্ত তহবিলের উপর দায় সম্পর্কিত সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয় নিম্নরূপ হইবে :

(ক) রাষ্ট্রপতিকে দেয় পারিশ্রমিক ও তাঁহার দপ্তর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়;

(খ)    (অ) স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার,

(আ) সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ,

(ই) মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক,

(ঈ) নির্বাচন কমিশনারগণ,

(উ) সরকারী কর্ম কমিশনের সদস্যদিগকে দেয় পারিশ্রমিক;

(গ) সংসদ, সুপ্রীম কোর্ট, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারী কর্ম কমিশনের কর্মচারীদিগকে দেয় পারিশ্রমিকসহ প্রশাসনিক ব্যয়;

(ঘ) সুদ, পরিশোধ-তহবিলের দায়, মূলধন পরিশোধ বা তাহার ক্রম-পরিশোধ এবং ঋণ সংগ্রহ-ব্যপদেশে ও সংযুক্ত তহবিলের জামানতে গৃহীত ঋণের মোচন-সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়সহ সরকারের ঋণ-সংক্রান্ত সকল দেনার দায়;

(ঙ) কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রদত্ত কোন রায়, ডিক্রী বা রোয়েদাদ কার্যকর করিবার জন্য প্রয়োজনীয় যেকোন পরিমাণ অর্থ; এবং

(চ) এই সংবিধান বা সংসদের আইন-দ্বারা অনুরূপ দায়যুক্ত বলিয়া ঘোষিত অন্য যেকোন ব্যয়।

বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি সম্পর্কিত পদ্ধতি সংবিধানের ৮৯ (১) অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হইবে, কিন্তু তাহা ভোটের আওতাভুক্ত হইবে না।’ এই ৮৯ (১) অনুচ্ছেদ পাঠে এটি স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে জাতীয় বাজেটে উত্থাপিত “সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়”-কে সংসদ সদস্যদের ভোটের আওতার বাইরে রেখে উপরিউক্ত সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়কে কার্যত ও আইনত দায়মুক্তি-বিধানের আওতায় আনা হয়েছে।

অর্থবিল সম্পর্কিত সংবিধানের ৮১ (৩) অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তাঁহার নিকট পেশ করিবার সময়ে প্রত্যেক অর্থবিলে স্পীকারের স্বাক্ষরে এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট থাকিবে যে, তাহা একটি অর্থবিল, এবং অনুরূপ সার্টিফিকেট সকল বিষয়ে চ‚ড়ান্ত হইবে এবং সেই সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

স্পীকারের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট-সংবলিত সংসদে পাসকৃত অর্থবিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তাঁর নিকট পেশ করিবার পূর্বে ‘সেই সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না’ মর্মে সংবিধানে প্রণীত আইনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে পাসকৃত অর্থবিলকে আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে কার্যত ও আইনত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া আইনপ্রণয়ন-পদ্ধতি সম্পর্কিত সংবিধানের ৮০ (৩) অনুচ্ছেদে লিখিত আছে : ‘রাষ্ট্রপতির নিকট কোন বিল পেশ করিবার পর পনের দিনের মধ্যে তিনি তাহাতে সম্মতিদান করিবেন কিংবা অর্থবিল ব্যতীত অন্য কোন বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তাহার কোন বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার কিংবা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্দেশিত কোন সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া একটি বার্তাসহ তিনি বিলটি সংসদে ফেরত দিতে পারিবেন; এবং রাষ্ট্রপতি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’ এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, উপরিউক্ত ৮০ (৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রপতির নিকট তাঁর সম্মতির জন্য পেশকৃত “অর্থবিল ব্যতীত অন্যকোন বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তাহার কোন বিশেষ বিধান পুনর্বিবেচনার কিংবা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্দেশিত কোন সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জ্ঞাপন করিয়া একটি বার্তাসহ তিনি বিলটি সংসদে ফেরত দিতে পারিবেন” বক্তব্যটির মধ্যে ‘অর্থবিল ব্যতীত অন্যকোন বিলের ক্ষেত্রে বিলটি বা তাহার কোন বিশেষ বিধান’ রাষ্ট্রপতি পুনর্বিবেচনা করিতে পারিবেন বলায় অর্থবিল বা জাতীয় বাজেটকে পুরোপুরি ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

এক্ষণে জাতীয় বাজেট প্রণয়নের পদ্ধতি সংশ্লেষে দায়মুক্তি-বিধান প্রসঙ্গটি অবলোকন করা যাক। ফাস্ট ট্র্যাকের দশটি মেগা প্রকল্পসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের খাতওয়ারি ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ২ জুন ২০১৬ তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট। এরপর রেওয়াজ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটের ওপর আমজনতাকে দেখানো টেবিল চাপড়ানো আলোচনা-সমালোচনাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব ও নামমাত্র সংশোধনীর পর বিভিন্ন খাতে বিল আকারে উপস্থাপিত উপরিউল্লিখিত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার বাজেট এবং এই বাজেট ব্যয়ের বাইরে নতুন অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে মোট ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৩ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকার ‘নির্দিষ্টকরণ বিল’ জাতীয় সংসদে গত ২৯ জুন ২০১৬ তারিখ বৃহস্পতিবার সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস ও গৃহীত হয়। এই নির্দিষ্টকরণ বিলের মধ্যে সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয় ১ লাখ ৫৩ হাজার ১৪৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকাÑযাহা সংবিধানের দায়মুক্তি-বিধানের অধীন সংসদ সদস্যদের ভোটের আওতার বাইরে রেখে দায়মুক্তি দেয়া আছে। আর নির্দিষ্টকরণ বিলের বাকি অর্থ ৩ লাখ ১১ হাজার ৪১০ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার টাকাÑযাহা সংসদ সদস্যদের ভোটের আওতায় রেখে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস ও গৃহীত হয়। তবে মোট বাজেট ব্যয়ের মধ্যে বৈদেশিক অনুদানের বরাদ্দকৃত অর্থ বাদ রেখেই এই নির্দিষ্টকরণ বিল সংসদে পাস করা হয়ে থাকে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের খাতওয়ারি ৫৬টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের বাইরে বিরোধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিভিন্ন ধরনের ৪২০টি ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। বিরোধী দলীয় ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের আলোচনা ও দাবি সত্তে¡ও ছাঁটাই প্রস্তাবগুলি সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এর আগে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় কয়েকটি প্রস্তাবের ওপর সংশোধনী আনতে বলেন। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর সংশোধনী প্রস্তাব অনুসারে ১৮টি নামমাত্র সংশোধনী গ্রহণ করে বাকিগুলি সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রদানের পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় বাজেটের ওপর দেয়া সংসদে তাঁর সমাপনী বক্তৃতা শেষে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি প্রস্তাব করেছেন। তাঁর এই প্রস্তাবকে আমি অনুশাসন মনে করি। কারণ আমি তাঁর হয়েই কাজ করি। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলেছেন, তাঁর সব প্রস্তাবই গ্রহণ হয়ে গেছে’ বলে জানান অর্থমন্ত্রী (নিজস্ব প্রতিবেদক : উৎসে কর কমিয়ে অর্থ বিল পাস, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ জুন ২০১৬, পৃষ্ঠা ১১)।

রেওয়াজ অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছর বা নতুন করবর্ষের জন্য বাজেট কার্যকর হয়। কিন্তু এদিকে বাজেট পাসের আগেই বাজেট কার্যকর হওয়ার অভিযোগ উঠেছে শিল্প ও বণিক সমিতির পক্ষ থেকে, এমনকি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে খোদ সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকেও।

গত ২ জুন ২০১৬ জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইলের সিম বা রিম কার্ডের ওপর বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাজেট ঘোষণার দিন অর্থাৎ ২ জুন ২০১৬ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মোবাইল সেবার ওপর এই বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক ধার্য করে এসআরও জারি করে। এদিকে একইভাবে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানী লিমিটেড (বিএটিবি)-এর পক্ষ থেকে ‘সকলের অবগতির জন্য সিগারেটের মূল্য সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে সিগারেটের নতুন শুল্ক আরোপের বিষয়ে উল্লেখ করে জানানো হয় : ‘গত ০২ জুন, ২০১৬ মহান জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট অনুসারে কিছু সংখ্যক সিগারেটের মূল্য পরিবর্তন করা হয়েছে।’ জাতীয় বাজেটে সিগারেটের নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণার দিন থেকেই সিগারেটের পরিবর্তিত নতুন মূল্য কার্যকর হয়।

সাধারণত রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতি করবর্ষে অর্থ বিলের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণার সময় আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন, সংশোধন ও সংযোজন করা হয়ে থাকে। অর্থ বিলের ঘোষণা অংশে বলা হয়, কোন কোন দফা অবিলম্বে কার্যকর হবে। প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস অ্যাক্ট, ১৯৩১-এর ধারা ৩-এর ক্ষমতাবলে এই ঘোষণা দেয়া হয়। আর অন্যদিকে কোন কোন দফা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে তা-ও উল্লেখ থাকে। রেওয়াজ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটের অংশীভুক্ত শুল্ক বাজেট ঘোষণার সাথে সাথেই সেটি কার্যকর হয়ে থাকে।

আগে থেকেই ছাপানো বই আকারে জাতীয় সংসদে যে-বাজেট প্রস্তাব সরকারের পক্ষ থেকে ও প্রধানমন্ত্রীর হয়ে অর্থমন্ত্রী উপস্থাপন করেন সেটি বাংলাদেশের সংবিধানে প্রণীত আইন অনুযায়ী আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত ছোটখাটো সংশোধন, সংযোজন বা পরিবর্তন ছাড়া কোনোরূপ মৌলিক সংশোধন, সংযোজন বা পরিবর্তন করার এখতিয়ার জাতীয় সংসদ বা সংসদ সদস্যদের দেয়া হয়নি।

ঘাটতি ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি (অনুদান ধরলে এ ঘাটতির পরিমাণ হচ্ছে ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা) ধরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী সংসদে উপস্থাপন করেন। সদ্য স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশটির প্রথম জাতীয় বাজেট ১৯৭২- এর ৩০ জুন বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৫২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের বিশালত্ব কিছুটা অনুমান করা যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি (১৬ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা) রাজস্ব আদায় করতে হবে। এই হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব জনগণের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির নামে এরকম একটি উচ্চাভিলাষী ও ঘাটতি বাজেটের বোঝা ও দায় জনগণের মাথায় চাপানো হলেও জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারকে বাংলাদেশের সংবিধান পুরোপুরি দায়মুক্তি দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রের হৃৎপিÐ স্বরূপ জাতীয় বাজেটের মতো একটি জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার মর্জিমাফিক জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস ও গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে এবং সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সকল কার্যক্রমকে কার্যত ও আইনত আগে থেকেই দায়মুক্তি দিয়ে রাখা হয়েছে।

জাতীয় বাজেটে দায়মুক্তি-বিধান নিয়ে যখন লিখছি তখন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, সচিবালয়ে গত ১৯ মার্চ ২০১৭, রোববার ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ বাণিজ্যিক ও দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত’ শীর্ষক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, সোনালী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) বর্তমানে ১৫ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি চলতি বছরের বাজেটে ব্যাংকগুলোকে দেয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা ২ হাজার কোটি টাকা দিয়েই আপাতত পূরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির এত পার্থক্য কীভাবে সমন্বয় করা হবে, জানতে চাইলে জবাব এড়িয়ে যান অর্থমন্ত্রী। এছাড়া বেসিক, জনতা ও রূপালী ব্যাংক যে ৪ হাজার ১শ কোটি টাকার বন্ড চেয়েছে সেটিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারী মালিকানাধীন প্রত্যেকটি ব্যাংকই দুর্বল ব্যাংক। হয় এদের মূলধন ঘাটতি আছে, নয়তো আছে প্রভিশন ঘাটতি। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে দুটি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এসেছে। বাজেট থেকে টাকা দেয়া ও বেসিক ব্যাংককে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেখা। বেসিক ব্যাংককে টাকা দেয়া মানে কি গর্তে টাকা ফেলা নয়, এমন এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘না, না, না। এটা সত্য নয়। বেসিক ব্যাংককে এখন টাকা দিলে তা গর্তে বা জলে পড়বে না।’ (নিজস্ব প্রতিবেদক : বাজেট থেকেই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ, প্রথম আলো, সোমবার, ২০ মার্চ ২০১৭, পৃষ্ঠা ১২)।

লুটপাট, দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি প্রতি বছরের মতো জনগণের করের টাকায় জাতীয় বাজেট থেকে পূরণ করা হচ্ছে। এভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপি, লুটপাট ও দুর্নীতির দায় জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। জাতীয় বাজেটের দায়মুক্তি-বিধানের এই হলো পরিণতি।

ছয় : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দায়মুক্তি-বিধান

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা দ্রæত নিরসন একান্ত অপরিহার্য এবং কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও গৃহস্থালি কাজের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে উহাদের উৎপাদন বৃদ্ধি, সঞ্চালন, পরিবহণ ও বিপণনের নিমিত্ত দ্রæত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের সুবিধার্থে এবং প্রয়োজনে, বিদেশ হইতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি করিবার পরিকল্পনা দ্রæত বাস্তবায়ন এবং জ্বালানি সম্পর্কিত খনিজ পদার্থের দ্রæত আহরণ ও ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের নিমিত্ত অনুসরণীয় বিশেষ বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়; ইত্যাদি প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪নং আইন)’ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে পাস হয়। সংসদে অনুমোদিত উপরিউক্ত আইনটি ৭ অক্টোবর ২০১০ তারিখে রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণক্রমে ১২ অক্টোবর ২০১০ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এ ‘পরিকল্পনা বা প্রস্তাব’ শিরোনামে ধারা ৬-এর উপধারা (২)-এ লিখিত আছে : ‘উপধারা (১)-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর সম্মতি গ্রহণক্রমে যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ধারা ৫-এ বর্ণিত প্রক্রিয়াকরণ কমিটি সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের সহিত যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে উক্ত কাজের জন্য মনোনীত করিয়া ধারা ৭-এ বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।’ উপরিউক্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আইনের বিশেষ বিধান অনুযায়ী ‘যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ধারা ৫-এ বর্ণিত প্রক্রিয়াকরণ কমিটি সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের সহিত যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে উক্ত কাজের জন্য মনোনীত করিয়া’ মর্মে বিধান থাকায় উš§ুক্ত দরপত্র ছাড়া যেকোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারকে কার্যত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। উপরিউক্ত আইনে ‘আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ’ শিরোনামে ধারা ৯-এ লিখিত আছে : ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এছাড়াও উপরিউক্ত আইনে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ’ শিরোনামে ধারা ১০-এ লিখিত আছে : ‘এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি, সাধারণ বা বিশেষ আদেশের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্যের জন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোনোপ্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না।’ ধারা ৯-এ লিখিত ‘কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না’ এবং ধারা ১০-এ লিখিত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানী বা ফৌজদারী মামলা বা অন্য কোনোপ্রকার আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না’ মর্মে বিধান থাকায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে পুরোপুরি দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে উপরিউক্ত আইনের ধারা ১-এর উপধারা (২)-এ লিখিত “৪ (চার) বৎসর” পর্যন্ত আইনটির কার্যকারিতার মেয়াদ আরও চার বছর বৃদ্ধি করে “৮ (আট) বৎসর” প্রতিস্থাপিত করে সংশোধিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৫ (২০১৫ সনের ৩নং আইন) প্রণীত হয়। এই আইনটি ৭ অক্টোবর, ২০১৪ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।

সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লাকে মূল জ্বালানি হিসেবে নির্ধারণ করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করে। মূলত ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লাকে মূল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের তাগিদ অনুভব করে সরকার। সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যসূত্রে জানা যায়, সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস, ডুয়েল ফুয়েল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেশের মোট উৎপাদনের বিদ্যুতের প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে। এই উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে ‘কোল পাওয়ার জেনারেশন, বাংলাদেশ’। সরকার পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্লান, ২০১০-কে সামনে রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রæত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর অধীন প্রথমে কুইক রেন্টাল বা রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মতো কিছুটা ব্যয়বহুল, ছোট ছোট আকারে ও অস্থায়ী ভিত্তিতে বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়। তবে পরবর্তীকালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রায় সব বড় বড় প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ বৃৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর অধীন দায়মুক্তি দেয়া হতে থাকে।

বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্পটি উপরিউক্ত দায়মুক্তি-বিধানের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে এখানে বিস্তারিত লেখার অবকাশ কম। খুলনা শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন, প্রাণ বৈচিত্র্য ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আধার বিশ্ব ঐতিহ্য ও রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষিত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে উপরিউক্ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবরেনর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর পানি, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ, সুন্দরবনের প্রাণীসম্পদ, মাটি ও বায়ুর ব্যাপক দূষণ ও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক ও সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। গত ২৯ জানুয়ারি ২০১২ খ্রি. তারিখে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) মধ্যে যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে ১৮৩৪ একর অধিগ্রহণকৃত জমিতে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্প স্থাপনের চুক্তি হয়। গত ৪ নভেম্বর ২০১২ খ্রি. তারিখে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গঠিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে প্রকল্প নির্মাণসহ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুমোদন করে। গত ১২ জুলাই ২০১৬ খ্রি. তারিখে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেডের (বিএইচইসিএল) মধ্যে একটি কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এক্সিম (এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট) ব্যাংক ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে। উপরিউক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য এক্সিম ব্যাংকের প্রদেয় ৭০ শতাংশ ঋণসহ উভয় পক্ষের ১৫ শতাংশ করে স্ব স্ব বিনিয়োগ মোট ৩০ শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় পক্ষের মালিকানা সমান অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশ ধরা হলেও বাংলাদেশ সরকারই হচ্ছে এই ব্যাংক ঋণের একক গ্যারান্টার। এক্সিম ব্যাংকের যাবতীয় শর্ত মেনেই রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। গত ১৮ জুন ২০১৬ খ্রি. তারিখে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাকক্ষে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিরিক্ত ব্যয়বহুল রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র : একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প আর্থিক ও পরিবেশগত দুই দিক থেকেই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হলেও বাস্তবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেকেলে প্রযুক্তি (টেন্ডার ডকুমেন্ট ইত্যাদি থেকে জানা যায়)। ভারতীয় কয়লা রপ্তানি নিশ্চিত করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে প্রায় ৪৭ লাখ ৪৫ হাজার টন কয়লা।

প্রকল্পটিতে উপেক্ষা করা হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষার নীতি। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হয় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তার চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি খরচ হবে। রামপাল প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ১৫ বছরের জন্য কর মওকুফ করেছে যার আর্থিক মূল্য ৯৩ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বিদ্যুৎ প্রকল্পটিতে কয়লা আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে নদী খনন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বছরে ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে। প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়া হবে। এরফলে সেদেশের জনগণের কর থেকে ৯৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ভর্তুকি দেয়া হবে। (তথ্যসূত্র : নিজস্ব প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় মূল্যায়ন/রামপাল প্রকল্পে সরকারকে বিপুল ভর্তুকি দিতে হবে; প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০১৬, পৃষ্ঠা ২০ ও ১৭।

পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভারতের এনটিপিসির প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল

ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, কৃষি জমি এবং নর্দমা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি নেয়া যাবে নাÑপরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক ও সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এই তিনিিট উদ্বেগের কারণে সেটি অবশেষে বাতিল করে সরকার। পরিবেশবাদীদের উদ্বেগের কারণের শ্রীলঙ্কার ত্রিনকোমালির শামপুরে ভারতের এনটিপিসির প্রস্তাবিত আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দেয় সেদেশের সরকার। প্রস্তাবিত ত্রিনকোমালি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ছিল শ্রীলঙ্কার সিলন ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের (সিইবি) সাথে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভারতের এনটিপিসির যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে শ্রীলঙ্কার সিইবি ও ভারতের এনটিপিসির মধ্যে যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গঠন করা হয় ত্রিনকোমালি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানির মাধ্যমে ৫শো মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ‘প্রস্তাবিত ত্রিনকোমালি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান ছিল ত্রিনকোমালি শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। এটি একটি শুষ্ক, কৃষিজমিবিহীন ও কম বসতিপূর্ণ এলাকা। স্থানটির আশপাশে কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল নেই, তবে অদূরে অবস্থিত ত্রিনকোমালি উপসাগর এলাকায় প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জীববৈচিত্র্য রয়েছে। পরিবেশবিদেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা থেকে নির্গত দুষক ত্রিনকোমালি উপসাগরের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এখানে গভীর সমূদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণীকুল অগভীর উপক‚ল এলাকায় এসে থাকে এবং এই এলাকায় কোরাল প্রজাতির বাস রয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার প্রাথমিকভাবে পরিবেশবিদদের আশঙ্কাকে অমূলক বলে নাকচ করে দিলেও পরবর্তী সময়ে তা গ্রহণযোগ্য মনে করে।’ (বদরূল ইমাম : কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র/রামপাল বনাম ত্রিনকোমালি; প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর ২০১৬, পৃষ্ঠা ১১)।

ভারতের মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় এবং শ্রীলঙ্কার ত্রিনকোমালির শামপুরে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) ভিন্ন ভিন্ন দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় বিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি বাতিল করে দেয় ভারত সরকার ও শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হলে দেশের সর্ববৃহৎ প্রাণবৈচিত্র্যের আধার, ম্যানগ্রোভ বন বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ধংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশবাদী, বিজ্ঞানী, গবেষক ও সচেতন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এই আশঙ্কা ও উদ্বেগ জানানো হচ্ছে শুরু থেকেই। বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তি আইনের আওতায় ভারতের এনটিপিসির প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বেপরোয়া ও অনড় শেখ হাসিনার সরকার।

একইভাবে বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ, ঘনবসতিপূর্ণ ও ভৌগোলিকভাবে তুলনামূলক ছোট আয়তনের একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের ইতিহাসে এ যাবৎ সবচেয়ে একক ব্যয়বহুল বৈদেশিক ঋণ নির্ভর ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পকে বিশেষ দায়মুক্তি আইনের আওতায় আনা হয়েছে। গত ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজ সম্পাদনে রাশিয়ান ফেডারেশনের এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট ও বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে সাধারণ চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এই প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মধ্যে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের স্টেট এক্সপোর্ট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। গত ৬ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ১১ লাখ টাকার বিশাল অঙ্কের ব্যয়ের প্রস্তাবের চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে ৫২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ও রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঋণ হিসেবে পাওয়া যাবে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। একনেক সভায় চ‚ড়ান্ত অনুমোদিত রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের এই বিশাল অঙ্কের ব্যয় বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ১ লাখ ১০ হাজার ৭শ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষে গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়। এই কোম্পানিতে কর্মরত সকল ব্যক্তি, কোম্পানির উন্নয়ন কর্মসূচি ও এর সামগ্রিক কর্মকাÐকে একটি বিশেষ আইনের অধীনে দায়মুক্তি দিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে পারমাণবিক বিদ্যুৎ আইন, ২০১৫ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বৃহদায়তন ও জনগণের করের বিশাল অঙ্কের টাকায় স্থাপিত প্রকল্পগুলো দায়মুক্তি আইনের আওতায় এনে সকল প্রকার জবাবদিহিতার ঊর্ধে রাখা হয়েছে। এসব প্রকল্পের আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতি, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন-সংগ্রাম করা যাবে কিন্তু জনস্বার্থে মামলা করা বা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে বারিত থাকতে হবে।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র উল্লেখ করে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ‘এই মুহূর্তে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বিশেষ আইনে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এরমধ্যে রয়েছে বাপেক্সের ১০৮টি ক‚প খনন প্রকল্প, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, ইস্টার্ণ রিফাইনারি ইউনিট-২ (এসপিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন, ভারতের নুমালীগড়-পার্বতীপুর পাইপলাইন নির্মাণ, গভীর সমুদ্র বøকগুলো ইজারা দেয়া, জ্বালানি বিভাগের আওতায় পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকায় এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্প।

এই আইনের বলে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে ১০টি ক‚প খননের কাজও বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়। সম্প্রতি গভীর সাগরে ৩টি তেল-গ্যাস বøক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর বøক। জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে ২৩৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে টেন্ডার ছাড়াই কাজ দিতে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও করা হয়।’

(লুৎফর রহমান কাকন : বিনা টেন্ডারে প্রকল্প বাস্তবায়নের হিড়িক; আমাদের সময়, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬।

সাত : সরকারী ক্রয় আইন এবং সরকারী ক্রয় বিধিমালার আওতায় দায়মুক্তি

সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সরকারী ক্রয় বিধিমালা আইন (চচঅ ২০০৬) এবং সরকারী ক্রয় বিধিমালা (চচজ ২০০৮)-এর আওতায় আনীত :

১. অনুন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ, সংযুক্ত দপ্তর (অঃঃধপযবফ উবঢ়ধৎঃসবহঃ) এবং অধস্তন অফিসসমূহকে প্রদত্ত আর্থিক ক্ষমতা (অনুন্নয়ন) সংশোধন (পরিপত্র, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুবিভাগ, নং-০৭,০০,০০০০, ১৫১,২২,০০৩,১৫-৩৫১(১), তারিখ : ১৬-০৮-২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ);

২. উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ/বিভাগীয় প্রধান/প্রকল্প পরিচালকগণকে অর্পিত আর্থিক ক্ষমতা (Delegation of Financial Powers for Development Projects) সংশোধন (পরিপত্র, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, বাজেট অনুবিভাগ-২, শাখা-১১, নং-০৭,১১১,০৩১,০১,০০,০১৩,২০১০-৫৭৪,তারিখ : ১৬/০৮/২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ এবং পরিপত্র, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, বাজেট অনুবিভাগ-২, শাখা-১১, নং-০৭,১১১,০৩১,০১,০০,০১৩,২০১০-৫৭৫;

৩.   (ক) গণখাতে কর্পোরেশন/স্বায়ত্তশাসিত/আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহের পূর্তকাজ সম্পাদন/পণ্য ক্রয়/পরামর্শক সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত চুক্তি অনুমোদন/সম্পাদন বিষয়ে আর্থিক ক্ষমতা প্রদান;

 (খ) সংবিধিবদ্ধ সংস্থার স্ব-অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনে আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ (পরিপত্র, অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, বাজেট অনুবিভাগ-২, শাখা-১১, নং-০৭,১১১,০৩১,০১,০০,০১৩,২০১০-৫৭৬, তারিখ: ১৬-০৮-২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ)।

উপরিউক্ত পরিপত্রসমূহ অনুযায়ী “প্রত্যেক অর্থবছরের শুরুতে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (Annual Procurement plan) প্রণয়নপূর্বক ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ প্রধান (Head of Procurement Entity- HOPE) অথবা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট হইতে যে অনুমোদন গ্রহণ করা হইবে তাহা প্রশাসনিক অনুমোদন হিসেবে বিবেচিত হইবে। পূর্তকাজ সম্পাদন এবং পণ্য/মালামাল/যন্ত্রপাতি/সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে ৫০ (পঞ্চাশ) কোটি টাকার ঊর্ধে ক্রয় প্রস্তাব ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করিতে হইবে।

অনুরূপভাবে পরামর্শক সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ১০ (দশ) কোটি টাকার উর্ধে ক্রয় প্রস্তাবে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হইবে।”

এখানে দেখা যাচ্ছে, পূর্তকাজ সম্পাদন এবং পণ্য/মালামাল/যন্ত্রপাতি/ সরঞ্জামাদির ক্ষেত্রে ৫০ (পঞ্চাশ) কোটি টাকা পর্যন্ত ক্রয় প্রস্তাব এবং পরামর্শক সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ১০ (দশ) কোটি টাকা পর্যন্ত ক্রয় প্রস্তাব সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির অনুমোদন ব্যতীত দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির বৈঠকে অনুমোদিত ক্রয় প্রস্তাব সাধারণত বৈঠকের নিয়মিত নোটিসে অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে কখনো কখনো নোটিশ ছাড়াই কোনোকোনো ক্রয় প্রস্তাব সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটিতে সরাসরি উপস্থাপন করা হয়। গত ৩ আগস্ট ২০১৬ তারিখে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির বৈঠকে ‘অনুমোদিত ক্রয় প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন খুলনায় ২০০-৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত ২০টি ক্রয় প্রস্তাব। বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে না-থাকলেও এটি শেষ মুহূর্তে বৈঠকে সরাসরি উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্পে ব্যয় হবে ২ হাজার ৩৭০ কোটি ১৪ লাখ টাকা। চায়না কোম্পানি কনসোর্টিয়াম চায়না হারভিন ও জিয়াংসু ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বলে অতিরিক্ত সচিব জানান। (অর্থনৈতিক প্রতিবেদক: ৫৩২৫ কোটি টাকার ২৭ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন; নয়া দিগন্ত, ৪ আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৩ ও ১১)।

এই নিবন্ধে জাতীয় বাজেট প্রণয়নসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তথা দেওয়ানি ক্ষতির দায় নিয়ে সংবিধান ও আইনে দায়মুক্তি-বিধানের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকারের পরতে পরতে আজ দায়মুক্তি চলছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনে দায়মুক্তি-বিধান আজ এদেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে তামাশায় রণত করেছে। দায়মুক্তি আইনের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের সরকার ও শাসকশ্রেণি জনগণের করের টাকা অবাধে লুটপাট করে যাচ্ছে। আর এর দায়ভার জনগণের মাথায় চাপাচ্ছে। দায়মুক্তি আইনের সব দায় সরকার ও রাষ্ট্রের। জনগণ সরকার ও শাসকশ্রেণির লুটপাট ও দুর্নীতির দায় নেবে কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *