- পারভেজ আলম
সুলতানের দুইটা ছবি নিয়ে আমার পাঠকে ‘গায়েবি পাঠ’ তকমা দিয়ে একটি সমালোচনা লেখা হয়েছে দেখলাম। গায়েবি পাঠ কী জিনিস তা জানিনা, এবং সমালোচনাটি তাচ্ছিল্যধর্মী। এই ধরণের তাচ্ছিল্যধর্মী সমালোচনার জবাব দেয়া যদিও জরুরি না, কিন্তু কিছু কারনে জবাব দিতে বাধ্য হলাম। সুলতানের “প্রথম বৃক্ষরোপন” ছবিটির যে পাঠ আমি করেছি তা মূলত ছবিটি নিয়ে তারেক মাসুদের পাঠেরই ধারাবাহিকতায়। তারেক মাসুদের পাঠ কারো অপছন্দ হতেই পারে, যেমন এই লেখাটিতে তার সুলতান পাঠ “অনেকাংশই অপরিপক্ক” বলে দাবি করা হয়েছে। এই ধরণের দাবি নেড়েচেড়ে দেখবার কোন ইচ্ছা ও সময় নাই। তারেক মাসুদের মতো একজন শিল্পী যখন সুলতানের মতো একজন শিল্পীর শিল্পের পাঠ করেন, তখন সেই পাঠকে “অপরিপক্ক” ধরণের শব্দ দিয়ে ধরা যায় কিনা সেই বিবেচনা পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। তাছাড়া শিল্প গবেষকদের পাঠ সবসময়ই শিল্পীদের পাঠের চাইতে বেশি পরিপক্ক হবে এও খুবি সাবজেক্টিভ একটা ধারণা মাত্র। লেখক আরো দাবি করেছেন যে সুলতান বিভিন্ন জনের পাত্রের আকার বুঝে সেই অনুপাতে পানি ঢালতেন। মানে তিনি তারেক মাসুদকে নিজের শিল্প সম্বন্ধে যা-ই বলেছেন তা মাসুদের পাত্রের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ীই বলেছেন। আমি এই দাবিটিকে একেবারেই উড়িয়ে দিতে পারছিনা। তবে একিসাথে মাসুদের পাত্র এবং এই লেখাটির লেখকের পাত্র অথবা সুলতান অন্য যাদের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন; তাদের কারো পাত্রই মেপে নিয়ে তুলনামূলক কোন আলাপ করা সম্ভব হচ্ছেনা।
তবে তারেক মাসুদের পাঠের বিপরীতে তিনি “সুলতানের অনেক ইন্টারভিউ”কে সূত্র মেনে “প্রথম বৃক্ষরোপন” ছবিটির যে ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তাতে এমন ভিন্ন পাত্র সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা পাই বটে। যেমন এইক্ষেত্রে তিনি লিখেছেন যে সুলতানের এসব ইন্টারভিউ মোতাবেক এই ছবিটি “প্রথম কৃষকের ছবি”। কিন্তু “প্রথম কৃষকের” ছবি ধারণাটি কেন আদমের ছবির ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক তা পরিষ্কার হলনা। এক জায়গায় অবশ্য তিনি লিখেছেন যে আদি পিতা কৃষক ছিলেন, “এই তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না”। কিন্তু একজন শিল্পী হিসাবে সুলতান কেন আদমকে প্রথম কৃষক হিসাবে কল্পনা করতে পারবেন না, তাও বোঝা গেলনা। তবে এইখানে বলে রাখা ভাল যে আদম কৃষক ছিলেন এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না বলে তিনি যে দাবিটি করেছেন তা ঠিক না। আদম হাওয়ার কাহিনীর সবচাইতে পুরাতন যে উৎস, অর্থাৎ তাওরাতের পয়দায়েশ অধ্যায়েই আছে যে জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার অপরাধে আল্লাহ্ আদমকে যখন আদনের বাগান থেকে নির্বাসিত করলেন, তখন বললেন যে “যে গাছের ফলের বিষয়ে আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি তা ভোজন করো না, তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে সেই গাছের ফল ভোজন করেছ। তাই তোমার দরুন ভূমিকে বদদোয়া দেওয়া হল; তুমি সারা জীবন কষ্ট করে তা ভোগ করবে; আর তাতে তোমার জন্য কাঁটা ও শেয়ালকাঁটা জন্মাবে এবং তুমি ক্ষেতের ওষধি ভোজন করবে” (পয়দায়েশ ৩ঃ ১৭-১৮)। ইবনে আব্বাস বর্ণিত একটি হাদিসেও আদমকে একজন কৃষক বলা হয়েছে। তবে, ইব্রাহিমি ঐতিহ্য মোতাবেক, আদম অনেক কিছুতেই প্রথম ছিলেন, প্রথম মানুষ বলেই। সুতরাং এই লেখায় যে দাবি করা হয়েছে আদম কৃষক ছিলেন এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না, এইটা একটা ভুল দাবি। তবে, আসল কথা হল যে এমন তথ্য থাকা বা না থাকার সাথে সুলতানের দিক থেকে আদমকে প্রথম কৃষক হিসাবে কল্পনা করা বা উপস্থাপনের কোন সম্পর্ক থাকা জরুরি নয়। সুলতান যেহেতু এই ছবিতে আদি পিতা বা প্রথম কৃষক ধরণের একটি সার্বিক ধারণা হাজির করতে চেয়েছেন বাঙালি কৃষক বিশেষের উপস্থাপনের মাধ্যমে, তার কাছে এইক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক অর্থডক্সি আশা করা অবান্তর।
এই লেখাটি পড়লে আরেকটি বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে আর তাহল যে তারেক মাসুদের আদম সুরত সিনেমাটির পোস্টার দেখেই মানুষ এই ছবিটিকে আদমের ছবি ভাবা শুরু করেছে। কিভাবে এমন ভ্রান্তি ছড়িয়েছে এই বিষয়ে তিনি আরো কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছেন যা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। বাস্তবে আদম সুরত সিনেমাটির ৩৩ মিনিট ৪৫ সেকন্ড নাগাদ ছবিটিকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে আদি পিতা আদমের ছবি হিসাবে। একটি সাক্ষাৎকারেও তারেক মাসুদ একি বক্তব্য হাজির করেছেন। এখন কারো পাঠ ও ব্যাখ্যা ছবিটি নিয়ে মাসুদের পাঠের চাইতে ভিন্ন হতেই পারে। শিল্পের ব্যাখ্যাতো আর অঙ্ক কষার মতো ব্যাপার না যে সকল পাঠের ক্ষেত্রেই একটা সুনির্দিষ্ট ফলাফল আসবে। যার যেমন পাত্র, সে একটা শিল্পকে সেই অনুযায়ীই ধারণ বা পাঠ করবে। আরো ভালভাবে বললে, একেকজনের ইন্টারপ্রিটিভ ফ্রেমওয়ার্ক একেক রকম হতে পারে, এবং শিল্পের পাঠও সেই অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। কেউ চাইলে প্রথম বৃক্ষরোপন ছবিটি দেখে আদমের সুরত উপস্থাপন পাঠ করার বদলে শুধুই প্রথম কৃষকের ছবি হিসাবে পাঠ করতেই পারেন। কিন্তু তাতে তারেক মাসুদ বা তার সূত্র ধরে আমার পাঠ “গায়েবি পাঠ” কেন হবে, এবং এই “গায়েবি পাঠ” জিনিসটাই বা কী, তা বোঝা গেলনা। সুলতানের ছবি নিয়ে তারেক মাসুদের নিজস্ব পাঠ ও দার্শনিকতার স্বাধীনতাকে খারিজ না করেও আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে “আদম সুরত” সিনেমাটি ১৯৮৯ সালে প্রথম প্রচারিত হয়। সুলতানতো তখন জীবিত ছিলেন। তাছাড়া তিনি এই সিনেমার জন্যে কয়েকটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। মাসুদের পাঠ নিয়ে যদি তার কোন আপত্তি না থাকে, তবে মাসুদের পাঠকে খোদ সুলতানের পাঠের সাথে সাংঘর্ষিক ধরে নেয়ার মতো কোন যুক্তি দেখিনা। কারো পাত্রের আকার, ইন্টারপ্রিটিভ ফ্রেমওয়ার্ক অথবা চেতনার দিগন্তের সীমার কারনে এমন সংঘর্ষ কেউ দেখলে অবশ্য তা নিয়ে কিছু বলার নাই। যেমন এই লেখাটিতে মাসুদ ও আমার পাঠের বিপরীতে “সুলতানের অনেক ইন্টারভিউ”-এর বরাতে দাবি করা হয়েছে যে সুলতান প্রথম বৃক্ষরোপন ছবিটিতে ডানাওয়ালা নারীমূর্তিটিকে বর্ণনা করেছেন “ঈশ্বরের প্রতিনিধি এক পরী” হিসাবে। আমি ঐ লেখাটির মতো যুক্তি দিতে চাইনা যে ইশ্বরের প্রতিনিধি কোন পরী আছে এমন তথ্য কোথাও নাই (থাকতেওতো পারে, আমি জানিনা)। তার বদলে যা বলা দরকার তা হল যে, দুনিয়ায় ডিভাইনিটির ফেমিনিন প্রকাশ বা সাকিনা ধরণের ধারণার সাথে “ইশ্বরের প্রতিনিধি পরী” ধরণের ধারণা সংঘর্ষ আছে বলে মনে হয় না। তবে ইশ্বরের প্রতিনিধি পরী কথাটি সেই পাত্রের ধারণের উপযুক্ত বলেই মনে হয় যে পাত্র দুনিয়ার বুকে খোদার ফেমিনিন প্রকাশ সংক্রান্ত ধর্মতাত্ত্বিক বা দার্শনিক জ্ঞান ধারণ করেনা। সুতরাং, তারেক মাসুদের তথাকথিত অপরিপক্ক পাত্রের চাইতে পরিপক্ক কোন পাত্রের সন্ধান এই লেখাটিতে পেলাম না, তা বলে রাখা দরকার।
এই লেখাটিতে সুলতানের আফটার দা ফ্লাড নামে পরিচিত ছবিটি নিয়ে আমার পাঠকে উল্লেখ করা হয়েছে “গুগল আর কল্পনা মেশানো” পাঠ হিসাবে। শিল্পের ব্যাখ্যায় কল্পনা নিন্দাযোগ্য কেন তা বোঝা গেলনা। আর গুগল প্রসঙ্গের অবতারণা করা এইক্ষেত্রে পুরাপুরি গায়েবি, মানে অদৃশ্য জ্ঞানের ব্যাপার। বাস্তবতা হল যে ছবিটির হত্যাযজ্ঞ (জেনোসাইড) এবং আফটার দা ফ্লাড, এই দুইটা নামের সাথেই আমি পরিচিত। এবং এরমধ্যে কোন একটা নাম ভুলে প্রকাশিত কিনা তা জানার জন্যে আমি বাংলাদেশে কয়েকজন বন্ধু ও শিল্পীর সাথে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছি, যেহেতু আমার পক্ষে অন্য কোন উপায়ে বিষয়টা যাচাই করা সম্ভব না। আমি এই ছবিটির পাঠ যখন লিখেছি তখন ও তারপর এই ছবিটির নাম সম্বন্ধে যা জানতে পেরেছি তাহল যে ছবিটি এই দুই নামেই প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য ছবিটির দুইটি সংস্করণ দুই নামে প্রকাশিত হয়েছে, এমন তথ্যও আমাকে একজন শিল্পী দিয়েছেন। যাই হোক, আমার পাঠের