গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে ‘গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার’ বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা
মোশাররফ হোসেন মুসা
১. গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার কী ও কেন: স্থানীয় মানুষের সেবা ও উন্নয়নের জন্য দেশের প্রতিটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিটে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে যে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থা থাকে তাকেই স্থানীয় সরকার বলে। নিয়ম অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার নিজস্ব আয় দ্বারা প্রথমে শতভাগ সিস্টেম কস্ট তথা দাপ্তরিক খরচ, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, আপ্যায়ন ব্যয় ইত্যাদি নির্বাহ করবে এবং একই সঙ্গে নিজস্ব উদ্বৃত্ত আয়ে ও প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে নিজস্ব এলাকায় সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাÐ পরিচালনা করবে। তাই বলা যায়, স্থানীয় সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া মানেই গোটা দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং স্থানীয় সেবা ও উন্নয়ন মানেই সমগ্র দেশের সমষ্টিগত সেবা ও উন্নয়ন সেবা নিশ্চিত হওয়া। ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রথমে স্থানীয় শাসন থেকে জাতীয় শাসন এসেছে। তারপর তারা জাতীয় রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যে বিস্তার করাতে সক্ষম হয়। এ দেশেও পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রজাতন্ত্র ছিল। এ দেশের সীমান্তগুলো ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মতো দুর্গম না হওয়ায় বিদেশিরা খুব সহজে বারবার আক্রমণ করে দেশটিকে দখলে নিয়েছে। ফলে এ দেশে স্থানীয় শাসন কাঠামো স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে উঠতে পারেনি বা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে অনেকেই স্থানীয় শাসনকে কার্যকর করার কথা বলছেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করার জন্য সময় ও দেশোপযোগী একটি নির্দিষ্ট ডিজাইন নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। ফলে সর্বস্তরে গণতন্ত্রায়নের পক্ষে বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে না। আশার কথা, ২০২০ সাল ও ২০৫০ সাল নাগাদ নগরায়নসহ অন্য পরিবর্তনশীল বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে স্বাবলম্বী, স্বশাসিত ও গতিশীল স্থানীয় সরকার স্থাপন করতে প্রথমে নিউইয়র্ক প্রবাসী স্থানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব তা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে একটি জাতীয় সেমিনারে সকলের বিবেচনার জন্য ‘গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা’ নামক একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন। অতঃপর ডিজাইনটি আরও উন্নত ও সময়োপযোগী করে সেটি নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বাস্তবায়নের স্বার্থে গত ২০০৮ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ‘সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক লোকাল গভর্ন্যান্স (সিডিএলজি)’ নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। সিডিএলজি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, এই রূপরেখাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল স্থানীয় স্তরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থানীয়করণ অর্থাৎ প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশকে গণতন্ত্রায়নের পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ।
২. সরকারের নামকরণ ও প্রকারভেদকরণ: বাংলাদেশে বর্তমানে একটিই সরকার, তা হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। একটি মাত্র সরকার থাকায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ প্রত্যয়টি ব্যবহৃত হওয়া সঠিক নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ‘স্থানীয় সরকার’ নামে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়ে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এগুলো বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগের স্থানীয় এজেন্ট বা শাখা হিসেবে কাজ করছে; এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নয় বলে তাদের পরিবর্তে সকল স্থানীয় স্তরে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকার গঠন করতে হবে। সংবিধানে ‘স্থানীয় শাসন’-এর পরিবর্তে ‘স্থানীয় সরকার’ প্রতিস্থাপন করতে হবে এবং আইন, বিধি-বিধান ও বই-পুস্তকের যেসব জায়গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বোঝাতে শুধু ‘সরকার’ শব্দটি রয়েছে সেসব জায়গায় ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ শব্দগুচ্ছ প্রতিস্থাপন করতে হবে। তা করা হলে বাংলাদেশে দুই প্রকারের সরকার, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব আইনত প্রতিষ্ঠিত হবে।
৩. স্থানীয় ইউনিট অথবা স্থানীয় সরকারের প্রকারভেদকরণ: বর্তমানে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ৪৮৭টি উপজেলা, ৩১৯টি পৌরসভা, ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ৪৫৪৩টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এসব স্থানীয় ইউনিটগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : (১) গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিট, যেমনÑ৪,৫৪৩টি ইউনিয়ন এবং ১৭৯টি উপজেলা (৫টি নব গঠিত উপজেলাসহ), কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত; (২) নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন-৩১৯টি পৌরসভা ও ১১টি নগর করপোরেশন, কারণ এসব ইউনিট আইনি মতে শুধু নগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত; এবং (৩) গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমনÑ৭টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা ও ৩১৮টি উপজেলা, কারণ এসব ইউনিট গ্রামীণ ও নগরীয় এলাকার সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণত গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ স্থানীয় সরকার’, নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘নগরীয় স্থানীয় সরকার’ এবং একইভাবে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় ‘গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার’। কিন্তু সরকারি বিধি-বিধান ও পাঠ্যপুস্তকে দুই প্রকারের স্থানীয় সরকার, তথা গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ও নগরীয় স্থানীয় সরকারের কথা উল্লেখ আছে। উদাহরণ স্বরূপ ৩১৮টি উপজেলা ও ৬৪টি জেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা ও ৯টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। উপজেলার আয়তনের মধ্যে বসবাসরত ভোটারদের ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন। আর জেলার আয়তনের মধ্যে স্থানীয় প্রতিনিধিদের ভোটে জেলা পরিষদ প্রশাসক নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে (গভর্নর)। সে মোতাবেক জেলা ও উপজেলাগুলো গ্রামীণ-নগরীয় হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে স্থানীয় ইউনিটের নামকরণ যথার্থভাবে করা হয়নি বলে প্রকারভেদকরণও যথার্থভাবে করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথার্থভাবে নির্ধারিত ও বণ্টিত হয়নি।
৪. প্রস্তাবিত একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ: স্থানীয় সরকার এক স্তরবিশিষ্ট হলে স্তরবিন্যাসকরণের বিষয়টি কখনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতো না। এটি বহু স্তরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এটিকে একটি তত্ত¡গত ফর্মুলায় বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রণয়ন করতে হবে, যা মুঘল-পূর্ব, মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলে অদ্যাবধি করা সম্ভব হয়নি। তত্ত¡গতভাবে প্রদর্শিত রেখাচিত্র অনুযায়ী ‘জেলা’ গ্রামীণ-নগরীয় চরিত্র নিয়ে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হতে পারে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার হিসেবে ‘জেলা সরকার’ হিসেবে কার্যকর থাকবে। তার একদিকে থাকবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকার অর্থাৎ উপজেলা সরকার (যদি প্রয়োজনীয়তা থাকে) ও ইউনিয়ন সরকার এবং অন্যদিকে থাকবে নগরীয় স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোতে একরূপ ‘নগর সরকার’। এ ক্ষেত্রে শুধু ইউনিয়ন নয়, উপজেলার এলাকার মধ্যে কোনো নগরীয় এলাকা (পৌরসভা) থাকবে না; তাতে ইউনিয়ন ও উপজেলা সম্পূর্ণভাবে গ্রামীণ ইউনিট হবে। পৌরসভা ও নগর করপোরেশনগুলো শুধু নগর হিসেবে আখ্যায়িত হবে এবং সেখানে এক ধরনের নগরীয় স্থানীয় সরকার থাকবে, তা করতে গিয়ে বর্তমানে দুই ধরনের নাম, দুই ধরনের আইন ও দুই ধরনের ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় বলে বিলুপ্ত হবে। এখানে লক্ষণীয় যে, নগরের আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ইউনিটগুলোর আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা কমতে থাকবে। গোটা বাংলাদেশ নগরে পরিণত হয়ে যাওয়ার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামীণ ইউনিটগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে; ফলে বাংলাদেশ অনেকগুলো নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে; তখন স্থানীয় সরকার দুই স্তরবিশিষ্ট-জেলা সরকার ও নগর সরকার হয়ে যাবে; এবং বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট তথা কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার ও নগর সরকার-হওয়ার মাধ্যমে সরকারের আকার-আয়তন ছোট হয়ে পড়বে। তাই প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাসটি খুবই গতিশীল ও সুদূরপ্রসারী। এটি গ্রহণ করে দ্রæত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম বলে প্রতীয়মান হয়।
৫. স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট-ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার: স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট যথার্থভাবে নির্ধারিত না হওয়ায় এক ধরনের মারাত্মক ধারণাগত বিভ্রান্তি বিরাজমান রয়েছে। পূর্বে ইউনিয়নের নিচে অন্য কোনো ইউনিটকে (গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা ইত্যাদি) স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হতো এবং বর্তমানে ইউনিয়নকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করা হয়। কেউ কেউ পৌরসভাকে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট মনে করেন (এখানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ প্রদর্শিত রেখচিত্র উদাহরণ হতে পারে।) তারা যুক্তি দেখান, যেহেতু ইউনিয়ন উপজেলার অধীনে ঠিক নিচে অবস্থান করছে সেজন্য ইউনিয়ন হলো গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট। যদি তাদেরকে পালটা প্রশ্ন করা যায়, পৌরসভাগুলো কি সিটি করপোরেশনগুলোর অধীনে আছে? সে ক্ষেত্রে তাদের নিকট থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলোÑস্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট একটি নয়; সর্বনিম্ন ইউনিট হতে হবে দুটিÑইউনিয়ন ও নগর (পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন), অর্থাৎ ইউনিয়ন সরকার ও নগর সরকার। নগর বলতে দেশের ৩১৯টি পৌরসভা ও ১১টি নগর করপোরেশনকে বোঝানো হয়েছে। তৃণমূলে ইউনিয়ন ও নগর পাশাপাশি অবস্থিত দুটি স্থানীয় ইউনিট এবং ভৌগোলিকভাবে পৃথক ও ভিন্ন ধরনের দুটি স্থানীয় প্রশাসনিক ইউনিট। তাই স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে একদিকে গ্রামীণ এলাকায় থাকবে ইউনিয়ন সরকার এবং অপরদিকে নগরীয় এলাকায় থাকবে নগর সরকারগুলো। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত ইউনিয়ন সরকারের রূপরেখা ও নগর সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয় অবশ্যই গঠন করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়নের নিচে আর কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্তে¡ও অতীতে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা, গ্রাম পরিষদ, গ্রাম সরকার ইত্যাদি নামে আরেকটি স্থানীয় সরকার ইউনিট স্থাপন করা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা ও মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে এবং তা করতে গিয়ে ইউনিয়নকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অথচ তারা ভেবে দেখেননি, ইউনিয়ন কার্যকর হওয়া মানেই গ্রাম, পাড়া ও ওয়ার্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া। আবার স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) গঠন ও কার্যকর করার ওপর জোর না দিয়ে মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে উপজেলার ওপর অতিমাত্রায় জোর দিতে গিয়েও ইউনিয়নকে অবহেলিত ও দুর্বলতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্তমানে ‘ওয়ার্ড সভা’ নামে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের স্বার্থে এসব অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে হয়। তাই আমাদেরকে ‘ইউনিয়নে ইউনিয়নে গণতন্ত্রায়ন, ইউনিয়নের জনগণের ক্ষমতায়ন’ এবং ‘নগরে নগরে গণতন্ত্রায়ন, নগরের জনগণের ক্ষমতায়ন’ শ্লোগানদ্বয়ের ভিতরগত তাৎপর্য উপলব্ধি করে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হতে হবে।
