সম্পাদকীয়র পরিবর্তে
ষোড়শ সংশোধনীর রায় ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতি
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের ভিত্তি
ষোড়শ সংশোধনীর রায প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট সাংবিধানিক মামলা-মোকদ্দমা ফয়সালার ক্ষেত্রে এক নতুন উচ্চতায় আসীন হয়েছে। এ পথে প্রথম যাত্রাটি শুরু হয়েছিল অনেক আগে বেরুবাড়ী মামলার মাধ্যমে। অষ্টম সংশোধনী মামলার মধ্য দিয়ে ২য় পর্যায়ে উত্তরণ ঘটলেও মূলত ৫ম সংশোধনী মামলার রায়ের মধ্য দিয়েই সংবিধান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। ৫ম সংশোধনী এবং ৭ম সংশোধনী মামলার রায়ে এদেশে সামরিক শাসনের জেনেসিস, আকার-প্রকার, প্রকৃতি, দর্শন এবং সর্বোপরি বৈধতা-অবৈধতা তথা সাংবিধানিকতা পরীক্ষা আর পর্যালোচনা করে সামরিক শাসনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং সংবিধানভঙ্গের অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে কেউ সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্পর্ধা না দেখায় তার জন্য আগাম হুঁশিয়ারীও দেয়া হয়েছে এসব রায়ে। এসব সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসনের উত্থান, এ ধরনের অসাংবিধানিক ব্যবস্থাকে বৈধতা দেয়ার ক্ষেত্রে আদালতের বিশ্লেষণের ভুল এবং সীমাবদ্ধতা ইত্যাদিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি এদেশের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, নতুন রাষ্ট্র ও সংবিধান অর্জনে জনগণের আকাক্সক্ষা ও অবদান, রাষ্ট্রক্ষমতার মালিকানার প্রশ্ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়েছে।
ষোড়শ সংশোধনীর মূল রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা। সংবিধান বিশ্লেষণে তিনি এবং তাঁর সতীর্থরা সেই ধারা বা পদ্ধতিরই অনুসরণ করেছেন যা ইতিপূর্বে বিচারপতি খায়রুল হক ৫ম সংশোধনী ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় লেখার সময় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া এস. কে. সিনহা নিজেও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে খায়রুল হকের একজন সমর্থক ছিলেন। ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’ বলতে বিচারক থাকাকালে খায়রুল হক নিজে যেসব মতামত বিভিন্ন রায়ে দিয়েছেন সেসব ধারণা ও মতামতকেই যথার্থভাবে প্রয়োগ করেছেন বিচারপতি এস. কে. সিনহা। আরো নির্দিষ্ট করে বলা চলে বিচারপতি খায়রুল হক তার পূর্বোল্লিখিত ২টি রায়ে সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন মি. সিনহা তার অনেকগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র।
এ ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত ‘আমি’ ও ‘আমরা’ বিষয়ক বিতর্কের কথা বলা যেতে পারে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে খায়রুল হক ‘তৃতীয় ভাগ’ শিরোনাম দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কিত আলোচনা শুরু করেছেন।
সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ অংশটুকু উদ্ধৃত করে ৮০৮ নম্বর পয়েন্টে তিনি বলছেন “৮০৮। উপরে বর্ণিত ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’ কাহারা এই জনগণ? বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, অগণিত জনমানুষ, জনতা, তাহারাই এই ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’। তাহাদের সৃষ্ট গণপরিষদ সকলের আশা, আকাক্সক্ষা ও অধিকারের মূর্তপ্রতীক হিসেবে এই সংবিধান রচনা করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে এই সংবিধান ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’-এরই সৃষ্টি।”
এস. কে সিনহার রায়ের যে সমালোচনা খায়রুল হক করেছেন তা শুধু স্ববিরোধী নয়, অনৈতিকও। এসব স্ববিরোধিতার অজস্র নমুনা আছে। এখানে আমরা শুধু ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় প্রদত্ত দীর্ঘতম রায়ের ১১৯৪ নং পয়েন্টে সারমর্ম শিরোনামে তিনি যা লিখেছিলেন তার কিছুটা এখানে উদ্বৃত করতে পারি।
“১১৯৪.৪৪। সারমর্ম
(১) জনগণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম;
(২) বাংলাদেশের সরকার মানুষের সরকার নহে আইনের সরকার;
(৩) সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, ইহা বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও পদ সৃষ্টি করিয়াছে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে;
(৪) জনগণের সার্বভৌমত্ব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্রের মূলভিত্তি এবং সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার;
(৫) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন ধরনের ... (Interruption) বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদন করে না;
(৬) সুপ্রীমকোর্ট ইহার জুডিশিয়াল রিভিউয়ের ক্ষমতাবলে যে কোনো অসাংবিধানিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করিতে পারে বা বাতিল করিতে পারে;
(৭) কোনো মোকদ্দমার শুনানিকালে কোনো আইনের সাংবিধানিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হইলে সুপ্রীমকোর্ট সে সম্পর্কে নির্লিপ্ত থাকিতে পারে না, আইনের প্রশ্নটি নিরসন করাই সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব;
(৮) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীনে জাতীয় সংসদ সংবিধানের যে কোনো সংশোধন করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কিন্তু রাষ্ট্রের মূলভিত্তি ও সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার ক্ষুণœ বা খর্ব বা সংশোধন করিতে পারে না;”
ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপরের সারমর্ম অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যদি সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার হয় আর বেসিক স্ট্রাকচারবিরোধী সংশোধনী বাতিল করাই যদি সুপ্রীমকোর্টের দায়িত্ব হয়, তা হলে প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা এবং তাঁর ব্রাদার বিচারকদের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার মাঝে তিনি পিপলস রিপাবলিকের বদলে ‘জাজেস রিপাবলিক’ আবিষ্কার করলেন কিভাবে, কেন?
মূল বিরোধ কোথায়
এ প্রশ্নের উত্তর বর্তমান আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধান বিচারপতির কাছে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর মতামত তুলে ধরতে যেয়ে যা বলেছেন, তাতে নির্বাহী বিভাগের বিরোধিতার কারণটি কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, “বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কেড়ে নিতে চায়”। এই দাবী কতটা যৌক্তিক সে আলোচনায় যাওয়ার আগে পরিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বলতে সংবিধানে যা বলা হয়েছে আদৌ তা আছে কি না বা থাকলে তা কদ্দুর?
সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কেবলমাত্র প্রধান বিচারপতি নিয়োগের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ৯৫ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা ছাড়া রাষ্ট্রপতির নামে আর যেসব ক্ষমতাচর্চা হয় তার কোনোটাই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নয়। সাধারণভাবে সংবিধান পড়লে যে মনে হয় তিনি দÐপ্রাপ্ত আসামীর দÐ মওকুফ করে দিতে পারেন (অনু. ৪৯), তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক (অনু. ৬১), তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের অধিকারী (অনু. ৬৪), কিংবা তিনি নির্বাচন কমিশন (অনু. ১১৮), মহা হিসাব নিরীক্ষক (অনু. ১২৭) বা কর্ম কমিশন প্রতিষ্ঠা ও নিয়োগের অধিকারী (অনু. ১৩৭) আসলে তার কোনোকিছুই সংবিধান তাঁকে স্বাধীনভাবে করার অধিকার দেয়নি। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী এসব ক্ষমতার প্রয়োগ হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। তার মানে অনুচ্ছেদ ১১৫(১)(খ) অনুযায়ী বিচার বিভাগীয় পদে বা বিচার বিভাগীয় ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়োগ দেয়ার বিধি প্রণয়ন করার আগে রাষ্ট্রপতির যে সুপ্রীমকোর্টের পরামর্শ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে সেটা রাষ্ট্রপতির নামে হলেও কার্যত প্রধানমন্ত্রীর বাধ্যবাধকতা। উচ্চ আদালত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকরভাবে ভোগ করার জন্য যে ক্ষমতা চাইছেন এটা আসলে এখন প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন ক্ষমতা এবং প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালত দাবী করেছে বলেই তিনি প্রধান বিচারপতি তথা উচ্চ আদালতের উপর নাখোশ।
বিচার বিভাগ এই ক্ষমতা গত ২২ বছর যাবতই ধারাবাহিকভাবে দাবী করে আসছেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বে বহুবার বহুভাবে বিচার বিভাগের এ দাবীর প্রতি তাঁর এবং তাঁর দলের সমর্থন জানিয়েছেন। মাসদার হোসেন মামলার রায় ছাড়াও আরো বিভিন্ন রায়ে বিচার বিভাগ তাদের এই দাবীর ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। সুপ্রীমকোর্ট রাষ্ট্রপতির বরাবর যে পরামর্শ পাঠাচ্ছেন আইন মন্ত্রণালয় কিছুতেই তা রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরছেন না, অথবা আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝাচ্ছেন এই অভিযোগ বহুবার আপীল বিভাগ অ্যাটর্নি জেনারেল তথা নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে এনেছেন, কিন্তু অগ্রগতি কিছু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন আইন মন্ত্রণালয় কিছুতেই অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে রাজী নয়। নির্বাচনের এক বছর আগে তো কিছুতেই নয়। বিচার বিভাগ ইতিপূর্বে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের এরকম চ্যালেঞ্জের মুখে কখনো পড়েনি।
সামরিক আইনে পাস করা সব আইনই অবৈধ, তবে ব্যতিক্রম আছে
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর বিখ্যাত ৫ম সংশোধনী মামলার রায়ে সামরিক শাসকদের কৃত সকল কর্মকাÐকে অবৈধ ঘোষণা করলেও ১৯৭৬ সালের ৪র্থ প্রোক্লামেশন দ্বারা ৭২-এর সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের যে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল তা কিন্তু বহাল রেখেছিলেন। আপীল বিভাগ খায়রুল হক প্রদত্ত রায়ের এ অংশ পরিমার্জন করে সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদও (সামরিক শাসক প্রণীত সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান) বহাল রাখেন। আর বর্তমান সরকার বিগত ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুপ্রীমকোর্টের এ বহাল রাখাকে শুধু অনুমোদন করেই ক্ষান্ত হননি, তারা এই অংশকে সংবিধানের অপরিবর্তনীয় বেসিক ষ্ট্রাকচার হিসেবেও অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্তমান মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের সামরিক শাসকদের কৃত আইনের অসাংবিধানিকতা বিষয়ক যুক্তির জবাব দিতে যেয়ে এস. কে সিনহা তাঁর প্রাক্তন সতীর্থ খায়রুল হককে অনুসরণ করেছেন এবং বলা যায় সে পথে এক কদম আগে বেড়ে পাকিস্তান আমলের সামরিক প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খানের ‘ফ্যামিলি ল অর্ডিন্যান্স’ স্বাধীনতার পরও বহাল রাখার নজীর পর্যন্ত এনেছেন। তিনি সামরিক শাসনের আওতায় করা আইনের ইতিহাস টানলেও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাহীদের অবস্থানের ইতিহাসটুকু এড়িয়ে গেছেন।
ব্রিটিশ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা যেভাবে কেন্দ্রীভ‚ত ছিল রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা বড় লাটের কাছে, ব্রিটিশদের বিদায়ের পর পাকিস্তান আমলেও তার কোনো হেরফের হয়নি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে এই ক্ষমতা সংসদ ও প্রেসিডেণ্টের মধ্যে কিছুটা ভাগাভাগির প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার জেরেই ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারী করে তা পুনরায় এক হাতে কেন্দ্রীভ‚ত করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের সময় এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। বিনা বিতর্কে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা প্রধান নির্বাহীর জন্য বরাদ্দ করা হয়- প্রধান নির্বাহী রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা সামরিক আইন প্রশাসক অর্থাৎ নামে বা পদবীতে যা-ই হোক না কেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষমতা বিন্যাসের এ মৌলিক কাঠামোতে কোনোকালেই কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিচার বিভাগই প্রথম এটাতে ভাগ চেয়ে বসেছে আর তা বাস্তবায়নও করতে চাচ্ছে। সমস্যাটা তাই এক অর্থে নতুন আর এক অর্থে অত্যন্ত প্রাচীন।
জাতির পিতার মর্যাদার প্রশ্ন
জাতির পিতা বলে কোনো শব্দ বা শব্দবন্ধ ৭২-এর সংবিধানে ছিল না। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও এ শব্দবন্ধটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এ পদবীটি সংবিধানে প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হয় ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। ৪র্থ সংশোধনীর ‘রাষ্ট্রপতি-সংক্রান্ত বিশেষ বিধান’-এর (খ)তে বলা হয়েছে “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন...।” কিন্তু সামরিক শাসনের সময়কালে ৪র্থ সংশোধনীর এসব বিধান বাতিল করা হয়। ৫ম সংশোধনী মামলার রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক সামরিক শাসনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ রায়ে সংবিধানের বেসিক ষ্ট্রাকচার; প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮ এবং ১৪২-এর যেসব সংশোধন করা হয়েছিল সেগুলো ছাড়া বাকী সংশোধনীগুলোকে পড়হফড়হব করা হয়। অর্থাৎ তিনি ৭২-এর সংবিধানের অনেক বিষয় পুনরুজ্জীবিত করার নির্দেশ যেমন দিয়েছেন তেমনি অনেক বিষয়কে বাস্তব ঝামেলা এড়ানোর লক্ষ্যে মার্জনাও করেছেন, উদাহরণ হিসেবে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইতিপূর্বে ফেরত আনা হয়েছিল এমন অনুচ্ছেদ ৯৫-এর কথা বলা যায়। কিন্তু ‘জাতির পিতা’ পদবীর যে বিলোপ ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ঘটেছিল তাকে তিনি নিজেও আর পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেননি। পরবর্তী সময় ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি প্রদর্শন এবং সংরক্ষণ আইন-২০০১’ পাস করে, কিন্তু ২০০২ সালে বিএনপি সরকার এ আইনটি রহিত করে। পরে ২০১৫ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদ হিসেবে ২০০১ সালের আইনটিকেই সংবিধানের অপরিবর্তনীয় অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এস. কে. সিনহার বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক অভিযোগটি হলো, তিনি ‘আমরা’র বিপরীতে ‘আমিত্বে’র সমালোচনা করে জাতির পিতার একক অবদানকে খাটো করার চেষ্টা করেছেন। এ বিষয়েও আমরা খায়রুল হকের ৫ম সংশোধনীর ‘মাইলফলক রায়’টি দেখে নিতে পারি। এ রায়ের ১০ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ‘HISTORY’ এবং ১১ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ÔA nation was bornÕ| এ অধ্যায়ের প্রথম ৩টি ভাগে স্বাধীনতা যুদ্ধ, সংবিধান প্রণয়ন এবং ১৫ই আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনা এবং সামরিক শাসন জারীর বিবরণ দিয়েছেন তিনি। আশ্চর্য হলেও সত্য এসব ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে, এমনকি তাঁর নৃশংস হত্যাকাÐের বিবরণেও তিনি কোথাও ‘বঙ্গবন্ধু’ কিংবা ‘জাতির পিতা’, এমনকি ‘শেখ মুজিবুর রহমান’Ñএর নামটি পর্যন্ত একবারও উল্লেখ করেননি। তিনি লিখেছিলেন ‘It may be mentioned here that this new nation plunged into a disaster and a constitutional crisis when in the early morning of August 15, 1975 The President of Bangladesh with his family members were brutally killed ...” এবং এর চেয়েও অনির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার করেছেন স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে। (কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ কেউ কখনো তোলেনি)। অবশ্য তারও কয়েক বছর পর ২০১০ সালে তিনি তা শোধরানোর সুযোগ নেন ‘প্রথম স¦াধীনতার ঘোষণা’ বিষয়ক এক মামলার রায়ে। এই মামলার ৩৪টি অধ্যায়ের মধ্যে একটির শিরোনাম ‘জাতির পিতা’।
এ অধ্যায়ে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বড় করতে গিয়ে বাঙালী জাতি সম্পর্কে লিখেছেন, “একটি দুর্বল ভেঙে পড়া ‘মাথায় খাট বহরে বড়’ কেরানী মনোবৃত্তি সম্পন্ন বাঙালী জাতিকে মুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরিত করাই ছিল শেখ মুজিবের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব।” হাইকোর্টের বিচারকের আসনে বসে একটি জাতিকে ‘মাথায় খাটো’ আর ‘বহরে বড়’ এরকম শ্লেষাত্মক বিশ্লেষনে বিশ্লেষিত করার যে ইতিহাস চর্চার দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন, বাঙালী জাতি সম্পর্কে যে অবমাননাকর বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন, তাতে প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা হলো, না অবনমন হলো, দলীয় মোসাহেব নয় এ রকম রুচি ও বিবেকসম্পন্ন প্রতিটি মানুষেরই তা বোঝার কথা।
এস. কে. সিনহার বিরুদ্ধে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’-এর কৃতিত্বকে খাটো করার অভিযোগ আনা হয়েছে। আগেই আলোচনা করা হয়েছে সংবিধানে ‘আমরা’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত বিবরণ খায়রুল হক সাহেবই আগে দিয়েছিলেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি এটাকে স্পষ্ট করার জন্য ‘আমরা’ এবং ‘আমি’র মধ্যকার পার্থক্যটি বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। আর ‘আমরা’র বদলে সবকিছু যদি ‘আমি’তে পর্যবসিত হয় তা হলে গণতন্ত্রের বদলে যে ক্ষমতার দৈত্য পয়দা হয় আর এটা যে জাতির পিতার স্বপ্নের পরিপন্থী তিনি সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন।
এমিকাস কিউরীদের অবস্থান কি?
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের মধ্যকার ২ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ মামলার দুই পর্যায়েই এমিকাস কিউরী হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে আদালত যেসব উপাদানকে গুরুত্ব দিয়েছেন তার একটি হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদগণ জনপ্রতিনিধি না হয়ে দলীয় প্রতিনিধিতে পরিণত হওয়ার বক্তব্যটি আদালত আমলে নিয়েছে। ড. কামাল হোসেন কিংবা ব্যারিষ্টার আমীর-উল ইসলাম সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যোগ করা ভুল ছিল কিংবা অভিজ্ঞতার অভাবজনিত ত্রæটির কারণে তা যুক্ত করেছিল কোথাও এমন স্বীকারোক্তি করেননি। এমিকাস কিউরী হিসেবে আদালতে বক্তব্য রাখা কোনো বাদী-বিবাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনার মতো বিষয় নয়। বাদী-বিবাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনার সময় আইনজীবীগণ বাদী-বিবাদীর বক্তব্যকেই আইনের ভাষায় তুলে ধরেন। কিন্তু এমিকাস কিউরীগণ মামলায় পক্ষভুক্তদের জয়-পরাজয় নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে তাদের নিজেদের মতামত তুলে ধরেন। সে জন্যে সংবিধান প্রনয়নে জড়িত ছিলেন এমন কেউ তাঁদের প্রণীত সংবিধানের কোনো অংশের বিরুদ্ধে যায় এমন বক্তব্য রাখার আগে তাঁদের নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট নয় এমন এমিকাস কিউরীদের বক্তব্য মামলার রায়কে নীতিগতভাবে সবল করে না বরং প্রশ্নবিদ্ধ ও দুর্বল করে।
স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সন্ধানে অথবা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের জের
আলোচ্য রায়ে যদিও আজকের বাংলাদেশে কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠা এবং রাষ্ট্রের কোনো স্তরে কোনো প্রকারের জবাবদিহিতা না থাকা, যথাযথ নির্বাচন ও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যোগ্য ও মেধাবীদের জাতীয় সংসদ গড়ে না ওঠা এবং রাজনীতি কিভাবে আদর্শহীন একটি ভয়াবহ বিধ্বংসী পদ্ধতি হয়ে উঠেছে তার একটা স্পষ্ট চিত্র মাত্র এক পাতায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এসব গড়ে না ওঠার কারণ বা উৎস যে এই সংবিধানের মধ্যেই নিহিত রায়ে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই উল্লেখ করা হয়নি। এ দেশের জনগণ দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে একটি কিঞ্চিৎ গ্রহণযোগ্য যে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল, তার ত্রæটি (যদি কিছু থেকেও থাকে) সংশোধনের কোনো পথনির্দেশ না দিয়ে পুরো পদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে নিজেরাই যে একটি অকার্যকর ‘জাতীয় সংসদ’ গড়ে তোলায় ভ‚মিকা নিয়েছিলেন সে বিষয়ে এস. কে. সিনহা নিজেও নীরব। অথচ ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার ৮ জন এমিকাস কিউরীর ৭ জনই অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে এই পদ্ধতি বাতিলের বিপদ সম্পর্কে বলেছিলেন। এই পদ্ধতিটিকে বহাল রেখেই কীভাবে তাকে সংবিধান সম্মত করা যায় সে বিষয়ে অন্তত দুজন এমিকাস কিউর দুটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সিনিয়র আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামের বক্তব্যটুকু যদি কেউ কষ্ট করে পাঠ করেন তা হলেও বোঝা যাবে কী ভয়াবহভাবে ফলে গেছে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীগুলো। অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে তিনি এটা খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, যদি তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় তবে ‘মানি এবং মাসল’ (অর্থ আর পেশী) নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ঠগ আর চোরেরা নির্বাচিত হয়ে আসবে এবং গণতন্ত্র আবার একটি দূরবর্তী কান্নায় পরিণত হবে। সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ জনগণকে যে সকল ক্ষমতার মালিক হিসেবে ঘোষণা করেছে, তাই কার্যত বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সবার উদ্বেগকে উপেক্ষা করে এস কে সিনহাকে সাথে নিয়ে ৪-৩ গরিষ্ঠতায় রায় দিলেও দেশ তখন ‘জাজেস রিপাবলিক’ হয়ে যায়নি, আর সে রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও কোনো সাবেক বিচারপতির তাতে মনে হয়নি যে নিশ্চিতভাবেই সে রায়ের ফলে দেশে কোনো সমস্যা বা সংকট তৈরী হয়েছে।
ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে যারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন তারা প্রধান বিচারপতির উপর রুষ্ট হলেও কিংবা তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণে জাতির পিতা কিংবা সংসদকে খাটো করেছেন এমন অভিযোগ করলেও তারা কিন্তু রায়ের অন্যান্য পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। বিপরীত দিকে এ দেশে যারা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার রাজনীতি করেন বলে দাবী করেন, তারাও এই সংকটের প্রকৃত কারণ এবং এসব শাসনতান্ত্রিক সংকট থেকে জাতি কোন পথে বেরিয়ে আসতে পারে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলারও প্রয়োজন বোধ করেনি।
রাজনীতির দায়
সংকটের একটা চিত্র সুপ্রীমকোর্ট দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ জানে যে ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন এবং অঙ্গীকার নিয়ে তারা যুদ্ধ করেছিল, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সে অঙ্গীকার থেকে সরে বিপরীত পথে যাত্রা করেছিল। কিন্তু জনগণের বড় অংশই এখনো জানে না এটা কোন জাদুমন্ত্রে সম্ভব হলো এবং এটা থেকে উদ্ধারই বা কোন পথে সম্ভব! প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার যারা করেছিল, স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান (‘রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র’) রচনার মূল দায়িত্বটি তাদের হাতে থাকেনি। বরং মুক্তিযুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত ছিলেন এমন একজনের কাছে এর মূল দায়িত্ব তুলে দেয়া হয়, যিঁনি যথেষ্ট চতুরতার সাথে এর ঘোষণাপত্র অংশে (সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে তৃতীয় অধ্যায়) সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের মনে যে ধরনের রাষ্ট্র গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা ছিল তার সবকিছুরই উল্লেখ যাতে থাকে সে রকম একটা গোঁজামিলের ব্যবস্থা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন এবং এর গঠনতন্ত্র বা ক্ষমতা কাঠামো অংশটি (সংবিধানের ৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) এমনভাবে নির্মাণ করেন যাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা জনগণ বা জনপ্রতিনিধিদের বদলে এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভ‚ত থাকে এবং এ কেন্দ্রীকরণ যেন এমনকি পাকিস্তান বা ব্রিটিশ আমলের ব্যক্তিতান্ত্রিকতার চাইতেও তীব্র হয়। সে উদ্দেশ্যে তারা ৪৮(৩), ৫৫(৫), ৬১, ৬৪, ৭০, ৭২, ৭৫, ৮১(৩), ৯৩, ১১৩(২), ১১৫(১)(খ), ১২৩(৩)(৪), ১২৭, ১২৮, ১৪৪ ও ১৪৯ অনুচ্ছেদসমূহসহ আরো অন্যান্য অনুচ্ছেদ তারা এ সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন।
সারাজীবন যিনি ব্যক্তিতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষমতায়ন তথা গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন, জেল-জুলুম-নির্যাতন যাঁকে কোনোদিন তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি, বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নের সমান সেই অবিসম্বাদিত নেতাকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই এরা এমন পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হন যা তাঁকে এবং একই সাথে তাঁর প্রতিচ্ছবির মতো দেশ ও দেশের জনগণকে তাদের সম্মিলিত আকাক্সক্ষার বিপরীত পথে ঠেলে দেয়।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো এই, এ সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো অংশ (৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) যখন যে মাত্রায় স্থগিত থেকেছে মানুষ সে মাত্রায় স্বস্তিবোধ করেছে। আমাদের দেশে সামরিক শাসকেরাও যে জনগণের চোখে কখনও কখনও নির্বাচিতদের তুলনায় অধিকতর গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার ‘সৌভাগ্য’ অর্জন করতে পেরেছে তার চাবিকাঠিটিও এখানে। সংবিধান অনুযায়ী যে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী শুধু সংবিধানের ঊর্ধ্বেই অবস্থান করে না, বরং সংবিধানই হয়ে পড়ে তার ইচ্ছাধীন, সে রাষ্ট্রে ‘গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান’ (মানে ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’র ক্ষমতায়নের প্রতিষ্ঠান) গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। বাংলাদেশে ষোড়শ সংশোধনীর রায় প্রসঙ্গে সরকার, সরকারী তাঁবেদার সাবেকদের তৎপরতা এবং বিদ্যমানদের দৌড়ঝাঁপ এবং হুঙ্কার জনগণকে একটি সংবাদই দিতে চেয়েছে যে প্রধান নির্বাহীর জন্য কেন্দ্রীভ‚ত ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা বরদাশ্ত করা হবে না। এর জবাব আদালতের কোনো বিচারকের পক্ষে (তিনি যত সৎ আর সাহসীই হোন না কেন, অবস্থান ও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই) দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সবশেষে আদালত রাষ্ট্রের কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মধ্যে একটি অঙ্গমাত্র এবং রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রেই (সংবিধান) যখন ওয়াচডগ, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স, যোগ্যতা ও মেধার স্বীকৃতি ইত্যাদির দাবী প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল তখন আদালত সেটা বন্ধ করতে পারে না। আদালত সংবিধানের রক্ষণ এবং কার্যকরতার নির্দেশ দিতে পারে, পরিবর্তন করতে পারে না।
পরিবর্তনের কাজ রাজনীতির। দুর্ভাগ্য এ জাতির, ষোড়শ সংশোধনীর রায় সেই এসওএস বার্তা পাঠালেও বিদ্যমান রাজনীতি এ বার্তাটি পাঠ করতে পারেনি বা চায়নি। আর এই বন্ধ্যা অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য যে নতুন রাজনীতির প্রয়োজন তা এখনো দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি।
অক্টোবর ২০১৭, ঢাকা
সম্পাদনা পর্ষদের পক্ষে
হাবিবুর রহমান
পুনশ্চ : এ সম্পাদকীয় ছাপা হওয়ার আগেই একজন সাবেক বিচারপতির ভাষ্য ‘তুমি শুধু পদত্যাগ করবানা দেশও ছাড়বা’ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি কথিত ছুটির দরখাস্ত জমা দিয়েছেন এবং দেশ ছেড়েছেন।