- বখতিয়ার আহমেদ
সম্পাদকীয় মন্তব্য: ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১৩ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন অন্তত ২০০ শ্রমিক। নিহত শ্রমিকদের অনেকেরই পরিচয় নিশ্চিত হতে না পেরে তাঁদের লাশ অজ্ঞাতনামা হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাজরীন ফ্যাশনসের এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে লিখিত বখতিয়ার আহমেদের এই আর্টিকেলটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ঘটনার পরের দিনই, ২৫ নভেম্বর ২০১২, অধুনা বিলুপ্ত অনলাইন পত্রিকা ‘উম্মোচন’-তে। এই বছর তাজরীন গার্মেন্টসের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আহত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও সু-চিকিৎসা এই তিনদাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছেন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রায় দুইমাস হতে চললো তাদের এই অবস্থান কর্মসূচির। রাষ্ট্র এখনো নির্বিকার। এই পরিস্থিতিতে বখতিয়ার আহমেদ এর পুরনো লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো। বর্তমান সংস্করণটি নেয়া হয়েছে লেখকের ফেসবুক নোট থেকে।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হিম শীতল মেঝেতে শুয়ে আছে সারি সারি পোড়া লাশ। কতগুলো? না সে হিসেব আমার কাছে নাই। লাশ গোনার জন্য আমাদের মিডিয়া আছে, পুলিশ আছে। খুলনা টেস্টের রান সংখ্যার মত অনলাইন দৈনিকগুলো লাশ গুনছে… লাইভ! চট্টগ্রামে আমাদের উন্নয়নের ফ্লাই ওভার ধ্বসে পড়েছে একটা… তার নীচেও আছে এক সার লাশ… সেও মিডিয়া গুনছে… ১১… ১২… ১৩… ১৫। লাশের সংখ্যানুযায়ী হবে কালকের পত্রিকার মেকাপ, আশুলিয়ায় যেহেতু সেঞ্চুরী হয়েছে, সেটা হয়তো ব্যানার হেডলাইন, আর চিটাগাং? ডান পাশে তিন কলাম ছয় ইঞ্চি… সাথে যাবে ছবি… ওরা গার্মেন্টস কর্মী, ওরা সব্জী বিক্রেতা… আবার কোন রাজকবি হয়তো এগিয়ে আসবেন রাজসিক পত্রিকাওয়ালাদের বাংলা শেখাতে… ক্যাপশন হবে ‘মুঠোফোন হাতে বোনের জন্য উদ্বিগ্ন বস্ত্রবালিকা’, বাংলা ভাষার এই অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে আমরা সাধুবাদ দিব বাহ বাহ… শুনতে পাই জীবন নাকি এখন ক্রিকেটের ভাষায়ও বয়ান করা যায়, ক্রিকেটকে জীবনের ভাষায়, তাহলে কোন ক্রীড়া প্রতিবেদক কি আগামী ম্যাচে লিখবেন ‘তামিমের ব্যাটে আশুলিয়ার আগুন’? কি জানি… হতেই পারে ‘সৃজনশীল’ সাংবাদিকতার এই যুগে।
কাল পরশুর ভেতরের পাতাগুলো সয়লাব হবে সমব্যথী উপসম্পাদকীয়তে… তারপর দুই একদিন ‘ফলো-আপ’… তারপর… এই সংবাদ ‘মোমেন্টাম’ হারাবে… পোড়া বা থ্যাঁতলানো লাশ তো আর নড়ে না। সংবাদ হতে হলে নড়তে হয়… মরে যাওয়ার আগে, গায়ে আগুন লেগে বহুতল বারান্দা থেকে লাফিয়ে না পড়লে, টন টন কংক্রিটের নীচে থ্যাঁতলে গিয়ে এক পায়ের পাতা বাইরে দেখা না গেলে তো আর তারা সংবাদ হয় না। তাদের তো আর অন্য কোন ‘নিউজ ভ্যালু’ নাই… তারা যে নিছক ‘বস্ত্রবালিকা’… কিম্বা বহদ্দার হাটের ফেরিওয়ালা। আমাদের মহান মুর্দা-ফরাস মিডিয়া খুব দক্ষতার সাথে লাশ গুনে চলেছে… যতক্ষন লাশ গোনা চলবে ততক্ষণ লাশেরা নিউজ… গোনা শেষ হলে ঘটনা আর ‘নিউ’ থাকেনা, ‘নিউজ’ হবে কোত্থেকে? লাশেরও একটা নাম থাকে… আমি একটা নামও জানিনা এখনো। জানিনা গত চব্বিশ ঘন্টায় লাশ হওয়া শতাধিক নাম লিখতে কয় কলাম কয় ইঞ্চি জায়গা লাগে। আর নাম জেনেই বা কি হবে… এরকম তো হর হামেশাই মরে… এইবার রান, থুক্কু… লাশ একটু বেশি এই যা… এই জন্যেই তো ব্যানার হেডলাইন…
এই পুড়ে কয়লা হওয়া সারি সারি লাশগুলো কারা? আশুলিয়ায়, সাভারে, মিরপুরে, হাজারিবাগে কিছুদিন পর পর কারা এমন পাইকারী হারে মারা পড়ে? আমরা সবাই জানি ওরা ভদ্রভাষায় গার্মেন্টস কর্মী… কাব্যিক ভাষায় বস্ত্রবালিকা… আর কারখানার ফ্লোর ইনচার্জের ভাষায় ছেমড়ি। আমি নিজেও দেখেছি বাসে করে যাওয়ার সময় আশুলিয়ার ইপিজেড ও তৎসংলগ্ন কারখানাগুলোতে ওদের পিঁপড়ার মত পিলপিল করে ঢুকতে বা বেরুতে। দেখেই বোঝা যায় খুব বেশিদিন হয়নি ওদের গ্রামের শিকড় ছিড়েছে। গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে নিওলিবারেল নাঙ্গাকরণ হয়েছে তার প্রথম শিকার হয়েছে আমাদের কৃষি অর্থনীতি। আমাদের কৃষিজ উৎপাদন আর কৃষকের পরিবারের ভরণ-পোষণে সক্ষম নয়। এমন নয় যে আমাদের কৃষকেরা কম উৎপাদন করছেন কিন্তু মুক্তবাজারের সার-বীজ-বিদ্যুত-ডিজেল কিনে, তারপর ফসল মুক্তবাজারে বেচে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে আর সংসার চলে না প্রান্তিক কৃষকের। ফলে আদরের মেয়েটি একদিন পাড়ি জমায় শহরে যেখানে কারখানার নগদ রোজগার হাতছানি দিয়ে ডাকে, হাতছানি দেয় নারী জীবনের অধরা আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন… ওরা শহরে আসে, গার্মেন্টসে কাজ নেয়। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় ষাটের দশকের শুরু থেকে আমাদের কৃষি সাম্রাজ্যিক অর্থনীতির কবলে পড়ে নিজের শক্তিমত্তা না হারালে আজকের গার্মেন্টসের জন্য এই বিপুল পরিমাণে সস্তা শ্রম শক্তির যোগান কোন ভাবেই সম্ভব হতো না।
এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী কি জিনিস? পৃথিবীর উত্তরের ধনী দেশগুলোতে মৌসুমে মৌসুমে পাল্টানোর জন্য যে পোষাক লাগে তার যোগান দেয়াই এই ফ্যাক্টরীগুলোর কাজ। এইটা বাংলাদেশের প্রথম গ্লোবাল শিল্প যেখানে কাপড়-সুতা আসে পূর্ব-এশিয়া থেকে, যন্ত্রপাতি আসে দূর-প্রাচ্য থেকে আর ক্রেতা আসে পশ্চিম থেকে। আমরা কি যোগান দিই? আমরা যোগান দেই শুধু সস্তা শ্রম। না না, ভুল হল, শুধু সস্তা শ্রম না, আমরা আরো যোগান দেই এই সস্তা শ্রমের কারবারি একটা উঠতি ধণিক শ্রেণীর যারা উন্নত দুনিয়ায় উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য কিনতে সক্ষম, কেএফসি আর পিৎজা হাটে গিয়ে ‘গ্লোবাল’ খাবার খেতে সক্ষম। সাথে ভোট দিয়ে যোগান দেই এই শ্রম ক্রমবর্ধমান হারে সস্তা রাখার জন্য ডান্ডাওয়ালা একেকটা সরকার, পুরা ব্যবস্থাটাকে বৈধতা দেয়ার মতন আইন-কানুন এবং গ্রহনযোগ্যতা এনে দেয়ার মত মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবিকূল –দুনিয়ার আর কোন সভ্য প্রান্তেই যেটা আর এত সহজে সম্ভব না। তৈরী পোষাকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের প্রধান তুরুপের তাস হচ্ছে কম দাম যেটা নিশ্চিত হয় অকল্পনীয় কম মজুরির কারণে। ২০০০ সালের দিকে যখন বিশ্বব্যাপী গার্মেন্টস বাণিজ্যের নির্ধারিত কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উদ্যোগে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকেরা তখন এই শ্রমিকদেরই দারিদ্রের দোহাই দিয়ে মার্কিনী সুশীল সমাজের মন গলিয়ে নিজেদের কোটাটুকু রক্ষা করেছিল।
বাংলাদেশের ইপিজেডগুলোতে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে, বাংলাদেশের সংবিধান কাজ করেনা। এখানে ট্রেড ইউনিয়ন করা যায় না, শ্রমিকদের দর কষাকষি তো দুরের ব্যাপার, পাওনা মজুরীটুকুও সময় মতো মেলে না প্রায়শই। মুক্তবাজারের পাগলা ঘোড়ায় চড়ে দ্রব্যমূল্য যখন আকাশ ছোঁয় তখন প্রহসনের ন্যূন্যতম মজুরীর দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিনিয়তই মার খেতে থাকে এই শ্রমিকেরা, গুম হয়ে যায় তাদের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরগুলো। চাকুরির কোন নিশ্চয়তা নেই, বেতনের নিশ্চয়তা নেই, নেই ওভার-টাইম, নেই ছুটি। আছে যৌন হয়রানি, পান থেকে চুন খসলেই বরখাস্ত, সময় মত বেতন চাইলে মাস্তান দিয়ে ঠেঙানো আর উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি। তারপরও নিরুপায় ওরা আসে… স্বামী-স্ত্রী কি ভাই-বোন মিলে কাজ করে এইসব কারখানায়, সামষ্টিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। ওদের শ্রমে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, ওই মুদ্রায় কেনা হয় ভোগ্য পণ্য, নানা বাহিনীর জন্য অস্ত্র আর পরিশোধ হয় বৈদেশিক ঋণের সুদ।
এই সব কিছুই জায়েজ হয় একটা অর্থনৈতিক মন্ত্র বলে যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন নিওলিবারেলিজম। কি সেই অমোঘ অর্থনীতির সূত্র? এই সুত্র মোতাবেক অর্থনীতির অবাধ উদারীকরণ ঘটাতে হবে (অবশ্যি শ্রম শক্তি বাদে), বিদেশী পুঁজি আর পণ্যের জন্য বাজার খুলে দিয়ে নাঙ্গা হতে হবে, প্রাইভেটাইজেশন হবে মূল চালিকা শক্তি যাকে সমস্ত নিয়মের নিগড় থেকে মুক্তি দিতে হবে। শুধু অর্থনীতি না, সমাজকেও তুলে দিতে হবে প্রাইভেট সেক্টরের হাতে। ব্যক্তি মালিকানাকে কোন ভাবেই কোন রকম বিরক্ত করা যাবে না। তৃণমূল থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হবে ঋণ-ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নিওলিবারেলিজমের প্রধান দুই এজেন্ট হচ্ছে অর্থনীতির ক্ষেত্রে রপ্তানি খাত আর সামাজিক ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ। রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার বিরোধী কোন রাজনৈতিক শক্তি সাম্রাজ্যের সমর্থন পাবে না। মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে নিওলিবারেল বিশ্বের কেন্দ্রের কোন রাষ্ট্র নয়, প্রান্তিক রাষ্ট্র। বৈশ্বিক নিওলিবারেল অর্থনীতিতে তার ভূমিকা মহাজনের নয়, মক্কেলের। ফলে কি রাজনীতি কি অর্থনীতি, সবখানেই তার নব্য-উদারীকরনের প্রকৃতি আর ফলাফলের একটা ভিন্ন চেহারা আছে।
তো গত বছর বিশেকের এই নব্য-উদারীকরণের ফলাফল আমরা দেখতে শুরু করেছি। কেএফসি’র পোড়া মুরগি থেকে শুরু করে আশুলিয়ার পোড়া লাশগুলো… সবই এই নিওলিবারেল তেলে ভাজা। নিওলিবারেল বিশ্বের আর সব মক্কেল রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশও ভেতর থেকে দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশেই এখন কিছু মানুষের জন্য আমেরিকান মানের ভোগ বিলাসিতার ব্যবস্থা আছে, ইথিওপিয়া বা সোমালিয়ার মানের দারিদ্রও আছে একটা বড় জনগোষ্ঠির জন্য। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প এই দ্বিখন্ডীকরণেরই প্রতিরুপ হয়ে বেড়ে উঠেছে। গার্মেন্টস শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিটা সরকারই খেয়াল রাখে গার্মেন্টস মালিকদের যেন কোনভাবেই যেন আইন-কানুন দিয়ে বিরক্ত করা না হয়। শ্রমিকদের মজুরী, নিরাপত্তা নিয়ে যেন তাদের কোনভাবেই কোন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়। একের পর এক কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিক মরলেও আমরা শুনি নাই যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় কোন কারখানা আজ পর্যন্ত সরকারের তরফে বন্ধ করা হয়েছে। ন্যায্য মজুরীর জন্য শ্রমিকেরা যেন মালিকদের বিরক্ত করতে না পারে, কারখানায় ভাঙচুর চালাতে না পারে সে জন্য গঠিত হয়েছে শিল্পাঞ্চল পুলিশ। তৎকালিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তো এই পুলিশের দায়িত্ব গার্মেন্টস মালিকদের হাতেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন।
তো অর্থনীতির বুনিয়াদী কাঠামোর এই রূপান্তর ছাপ ফেলেছে আমাদের সবকিছুতেই। এর ছাপ পড়ে নগরায়নে। কৃষিসহ স্থানিক অর্থনীতি যখন মুমুর্ষু হয়ে পড়ে, দলে দলে মানুষ তখন শহরমুখী হয়…পাহাড়ী গাঁয়ের কিশোরী মেয়েটিও তখন চট্টগ্রামে এসে গার্মেন্টসে কাজ নেয়, কাজ শেষে আশ্রয় নেয় কোন বস্তিতে। সেই বস্তিরও আবার ভাগ-বাটোয়ারা আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পান্ডা সংগঠনগুলোর মাঝে সরকার বদলের সাথে সাথে বস্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণও হাত বদল হয়… সরকার বদলের ঠিক আগে বা পরপরই কেন যেন বস্তিগুলোতে আগুন লাগতে থাকে… কারখানায় যারা পুড়ে মরেনা তারা মরে বস্তিতে লেগে যাওয়া আগুনে। কারখানায় আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রনে আনে আগুন আর পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনে ক্ষিপ্ত জনতাকে। গতকাল আশুলিয়াতেও পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে ক্ষিপ্ত শ্রমিকদের উপর। মানে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণই অর্ডার, নিয়ন্ত্রনই সাফল্য, নিয়ন্ত্রণই শেষ কথা।
আর এই সব কিছুকে আমাদের কাছে সহনীয় করে তুলতে, নানা বিনোদনে ভুলিয়ে দিতে আছে আমাদের যন্তর-মন্তর ঘর –নিওলিবারেল মিডিয়া। আমি নিজে আরেকবার নিশ্চিত হতে চলেছি যে বাংলাদেশে কর্পোরেটগুলোর হাত ধরে যে তথাকথিত গণমাধ্যম-বিপ্লব ঘটে গেছে গত দুই যুগে, তার প্রধানতম অবদান হচ্ছে ‘সাংবাদিকতা’কে ‘গণ-সংযোগে’ পরিণত করা। আমাদের সম্পাদকেরা এখন বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকাধীন কর্পোরেটের মুখ্য গণ-সংযোগ কর্মকর্তা… সাংবাদিকেরা জানতে বা অজান্তে তাদেরই গণসংযোগ কর্মী। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত ‘সাংবাদিকতা’ আর ‘গণ-সংযোগ’ একই বিভাগে পড়ানো হয়। আমি জানিনা বিভাগগুলো এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ কিভাবে শেখান তাদের শিক্ষার্থীদের, আমি নিজে এই দুইয়ের পার্থক্য করতে শিখেছি জর্জ অরওয়েলের কাছে। ‘সাংবাদিকতা’ হচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা যা প্রকাশ হতে দিতে চায় না তা প্রকাশ করা, এর বাইরে যা কিছু সম্প্রচারিত হয় তার সবই গণ-সংযোগ।
তো এই লাশ-গোনা সাংবাদিকতায় আমরা সেই গণ-সংযোগের এক নিষ্টাবান নিদর্শন দেখছি আশুলিয়া হত্যাকান্ড নিয়ে। খবরের শুরুর দিকেই একটা শীর্ষ দৈনিক তাজরীন গার্মেন্টসের মালিকের বক্তব্য ছেপেছে। তিনি পত্রিকায় আহাজারি করছেন চীন থেকে আমদানি করা ৫০০ টন সুতার জন্য, কাটিং মেশিনের জন্য, সেলাই মেশিনের জন্য… শ্রমিকদের নিয়ে হারাম কোন বাক্য বাইর হয় নাই তার মুখ দিয়ে। আর আমাদের গন-সংযোগী সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছেন কারখানাটিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কিনা, আগুন লাগলে বেরুনোর জন্য কোন পথ ছিল কিনা, তার কারখানায় ফায়ার ড্রিল হতো কিনা। এখনো তাদের মনে এই প্রশ্নটা জাগেনি যে আগুন লাগলে যেখানে বেরুনোর পথ নেই সেখানে ফ্যাক্টরি ফাঁদার অনুমোদন এসেছিল কার স্বাক্ষরে… শিল্পাঞ্চল পুলিশ এতোদিন কোথাকার ঘাস কেটেছে… এখনো মালিক ও অনুমোদন দেয়া কর্তা গ্রেফতার হয়নি কেন? গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠনের লাশ প্রতি এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের খবর চলে এসেছে লাশ-গোনা শেষ হওয়ার আগেই। শুধু তাদের মনের পড়েনি গত এক দশকে কতগুলো গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লেগেছে, ছাঁদ ধ্বসেছে। সেই হিসেব নিলে যে এটাকে স্রেফ একটা দুর্ঘটনা বলে চালান কঠিন হয়ে পড়বে। গার্মেন্টস কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অদ্যাবধি কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চোখে পড়েনি আমার। কে যাবে এত দায় কাঁধে নিতে? তার চেয়ে বসে বসে লাশের নামতা মুখস্ত লেখাই ভাল। পুড়ে কয়লা হওয়া শ্রমিকদের তারা সৎকার করছে তাদের নিছক সংখ্যায় পরিণত করে। খুলনা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের রান কত আর আশুলিয়ায় পুড়ে মরা শ্রমিক সংখ্যা কত এই দুই হিসাবের কোন পরিবেশনগত পার্থক্য নাই পত্রিকায়। হায় উদার নিরপেক্ষ মিডিয়া! সব মিলিয়ে আমাদের মিডিয়ার এই মুর্দা-ফরাস সাংবাদিকতা এই পরিস্থিতির পৌনপুনিকতার জন্য কম দায়ী নয়। যাদের রক্ত-ঘামে লুঠেরা ধনী, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলাদের তুলতুলে ভোগ-বিলাসিতা নিশ্চিত হয়, যাদের শ্রমে তাদের পোষা একোনমিস্টরা জিডিপি’র জয়গান গাইতে গাইতে ঠোঁটের দুই কোনায় ঘা বানিয়ে ফেলে… পুড়িয়ে মারার পর ওরা কেবলই সংখ্যা, একশ’র নীচে হলে ওকে, বেশি হলে ব্যাড… পাবলিক ইস্যু হয়ে যায়, পাবলিককে ভোলাতে সময় বেশি লাগে।
কাজেই নিওলিবারেল বাংলাদেশে আজ একটা নীরব ক্লাস-জেনোসাইড চলছে… এইগুলা দুর্ঘটনা না, কাঠামোগত হত্যাকান্ড, ওরা নির্দয় নিওলিবারেল মুনাফার শিকার। যে ঘটনা এত ঘন ঘন একই ছকে ঘটে সেটা দুর্ঘটনা হতে পারেনা। এই পুড়ে যাওয়া, মরে কয়লা হয়ে যাওয়ার নাম শ্রেনী-গণহত্যা। নাইলে গার্মেন্টসে পুড়ে, ফ্লাইওভারের নীচে, লঞ্চডুবিতে, বস্তি পুড়ে শুধু গরিবেরাই মরবে কেন? মিডিয়ার মন্তর মোতাবেক এসব কাঠামোগত গণহত্যাকে আমরা যতদিন ‘দুর্ঘটনা’ বলে মানব, এই লাশের মিছিল থামবে না… আমাদের বাতাসে পোড়া-পচা লাশের গন্ধ ফিরে ফিরে আসবে।
২৫ নভেম্বর ২০১২
দি এন্ট্রেন্স, সেন্ট্রাল কোস্ট
নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।