৬. প্রাদেশিক সরকার, না জেলা সরকার: বাংলাদেশ শুরু থেকেই এককেন্দ্রিক সরকার হওয়ায়, তথা প্রদেশ সৃষ্টি না করায় স্থানীয় সরকারগুলো সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সেজন্য কেউ কেউ প্রদেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে সিডিএলজির বক্তব্য হলোÑ‘প্রদেশ’ নামক একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক ব্যয়ভার আসবে কোত্থেকে? সকলের জানা রয়েছে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো আয়ের থেকে ব্যয় কম হওয়া। যদিও ব্রিটিশরা শাসনের প্রয়োজনে বহুস্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার সৃষ্টি করে। এখন উন্নয়নের প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারগুলো মেরামত করা জরুরি। এ দেশের আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জনসংখ্যা ইত্যাদি প্রদেশ সৃষ্টির অনুক‚ল নয়। একই কারণে এ দেশে প্রদেশকেন্দ্রিক চিন্তা ও কাজ নেই। দুই প্রকারের চিন্তা ও কাজ তথা জাতীয় ও স্থানীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবানুগ। তার আগে অবশ্যই স্থানীয় সরকারের সমন্বিত স্তরবিন্যাস করতে হবে। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত ও কার্যকরী না থাকায় মারাত্মক বিভ্রান্তি ও অসঙ্গতির মধ্যে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও অধিকার নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি খুবই দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। কাজের বিবেচনায় কেন্দ্রের নিচে সকল ইউনিটই স্থানীয়। সে হিসেবে বিভাগ স্থানীয় ইউনিট হিসেবে থাকার কথা। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা বিভাগকে মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর মনে করেন। যদি বিভাগকে মাঠ পর্যায়ের সর্বোচ্চ স্থানীয় ইউনিট বলা হয় তা হলে সেগুলোতে যথেষ্ট ক্ষমতা ও কার্যাবলি অর্পণ করে নির্বাচিত প্রতিনিধির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর যদি সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে বিভাগ অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হয় তদস্থলে জেলাকে সর্বোচ্চ ইউনিট করা যেতে পারে, এবং সে ক্ষেত্রে বিভাগকে অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত জেলা সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় জেলা সরকার স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে ইতিহাস-ঐতিহ্যে জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ দেশের মানুষেরা জেলার নামে পরিচিত হতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ঢাকা নগরে অবস্থিত বিভিন্ন জেলা সমিতিগুলো তার প্রমাণ। সে জন্য অনেকে জেলাকে সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে দেখতে চান। অর্থাৎ সিডিএলজি এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায ‘টু-টায়ার বিশিষ্ট’ স্থানীয় সরকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাচ্ছে। তা ছাড়া প্রতিটি জেলায় জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের জন্য ২ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন। তাদের ১ জন হবেন পুরুষ আর অন্য ১ জন হবেন নারী। মোট ১২৮ জন প্রতিনিধি উচ্চ কক্ষের জন্য নির্বাচিত হবেন।
৭. স্থানীয় সরকারগুলোতেও ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্তে¡র প্রয়োগ করতে হবে: সরকার কী, সরকার কীভাবে গঠিত হয়, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোন বিভাগের কী ক্ষমতা ও দায়িত্ব, সরকারের রাজস্ব আয়ের উৎস কী কী, বিধানিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্ষমতার পৃথকীকরণ ইত্যাদি বিষয় তৃণমূলের ইউনিটে দৃশ্যমান না থাকায় মানুষের কাছে ‘সরকার’ একটি অস্পষ্ট ও দূরবর্তী বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। সে জন্য স্থানীয় ইউনিটগুলোতেও উন্নয়নের স্বার্থেই কেন্দ্রীয় সরকারের মতো স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সংসদ ও স্থানীয় আদালত সংবলিত ‘সরকার কাঠামো’ স্থাপন করতে হবে; অর্থাৎ ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্তে¡র প্রয়োগ ঘটাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনগুলো হবে : জেলা প্রশাসন, নগর প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন প্রশাসন। স্থানীয় সংসদগুলো হবে : জেলা সংসদ, নগর সংসদ, উপজেলা সংসদ ও ইউনিয়ন সংসদ। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন আদালত, নগর আদালত ইত্যাদি গঠন করতে হবে। এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় ব্যবস্থামতে গঠন করতে হবে।
৮. ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নর-নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন: প্রকৃতিগতভাবে ও মেধাগত বিবেচনায় পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সে জন্য সরকারের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানে (প্রথমে সকল বিধানিক প্রতিষ্ঠানে ও যথাসম্ভব অন্যান্য ক্ষেত্রে) ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নর-নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। সে রকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে নারীরা কোথায়, কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তখন তারাই নিরসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। সে জন্য জাতীয় সংসদে এবং স্থানীয় সরকারে বিধানিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে তাতে নারীদের ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন সুনিশ্চিত করতে হবে; সেই লক্ষ্য পূরণ করতে ইতোমধ্যে সিডিএলজির পক্ষ থেকে ১১ দফা সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে এবং ‘এমপো’ (মিলেনিয়াম প্রোপোজাল পার্ট ওয়ান) বাস্তবায়ন ফোরাম বাংলাদেশ নামে বিভিন্ন নারী সংগঠন বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করছে। ১১ দফায় বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে একজন মহিলা ডেপুটি স্পিকার ও একজন পুরুষ ডেপুটি স্পিকার এবং প্রতি আসনে একজন মহিলা সদস্য ও একজন পুরুষ সদস্য নির্বাচিত হবেন। ইউনিয়নের ক্ষেত্রে একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান এবং প্রতি ওয়ার্ডে একজন মহিলা মেম্বার ও একজন পুরুষ মেম্বার নির্বাচিত হবেন। নগরের ক্ষেত্রে একজন মহিলা ডেপুটি মেয়র ও একজন পুরুষ ডেপুটি মেয়র এবং প্রতি ওয়ার্ডে একজন মহিলা কাউন্সিলর ও একজন পুরুষ কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। এ ছাড়া ‘এমপো’ অনুযায়ী উপজেলায় নির্বাচিত একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যানের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
৯. ‘বটম-আপ’ পদ্ধতিতে ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদান: ক্ষমতা ও দায়িত্ব ‘বটম-আপ’ পদ্ধতিতে অর্থাৎ নিচ থেকে উপরের দিকে বণ্টিত হওয়া উচিত। যেমনÑইউনিয়ন যে কাজগুলো করতে পারবে না সেগুলো উপজেলা, উপজেলা যে কাজগুলো করতে পারবে না সেগুলো জেলা এবং নগর ও জেলা যে কাজগুলো করতে পারবে না সেগুলো বিভাগ সম্পাদন করবে (যদি বিভাগকে সর্বোচ্চ ইউনিট মনে করা হয়)। কেন্দ্রীয় সরকার মূলত জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো সম্পাদন করার পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের কাজে সহযোগিতামূলক ভ‚মিকায় থাকবে। এ ব্যবস্থায় কেন্দ্রের সঙ্গে শুধু জেলার সম্পর্ক থাকবে। স্থানীয় সরকারের ইউনিটগুলোতে স্বশাসন না থাকায় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বাবলি পালনে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা দেখা যায়। যেমনÑপত্রিকা সূত্রে জানা যায়Ñএকটি হাটের জায়গা কতিপয় ব্যক্তি দখল করে নিলে সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকার এসে হাটের জায়গা উদ্ধার করুক।’ এই বক্তব্যে বোঝা যায়, তারা কোনো কাজকেই নিজের কাজ মনে করেন না, এবং নিজেদেরকে ‘সরকার’ মনে করেন না, আবার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা তাদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য দাবি করে আসছে; অর্থাৎ স্থানীয় সরকারও যে আরেক সরকার হতে পারে এটি তাদের ভাবনাতেই নেই। সেজন্য এজেন্ট হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থ চাওয়া এবং অর্থ আদায় করাকেই তারা কৃতিত্ব ও সফলতা মনে করে থাকেন; নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের আয়ে কিছু করার বিষয়টি মাথায় থাকে না অথবা থাকছে না। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া খুবই প্রয়োজন; তাই প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে স্বশাসন প্রদান করে প্রতিটি ইউনিটকে আলাদা ‘সরকার’ হিসেবে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
১০. স্থানীয় নির্বাচনী বোর্ড গঠন: প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে সরকার কাঠামোর বাইরে একটি করে নির্বাচনী বোর্ড থাকবে, তথা ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন নির্বাচনী বোর্ড’, উপজেলায় ‘উপজেলা নির্বাচনী বোর্ড’, জেলায় ‘জেলা নির্বাচনী বোর্ড’, এবং নগরে ‘নগর নির্বাচনী বোর্ড’ গঠন করতে হবে। সে রকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে প্রতিটি ইউনিট নিজস্ব দায়িত্বে, নিজস্ব অর্থে সময়মতো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার ব্যবস্থা করবে (যেমনি ভাবে প্রেসক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি, বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় করে থাকে)। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে, স্থানীয় সরকারগুলো অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে এবং আস্থার সমাজ গড়ে উঠবে। একইভাবে ‘জাতীয় নির্বাচনিক বোর্ড’ গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনও সম্পন্ন করা সম্ভব।
১১. স্থানীয় ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি: প্রতিটি ইউনিটে একজন করে ন্যায়পাল থাকবেন, তথা ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন ন্যায়পাল’, উপজেলায় ‘উপজেলা ন্যায়পাল’, জেলায় ‘জেলা ন্যায়পাল’, নগরে ‘নগর ন্যায়পাল’ থাকবেন। স্থানীয় ন্যায়পালগণ প্রতিটি ইউনিটের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে মীমাংসা করবেন। এতে প্রতিটি ইউনিটে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং তাতে প্রতিনিয়ত গণ-অসন্তোষ নিরসন করা সম্ভব হবে।
১২. ৩৩০টি ‘নগর সরকার’ গঠন করে কেবল ঢাকা শহর নয়, ৩৩০টি শহরকেই রক্ষা করতে হবে: পরিবেশের প্রতি চরম উদাসীনতা ও অপরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের কারণে ঢাকা শহর আজকের মরণদশায় উপনীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭ রিখটার মাত্রার ভ‚মিকম্প হলে ঢাকা শহর ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হবে এবং তাতে তাৎক্ষণিকভাবে ১ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা নগরবাসী যে কত ভয়ানক অবস্থায় বসবাস করছে তা নিমতলী ট্রাজেডিতে প্রমাণিত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটি মাত্র সরকার ব্যবস্থা থাকার কারণে সমগ্র দেশের মানুষ ঢাকা শহরমুখী। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের যে অবস্থা, সে অবস্থা আগামীতে অন্যান্য শহরেও প্রকটভাবে দেখা দেবে, যার আলামত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেজন্য দেশের ৩৩০টি শহরে ৩৩০টি ‘নগর সরকার’ গঠন করে তাদের মাধ্যমে নগরগুলোকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং যেসব গ্রামীণ ইউনিট এখনও নগরে পরিণত হয়নি সেগুলোকে পরিবেশবান্ধব-পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখনই উপযুক্ত ডিজাইন নিয়ে চিন্তা করতে হবে (একইভাবে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোতেও ‘ক্যান্টনমেন্ট নগর সরকার’ গঠন করতে হবে)। এতে একদিকে ঢাকা শহরকেন্দ্রিকতা রাতারাতি হ্রাস পাবে এবং অন্যদিকে ঢাকা শহরসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত দেশের ৩৩০টি শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মকাÐ পরিচালিত ও বিকশিত হবে। সর্বশেষ তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থীরা নগর সরকারের পক্ষে বহু কথা বলেছেন। এটি সিডিএলজির লাগাতার ক্যাম্পেনের ফসল বলে দাবি করা যায়।
১৩. স্থানীয় সরকারের সংখ্যা ও স্তর হ্রাস এবং মধ্যবর্তী ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা: ছোট্ট সরকার সাধারণত দক্ষ সরকার হয়ে থাকে; সিস্টেম কস্ট কমানো গেলে সেবা ও উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানো যায়। আমাদের দেশের আয়তন, জনসংখ্যার ঘনত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্রমাগত দ্রæত নগরায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির বিপুল প্রসার ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা নিয়ে বলা যায়, স্থানীয় ইউনিটের স্তর ও সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। প্রাথমিকভাবে ইউনিয়নের সংখ্যা ৪,৫৪৩ থেকে কমিয়ে ৩,০০০ করা যেতে পারে; উপজেলার সংখ্যা ৪৮৭ থেকে কমিয়ে ৪০০ করা যায় (বর্তমানে অপ্রয়োজনে বেশ কয়েকটি নতুন উপজেলা সৃষ্টি করা হযেছে)। পূর্বে মিরপুর ও গুলশান আলাদা পৌরসভা ছিল। সরকারের কেন্দ্রীভ‚ত শাসনের প্রয়োজনে সেগুলোকে বিলুপ্ত করে ঢাকা নগরের আয়তন বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমান সরকার একই প্রয়োজনে ঢাকা নগরকে দু ভাগে বিভক্ত করেছে। একইভাবে সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুল পৌরসভাকে বিলুপ্ত করে নারায়ণগঞ্জ নগরের সঙ্গে একীভ‚ত করা হয়। ভবিষ্যতে নারায়ণগঞ্জ নগরকে আবারও দু ভাগে বিভক্ত করা হবে না, এর নিশ্চয়তা কী? স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (জেলা অথবা বিভাগ) এবং সর্বনিম্ন ইউনিট (ইউনিয়ন ও নগর) ভালোভাবে কার্যকর করার পাশাপাশি মধ্যবর্তী ইউনিটের অস্তিত্ব প্রয়োজনের নিরিখে নির্ধারিত হওয়া খুবই প্রয়োজন বলে প্রতীয়মান হয়। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে উপজেলা সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত এটিকে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ‘স্থানীয় সরকার’ হতে হলে তার নিজস্ব আয় থাকতে হয়। উপজেলার কোনো নিজস্ব আয় না থাকায় ইউনিয়নের আয়ের অর্থ দ্বারা চলতে হয়। উপজেলা আয়তনের মধ্যে পৌরসভা থাকলেও পৌরসভা থেকে কোনো অর্থ নেওয়ার ক্ষমতা উপজেলার নেই। আবার উপজেলা আইনত গ্রামীণ ইউনিট হলেও পৌরবাসীর ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যানগণ নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সে জন্য প্রশ্ন করা যেতে পারে, নগরীয় কাজগুলো যদি পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো একাই করতে পারে তাহলে গ্রামীণ কাজগুলো ইউনিয়ন কেন এককভাবে করতে পারবে না? অর্থাৎ মধ্যবর্তী স্তর উপজেলার প্রয়োজন আছে কি না, এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
১৪. ‘পার্বত্য জেলা সরকার’ বনাম পার্বত্য চট্রগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির আওতায় গঠিত পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদকে সম্প্রতি মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এই রায়ে বলা হয়েছে, ‘এটা স্থানীয় সরকারের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এই আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে একক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে।’ অথচ ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা শহরে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সেমিনারে ‘গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা’য় ৬টি বিভাগীয় সরকার এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের সংঘাতপূর্ণ সমস্যাটি নিরসনকল্পে একটি নতুন ‘পার্বত্য বিভাগ’ গঠন করে তাতে পার্বত্য বিভাগীয় সরকার গঠন করার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
তৎকালীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন না করে যদি পার্বত্য বিভাগ গঠন করে তাতে ‘পার্বত্য বিভাগীয় সরকার’ গঠন করতেন তা হলে সরকারের এই মহৎ শান্তি উদ্যোগটি এভাবে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অবৈধ বলে ঘোষিত হতো না। এখানে উল্লেখ্য, সংবিধান সংশোধন না করে প্রতি জেলায় ‘জেলা সরকার’ এবং পার্বত্য অঞ্চলে ‘পার্বত্য জেলা সরকার’ গঠন করে বর্তমান সংকট নিরসন সম্ভব।
১৫. গোটা দেশের নগরায়ন, নগরীয় কৃষি ও নগর সরকার: বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। ২০২০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় গোটা জনগোষ্ঠী নগরবাসী হবেন। সে জন্য এখনই দেশের ৩৩০টি নগরকে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরে পরিণত করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর ও নগরায়ন বজায় রাখতে এবং কৃষি জমি রক্ষায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ফলে গ্রামীণ কৃষি, গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ সভ্যতা, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে যথাক্রমে নগরীয় কৃষি, নগরীয় জীবন, নগরীয় সমাজ, নগরীয় সভ্যতা, নগরীয় সংস্কৃতি ও নগরীয় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকবে। বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি নগর সরকারের মাধ্যমে প্রতি নগরে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর সবিশেষ জোর দিতে হবে, এবং ভবিষ্যতের কৃষি হিসেবে নগরীয় কৃষির ওপর গুরুত্বারোপ তো অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে, এবং ‘নগর মানে কৃষি নয়’ এই ক্ষতিকর ভাবনার বিপরীতে ‘কৃষিকে নিয়েই নগর’ এই উপকারী ভাবনা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ক্রমাগতভাবে দ্রæত নগরায়ণের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামভিত্তিক প্রশাসনিক ইউনিটগুলো তথা ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার বিলুপ্তি ঘটবে; ফলে সে সময় নগরগুলো বিভাগ/জেলার অধীনে পরিচালিত হবে। তখন গোটা সরকার ব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন কেন্দ্রীয় সরকার, বিভাগীয় সরকার ও নগর সরকার অথবা কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার ও নগর সরকার থাকবে। কেউ কেউ সরকারের আকার-আয়তন, স্তরবিন্যাসকরণ, প্রকারভেদকরণ, নগরায়ন, বিদ্যুতায়ন, পেশাগত পরিবর্তন, শিক্ষার প্রসার, বহুতল ভবন, জনঘনত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, সিস্টেম কস্ট, সেবা ও উন্নয়ন কস্টের বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে নতুন নতুন ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও প্রদেশ সৃষ্টির প্রস্তাব করছেন, যা খুবই অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন বলে প্রতীয়মান হয়। তাই গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় উপস্থাপিত সমন্বিত স্তরবিন্যাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, গতিশীল ও সুদূরপ্রসারী বলে আমরা মনে করি।
১৬. ২০৫০ সালের মধ্যে উন্নত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ: গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, অর্থাৎ উন্নত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঝুলিয়ে না রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। গণস্বপ্ন ২০২০ হচ্ছে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৫টি ক্ষেত্রে (যেমনÑগণতান্ত্রিক সংবিধান, গণতান্ত্রিক জাতীয় সংসদ, গণতান্ত্রিক আদালত ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন কমিশন, গণতান্ত্রিক মিডিয়া, গণতান্ত্রিক মহাহিসাব রক্ষণ বিভাগ, গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণতান্ত্রিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) স্বল্প টাকায় গণতন্ত্রায়ন সম্পন্ন করে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা। যদি এই কাজটি ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়, তা হলে তার কয়েক মাস পরেই অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে একে একটি বিশেষ অর্জন হিসেবে উল্লেখ করা সম্ভব হবে। অনুরূপভাবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসবকে সামনে রেখে অন্যান্য বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমাও ২০২০ সালকেন্দ্রিক করে এগিয়ে যাওয়া খুবই যৌক্তিক হবে বলে মনে হয়। এ ছাড়া ২০২০ সাল গোটা বিশ্বজুড়েই নানা ধরনের বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমার একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে খুবই সুপরিচিত সাল। সেই বিবেচনায়ও একে লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা ধরে একটি জাতীয় কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হতে পারে।
১৭. শেষ কথা: একটি মানুষ যতই উন্নত চিন্তা কিংবা উন্নত কাজ করুক না কেন, তাকে কোনো না কোনো স্থানীয় এলাকায় বসবাস করতে হয়। তাকে চলাচলের জন্য ফুটপাত, বেড়ানোর জন্য পার্ক, প্রার্থনার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সন্তানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শপিং করার জন্য মার্কেট ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের সারাদিনের প্রায় ৯৫ ভাগ কাজ থাকে স্থানীয়তে। সেজন্য বর্তমানে ‘Think globaly, Act localy’ শ্লোগানটি বহুল প্রচলিত। এ দেশের জনগণ স্থানীয়তাকে আত্মীয়তার মতো দেখে থাকে। মনীষীরা রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বহু আগেই বলেছেন, ‘জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা না পাওয়া গেলে স্থানীয়তে কাজ করা সমুচিত।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘স্থানীয়তাকে অস্বীকার করে পূর্ণ নাগরিক হওয়া যায় না।’ এ দেশটি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এখানে একটি লিখিত সংবিধান আছে। আছে একটি সরকার ব্যবস্থাও। কিন্তু সরকার ব্যবস্থা সংস্কার ও কার্যকর করার বদলে এ দেশের রাজনীতিবিদরা তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকেন। ফলে একজন চায়ের দোকানদার কিংবা মুদি ব্যবসায়ীও জাতীয় সমস্যা নিয়ে মশগুল থাকেন বেশি। অথচ তাদের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে সরব থাকার কথা। বলা যায়, স্থানীয় সরকারগুলো অকার্যকর থাকায় জনগণ স্থানীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছে না এবং একই কারণে তারা ‘নাগরিক’ (Civic-জ্ঞানসম্পন্ন) শ্রেণিতে রূপান্তরিত হতে পারছেন না। তাই উন্নত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণে, ব্যক্তির গণতান্ত্রিক নাগরিক হয়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টিতে স্বাবলম্বী, স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নাই।