সমালোচনায় “আফটার দা ফ্লাড” নামটিকে ভুল নাম দাবি করা হয়েছে, যার সাথে আমি একমত হতে পারছিনা বিভিন্ন কারনে। এই লেখায় অবশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে আর তাহল যে “আফটার দি ফ্লাড” নামটি দিয়েছিলেন সুবীর চৌধুরী। এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং সুলতানের এই ছবিটির উপর আমার পাঠকে ভবিষ্যতে আরো বিস্তৃত করার সুযোগ পেলে তাতে এই তথ্য যুক্ত করার ইচ্ছা রাখি। কিন্তু সুবীর চৌধুরী এই নামটি সুলতানের জীবদ্দশায় দিয়েছেন কিনা (আমার ধারণা সুলতানের জীবদ্দশায় এবং তার জ্ঞাতেই দিয়েছেন), এবং এর বিরুদ্ধে সুলতানের কোন আপত্তি ছিল কিনা তাও জানা গেল না। চিত্রকলার জগতে একি ছবির একাধিক নাম কোন বিরল ঘটনা না। এই ছবিটিকে আমি যে “গার্ডেন অফ আর্থলি ডিলাইট” নামক ছবির সাথে তুলনা করে আলাপ করেছি, সেই ছবিটিরও আদিতে কোন নাম ছিল না এবং এই নামটি পরে দেয়া। সুলতানের এই ছবির নামকরণের বিস্তারিত ইতিহাস জানিনা আমি, হত্যাযজ্ঞ নামকরণের ইতিহাসও না। তবে ছবিটি দুইটি নামেই পরিচিতি পেয়েছে। যার কারনে, এরমধ্যে একটি নামকে ভুল বলে উড়িয়ে দেয়ার মতো যুক্তি এই সমালোচনাটিতে আছে বলে মনে করিনা।
তাছাড়া এই নামকরণের ইতিহাস আমার পাঠের সাথে সাংঘর্ষিকও না। এমনকি এই নামটি সুবীর চৌধুরীর দেয়া হলেও না। কেননা, এই লেখায় সুবীর চৌধুরীর এই নামকরণকে যে “আল্লাদ” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই আল্লাদকে তার ইন্টারপ্রিটেশনও বলা যায়। এই ইন্টারপ্রিটেশনের সাথে খোদ সুলতানের ইন্টারপ্রিটেশনের কোন সম্পর্ক যদি নাও থাকে (যদিও তেমন কোন প্রমাণ পাই নাই), তাও আমি এই ইন্টারপ্রিটেশন ও নামের উপর ভিত্তি করে আমার একটা পাঠ হাজির করতেই পারি। বড়জোর কিছু বাড়তি তথ্য আমার যুক্ত করতে হবে। কারন প্রথম থেকেই, বন্যার পর বলি বা হত্যাযজ্ঞ, এই ছবিটির মধ্যে আমি একটি কেয়ামত বা পুনরুত্থানই পাঠ করেছি। বন্যা বলেন বা জেনোসাইড, তার উপস্থাপনতো সুলতান ধ্বংস ও মৃত্যুর চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে করেন নাই, বরং পুনরুত্থান বা পুনর্জাগরণের উপস্থাপন হিসাবে করেছেন। আমার পাঠটি যারা পড়েছেন,তারা জানেন যে আমি এই পুনরুত্থানকে ব্যক্তি এবং জাতির জীবনের প্রেক্ষিতেও আলোচনা করেছি। এই আলোচনা করার সময় হত্যাযজ্ঞ নামটিও আমার মাথায় ছিল। তবে এই ধরণের লেখা যেহেতু ফেসবুকের জন্যে এবং এক বসায় লেখা, সেহেতু এরমধ্যে অতো বিস্তারিত আলাপে যাওয়া সম্ভবও না। আশা রাখি যে ভবিষ্যতে সুলতানের ছবি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলাপ করার সুযোগ হবে।
ফেসবুক: ১৯ আগস্ট ২০২০
- পারভেজ আলম: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী