হল্যান্ড-ভিত্তিক ইতিহাসবিদ ও লেখক রুটগার ব্রেগম্যান ইউরোপের অন্যতম তরুণ চিন্তকদের একজন। মানুষকে স্বভাবত স্বার্থপর ও খারাপ ভাবার যে প্রবণতা চালু আছে তার বিরুদ্ধে তার নতুন বই Humankind– এ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। মানুষ আদতে ভালো এতে বিশ্বাস করা যে বাস্তবসম্মত এবং উপকারী, পাল্টা যুক্তিতে তিনি তা ব্যাখ্যা করেছেন। লর্ড অফ দ্য ফ্লাইস থেকে শুরু করে আরো বহু পরীক্ষা নিরীক্ষায় চালু থাকা প্রচলিত জনপ্রিয় ব্যাখ্যানগুলোকে এই বইয়ে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভিত্তিতে উলটে দেয়া হয়েছে। রুটগার ব্রেগম্যানের একটি ইন্টারভিউ সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ The Hindu-তে প্রকাশিত হয়; নিচে তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বৈষ্ণ রায়। অনুবাদ করেছেন নিশাত জাহান নিশা।
আপনার বইয়ে সভ্যতার ধারণাকে এমন একটি সূক্ষ্ম আবরণের সাথে তুলনা করা হয়েছে যেটি চাপের প্রথম ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়বে। আপনার এই মতামতের স্বপক্ষে ইতিহাস থেকে একটি উদাহরণ আমাদের দিন।
আমি এমন শ’খানেক উদাহরণ দিতে পারি। সেই ১৯৬০ সাল থেকে সমাজবিজ্ঞানীরা ৭০০’র অধিক কেস স্টাডি করেছেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর পরে ঠিক কি ঘটে সেটা জানতে। হারিকেন, ভূমিকম্প বা সুনামি যাই হোক না কেন প্রতিবার আপনি একই জিনিস দেখবেন-আর সেটি হল সহযোগিতার জোয়ার। বামপন্থী থেকে ডানপন্থী, ধনী-গরীব, এমনকি তরুণ এবং বৃদ্ধরা অর্থাৎ সবধরণের মানুষ একসাথে কাজ করে এসময়। বিপর্যয়ের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে হলিউডের সিনেমাগুলোয় এবং খবরে যা প্রকাশ করা হয় বাস্তবতা আসলে তার পুরো বিপরীত। সংকটকালীন সময়ে মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে যায়।
রেবেকা সলনিট তাঁর হ্যারিকেন ক্যাটরিনা’র পরিণতি নিয়ে লেখা বইয়ে ‘অভিজাত আতঙ্কের’ কথা বলেছেন। আপনি কি টার্মটা একটু ব্যখা করবেন এবং এটি ঠিক কিভাবে সংকটকালীন সময়ের পরিস্থিতিকা খারাপের দিকে নিয়ে যায় বলে আপনার ধারণা?
মানুষের প্রকৃতি বিচারের ক্ষেত্রে অভিজাতরা প্রায়শই ভাবেন অধিকাংশ মানুষ-ই স্বার্থপর, ঠিক যেন আয়নায় দেখা তাদের নিজেদের প্রতিবিম্বের মত। আর তাই বিপুলসংখ্যক মানুষের লুটপাট ও লুণ্ঠন শুরু করার ভয়ে ভীত হয়ে তারা পুলিশ পাঠায় নিয়ন্ত্রণ করতে। ক্যাটরিনার পরের বিপর্যয়টি ঘটেছিল সরকার কর্তৃক নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চালানোয়। বেশিরভাগ এলিটদের ওয়ার্ল্ডভিউ পুরোপুরি উল্টো বলেই তারা নিজেদেরকে সমাধানকর্তাভাবে যেখানে সমস্যার মূল-ই হল তারা। ক্ষমতা যে মানুষকে কলুষিত করে এবং বেশিরভাগ মানুষ যে প্রকৃতঅর্থেই ভালো সে ব্যাপারে বহু সাইকোলজিক্যাল প্রমাণাদি আছে।
আমি মানছি মানুষকে তার চরিত্রের সবচেয়ে খারাপদিকটাতে দেখতেই আমরা পছন্দ করি, কিন্তু মিডিয়া এবং খবরের নেতিবাচকতাকে আপনি এর জন্য অনেক বেশি দায় দিচ্ছেন। আপনার কি মনে হয় না জলবায়ু পরিবর্তন, জাতিভেদ, বর্ণবাদ এবং আরো যা যা বাড়ছে এ সমস্তের দায় এড়াতে ট্রাম্প এবং তার স্বৈরশাসন যে পথে এগুচ্ছে এটি অনেকটা সেরকম?
অধিকাংশসময় নেতিবাচক ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করাটা আমাদের জন্য আসলে খুব একটা সুখকর নয়। এটি আমাদেরকে উদ্বিগ্ন, মানববিদ্বেষী এবং বিষণ্ন করে তোলে। সাইকোলজিস্টরা যাকে বলেন ‘মিন ওয়ার্ল্ড সিনড্রোম’। খবর (News) এবং সাংবাদিকতা (Journalism) এর মধ্যকার ফারাক করতে পারাটা খুব জরুরি। ভালো এবং গঠনমূলক সাংবাদিকতা আসলে ক্ষমতার সত্যরূপটি জানায়, পৃথিবীকে বুঝতে সাহায্য করে এবং ইতিহাস ও প্রকৃতি নিয়ে যুক্তিসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি গড়তে সাহায্য করে।
‘আদি পাপ’ নিয়ে যে খৃস্টীয় ধারণা আছে, সেটিকে মানবতার পক্ষে যথেষ্ট নিষ্ঠুর বলে আমার মনে হয়। তো পাশ্চাত্য দর্শন নিয়ে যখন আপনাকে তীব্র কৌতুক করতে দেখলাম, আমার কাছে ব্যাপারটা কৌতূহলোদ্দীপক মনে হলো। চিন্তাভাবনার অন্যান্য শাখাগুলোয়ও কি আপনি এরকম কৌতূহলী প্রতিরূপ বা কাউন্টারপয়েন্ট দেখতে পান?
মানুষকে স্বার্থপর ভাবার প্রবণতা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে প্রবল। প্রাচীন গ্রীক থেকে শুরু করে, গোঁড়া খ্রিস্টান, এমনকি এনলাইটমেন্টের দার্শনিকদের মাঝেও এটি দেখা যায়। অবশ্য খুব অল্প হলেও সেখানেও কিছু ব্যতিক্রম ছিল। ১৯ শতকের এনার্কিস্ট পিটার ত্রপোৎকিনের কথাই ধরুণ, তিনি মানুষের ভালোত্বে বিশ্বসা করতেন, এবং অবশ্যই এধরণের মানুষকে তাদের এমন ভয়ংকর চিন্তার জন্য নিগৃহীত হতে হত কেননা উপরতলার মানুষেরা বুঝতে পেরেছিলেন মানবপ্রকৃতির এমন আশাবাদী চরিত্রের ফলাফল কি হতে পারে। তারা এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমনটা হলে তাদেরকে আর আমাদের প্রয়োজন পড়বে না। তো বুঝতেই পারছেন, মানুষের ভালোত্বে বিশ্বাস করা একটি বৈপ্লবিক কাজ।
দিমিত্রি বেলিয়ায়েভ পরীক্ষা এবং আপনার উপসংহার- আপনি বলেছেন, ‘What dogs are to wolves, we are to Neanderthals’– দুটোই পাঠই চিত্তাকর্ষক। হোমো পাপি নিয়ে আমাদের আরো কিছু বলেন।
বর্তমান সময়ে জীবিবিজ্ঞানের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক তত্ত্বগুলোর মাঝে এটি একটি। মানুষ যে গরু এবং শূকরের মতই গৃহপালিত প্রাণী তার স্বপক্ষে বহু প্রমাণাদি আছে। যেসব প্রজাতি গৃহপালিত, তাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে- যেমন ধরুণ হাড়গুলো খুব চিকন এবং মাথা ছোট আকারের হয়, জীববিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকে এসব জানেন। সবচেয়ে জরুরি যেটা, গৃহপালিত প্রজাতিগুলো তাদের আদি পূর্বপুরুষের তুলনায় বেশ শিশুসুলভ এবং আদুরে হয়। মানুষের মাঝেও আপনি এটি দেখতে পাবেন। আর্কিওলজক্যাল রেকর্ডানুযায়ী আপনি যদি আজ থেকে ৫ বিলিয়ন ৪ লক্ষ ৩ হাজার ২০ বছর এবং ১০,০০০ বছর আগেকার আমাদের স্কেলেটনের তুলনা করেন, তবে মানবতার আদুরে ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন: আমরা আসলে হোমো পাপি। এমনকি জীববিজ্ঞানীরা ‘বন্ধুত্বের টিকে থাকার’ ব্যাপার নিয়েও কথা বলেছেন: ব্যপারটা এমন, সেই সহস্রাব্দ থেকে বন্ধুসুলভ মানুষদের-ই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে নিজেদের জীন দেওয়ার হার বেশি ছিল। বিজ্ঞানীদের মাঝে রাশিয়ান জীববিজ্ঞানী দিমিত্রি বেলিয়ায়েভ প্রথম এটি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন প্রাণীদের বশ মানানো সম্ভব, পরীক্ষার জন্য তিনি বেছে নিয়াছিলেন ওয়াইল্ড সিলভার ফক্সকে। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখিয়েছিলেন গৃহপালিত প্রাণীরা বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষায়ও বেশ ভাল করে। এমনকি পরবর্তীতে একজন জীববিজ্ঞানী বলেছিলেন, আপনি যদি কোন বুদ্ধিমান শেয়াল বেছে নেন, তবে আপনি তার বুদ্ধিমত্তা নয় বরং বন্ধুত্বদের জন্যই তাকে নেন। আমাদের প্রজাতির বিবর্তনেও ঠিক এটা ঘটে।
রিচার্ড ডকিন্সের আইকনিক বই ‘দ্য সেলফিস জিন’ এ মানুষের স্বার্থপরতা নিয়ে যেসব তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে আপনি সেগুলোকে পাল্টে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না দৈনন্দিন জীবন থেকে প্রতিযোগিতা দূরে রাখতে চাওয়া খুব সরল ভাবনা?
আমি আসলে কিছুই দূর করে দিতে চাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি আমাদের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতা বেশি জরুরি। আমাদের সমস্ত সাফল্যের মূলে রয়েছে বন্ধুত্ব এবং এটি আমাদেরকে এমনভাবে সহযোগিতা করতে শিখিয়েছে যেটি পুরো প্রাণীজগতের আর কেউ পারেনা। এমনকি এটি আমাদের শরীরের ক্ষেত্রেও আপনি তা দেখতে পাবেন। এখনো উৎফুল্ল হওয়ার মত অনন্য ক্ষমতা আমদের আছে- অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও অন্যের সাথে অনুভূতি শেয়ার করতে পারি। আপনি ভাবতে পারেন উৎফুল্ল হওয়া কি করে বিবর্তনের সুবিধা হতে পারে? এটি আসলে আমাদের অন্যের ওপর ভরসা করতে এবং অন্যকে সহযোগিতা করতে শেখায়।
এমনকি আপনার বইয়ে পশ্চিমা ধাঁচের ব্যক্তিত্ববাদের বদলে আপনি বহু প্রচলিত সাম্প্রদায়িক কাঠামোর [communal structure] সমাজের পক্ষে কথা বলছেন বলে মনে হয়।
‘প্রচলিত’ দিয়ে আপনি যদি ‘যাযাবর শিকারী বা সংগ্রহকারী’ সমাজ বুঝিয়ে থাকেন, তবে ঠিক আছে। আমাদের ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে যে আমরা সমতাবাদী, প্রোটো-নারীবাদী-সমাজে ছিলাম সে ব্যাপারে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক প্রমাণাদি আছে। আমরা বিকশিত হয়েছি একসাথে। অন্যের সাথে যুক্ততা আমাদের ঠিক ততটা দরকার যতটা খাদ্য আমাদের দরকার হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে দিনে ১৫টা সিগারেট খেলে যতটূকু ক্ষতি হয়, একাকীত্ব ঠিক ততটাই ক্ষতি করে।
মানব ইতিহাসের অনেক বড় একটা সময় জুড়ে যদি আমরা প্রোটো-ফেমিনিস্ট-সমাজে থাকি, তাহলে ঠিক কখন থেকে হাইপার-মাস্কুলিনিটি এবং আগ্রাসন শুরু হলো?
কঠোর শ্রেণীবিন্যাস এবং পুরুষতন্ত্র আসলে খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। মাত্র ১৫০০০ বছর আগে মানুষ যখন গ্রাম ও শহরে আবাস গড়ল এবং কৃষির উদ্ভাবন হল, তখন এর শুরু হয়। আমরা যাকে ‘সভ্যতা’ বলি সেটা আসলে অনেক বড় একটি বিপর্যয়। সভ্যতার কারণে আমরা পেয়েছি যুদ্ধ, দাসত্ব, সংক্রামক ব্যাধি এবং দীর্ঘ কর্মময় সময়। সম্প্রতি জিনিসগুলো কিছুটা ভাল হয়েছে। এটি বেশ আশার কথা যে, ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য ও শিশু মৃত্যুর হার কমছে। কিন্তু প্রশ্ন হল আমাদের ‘সভ্যতা’ ঠিক কতটুকু টেকসই? আপনি দেখেন, আমাদের জলবায়ু কিভাবে বদলে যাচ্ছে এবং কত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে আপনি বলছেন, ‘সভ্যতা’ মানে আসলে ‘নগর’ না? আপনার কি মনে হয় না সমস্ত কিছুকে আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাওয়ার ধারণা খুব অযৌক্তিক?
অবশ্যই আমরা আগের জায়গায় ফিরতে পারব না এবং ফেরার উপায় যদি থাকত তবুও আমি বলতাম, না ফিরতে। কিন্তু আমরা কোথা থেকে এসেছি সেটি জানা জরুরি। প্রাচীন গ্রীকরা যেমন বলতেন ‘Gnothi seauton’, মানে ‘নিজেকে জানো।’ দীর্ঘ একটা সময় ধরে মানবপ্রকৃতি নিয়ে ভুল এবং ভয়ংকর সব দৃষ্টিভঙ্গির ওপর পশ্চিমারা তাদের প্রতিষ্ঠান তৈরী করেছে এবং বিশ্বব্যাপী তা প্রচার করেছে। কিন্তু প্রজাতি হিসেবে আমরা আসলেই কি সেটি ভাবার সময় এখন এসেছে।
আপনি বলেন, সমাজের মানবতা সচল করা কোন মিথ্যা স্বপ্ন নয়। এটা ঠিক কিভাবে করা সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?
মানুষের সম্পর্কে আপনি যা ভাববেন, আপনি আসলে তাই দেখবেন। দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে খারাপ ভেবেই স্কুল, কাজেরক্ষেত্র এবং জেল তৈরী করা হয়েছে। এতে আমাদের অনেকের মাঝে সবচেয়ে খারাপ দিকটাই প্রকাশ পেয়েছে। নৃবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং সাইকোলজিস্টদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা সমাজকে নতুন করে ভাবতে পারি এবং গড়তে পারি। এজন্য যারা কাজ করছে, তাদেরকে হয়ত আজকে নির্বোধ বলে সরিয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা জানি আজ যা উদ্ভট কাল তাই কাণ্ডজ্ঞান বলে বিবেচিত হবে। দাসপ্রথার বিলোপ বা গণতন্ত্রের উত্থানের কথাই ভাবুন, শুরু হওয়ার আগে এগুলোকেও অসম্ভব বলে মনে করা হত। অথবা অস্কার ওয়াইল্ড যেমন বলতেন, progress is the realisation of utopias।
- অনুবাদক: নিশাত জাহান নিশা, শিক্ষার্থী শাবিপ্রবি