এতিয়েঁন বালিবার (Etienne Balibar) ফরাসি মার্কসীয় দার্শনিক এবং আলথুসারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-সাধকদের একজন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকগুলোতেই ফ্রান্স পূর্বের জ্ঞানজাগতিক ও বিদ্যায়তনিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠে। এরপর আমরা ফ্রান্স থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে চিন্তক ও দার্শনিকদের আবির্ভাব দেখতে পাই। এদের বিপুল অংশ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আমাদের চিন্তাদুনিয়া গঠনেও এইসব ফরাসি চিন্তকদের অবদান একেবারে নগণ্য নয়। এইসব চিন্তক ও দার্শনিকদের পারস্পরিক লেনদেন ও বোঝাপড়া, তর্ক-বিতর্ক, প্রভাব এবং সমকালের রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়ার চল আমাদের রয়েছে। আলথুসারের অন্যতম বিখ্যাত ছাত্র ও মার্কসীয় দার্শনিক এতিয়েঁন বালিবারের এই সাক্ষাৎকারটি আমাদেরকে আটষট্টির প্যারিস ছাত্র আন্দোলন ও ষাট-সত্তরের দশকের ফ্রান্সের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার হালচাল নিয়ে কিছুদূর অবগত করবে। লুই আলথুসার, জ্যাক রঁসিয়ে ও অন্যান্য চিন্তকদের সাথে এতিয়েঁন বালিবারও সহ-লেখক ছিলেন বিখ্যাত Reading Capital(১৯৬৫) গ্রন্থের। বালিবার ইউরোপীয় বর্ণবাদ, নাগরিকত্ব, সীমানা বা বর্ডার, ভায়োলেন্স, পরিচয় ও নাজাত ইত্যাদি প্রশ্নে কাজ করে চলেছেন। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো হচ্ছেঃ Race, Nation, Class(১৯৯১), The Philosophy of Marx(১৯৯৪), Spinoza and Politics(১৯৮৫), Politics and the Other Scene(২০০২), We, the People of Europe? Reflections on Transnational Citizenship(২০০৪), Violence and Civility (২০১৫) এবং Citizenship(২০১৫) ইত্যাদি। এতিয়েঁন বালিবারের এই সাক্ষাৎকারটি ২০১৫ সনের ১৩ই মার্চে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে L’Humanité-তে, ফরাসি ভাষায়। Viewpoint Magazine-তে ঐ বছরের ১৭ই মার্চেই এটির ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়েছিল, “A Period of Intense Debate about Marxist Philosophy”: An Interview with Étienne Balibar শিরোনামে। প্যাট্রিক কিং ও সালার মোহনেশি কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বালিবারের এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন কাফি মোহাম্মদ তামিম। কাফি মোহাম্মদ তামিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অনুবাদটি বোধিচিত্তে প্রথম প্রকাশিত হয়।
জেহোম স্ক্যালস্কি : ৫০ বছর আগে লুই আলথুসারের ফর মার্কস(১৯৬৫) এবং তাঁর দিক নির্দেশনায়, রিডিং ক্যাপিটাল(১৯৬৫) প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিত কি ছিল?
এতিয়েঁন বালিবার : খুব সংক্ষেপে বললে, আমি এটাই বলব যে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং এমনকি বিদ্যায়তনিক জায়গা থেকে প্রশ্ন করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক জায়গা থেকেও করা হয়েছে। আমি এমন প্রজন্মের অংশ যারা কিনা ১৯৬০ সালে এক্যোল নরমেল সুপিরিয়রে (École Normale Supérieure, সংক্ষেপে ENS)১ প্রবেশ করেছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। আলথুসারকে ঘিরে ধীরে ধীরে আমাদের দল গড়ে উঠেছিল। অবশ্যই সেখানে ছাত্ররা ছিল, তবে এছাড়াও শিষ্যরাও ছিল। যারা কিছুটা বয়স্ক তাঁরা ছিল, যেমন পিয়েহ মাশেহে (Pierre Macherey); আর যারা কিছুটা তরুণ তার পরেই এসেছে, যেমন ভবিষ্যৎ মাওবাদী দমিনিক লক্যু (Dominique Lecourt)। অর্থাৎ পাঁচ বা ছয় বছরের ব্যবধানে। তখন, ১৯৬০ সন একদিকে আলজেরিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার দুই বছর আগের সন এবং আরেকদিকে সেই সন যখন জঁ পল সার্ত্রের Critique of Dialectical Reason(১৯৬০) প্রকাশিত হয়েছিল। আলজেরিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক হয়ে উঠেছিলাম। আমরা ইউএনইএফ (The National Union of Students of France Union or nationale des étudiants de France, UNEF)-এর সমস্ত সংগ্রামী যারা প্রথম ফরাসি ইউনিয়ন হিসেবে এফএলএন (The National Liberation Front or Front de libération nationale, FLN)-এর সাথে যুক্ত আলজেরিয়ার ইউনিয়নগুলোর সাথে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মিলিত হই। এই প্রসঙ্গ ছিল তীব্র রাজনৈতিক এবং যুদ্ধোদ্যম (mobilization, তৎপরতার লক্ষ্যে লোকবল জড়ো করা) তবে এছাড়াও অতিসূক্ষ্ম অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও ছিল। আমাদের রাজনৈতিকতার ভিত্তি বেশিরভাগটাই ছিল উপনিবেশ-বিরোধিতা এবং ফলস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধোদ্যম। সামাজিক মাত্রা বিদ্যমান ছিল, তবে এটা বাড়তি সংযুক্তি হিসেবে এসেছে।
অন্যদিকে, এটা ছিল মার্কসীয় দর্শন নিয়ে তীব্র বিতর্কের কাল—যার ভূমিকায় ছিল কমিউনিস্ট দলের কিছু মার্কসীয় দার্শনিকরা। তবে এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মার্কসীয় দার্শনিকরাও ছিল যারা পরে আর কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলনা (যেমন হেনরি লেফেভ্রে), তেমনি ন-কমিউনিষ্ট মার্কসীয় প্রবণতার শরীকও ছিলনা। তখন ছিল জঁ পল সার্ত্র, যিনি নিজেই নিজেকে একজন সহযাত্রী হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর সদ্য প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ কাজে মার্কসবাদকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন এবং গ্রন্থের ভূমিকায় বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল সেই বিখ্যাত বাক্য যা আমরা প্রায়শই ভূলভাবে পুনরাবৃত্তি করি : “মার্কসবাদ হলো আমাদের সময়ের অনতিক্রম্য দার্শনিক দিগন্ত”। আমি এটা বলছিনা যে ফ্রান্সের সমস্ত দার্শনিক কাজ মার্কসকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান ছিল। এটা বললে পুরোপুরি মিথ্যা বলা হবে। তবে আমরা এটা বলতে পারি একদা মার্কসকে নিয়ে বিতর্কটা ছিল সত্যসত্যই বেশ দৃশ্যমান, বেশ তীব্র, বেশ আবেগমথিত এবং বেশ আকর্ষণীয়। এটা আরও ছিল সেই সময়, যখন কমিউনিস্ট পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল লা পঁসে (La Pensée) অথবা লা নুভেল ক্রিতিক (La Pensée or La Nouvelle Critique)-এর মত পর্যালোচনা দিয়ে একটা মার্কসীয় অধ্যয়ন ও গবেষণা কেন্দ্র সংগঠিত করবে। পার্টি আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সোমেন দো লা পঁসে মাক্সিস্ত (“Semaines de la pensée marxiste”, সপ্তাহব্যাপি মার্কসীয় চিন্তা) আয়োজন করবে।
সেই সময়ের একটা ধারণা দিতে হলে ,আমি সার্ত্রের বই প্রকাশিত হওয়ার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬১ সালকে উল্লেখ করবো। সেই বছর “সোমেন দো লা পঁসে মাক্সিস্ত”-এর মূল ঘটনা ছিল বিতর্ক যার একদিকে ছিলেন সার্ত্রে এবং জঁ ইপ্পোলিৎ, অন্যদিকে ছিলেন রজার গারুদি এবং জঁ-পিয়ের বিজিয়া। এদের মধ্যে প্রখ্যাত হেগেল বিশেষজ্ঞ জঁ এপ্পোলিৎ ছিলেন আমাদের এক্যোল নরমেল সুপিরিয়রের পরিচালক, রজার গারুদি দর্শন বিষয়ে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির (Parti communiste français, সংক্ষেপে PCF) আনুষ্ঠানিক ধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং জঁ-পিয়ের বিজিয়া ছিলেন প্রতিরোধ যোদ্ধা, পদার্থবিদ, দার্শনিক এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এই জম্পেশ বিতর্কটি আয়োজিত হয়েছিল মিউতুয়ালিতে (Mutualité) অডিটরিয়ামে। আয়োজনটি ছিল বিশাল। আলথুসার ছিলেন দর্শনের অধ্যাপক এবং আগ্রেজে-হেপেতিতো (agrégé-répétiteur)২, agrégation পরীক্ষার জন্য আমাদের প্রস্তুত করার দায়িত্বে ছিলেন। স্পষ্টতই, তাঁর কোর্সগুলো মার্কসবাদ সম্পর্কিত ছিল না, বরং সবধরনের বিষয়ই ছিল। তিনি অন্যান্যদের অনুসরণ করে তাঁর প্রথম লেখা ১৯৬১ সনে লা পঁসে’ পত্রিকায় প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা তৎক্ষণাৎ পার্টির ভেতরে ও বাহিরে দারুণ বিতর্ক উসকে দেয়। এতে তখনই আমাদেরআগ্রহ টেনেছিল। আমরা তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম এবং একটা পাঠচক্র তৈরির প্রস্তাব করেছিলাম যা ধীরে ধীরে ছোটদল হয়ে গিয়েছিল। স্বীকার করছি, এটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনকি, ১৯৬৮ সালের আগেও এটি তীব্র অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা প্রতিরোধ করতে পারেনি। তবে আমরা একসাথে বেশ কয়েকবছর ধরে মার্কসবাদ ও সেই সময়কার ফরাসি দর্শন—উভয়কে নিয়ে কাঠামোবদ্ধ উপায়ে কাজ করেছিলাম যার মধ্যে (আমাদের দৃষ্টিতে) উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল গড়নবাদ (বা কাঠামোবাদ) বা স্ট্রাকচারালিজমের জন্ম। আমরা একটি পাবলিক সেমিনারের আয়োজন করেছিলাম। এটা সারাবছর জুড়ে স্থায়ী ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে, এটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটা ছিল সেই মূহুর্ত, যখন আলথুসারের প্রভাব একটা নির্দিষ্ট অংশের ফরাসি মার্কসীয় বা মার্কসীয় বাম বিদ্বৎসমাজে সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছে ছিল।
জেহোম স্ক্যালস্কি : লুই আলথুসারের চিন্তা গড়ে উঠা’টা কেমন ছিল?
এতিয়েঁন বালিবার : আমি জানি না যে, আমি এই বিষয়গুলো সার-সংক্ষেপ করতে পারবো কিনা। প্রথমত, যদিও আলথুসার পরে এই বলে আত্ম-সমালোচনা করেছিলেন যে এক অর্থে তিনি রাজনীতি ভুলে গিয়েছিলেন, আমি মনে করি যে আলথুসারের প্রথম নিবন্ধ থেকে প্রকল্পটি রাজনৈতিক এবং দার্শনিক এই দ্বৈত মাত্রার ছিল। স্পষ্টত-ই, অনেক তরুণ মার্কসবাদীদের এমনকি আরও সাধারণভাবে তরুণ দার্শনিকদেরও আলথুসারের প্রকল্পের আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে একটি ছিল এটা। সত্যি তা-ই, যে তিনি কখনোই [রাজনৈতিক ও দার্শনিক] দুটি মাত্রার একটিকেও অন্যটির জন্য ত্যাগ করতে চাননি। একদিকে, তিনি মার্কসবাদকে মহান দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে, দর্শন সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল, যার জমিনে মার্কসবাদকে গঠন করেছিল এবং তা ছিল ফয়েরবাখের উপর লেখা মার্কসের ১১ নম্বর থিসিস, “কেবলমাত্র দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার উপায় নয়, বরং দুনিয়াকে পরিবর্তন করা”। সবকিছু যা বর্তমানে অনেকটা দূরবর্তী মনে হতে পারে, তবে তাঁর [আলথুসারের] হস্তক্ষেপে আপনা থেকেই মার্কসবাদের দুটি দিক ঘিরে বক্তৃতা সংগঠিত হয়েছিল যা স্ট্যালিন একটি বিখ্যাত পুস্তিকায় সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, যা নিশ্চিতরূপে ক্ষণকালের জন্য বিষয়গুলো কুৎসিত করেছিল। আমার মনে হয় এই বিষয়টা আলথুসারের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিল| একদিকে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ—মার্কসবাদের দার্শনিক মাত্রা (dimension), অন্যদিকে ঐতিহাসিক বস্তবাদ—যাকে বলা যায় ইতিহাসের তত্ত্ব এবং ফলস্বরুপ রাজনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনের তত্ত্ব।
জেহোম স্ক্যালস্কি : স্পিনোজাও কি র্যাডিক্যাল গণতন্ত্রের একজন চিন্তক ছিলেন না? দার্শনিকভাবে, আলথুসারীয় মার্কসবাদ কি স্পিনোজায় প্রত্যাবর্তন নয়?
এতিয়েঁন বালিবার: আলথুসার Theological-Political Treatise(১৬৭০)-এর জন্য স্পিনোজার প্রশংসা করেছিলেন, তবে এই দিকটি তাঁকে বেশি আগ্রহী করে তোলেনি। আপনি একদম ঠিকই বলেছেন যে স্পিনোজার চিন্তা ছিল র্যাডিক্যালি গণতান্ত্রিক চিন্তা। এটি এমন এক মাত্রা যা কিছুসময়ের জন্য সম্মুখে এসেছিল এবং যা বিভিন্ন ঘরানার দার্শনিকদের (যার মধ্যে কিছুসংখ্যক কার্যকরভাবে মার্কসীয় পটভূমি থেকে উঠে আসা) একীভূত করেছিল| যাইহোক, এটা এমন কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা মাত্রা ছিল না যা আলথুসারকে আগ্রহী করতে পারত। তিনি এটার বিরোধিতা করার কারণে নয়, বরং কারণ তিনি মৌলিকভাবে চিন্তা করেছিলেন যে র্যাডিক্যাল গণতন্ত্র হলো প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্রের দিকে উত্তরণের মধ্যবর্তী পর্যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ছিলেন একজন খুব গোঁড়া মার্কসবাদী। তিনি স্পিনোজার যে দিকটাতে জোর দিয়েছিলেন তা ভাবাদর্শ (ideology) তত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত। স্পিনোজার মধ্যে ভাবাদর্শের প্রথম মহান বস্তুবাদী সমালোচক রয়েছে। আলথুসার একটি প্যারাডক্সিক্যাল থিসিস বা অভিসন্দর্ভকে সমর্থন করেছিলেন। আমি বুঝতে পারছি যে তৎকালীন এটা অনেক মার্কসবাদীকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছিল, তবে অন্যদিকে আমাদের মধ্যে কিছু মানুষের কাছে এটা খুব আকর্ষণীয় ছিল। এই ভাবনাটা ছিল যে, মার্কসের তত্ত্বীয় বিপ্লবের বুনিয়াদি দিক ছিল ভাবাদর্শের ধারণা : শুধু মাত্র বুর্জোয়া ভাবাদর্শের সমালোচনা নয়, বরং যেকোন ভাবাদর্শের সমালোচনা। আলথুসারের কাছে এটিও তৎকালীন কমিউনিজমের অভ্যন্তরীণ বিতর্কের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল, এই কারণে যে এটি ভাবাদর্শিক জটিলতা দ্বারা আধিপত্য করছিল যাকে তিনি মানবতাবাদ (humanism) এবং অর্থনীতিবাদ (economism) বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে ভাবাদর্শের প্রশ্নে মার্কসীয় ঐতিহ্য দুর্বল ছিল এবং মার্কস নিজেও—যদিও তিনি [মার্কস] সহজাত প্রতিভায় এই কনসেপ্ট বা ধারণাটি উদ্ভাবন করার সত্ত্বাধিকারী—তবুও তার এটির একটি খুব বাজে বিশ্লেষণ ছিল। স্পিনোজার মধ্যে তিনি [আলথুসার] ভাবাদর্শের বস্তুবাদী তত্ত্বের উপাদান খুঁজে পেয়েছিলেন যা ফয়েরবাখীয় কিংবা হেগেলীয়ও কোনোটিই নয় এবং ইতিহাসের দর্শন বা মানুষের বিচ্ছিন্নতার ধারণা অথবা মানবীয় সারসত্তার সাথেও সম্পর্কযুক্ত ছিল না। এই সমস্তটাই আলথুসারের যাকে বিজ্ঞানবাদিতা (scientism) বলা হতো খুব ভালোভাবে তার সাথে যুক্ত ছিল যেমন, এটি জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ (epistemological break) ধারণার মধ্যে ব্যক্ত হয়েছিল এবং কাঠামোবাদের বা স্ট্রাকচারালিজমের সাথে এটার সান্নিধ্যের দিকে পরিচালিত করেছিল। আলথুসার দ্রুতই তাঁর আত্মসমালোচনার উপাদানসমূহের এই অবস্থানকে সমালোচনা করেছেন।
জেহোম স্ক্যালস্কি : আলথুসারের দার্শনিক ইন্টারভেনশন বা অভিঘাতের কিছু কি অবশিষ্ট রয়েছে এবং সেই সময়ের বিতর্কের বর্তমান অবস্থান কি?
এতিয়েঁন বালিবার : স্পষ্টতই, আমার দৃষ্টিতে পুঁজিবাদের পর্যালোচনা প্রয়োজন যা বর্তমানের দাবিগুলোর পক্ষে পর্যাপ্ত হবে। বর্তমানের দাবিগুলো : এইগুলো হলো, বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক সমস্যার একত্রে জড়ানো চরিত্র এবং প্রতিবেশগত সমস্যা। এটা নতুন ধরনের শাসন পদ্ধতির উথান। আমরা যেমনটা বলি, যে উভয় অংশে ইনফ্রা-স্ট্যাটিস্ট (infra-statist) এবং সুপ্রা-স্ট্যাটিস্ট (supra-statist) বা পোস্ট-স্ট্যাটিস্ট (post-statist)। এটা একধরনের সর্বজনীন পুনর্নির্মাণ(reworking) বা পুনরাকৃতি(reshaping)। আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও রাজনীতির এক নতুন পর্যালোচনা প্রয়োজন। মার্কস এই কাজের জন্য অনর্থক নয়, বরং তিনি একেবারে অপরিহার্য—তিনি নিজেই এ থেকে রূপান্তরিত হয়ে আবির্ভূত হবেন। আলথুসার তাঁর লেখা শেষ গ্রন্থগুলির একটিতে মার্কসবাদকে একটি সীমাবদ্ধ (finie) তত্ত্ব হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। স্পষ্টতই, এটা ছিল তৎকালীন শব্দের শক্তিশালী নাটকীয় ব্যবহার। প্রত্যেকেই মার্কসবাদের সমাপ্তি নিয়ে কথা বলছিল। আলথুসার বলেছিলেন যে, এটি মার্কসবাদের সমাপ্তি নয়। বরং তিনি মার্কসবাদকে সংজ্ঞায়িত করার দিকে বা নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন। জোর দিয়েছিলেন নিজস্ব ঐতিহাসিক সীমারেখার প্রয়োজনীয়তার উপরও। আপনি একভাবে বলতে পারেন যে তিনি শুরুতে যতটা না ইতিহাসবাদী (historicist) ছিলেন, তারও চেয়ে অধিক ইতিহাসবাদী হয়ে উঠছিলেন। আমরা ইতিমধ্যে মার্কসবাদ ব্যাখ্যার একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছি যা অনিবার্যভাবে, সম্ভবত মার্ক্সবাদের সম্পূর্ণ র্যাডিক্যাল রূপান্তর। নিঃসন্দেহে এই রূপান্তর থেকে এটা উত্থিত হবে যা সম্পুর্ণভাবে অপরিচিত। এই অবস্থান থেকে দেখলে, ১৯৬০-এর মধ্য দশকের মাঝামাঝি সময়ে যা-কিছু ঘটেছিল তা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পরামর্শের জন্যই নয়, যা সে সময় করা হয়েছিল এবং যা পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা হয়নি; নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, আলথুসারের আত্মসমালোচনার নেতিবাচক প্রভাব ছিল। তবে বিশেষভাবে এই কারণে হয়তো যে, মার্কসবাদের প্রত্যাবর্তনের এই বিতর্কে আলথুসার একমাত্র প্রটাগনিস্ট বা নায়ক ছিলেন না। একভাবে, তা ছিল, সেই বছরগুলো জুড়ে চলা বিভিন্ন দেশগুলোর মার্কসবাদীদের মধ্যে সাধারণভাবে চলা অতিরিক্ত প্রকল্পে ঢাকা। আমার নিজের কাছে, আলথুসারের জীবনীর একধরনের অগ্রাধিকার রয়েছে, তবে এর চূড়ান্ত অগ্রাধিকার নেই। যদি পরিপ্রেক্ষিত বিস্তৃত বা সম্প্রসারিত করা না হয়, তাহলে তিনি কি অবদান রেখেছিলেন তা পরিমাপ এবং পর্যালোচনা করা যাবে না। ষাটের দশকে, জার্মানির পর্যালোচনামূলক মার্কসবাদের কাঠামোয় ছিল নয়া reading of capital (Neue Marx-Lektüre), যার বেশিরভাগটাই ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কাছে ঋণী এবং যা বিশেষভাবে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঘটনাবলির দিকে নজর ছিল। কারণ এটা commodity-form-এর সাধারণীকরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এটি এমন একটি বিষয় ছিল যা আলথুসার ভালো জানতেন না অথবা জানতে চাননি। সেখানে ইতালীয় ওয়ার্কারিজমের (Italian workerism) আলাদা অবস্থান ছিল, এটার প্রধান চরিত্র হচ্ছে মারিও ত্রোনতি(Mario Tronti)। আলথুসার ও তাঁর দলের ঠিক সমসাময়িক মুহূর্তে, ত্রোনতিও ক্যাপিটালের পুনর্পঠন লিখেছিলেন যা নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় আলথুসারের সাথে মিলেছিল আর অন্যান্য জায়গায় ভিন্ন হয়েছিল। তবে আমরা লাতিন আমেরিকা থেকে আসা পর্যালোচনামূলক মার্কসবাদী ধারাগুলির সাথে দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও বিস্তৃত করে তুলতে পারি। তারপর এরিক হবসবম, মরিস ডোব, ক্রিস্টোফার হিল বা পেরি অ্যান্ডারসনের মাধ্যমে মার্কসবাদী ইতিহাসের ঐতিহ্য অ্যাংলো-স্যাক্সন বা ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় উদাহরণ হয়ে আছে। আমরা যদি ১৯৬৫’তে ফিরে যাই, আমরা দেখবো পূর্ণ বিকশিত মার্কসবাদ, যা সম্পূর্ণ স্ববিরোধী [নিজের সাথে বিরোধে লিপ্ত]। একদিকে, রাষ্ট্রীয় কমিউনিজমের সংকটের জগদ্দল অসার অবস্থা, অন্যদিকে বৈপ্লবিক আশা : এইসবের মাঝেও, মার্কসীয় দর্শন এবং সমকালীন দর্শনের মধ্যে সংযোগ বা সম্পর্ক নবায়ন করার সামর্থ্য। আমরা ঠিক আবার একইভাবে শুরু করতে পারি না, তবে এই সময়টি নিশ্চয়ই আজকের জন্য একটি ইতিবাচক প্রতীতি ধারণ করে।
অনুবাদকের টীকা :
[১] এক্যোল নরমেল সুপিরিয়রঃ École Normale Supérieure (সংক্ষেপে ENS) হচ্ছে প্যারিসের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষ্য ছিল গবেষক, অধ্যাপক এবং স্বাধীন প্রশাসক তৈরি করা। ফরাসি (ও সেইসাথে বিশ্বেরও) চিন্তাদুনিয়ায় প্রভাববিস্তারী সিংহভাগ ফরাসি তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের আঁতুড়ঘর বলা যায় এটাকে।
ইংরেজি অনুবাদের টীকা :
[২] agrégation হলো ফরাসি শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপুল প্রতিযোগিতামূলক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা যেখানে শিক্ষকতার জন্য নির্দিষ্ট পোস্ট বা পদ থাকে। Agrégé-répétiteur হলো agrégation পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক।